জমির নথি থেকে যেভাবে দুর্নীতি উন্মোচন করলেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা

English

জমির রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে অনেক বড় বড় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। যা দুর্নীতির নানান ঘটনা উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

নিচে তেমন কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হলো। পড়লেই ‍বুঝতে পারবেন, সম্পত্তির রেকর্ড অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় কতটা বৈচিত্র্য আনতে পারে। এদের বেশিরভাগই করা হয়েছে ২০১৮ সালে।
কর্মকর্তাদের দুর্নীতি প্রমাণে জমির নথি
“মিলিওনেয়ারস অ্যামোং দ্য নোমিনিস” নামের প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সারায়েভোর সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং (সিআইএন)। অনুসন্ধানটি পরিচালিত হয় বসনিয়ার ১২১ জন রাজনীতিবিদের সম্পত্তি নিয়ে, যার কেন্দ্রে ছিলেন শীর্ষ ১০ ধনী-রাজনীতিবিদ। সিআইএনের রিপোর্টাররা ভূমি রেকর্ড এবং ঘোষিত সম্পদের বিবরণ থেকে তাদের সম্পত্তির যাবতীয় তথ্য যোগাড় করেন। পরে সব তথ্য “রাজনীতিবিদদের সম্পদ” নামের একটি ডেটাবেজে সংরক্ষণ করা হয়।

মাঝে মাঝে সরকারি কর্মকর্তা এবং কর্পোরেট নির্বাহীদের বিলাসবহুল বাড়ীর খবরও উন্মোচন করার প্রয়োজন দেখা দেয়। আর আর্মেনিয়ার সাংবাদিকরা এই কাজ করেছেন বেশ কয়েকবার।

আর্মেনিয়ার কর্মকর্তারা কীভাবে আয় গোপন করে সেই টাকা দিয়ে চেক রিপাবলিকে সম্পদ গড়েছেন – তা খুঁজে বের করে হেটকিউ নামের একটি অনলাইন। রিপোর্টটি প্রকাশ করে দেশটির অ্যাসোসিয়েশন অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস। গভীর এই অনুসন্ধানী সিরিজের আরেকটি পর্বে দেখানো হয়, আর্মেনিয়া পুলিশের সাবেক প্রধান কীভাবে ৩০ লাখ মার্কিন ডলারের একটি বিলাসবহুল বাড়ী ২০ লাখ ডলারে কিনে নেন, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে।”

ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় আদালতের বিচারক মারসেলো এবং সিমোন ব্রেটাসের মালিকানাধীন ৫৮ লাখ মার্কিন ডলার মূল্যের বিশাল অট্টালিকা নিয়ে রিপোর্ট করে দি ইন্টারসেপ্ট। পরে পিয়াউই ম্যাগাজিনের রিপোর্টাররা জমি নিবন্ধনের রেকর্ড ঘেঁটে খুঁজে বের করেন – এই বিপুল সম্পদের মালিক আসলে ব্রাজিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিচেল তেমের।

চীনের কর্পোরেট গ্রুপ এইচএনএ’র নির্বাহীরা বিলাসবহুল যত বাড়ী কিনেছেন, তার তালিকা প্রকাশ করেছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। আর এই অনুসন্ধানে বড় ভূমিকা রেখেছে আবাসন রেকর্ড।

বিদেশে নাইরেজিয়ান রাজনীতিবিদরা কত সম্পদ গড়েছেন, এই নিয়ে একটি অনুসন্ধান করেছিল দ্য হেরাল্ড ইন নাইজেরিয়া। তারা রিপোর্টটি দাঁড় করিয়েছিল আবাসন বিষয়ক ওয়েবসাইট এবং গুগল থেকে নেয়া ছবি ব্যবহার করে।

রাশিয়ার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত এলাকায় লাখ লাখ ডলার দাম দিয়ে জমি কেনা হয়েছে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের একজন বডিগার্ডের নামে – পড়ুন নোভায়া গেজেটার এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।

অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রোজেক্ট (ওসিসিআরপি), তাদের একটি রিপোর্টে দেখিয়েছে, রাশিয়ার সাবেক শিল্পমন্ত্রী কীভাবে একটি গলফ কোর্সের কয়েক লাখ ডলার মূল্যের শেয়ার আত্মসাৎ করেছেন। রিপোর্টে বলা হয়: “এই সম্পত্তির মালিক ছিলেন কয়েকজন ব্যবসায়ী।  কিন্তু দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে তা নজরে পড়ে যায়, সেই মন্ত্রীর।”

পেরুতে জাল-জালিয়াতি করে জমি বেচাকেনার একটি চক্রকে উন্মোচন করেছিল মোংগাবে।  এই রিপোর্টের কারণে, মিথ্যা নথিপত্র তৈরির অভিযোগে কয়েকজন কর্মকর্তা আটক হন।
ফাঁস হওয়া তথ্যে সম্পত্তির বিবরণ
ওপরে যত রিপোর্টের কথা বলা হয়েছে, তাদের সবই উন্মুক্ত, তথা পাবলিক রেকর্ড-ভিত্তিক। কিন্তু নিচের প্রতিবেদনগুলো তৈরি করা হয়েছে ফাঁস হওয়া তথ্যের ভিত্তিতে।

জমি বা সম্পত্তির রেকর্ড কীভাবে খুঁজবেন, জানতে হলে পড়ুন জিআইজেএনের প্রোপার্টি গাইড।সাবেক পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে জুলাই মাসে ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০৬ লাখ মার্কিন ডলার অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস – আইসিআইজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর কারণ ছিল পানামা পেপার্স। সেখানে উঠে আসে, বিদেশে নওয়াজ পরিবারের সম্পত্তির বিষয়টি।

“অবৈধ সম্পদ বিদেশে পাচার কীভাবে দুবাইয়ের সম্পত্তির বাজারকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলছে” সম্প্রতি তা বেরিয়ে আসে অনুসন্ধানী প্রকল্প স্যান্ডকাসলস থেকে। অনুসন্ধানটি করেছে সি৪এডিএস নামের একটি আমেরিকান সংগঠন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবাসন বিশেষজ্ঞরা দুবাইয়ে বিলাসবহুল বাড়ী বেচাকেনার যে তথ্য সংকলন করেছিলেন, সেটিই ফাঁস করে দেয়া হয় সি৪এডিএসের কাছে।

যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক সংগঠন ফাইনান্স আনকভার্ড ফাঁস হওয়া সেই তথ্য ব্যবহার করে লিখেছে, “দুবাই লিকস: গোপন সম্পত্তি রেকর্ড বলছে, আমিরাত হচ্ছে পৃথিবীর “কোস্তা দেল ক্রাইম।” এই প্রতিবেদন দুবাইয়ের শত শত বিলাসবহুল সম্পত্তির মালিকদের পরিচয় উন্মোচন করে দেয়। সি৪এডিএস প্রাথমিকভাবে যে তথ্য পেয়েছিলো, তার আরো গভীরে যাওয়ার জন্য এই গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে ওসিসিআরপি’র সংকলন করা রেকর্ড।

২০১৫ সালে সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসে খুব বিখ্যাত একটি অনুসন্ধান প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখানো হয়, নিউ ইয়র্ক শহরের সবচেয়ে দামী কয়েকটি আবাসিক ভবন, কীভাবে কেনা হচ্ছে কাগজ-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে। অনুসন্ধানটি শেষ করতে সময় লেগেছে দুই বছর। এই প্রতিবেদনে রিপোর্টাররা তাদের সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। ধনী ক্রেতাদের আগ্রহ কোথায় তা বুঝার জন্য তারা বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ করেন। কাগজ-সর্বস্ব শেল কোম্পানিগুলোর তথ্য উদ্ঘাটন করতেও এই অনুসন্ধানটি কাজে এসেছে।
জমির তথ্যে লুকিয়ে থাকে সামাজিক সমস্যা
সামাজিক এবং নীতিমালার সমস্যা সংক্রান্ত প্রতিবেদনেও ভূমি বিষয়ক তথ্য ব্যবহার করা যায়।

ক্যালিফোর্নিয়ার সম্পত্তি কর নীতিমালার কারণে কীভাবে মুষ্টিমেয় ধনী ব্যক্তি লাভবান হচ্ছেন এমন একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস। এই প্রতিবেদনের জন্য তারা ক্যালিফোর্নিয়ার কয়েকটি কাউন্টি থেকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হস্তান্তর সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে।

ভূমিধ্বসের ঝুঁকিতে থাকা একটি এলাকায় নিয়ন্ত্রণহীন নির্মাণকাজের ওপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করে, ক্রাইম মলদোভা। “দ্য ‘স্লাইডিং’ বিজনেস অফ দা স্টাটি ফ্যামিলি” নামের সেই অনুসন্ধানে তারা সম্পত্তির মালিকানার রেকর্ড ব্যবহার করেছে।

একজন ইথিওপিয়ান কফিচাষীর পিতৃদত্ত জমি ফেরত পাওয়ার লড়াই নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় প্লেইস-এ। জমির আনুষ্ঠানিক দলিল না থাকলে কী ধরণের সমস্যা হয়, তা-ই ছিল এই অনুসন্ধানের মূল উপজীব্য। প্লেইস হচ্ছে ভূমি অধিকার সংক্রান্ত একটি ওয়েবসাইট। থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন তাদের পৃষ্ঠপোষক। পরিবেশ বিপর্যয় বা খাদ্যের অভাব থেকে শুরু করে সংঘাত এবং যুদ্ধের মত কারণে কেউ ভূমি অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে – সমাজ, রাজনীতি বা অর্থনীতিতে তার যে প্রভাব পড়ে, তার সবকিছুই বিশ্লেষণ করে প্লেইস। তাদের আরেকটি প্রতিবেদন ছিল: “কৃষকদের জন্য ভূমি অধিকার কি ঘানার কোকোয়া খাতকে বাঁচাতে পারবে?” নেটওয়ার্ক অফ ইরাকি রিপোর্টারস ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম ২০১৭ সালে “আইসিসের আবাসন সাম্রাজ্য: নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং সম্পত্তি জালিয়াতির প্রত্যাবর্তন,” শিরোনামে একটি অনুসন্ধান প্রকাশ করে। সেখানে তারা উন্মোচন করে, আইসিস কীভাবে জমির দলিল বিকৃত করে মানুষের বাড়িঘর দখল করে নিয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বন্য প্রাণী চোরাচালান প্রতিরোধে ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কের সীমানায় নিরাপদ অঞ্চল তৈরির প্রভাব নিয়ে অনুসন্ধান করে অক্সপেকার্স। তারা দেখতে পায় “দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের সহায়তায় ভিনদেশী ধনীরা জায়গাটি দখল করে ফেলেছে।” এই অনুসন্ধানে তারা কী পদ্ধতি এবং টুল ব্যবহার করেছে, দেখে নিন এই প্রতিবেদনে।
সচিত্র উপস্থাপনা
যেখানে ডেটা আছে, সেখানেই গ্রাফিক্সের মাধ্যমে তা উপস্থাপনেরও সুযোগ থাকে।

গ্যাস স্টেশন, অবকাঠামো সংস্কার এবং ক্যাফেসহ কয়েকশ অবৈধ নির্মাণ-কাজের এলাকাভিত্তিক চিত্র, গ্রাফিক্সের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে কিয়েভ পোস্টের এই প্রতিবেদনে।

নিউ ইয়র্ক শহরের আবাসন বিষয়ক গণমাধ্যম রিয়েল ডিল “প্রথমবারের মতো একটি অসাধারণ র‍্যাংকিং” প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল “নিউ ইয়র্কের মালিক কে?”

জমির মালিকানা: জানা জরুরি, কিন্তু পাওয়া কঠিন

English

জমির মালিকানা কার – এই তথ্য খুঁজে বের করা বেশ কঠিন কাজ। সব দেশেই সম্পত্তির নিবন্ধন পদ্ধতি চালু আছে, তবু তথ্যের মান এবং তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা প্রায়ই বলে থাকেন, বিশ্বে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশের নিজ মালিকানাধীন জমির আইনগত নিবন্ধন রয়েছে। কিন্তু তাদের এই পরিসংখ্যানও অনুমান-নির্ভর।

তারওপর সম্পত্তির অসম্পূর্ণ বা ভুল রেকর্ড তো আছেই।

২০১৮ সালের একটি ব্লগ পোস্টে বিশ্বব্যাংকের ভূমি বিশেষজ্ঞ ক্লস ডেইনিংগার বলেন, “বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি দেশ, তাদের রাজধানীতে থাকা ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির নিবন্ধন বা মানচিত্র তৈরি করতে পারেনি। রাজধানীর বাইরে তো দূরের কথা, অনেক সময় ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির নিবন্ধনই করা হয় না।” বিশ্বব্যাংকের আরেক কর্মকর্তা বলেন, ভূমি রেকর্ডের নিরাপত্তায় ঘাটতির মানে, একই জমি একাধিক মালিকের নামে তালিকাভুক্ত হতে পারে যে কোনো সময়ই।

তারপরও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও হংকংয়ের মতো অনেক উন্নত দেশে  ভূমি নিবন্ধনের তালিকা সবার জন্য উন্মুক্ত। এখান থেকে মূল্যবান তথ্য বের করে আনা সম্ভব। রেকর্ডগুলো সাধারণত স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হয়। কেন্দ্রীয় জাতীয় নিবন্ধন এবং অনলাইনে তা না-ও পাওয়া যেতে পারে। ডেইনিংগারের ভাষ্য অনুযায়ী, বিশ্বের এক তৃতীয়াংশেরও কম দেশ ডিজিটাল রেকর্ড সংরক্ষণ করে।

আরেকটি জটিলতা হচ্ছে. ব্যক্তি-গোপনীয়তা রক্ষার্থে অনেক দেশে সম্পত্তির মালিকের নাম প্রকাশ করা হয় না। উন্নয়নশীল এবং উন্নত – দুই ধরণের দেশেই এমনটা ঘটতে দেখা যায়।

খুঁজে পাওয়া সম্ভব এমন যে কোনো ভূমি রেকর্ড পেতে আপনাকে সাহায্য করবে জিআইজেএনের এই নির্দেশিকা। শুরুতেই থাকছে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং জাতীয় উৎসগুলোর লিংক এবং বর্ণনা।
জমির তথ্য কী কাজে আসে?

জমির মালিকানা: রিপোর্ট আপনার পায়ের নিচেই!

English

সম্পত্তি রেকর্ডের স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে গণমাধ্যমে খুব একটা রিপোর্ট হয় না। কারণ বেশিরভাগ সাংবাদিকের এই বিষয় নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। ভূমি নীতি বিশেষজ্ঞরা সাংবাদিকদের এমন অনীহায় রীতিমত হতাশ।

কোনো কোনো সময় জাতীয় দৈনিকের শিরোনামে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও কর্পোরেট স্বার্থের মধ্যে ভূমি মালিকানা নিয়ে সুনির্দিষ্ট বিবাদের খবর চোখে পড়ে। কিন্তু ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা, দুর্নীতি, দুর্বল ভূমি অধিকার আইন এবং অস্পষ্ট রেকর্ডের মত নেপথ্য কারণগুলো নিয়ে পর্যাপ্ত রিপোর্ট হয়না।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমস্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে সঠিক রেকর্ডের অভাব। সম্পত্তি অধিকার নিয়ে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতার পেছনেও এটিই কাজ করে।

দলিলবিহীন জমির সমস্যাটি বেশ প্রকট। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ ভূমির দলিল নেই।

“বিশ্বে বড়জোর অর্ধেক দেশের রাজধানীতে (আফ্রিকাতে মাত্র ১৩ শতাংশ দেশে) ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির নিবন্ধন বা মানচিত্র পাওয়া যাবে। বেশিরভাগ সময় সরকারি জমির নিবন্ধন থাকেই না” – ২০১৮ সালের একটি ব্লগ পোস্টে বলেছেন বিশ্বব্যাংকের ভূমি বিশেষজ্ঞ ক্লস ডেইনিংগার। এক-তৃতীয়াংশেরও কম দেশে ডিজিটাল রেকর্ড রাখা হয় বলে তিনি জানান।

এসব সমস্যার সামাজিক প্রভাব অনেক, বিশেষ করে, পরিবেশ এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর। এসব বিষয় নিয়ে রিপোর্ট হওয়া উচিৎ। দলিল না থাকলে আদিবাসী গোষ্ঠীর দখলে থাকা জমি চলে যেতে পারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের অধীনে। তার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে তারা পরিবেশেরও ক্ষতি করতে পারে। ভূমির অপর্যাপ্ত রেকর্ড দূর্নীতির পৃষ্ঠপোষক হিসাবে কাজ করে। আরো ভালোভাবে বলতে গেলে, ভূমি অধিকারের অভাব বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

সমস্যাটির গুরুত্ব এতই যে, জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যেও (লক্ষ্য ১.৪, সূচক ১.৪.২)  ভূমি ভোগদখলের নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

গ্লোবাল ল্যান্ড অ্যালায়েন্স এবং ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের যৌথ উদ্যোগ পিআর-ইনডেক্স ভূমি ভোগদখলের সুরাক্ষা নিয়ে দেশ-ভিত্তিক পরিস্থিতি পরিমাপ করবে। এটি ভবিষ্যতে লেখালেখির খোরাক যোগাতে পারে।
সংস্কারের সম্ভাব্য সুবিধা
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নির্ভুল, গতিশীল এবং স্বচ্ছ ভূমি রেকর্ড ব্যবস্থার অনেক সুবিধা। যেমন

বিনিয়োগ বৃদ্ধি
দুর্নীতি হ্রাস
কর রাজস্ব বৃদ্ধি
অবকাঠামো উন্নয়নে প্রণোদনা
কৃষকের নিরাপত্তা
স্থির এবং স্বচ্ছ আবাসন বাজার তৈরি
দুর্যোগে দ্রুত সাড়া দেয়ার সক্ষমতা
নগর পরিকল্পনার উন্নয়ন
উন্নততর স্বাস্থ্য সেবায় সহায়তা
পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই সম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রসার
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা

দুর্বল রেকর্ড-রক্ষণ এবং বিস্তৃতির অভাবের কারণে বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমি নিবন্ধন এবং ক্যাডেস্টারের আধুনিকীকরণ নিয়ে কাজ করছে (২০১৮ সালের সিস্টেমেটিক প্রোপার্টি রেজিস্ট্রেশন: রিস্কস অ্যান্ড রেমেডিস দেখুন)। এক্ষেত্রে সহায়তার সম্ভাব্য নতুন ক্ষেত্র হতে পারে এরিয়াল ছবি এবং ব্লকচেইন ব্যবস্থা। কিন্তু নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তন এবং ধরে রাখার চড়া খরচ এবং আমলাদের প্রতিবন্ধকতার কারণে এর প্রসার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

অর্গানাইজেশন অফ আমেরিকান স্টেটস ক্যাডেস্টার আধুনিকীকরণের জন্য একটি টুলকিট তৈরি করেছে।

ইউরোপিয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই রেকর্ডের স্বচ্ছতা এবং ভূমি নীতিমালা হয়ে উঠেছে আলোচনার মূল বিষয়।
তথ্যের বড় উৎস বিশ্বব্যাংক
বিশ্বব্যাংকের অসংখ্য রিপোর্ট আছে, যা আপনাকে সম্ভাব্য অনুসন্ধানের সূত্র যোগাবে।

জাতীয় পর্যায়েও এমন রিপোর্ট রয়েছে। যেমন, বিশ্বব্যাংক ২০১৪ সালে ভিয়েতনামের ভূমি রেকর্ড ব্যবস্থা নিয়ে আলাদা প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

জমি বা সম্পত্তির রেকর্ড কীভাবে খুঁজবেন, জানতে হলে পড়ুন জিআইজেএনের প্রোপার্টি গাইড।ভিয়েতনাম ল্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি স্টাডি নামের সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী “স্বচ্ছতার সমস্যা প্রভাব ফেলেছে সেখানকার স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর আচরণ, সক্ষমতা আর নেতৃত্বে।”

বিশ্বব্যাংক অনেক ভূমি বিষয়ক প্রকল্পে যুক্ত। আরো জানতে “ল্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ক্যাডেস্টার” সার্চ করুন।

বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের এই রিপোর্ট নিয়ে ফলো-আপ করা উচিত সাংবাদিকদের। এখানে মানচিত্র ও ভূমি-কর ব্যবস্থার উন্নয়নের স্যাটেলাইট ছবির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।

ল্যান্ড পোর্টাল ওয়েবসাইটে ডেটাসেটের দারুণ একটি সংকলন পাওয়া যায়।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার পত্রিকা বিজনেস ডে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্নীতি দমন সংস্থা একটি ভূমি সংস্কার প্রকল্পে এমন “ব্যবস্থাপনাগত দূর্বলতা” খুঁজে পেয়েছে, যার মাধ্যমে ২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার দামের জমি, প্রতারণার মাধ্যমে জবর দখল করা হয়েছিলো।
অন্যান্য রিপোর্ট
ইন্টারনেট ঘাঁটলেই ভূমি সংস্কার নিয়ে অনেক রিপোর্ট পাওয়া যায়। যেমন: ইনোভেশনস ইন ল্যান্ড রেজিস্ট্রি ম্যানেজমেন্ট নামের ২০১৮ সালের এই অ্যাকাডেমিক পেপার। এখানে বলা হয়েছে, “জমি নিবন্ধন ব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণে ছোট-বড় দুই ধরণের দুর্নীতিকেই উৎসাহিত করে।” এই পেপারে ভূমি নিবন্ধন সংস্কারের কিছু কার্যক্রম পর্যালোচনা করা হয়েছে।

কম্বোডিয়া, ভারত এবং পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে ভূমি বিষয়ক সেবা পেতে ঘুষের পরিমাণ অনেক সময় ৫০ শতাংশও ছাড়িয়ে যায়। এমন তথ্য পাবেন ল্যান্ডপোর্টাল ওয়েবসাইটের ল্যান্ড অ্যান্ড করাপশন পোর্টফোলিওতে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে আফ্রিকায় মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ মানুষ ভূমি-দুর্নীতির শিকার। যুবসমাজকে ভূমি সংস্কারে আগ্রহী করে তোলার জন্য সম্প্রতি তারা একটি প্রতিযোগিতা শুরু করেছে।

কার্বিং করপোরেশন ভূমি অধিকার এবং দুর্নীতির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে একটি দুর্দান্ত গাইড প্রকাশ করেছে। সেখানে “ভূমি ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতির বিভিন্ন রূপ” সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা হয়েছে।

টেরোরিজম, ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন সেন্টারের ২০১৮ সালের একটি রিপোর্টে জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের শার স্কুল অফ পলিসি অ্যান্ড গভর্নমেন্ট বলছে, “আবাসনখাতে অর্থ পাচার – উন্নত এবং উন্নয়নশীল দুই ধরণের দেশের জন্যেই সমস্যা।”

ভূমি সংস্কারে অগ্রগণ্য দেশগুলোর একটি নেদারল্যান্ডস। তারা ক্যাডেস্টার অ্যাব্রোড নামের একটি নিউজলেটার প্রকাশ করে।

ভূমি রেকর্ডে প্রবেশাধিকার বেশিরভাগ সময়েই সংরক্ষিত থাকে। দেশের মাত্র এক শতাংশ মানুষ উন্মুক্তভাবে তাদের ভূমি মালিকানার তথ্য প্রকাশ করে, অন্যদিকে, ওপেন ডেটা ব্যারোমিটার বলছে, ১০ শতাংশ দেশে বাজেটের তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত। ওপেন নলেজ ইন্টারন্যাশনালের তৈরি গ্লোবাল ওপেন ডেটা ইনডেক্স অনুযায়ী, সবার জন্য উন্মুক্ত ১৫ ধরণের তথ্যের মধ্যে ভূমি মালিকানার তথ্য সবচেয়ে নিচে।

গণমাধ্যমের অনীহা
ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ক পত্রিকাগুলো বাড়ী বেচাকেনা, আবাসনখাতে নতুন ধ্যানধারণা এবং বাজার-প্রবণতা নিয়ে নিয়মিত রিপোর্ট করে। কিন্তু প্রচলিত গণমাধ্যমের মত, তারাও ভূমি বিষয়ক সমস্যাগুলো এড়িয়ে যায়।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা রাজনৈতিক দুর্নীতি জাতীয় প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে হয়তো সম্পত্তির রেকর্ড ব্যবহার করেন। কিন্তু তারা ভূমি ব্যবস্থাপনার ভেতরে খুব একটা ঢুকতে চান না বা ভূমি রেকর্ডের অস্বচ্ছতা নিয়ে অনুসন্ধান করেন না।

এদের মধ্যে ব্যতিক্রম হচ্ছে থমসন রয়টার্সের প্লেইস। তারা ভূমি নিয়েই কাজ করে। তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টের মধ্যে আছে:

কেনিয়ার অধিবাসীরা জমি বিক্রি করছেন নামমাত্র মূল্যে
দরিদ্রদের বদলে কারখানাকে ভূমি দিতে আইন সংশোধন করলো ভারতের গুজরাট রাজ্য
কৃষকদের ভূমি অধিকার কি ঘানার কোকোয়া খাতকে বাচাঁতে পারবে? জমি দখলের প্রতিযোগিতায় ইথিওপিয়ার কফি চাষিরা বিপাকে

রেকর্ড ব্যবস্থা আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টাগুলোও অবশ্য বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। রয়টার্সের একটি রিপোর্টে উঠে আসে, কারো সাথে পরামর্শ না করেই কেনিয়ায় ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু পরে তা বন্ধ করার দাবি ওঠে।

ভূমি রেকর্ড ব্যবস্থা বেসরকারিখাতের হাতে ছেড়ে দেয়ার বেশ কিছু সুবিধা আছে। আবার এ নিয়ে বিতর্কও কম নয়। অস্ট্রেলিয়ার ফাইনান্সিয়াল রিভিউতে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিয়ে বিতর্কের খবর ছাপা হয়েছে।
প্রণোদনার অভাব
ভূমি নিয়ে রিপোর্টিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা পান না সাংবাদিকরা।

বিশ্বব্যাপী স্বাধীন সাংবাদিকতাকে সহায়তা দেয় পুলিৎজার সেন্টার অন ক্রাইসিস রিপোর্টিং। তারা ভূমি এবং সম্পত্তির অধিকার বিষয়ক ডেটা জার্নালিজম প্রকল্পে পৃষ্ঠপোষকতা করে।

এন/কোর এবং ওমিডায়ার নেটওয়ার্ক পরিচালিত ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম গ্রান্ট, ভারতে ভূমি এবং সম্পত্তি বিষয়ক উদ্ভাবনী সাংবাদিকতার প্রসারে কাজ করছে।
এনজিওর তৈরি রিপোর্ট
বিভিন্ন এনজিও ভূমি নীতিমালা নিয়ে রিপোর্ট করে। তাদের রিপোর্টে  অনেক সময় অনুসন্ধানী পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

জমির রেকর্ড থেকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা কীভাবে দুর্নীতি খুঁজে বের করেছেন, দেখুন জিআইজেএনের এই সংকলনে।মোঙ্গাবে, ২০১৮ সালের অগাস্টে প্রকাশিত এক রিপোর্টে তুলে ধরে, ইন্দোনেশিয়ার সরকার আদিবাসীদের জমি বাদ দিয়ে কীভাবে ভূমি-ব্যবহার ডেটাবেস ও মানচিত্র তৈরির পরিকল্পনা করছিল।

২০১৭ সালের এপ্রিলে “সাও পাওলো: ডাজ করাপশন লিভ নেক্সট ডোর?”

সরবরাহ চেইন অনুসন্ধানের যত রকম কৌশল

English

সাপ্লাই চেইন, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় সরবরাহ শিকল। এটি হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট পণ্য উৎপাদন, বিতরণ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোর একটি নেটওয়ার্ক। এই শিকলে থাকতে পারে কাঁচামাল সরবরাহকারী থেকে শুরু করে, সেই কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদনকারী, উৎপাদিত পণ্য গুদামে সংরক্ষণকারী, বাজারে বিতরণকারী এবং শেষ পর্যন্ত পণ্যটি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া খুচরা বিক্রয়কারী পর্যন্ত সব ধরনের প্রতিষ্ঠান। পোশাক, ইলেকট্রনিকস, যানবাহন, খাদ্য বা ওষুধ—পণ্য যেমন হতে পারে বৈচিত্র্যময়, সরবরাহ চেইনও ঠিক তেমনই। 

পণ্য—তা সে কৃষিজাত হোক বা শিল্প—কোথা থেকে আসে বা কোথায় যায়, তার অনুসন্ধান হতে পারে রিপোর্টারদের জন্য কাজের দারুণ ক্ষেত্র। এ ধরনের অনুসন্ধান থেকে বেরিয়ে আসে জোরপূর্বক শ্রম, পরিবেশগত অপরাধ, দুর্নীতি, এমনকি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও। 

তবে গুরুতর চ্যালেঞ্জ হলো, এত কিছুর মধ্যে সংযোগ খুঁজে বের করাটা।

কোনো ভোগ্যপণ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষিজমি, প্রাকৃতিক সম্পদের খনি বা শিল্পকারখানায় কাজের পরিবেশ কেমন এবং তাদের সঙ্গে সরবরাহ চেইনের সম্পর্ক কী, তা উন্মোচন করতে গেলে আপনার দরকার হবে অনেক ধরনের অনুসন্ধানী টুল। 

আপনার হাতে সেই সব টুল, গবেষণার উপকরণ, রিপোর্ট এবং নানা রকম তথ্যের উৎসের খবর তুলে দিতেই জিআইজেএন তৈরি করেছে সাপ্লাই চেইন রিসোর্স পেইজ। এর বাইরেও যদি জানতে চান, পড়ে নিন জিআইজেএনের  প্রাসঙ্গিক এই রিসোর্সগুলো:  

সাগরে থাকা জাহাজ অনুসরণ

মানব পাচার ও দাসত্ব 

খনিজ উত্তোলন শিল্প

দুর্নীতি বিষয়ক তথ্যভাণ্ডার

বিষয়টি সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানতে চাইলে, পড়তে পারেন: লার্নিং কাস্টম ল্যাঙ্গুয়েজ টু ট্র্যাক শিপমেন্ট। অষ্টম এশিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে এটি উপস্থাপন করেছিলেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার শিক্ষক জিয়ানিনা সেনিনি। তিনি এখানে তুলে ধরেছেন কাস্টমস কোডের ব্যবহার, বিল অব লেডিং, জাহাজ অনুসরণ এবং কীভাবে পণ্যবাহী কনটেইনার ট্র্যাক করতে হয়। 

এ ছাড়া দেখতে পারেন জিআইজেনের এই ভিডিও, যেখানে এপির সাংবাদিক মার্থা মেনডোজা বলেছেন, তারা মৎস্যশিল্পে দাসপ্রথার চল নিয়ে কীভাবে অনুসন্ধান করেছেন। 

অনুসন্ধান হতে পারে বহুমুখী 
সরবরাহ চেইন নিয়ে রিপোর্টিং করাটা নানা কারণেই চ্যালেঞ্জিং। কারণ, এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে প্রতারণা ও গোপনীয়তা। নিজেদের আড়াল করতে চাওয়া সরবরাহ নেটওয়ার্কের কর্মকাণ্ড উন্মোচন করতে গেলে দরকার হয়, উদ্ভাবনী দক্ষতা ও লেগে থাকার মানসিকতা। সরবরাহ চেইন অনেক সময় হতে পারে জটিল এবং একাধিক দেশে বিস্তৃত। ফলে সামগ্রিক চিত্র তুলে আনতে গিয়ে আপনার দরকার হতে পারে অন্য দেশের সাংবাদিকদের সহযোগিতা। এসব কারণে এ ধরনের অনুসন্ধানী প্রকল্পগুলো হয়ে উঠতে পারে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। 

পণ্য সরবরাহের শিকলটিকে বুঝতে হলে আপনাকে তার প্রতিটি সংযোগ চিহ্নিত করতে হবে। অনুসন্ধানে এই কাজটিই সবচেয়ে কঠিন। শিকলের জোড়াগুলোকে খুঁজে বের করতে যেসব তথ্য দরকার হয়, তা পাওয়া যায় বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সোর্স বা উৎস থেকে। পানজিভা, পিয়ার্স বা ইনিগমার মতো বাণিজ্য-তথ্যের দরকারি সেই উৎসগুলোর ঠিকানা মিলবে জিআইজেএনের এই টুলকিটে।

সরবরাহ চেইনে ছোট-বড় নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান থাকে। একেবারে নিচের দিকের ছোট কোম্পানিগুলোর মালিক কারা, তা খুঁজে বের করাও আপনার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ অনেক দেশেই করপোরেট মালিকানার তথ্য প্রকাশসংক্রান্ত আইনগুলো দুর্বল। মালিকানার তথ্য খোঁজার জন্য সাংবাদিকেরা ওপেন করপোরেটস, ইনভেস্টিগেটিভ ড্যাশবোর্ড এবং বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস রিসোর্স সেন্টারের মতো কিছু প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন। আমাদের রিসোর্স তালিকায় তাদের পরিচিতিও তুলে ধরা হয়েছে।
সমসাময়িক উন্মোচন
জটিলতা যতই থাকুক, তার গভীরে গিয়ে সমস্যাকে তুলে আনাই সাংবাদিকদের কাজ। সরবরাহ চেইন নিয়েও এমন অনেক অনুসন্ধান হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে তেমনই কিছু উদাহরণ।

২০১৯ সালে গার্ডিয়ান ও দ্য ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ নিউজের সঙ্গে জোট বেঁধে পরিবেশবিধ্বংসী মাংস ব্যবসার খবর প্রকাশ করেছিল রিপোর্টার ব্রাজিল। মারফ্রিগ একটি ব্রাজিলিয় মাংস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। তারা ফাস্ট ফুডের দোকানে মাংস সরবরাহ করে। সাংবাদিকেরা অনুসন্ধান করে বের করেন, প্রতিষ্ঠানটি যে খামার থেকে গবাদিপশু কেনে, তারা গরু পালনের নামে অবৈধভাবে বনভূমি ধ্বংস করছে। (দেখুন সেই প্রতিবেদন)

২০১৯ সালে ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ নিউজের সংগ্রহ করা তথ্যের সঙ্গে নিজেদের তথ্য মিলিয়ে দেখেছিল জার্মানির সংবাদপত্র ওয়েল্ট এম জোনট্যাগ। তারা হিসেব করে দেখায়, জার্মানির রেস্তোরাঁ ও রিটেইল চেইনশপগুলোতে বছরে গড়ে ৪০ হাজার টন গরুর মাংস লাগে। আর এই মাংস তারা আমদানি করেছে ব্রাজিলীয় প্রতিষ্ঠান জেবিএস, মারফ্রিগ ও মিনার্ভার কাছ থেকে।

২০১৬ সালে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সাংবাদিকেরা উন্মোচন করেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মৎস্যশিল্পে দাসপ্রথার করুণ চিত্র। এই রিপোর্টের কারণে মুক্তি পেয়েছিল দুই হাজারের বেশি আধুনিক ক্রীতদাস, যারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি কোম্পানির হয়ে সাগরে মাছ ধরতেন। এপির সাংবাদিকেরা খুঁজে বের করেন, এই সামুদ্রিক মাছগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোন সুপারমার্কেটে যায়, এবং কারা সেই মাছ দিয়ে পোষা প্রাণীর খাদ্য তৈরি করে। এই অনুসন্ধানী সিরিজের জন্য, ২০১৬ সালে পাবলিক সার্ভিস ক্যাটাগরিতে পুলিৎজার পুরস্কার জেতে এপি।২০১৮ সালের জুনে সাড়া জাগানো আরেকটি অনুসন্ধান প্রকাশ করে এপি। এবার তারা দেখায়, কীভাবে বিদেশি জলসীমা থেকে ধরে আনা ইয়েলোফিন টুনা বিক্রি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে, যদিও মার্কিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দাবি ছিল, মাছগুলো নেহাতই সাধারণ ও সামুদ্রিক। এই অনুসন্ধানে এপির সাংবাদিকেরা আমেরিকার সবচেয়ে বড় মাছের বাজারে নজরদারি করেছেন, মাছবাহী  ট্রাক অনুসরণ করেছেন, স্বাদ বুঝতে একজন বাবুর্চিকে সঙ্গে নিয়েছেন, মাছের ডিএনএ টেস্ট করিয়েছেন এবং তিনটি মহাদেশের জেলেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। মার্কিন এই কোম্পানির সরবরাহ চেইন খুঁজতে গিয়ে সাংবাদিকেরা পেয়েছেন বিদেশি জলসীমায় কাজ করা অভিবাসী জেলেদের। তাদের মুখ থেকেই উঠে আসে, “শ্রম আইন লঙ্ঘন, চোরাচালান এবং হাঙর, তিমি ও ডলফিন হত্যার গুরুতর অভিযোগ ।”

এবার নজর দেওয়া যাক পোশাকশিল্পের দিকে। এই খাতের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা অনেক, বিভিন্ন দেশে তদন্তও হয়েছে।

২০১৬ সালে বিবিসি একটি অনুসন্ধান করে। তারা দেখায়, তুরস্কে শরণার্থী হয়ে আসা সিরীয় শিশুদের দিয়ে পোশাক তৈরি হচ্ছে মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার এবং অনলাইন রিটেইলার আসোসের জন্য। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের রিপোর্টার নাটালি কিট্রোয়েফ ও ভিক্টোরিয়া কিম, ২০১৭ সালে লিখেছিলেন এই প্রতিবেদন: ১৩ ডলারের একটি শার্টের নেপথ্যে ঘণ্টায় ৬ ডলার পাওয়া শ্রমিক। লেখার উপশিরোনাম ছিল, “কম মজুরিতে পোশাক বানিয়ে দায় এড়াচ্ছে ফরেভার ২১ এবং অন্য রিটেইলাররা।”

কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের চিপ তৈরিতে ব্যবহার হয় কোবাল্ট। এটি উত্তোলন করা হয় খনি থেকে। কঙ্গোর কোবাল্ট খনিতে কভাবে শিশুশ্রম ব্যবহার হচ্ছে, তা নিয়ে ২০১৮ সালে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে সিবিএস নিউজ। এ জন্য কঙ্গোর সেই খনিতে যান তাদের রিপোর্টার ডেবোরা পাট্টা। সিবিএস-এর সেই রিপোর্টে বলা হয়, “কঙ্গোর কোবাল্ট খনিতে কাজের পরিবেশ নিয়ে এতই স্পর্শকাতরতা ছিল যে, প্রতি একশ ফুট পরপর সিবিএস নিউজের দলকে থামানো হয়েছে; নিরাপত্তারক্ষীরা বারবার কাগজপত্র দেখতে চেয়েছে; যদিও আগেই অনুমতি নেওয়া ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।”

কঙ্গোতে যারা কোবাল্ট কেনাবেচা করে, তারা কখনো প্রশ্ন করেনি—এই কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে কি না। গোপন একটি ক্যামেরা ব্যবহার করে ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছিল সিবিএস। বড় বড় কোম্পানি দাবি করে, তারা এজাতীয় কোবাল্ট ব্যবহারই করে না।

ওয়ালমার্টের চীনা কারখানাগুলো কীভাবে পরিবেশ দূষণ করছে, তা তুলে এনেছিলেন অ্যান্ডি ক্রোল। ২০১৩ সালে মাদার জোনসের একটি আর্টিকেলে তিনি উপসংহার টানেন, কোম্পানির অডিটররা যেন কিছুই দেখছেন না। 
মূল্যবান হতে পারে এনজিও যোগাযোগ
সরবরাহ চেইন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা প্রায়ই স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর সাহায্য নেন। তাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকে। একেকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে একেক খাতের তথ্য পাওয়া যায়। যেমন সিফুড, তৈরি পোশাক, খনিজ দ্রব্য, ইলেকট্রনিক পণ্য ইত্যাদি। অনুসন্ধানের জন্য প্রাথমিক তথ্য আসতে পারে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট, ইউনিয়ন, কমিউনিটি গ্রুপ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকেও।

সরবরাহ চেইন নিয়ে এনজিওগুলো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান করেছে। ২০১৮ সালের মে মাসে গ্রিনপিসের একটি রিপোর্ট ছিল সমুদ্রে মাছ ধরার পরিস্থিতি নিয়ে। সমুদ্রে দুর্দশা নামের এই রিপোর্টে দেখানো হয় করুণ কর্মপরিবেশ এবং তাইওয়ানে দূর থেকে বসে মাছ ধরার ক্ষতিকর পদ্ধতি। ২০১৮ সালের জুনে, ট্রেড ইউনিয়নগুলোর বৈশ্বিক জোট এবং শ্রম ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো প্রকাশ করে আরেকটি রিপোর্ট। সেখানে দেখানো হয় এইচএন্ডএম এর পোশাক সরবরাহ চেইনে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার চিত্র। 

কখনো কখনো, সাংবাদিকেরা সরাসরি কাজ করেন অ্যাকটিভিস্টদের সঙ্গেও।

দক্ষিণ আফ্রিকার সংবাদমাধ্যম, কার্তে ব্লস কাজ করেছিল অস্ত্র চোরাচালান বিশেষজ্ঞ ক্যাথি লিন অস্টিনের সঙ্গে জোট বেঁধে। তাঁরা গন্ডার শিকারের ঘটনাস্থলগুলো ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছিলেন ব্যবহৃত বুলেট-গোলাবারুদ, যা তৈরি হয়েছে চেক রিপাবলিকে। চার পর্বের এই সিরিজ প্রযোজনা করেন জাশা সোয়েনডেনওয়াইন। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই অনুসন্ধানী প্রকল্পে রিপোর্টিং করা হয় মোজাম্বিক, পর্তুগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। নজরদারি এবং সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের। খুঁজে বের করা হয় সরকারি নথিপত্র এবং ব্যবহার করা হয় গোপন ক্যামেরা।
করপোরেট আইনের সুবিধা নিন
সরবরাহ চেইন নিয়ে গবেষণার জন্য আপনাকে করপোরেট আইন বুঝতে হবে। এসব আইনের কারণেই প্রতিষ্ঠানের মালিক ও শীর্ষ নির্বাহীরা নিয়ন্ত্রণে বা চাপে থাকেন। 

করপোরেট আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এমন আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও আইন ক্রমেই বাড়ছে। বিভিন্ন দেশের সরকার এবং এনজিওগুলোর উদ্যোগে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসার নানা পদ্ধতিও তৈরি হচ্ছে। তেমনই কয়েকটি এনজিও – নো দ্য চেইন, টার্নিং পয়েন্ট এবং করপোরেট হিউম্যান রাইটস বেঞ্চমার্ক।

করপোরেশনগুলো যেন তাদের সরবরাহ চেইনে থাকা সমস্যা খুঁজে বের করে এবং তা সমাধান করে, সে জন্য তাদের ওপর চাপ অব্যাহত আছে। আর এই কাজে তাদের সহায়তার জন্য গড়ে উঠছে অনেক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। রিপরিস্ক তাদের অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্য: “স্বতন্ত্র তথ্যপ্রযুক্তি টুল ব্যবহারের মাধ্যমে, রিপরিস্ক প্রতিদিন ৮০ হাজারের বেশি সংবাদমাধ্যম ও স্টেকহোল্ডারদের থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই ও মূল্যায়ন করে। কোনো সমস্যা বা ঝুঁকি দ্রুত চিহ্নিত করার জন্য, ১৫টি ভাষায় চালানো হয় এই যাচাই ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া।”

কিন্তু তাদের কাছ থেকে খুব বেশি স্বচ্ছতা আশা করবেন না। এই পরামর্শকেরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে দায়বদ্ধ। সরবরাহ চেইন নিয়ে এসব করপোরেট রেকর্ড সংবাদমাধ্যমের কাছে পৌঁছায় না বললেই চলে। তবে সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে কিছু প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকদের তথ্য দিয়ে সাহায্য করে। 

সরবরাহ চেইন অনেক সময় হতে পারে জটিল এবং একাধিক দেশে বিস্তৃত। ফলে সামগ্রিক চিত্র তুলে আনতে গিয়ে আপনার দরকার হতে পারে অন্য দেশের সাংবাদিকদের সহযোগিতা।২০১০ ক্যালিফোর্নিয়া ট্রান্সপারেন্সি ইন সাপ্লাই চেইন অ্যাক্ট এবং যুক্তরাজ্যের ২০১৫ মডার্ন স্লেভারি বিলের মতো কিছু আইনের কারণে এখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চেয়ে বেশি তথ্য প্রকাশ করে।

এভাবে, সামনের দিনগুলোতে হয়তো স্বচ্ছতা আরও বাড়বে, এবং তার প্রতিফলন দেখা যাবে দোকানে রাখা পণ্যের তাকে। 

প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বের কিছু অংশে এমন দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে যেখানে ক্রেতারা তাদের ফোন দিয়ে মোড়ক স্ক্যান করে দেখে নিতে পারছেন – পণ্যটি কোথায়, কারা, কোন পরিস্থিতিতে তৈরি করেছে। কিন্তু এ ধরনের প্রক্রিয়া আরও বিস্তৃত আকারে বাস্তবায়ন এখনো অনেক দূরের ব্যাপার।
খবরের প্রতিক্রিয়া 
সংবাদমাধ্যমের কাভারেজ এই ইস্যুতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। 

২০১৭ সালে স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণার শেষটা করা হয়েছিল এভাবে: “এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল অ্যান্ড গভর্ন্যান্স  (ইএসজি)-কে ঘিরে সংবাদমাধ্যমের নেতিবাচক প্রতিবেদন একটি প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট রিস্ক বাড়ায়।” 

কখনো কখনো সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা শ্রমিকদের জীবনও বাঁচায়। এপির সাংবাদিক মার্থা মেনডোজা ও তাঁর সহকর্মীরা মিলে ১৮ মাস ধরে একটি অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন। যার ফলে ইন্দোনেশিয়ার জেলে নৌকায় ক্রীতদাসের মতো কাজ করা দুই হাজার মানুষ মুক্তি পেয়েছিলেন।

এমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমাগত ঘটতে থাকে। তাই ফলোআপ করাটা জরুরি। সাংবাদিক ও গবেষক নিকোলাস পোপ বলেন, “কখনো কখনো বিষয়টি আমাদের চোখের আড়ালেই রয়ে যায়।” তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন এভাবে: “সাধারণত দেখা যায়, বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য সরবরাহ করে, এমন কোনো কারখানায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রকাশ পেলে (ধরা যাক শিশুশ্রম নিয়ে), সত্যিকারের কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে বরং সেখান থেকে সরে পড়ে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি। তারা বড় বড় ঘোষণা দেয়। বলে, এসব তারা জানত না এবং অবিলম্বে সেই সরবরাহকারী কারখানার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করবে। তাদের আশা থাকে, কেলেঙ্কারিটা যেন এভাবে সবার অগোচরে চলে যায়।”

কিন্তু কাহিনি এখানেই শেষ হয় না। এমন ছোট ছোট কারখানার সঙ্গে বড় একটি ব্র্যান্ড চুক্তি বাতিল করলে হাজারো শ্রমিক তাদের জীবিকা হারান। এঁদের সহায়তায় কেউই কিছু করে না। যে সাংবাদিকেরা এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো উন্মোচন করছেন, তাঁদের এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, নিপীড়নের শিকার শ্রমিকদের এই দুরবস্থার অবসান ঘটানোর জন্য বড় ব্র্যান্ডগুলোই যেন পদক্ষেপ নেয়। কারণ, দাম ও পণ্য হস্তান্তরের সময় নিয়ে ব্র্যান্ডগুলো যে চাপ তৈরি করে, তা-ই সমস্যার প্রধান কারণ, বিশেষত তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে।

সরবরাহ চেইন নিয়ে রিপোর্টিং বিপজ্জনকও হতে পারে। যেমন: ইন্দোনেশিয়ার দুর্গম অঞ্চলে পাম তেল উৎপাদন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে হুমকি ও শারীরিক নিপীড়নের মুখে পড়েছেন সাংবাদিকেরা। তুর্কমেনিস্তানের তুলা শিল্পে জোরপূর্বক শ্রম নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে কারাগারে বন্দি হয়েছেন গ্যাসপার মাতালেভ। ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইট ফোরাম ও দ্য ইনডিপেনডেন্ট সূত্রে জানা গেছে, তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

এই গাইড সম্পাদনা করেছেন জিআইজেএন রিসোর্স সেন্টারের পরিচালক টবি ম্যাকিনটশ। তিনি ছিলেন ওয়াশিংটনভিত্তিক রিপোর্টার এবং ৩৯ বছর ধরে ব্লুমবার্গ বিএনএ-এর সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। অলাভজনক ওয়েবসাইট ফ্রিডমইনফো ডট ওআরজি-এর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। এখানে তিনি কাজ লেখালেখি করেছেন বিশ্বজুড়ে তথ্য অধিকারের ব্যবহার নিয়ে। তথ্য অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, এফওআইএনেট-এর পরিচালনা পর্ষদেও ছিলেন তিনি।

যখন সাংবাদিকতা খারাপ হয়ে ওঠে: দক্ষিণ আফ্রিকার একটি কেইস স্টাডি

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রভাবশালী পত্রিকা সানডে টাইমস। অর্থনৈতিক চাপের মুখে বিক্রি বাড়াতে, তারা নিয়মিত আলোড়ন তোলার মতো প্রতিবেদন ছাপার কৌশল নিয়েছিল। কিন্তু ক্রমেই ভুল বাড়তে থাকে তাদের রিপোর্টে। শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে তারা তথ্য-প্রমাণও অগ্রাহ্য করতে শুরু করে।  এই সুযোগে গোয়েন্দা সংস্থা ও ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো তাদের ব্যবহার করতে শুরু করে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে। আর এভাবে শতবর্ষী পত্রিকাটি হয়ে ওঠে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যে নীলনকশা, তার অন্যতম অংশ।