অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ইম্প্যাক্ট বা প্রভাব বাড়াতে যা করবেন

একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেই সাংবাদিকদের কাজ শেষ হয়ে যায় না। সেটি যেন জনপরিসরে প্রভাব তৈরি করতে পারে, ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে–সেদিকে নজর দেওয়াও জরুরি। জিআইজেএনের সাম্প্রতিক একটি ওয়েবিনারে এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কৌশল-পরামর্শ ও টুল নিয়ে আলোচনা করেছেন অভিজ্ঞ সাংবাদিকেরা।

সরবরাহ চেইন অনুসন্ধানের যত রকম কৌশল

English

সাপ্লাই চেইন, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় সরবরাহ শিকল। এটি হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট পণ্য উৎপাদন, বিতরণ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোর একটি নেটওয়ার্ক। এই শিকলে থাকতে পারে কাঁচামাল সরবরাহকারী থেকে শুরু করে, সেই কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদনকারী, উৎপাদিত পণ্য গুদামে সংরক্ষণকারী, বাজারে বিতরণকারী এবং শেষ পর্যন্ত পণ্যটি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া খুচরা বিক্রয়কারী পর্যন্ত সব ধরনের প্রতিষ্ঠান। পোশাক, ইলেকট্রনিকস, যানবাহন, খাদ্য বা ওষুধ—পণ্য যেমন হতে পারে বৈচিত্র্যময়, সরবরাহ চেইনও ঠিক তেমনই। 

পণ্য—তা সে কৃষিজাত হোক বা শিল্প—কোথা থেকে আসে বা কোথায় যায়, তার অনুসন্ধান হতে পারে রিপোর্টারদের জন্য কাজের দারুণ ক্ষেত্র। এ ধরনের অনুসন্ধান থেকে বেরিয়ে আসে জোরপূর্বক শ্রম, পরিবেশগত অপরাধ, দুর্নীতি, এমনকি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও। 

তবে গুরুতর চ্যালেঞ্জ হলো, এত কিছুর মধ্যে সংযোগ খুঁজে বের করাটা।

কোনো ভোগ্যপণ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষিজমি, প্রাকৃতিক সম্পদের খনি বা শিল্পকারখানায় কাজের পরিবেশ কেমন এবং তাদের সঙ্গে সরবরাহ চেইনের সম্পর্ক কী, তা উন্মোচন করতে গেলে আপনার দরকার হবে অনেক ধরনের অনুসন্ধানী টুল। 

আপনার হাতে সেই সব টুল, গবেষণার উপকরণ, রিপোর্ট এবং নানা রকম তথ্যের উৎসের খবর তুলে দিতেই জিআইজেএন তৈরি করেছে সাপ্লাই চেইন রিসোর্স পেইজ। এর বাইরেও যদি জানতে চান, পড়ে নিন জিআইজেএনের  প্রাসঙ্গিক এই রিসোর্সগুলো:  

সাগরে থাকা জাহাজ অনুসরণ

মানব পাচার ও দাসত্ব 

খনিজ উত্তোলন শিল্প

দুর্নীতি বিষয়ক তথ্যভাণ্ডার

বিষয়টি সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানতে চাইলে, পড়তে পারেন: লার্নিং কাস্টম ল্যাঙ্গুয়েজ টু ট্র্যাক শিপমেন্ট। অষ্টম এশিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে এটি উপস্থাপন করেছিলেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার শিক্ষক জিয়ানিনা সেনিনি। তিনি এখানে তুলে ধরেছেন কাস্টমস কোডের ব্যবহার, বিল অব লেডিং, জাহাজ অনুসরণ এবং কীভাবে পণ্যবাহী কনটেইনার ট্র্যাক করতে হয়। 

এ ছাড়া দেখতে পারেন জিআইজেনের এই ভিডিও, যেখানে এপির সাংবাদিক মার্থা মেনডোজা বলেছেন, তারা মৎস্যশিল্পে দাসপ্রথার চল নিয়ে কীভাবে অনুসন্ধান করেছেন। 

অনুসন্ধান হতে পারে বহুমুখী 
সরবরাহ চেইন নিয়ে রিপোর্টিং করাটা নানা কারণেই চ্যালেঞ্জিং। কারণ, এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে প্রতারণা ও গোপনীয়তা। নিজেদের আড়াল করতে চাওয়া সরবরাহ নেটওয়ার্কের কর্মকাণ্ড উন্মোচন করতে গেলে দরকার হয়, উদ্ভাবনী দক্ষতা ও লেগে থাকার মানসিকতা। সরবরাহ চেইন অনেক সময় হতে পারে জটিল এবং একাধিক দেশে বিস্তৃত। ফলে সামগ্রিক চিত্র তুলে আনতে গিয়ে আপনার দরকার হতে পারে অন্য দেশের সাংবাদিকদের সহযোগিতা। এসব কারণে এ ধরনের অনুসন্ধানী প্রকল্পগুলো হয়ে উঠতে পারে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। 

পণ্য সরবরাহের শিকলটিকে বুঝতে হলে আপনাকে তার প্রতিটি সংযোগ চিহ্নিত করতে হবে। অনুসন্ধানে এই কাজটিই সবচেয়ে কঠিন। শিকলের জোড়াগুলোকে খুঁজে বের করতে যেসব তথ্য দরকার হয়, তা পাওয়া যায় বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সোর্স বা উৎস থেকে। পানজিভা, পিয়ার্স বা ইনিগমার মতো বাণিজ্য-তথ্যের দরকারি সেই উৎসগুলোর ঠিকানা মিলবে জিআইজেএনের এই টুলকিটে।

সরবরাহ চেইনে ছোট-বড় নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান থাকে। একেবারে নিচের দিকের ছোট কোম্পানিগুলোর মালিক কারা, তা খুঁজে বের করাও আপনার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ অনেক দেশেই করপোরেট মালিকানার তথ্য প্রকাশসংক্রান্ত আইনগুলো দুর্বল। মালিকানার তথ্য খোঁজার জন্য সাংবাদিকেরা ওপেন করপোরেটস, ইনভেস্টিগেটিভ ড্যাশবোর্ড এবং বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস রিসোর্স সেন্টারের মতো কিছু প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন। আমাদের রিসোর্স তালিকায় তাদের পরিচিতিও তুলে ধরা হয়েছে।
সমসাময়িক উন্মোচন
জটিলতা যতই থাকুক, তার গভীরে গিয়ে সমস্যাকে তুলে আনাই সাংবাদিকদের কাজ। সরবরাহ চেইন নিয়েও এমন অনেক অনুসন্ধান হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে তেমনই কিছু উদাহরণ।

২০১৯ সালে গার্ডিয়ান ও দ্য ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ নিউজের সঙ্গে জোট বেঁধে পরিবেশবিধ্বংসী মাংস ব্যবসার খবর প্রকাশ করেছিল রিপোর্টার ব্রাজিল। মারফ্রিগ একটি ব্রাজিলিয় মাংস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। তারা ফাস্ট ফুডের দোকানে মাংস সরবরাহ করে। সাংবাদিকেরা অনুসন্ধান করে বের করেন, প্রতিষ্ঠানটি যে খামার থেকে গবাদিপশু কেনে, তারা গরু পালনের নামে অবৈধভাবে বনভূমি ধ্বংস করছে। (দেখুন সেই প্রতিবেদন)

২০১৯ সালে ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ নিউজের সংগ্রহ করা তথ্যের সঙ্গে নিজেদের তথ্য মিলিয়ে দেখেছিল জার্মানির সংবাদপত্র ওয়েল্ট এম জোনট্যাগ। তারা হিসেব করে দেখায়, জার্মানির রেস্তোরাঁ ও রিটেইল চেইনশপগুলোতে বছরে গড়ে ৪০ হাজার টন গরুর মাংস লাগে। আর এই মাংস তারা আমদানি করেছে ব্রাজিলীয় প্রতিষ্ঠান জেবিএস, মারফ্রিগ ও মিনার্ভার কাছ থেকে।

২০১৬ সালে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সাংবাদিকেরা উন্মোচন করেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মৎস্যশিল্পে দাসপ্রথার করুণ চিত্র। এই রিপোর্টের কারণে মুক্তি পেয়েছিল দুই হাজারের বেশি আধুনিক ক্রীতদাস, যারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি কোম্পানির হয়ে সাগরে মাছ ধরতেন। এপির সাংবাদিকেরা খুঁজে বের করেন, এই সামুদ্রিক মাছগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোন সুপারমার্কেটে যায়, এবং কারা সেই মাছ দিয়ে পোষা প্রাণীর খাদ্য তৈরি করে। এই অনুসন্ধানী সিরিজের জন্য, ২০১৬ সালে পাবলিক সার্ভিস ক্যাটাগরিতে পুলিৎজার পুরস্কার জেতে এপি।২০১৮ সালের জুনে সাড়া জাগানো আরেকটি অনুসন্ধান প্রকাশ করে এপি। এবার তারা দেখায়, কীভাবে বিদেশি জলসীমা থেকে ধরে আনা ইয়েলোফিন টুনা বিক্রি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে, যদিও মার্কিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দাবি ছিল, মাছগুলো নেহাতই সাধারণ ও সামুদ্রিক। এই অনুসন্ধানে এপির সাংবাদিকেরা আমেরিকার সবচেয়ে বড় মাছের বাজারে নজরদারি করেছেন, মাছবাহী  ট্রাক অনুসরণ করেছেন, স্বাদ বুঝতে একজন বাবুর্চিকে সঙ্গে নিয়েছেন, মাছের ডিএনএ টেস্ট করিয়েছেন এবং তিনটি মহাদেশের জেলেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। মার্কিন এই কোম্পানির সরবরাহ চেইন খুঁজতে গিয়ে সাংবাদিকেরা পেয়েছেন বিদেশি জলসীমায় কাজ করা অভিবাসী জেলেদের। তাদের মুখ থেকেই উঠে আসে, “শ্রম আইন লঙ্ঘন, চোরাচালান এবং হাঙর, তিমি ও ডলফিন হত্যার গুরুতর অভিযোগ ।”

এবার নজর দেওয়া যাক পোশাকশিল্পের দিকে। এই খাতের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা অনেক, বিভিন্ন দেশে তদন্তও হয়েছে।

২০১৬ সালে বিবিসি একটি অনুসন্ধান করে। তারা দেখায়, তুরস্কে শরণার্থী হয়ে আসা সিরীয় শিশুদের দিয়ে পোশাক তৈরি হচ্ছে মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার এবং অনলাইন রিটেইলার আসোসের জন্য। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের রিপোর্টার নাটালি কিট্রোয়েফ ও ভিক্টোরিয়া কিম, ২০১৭ সালে লিখেছিলেন এই প্রতিবেদন: ১৩ ডলারের একটি শার্টের নেপথ্যে ঘণ্টায় ৬ ডলার পাওয়া শ্রমিক। লেখার উপশিরোনাম ছিল, “কম মজুরিতে পোশাক বানিয়ে দায় এড়াচ্ছে ফরেভার ২১ এবং অন্য রিটেইলাররা।”

কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের চিপ তৈরিতে ব্যবহার হয় কোবাল্ট। এটি উত্তোলন করা হয় খনি থেকে। কঙ্গোর কোবাল্ট খনিতে কভাবে শিশুশ্রম ব্যবহার হচ্ছে, তা নিয়ে ২০১৮ সালে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে সিবিএস নিউজ। এ জন্য কঙ্গোর সেই খনিতে যান তাদের রিপোর্টার ডেবোরা পাট্টা। সিবিএস-এর সেই রিপোর্টে বলা হয়, “কঙ্গোর কোবাল্ট খনিতে কাজের পরিবেশ নিয়ে এতই স্পর্শকাতরতা ছিল যে, প্রতি একশ ফুট পরপর সিবিএস নিউজের দলকে থামানো হয়েছে; নিরাপত্তারক্ষীরা বারবার কাগজপত্র দেখতে চেয়েছে; যদিও আগেই অনুমতি নেওয়া ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।”

কঙ্গোতে যারা কোবাল্ট কেনাবেচা করে, তারা কখনো প্রশ্ন করেনি—এই কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে কি না। গোপন একটি ক্যামেরা ব্যবহার করে ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছিল সিবিএস। বড় বড় কোম্পানি দাবি করে, তারা এজাতীয় কোবাল্ট ব্যবহারই করে না।

ওয়ালমার্টের চীনা কারখানাগুলো কীভাবে পরিবেশ দূষণ করছে, তা তুলে এনেছিলেন অ্যান্ডি ক্রোল। ২০১৩ সালে মাদার জোনসের একটি আর্টিকেলে তিনি উপসংহার টানেন, কোম্পানির অডিটররা যেন কিছুই দেখছেন না। 
মূল্যবান হতে পারে এনজিও যোগাযোগ
সরবরাহ চেইন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা প্রায়ই স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর সাহায্য নেন। তাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকে। একেকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে একেক খাতের তথ্য পাওয়া যায়। যেমন সিফুড, তৈরি পোশাক, খনিজ দ্রব্য, ইলেকট্রনিক পণ্য ইত্যাদি। অনুসন্ধানের জন্য প্রাথমিক তথ্য আসতে পারে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট, ইউনিয়ন, কমিউনিটি গ্রুপ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকেও।

সরবরাহ চেইন নিয়ে এনজিওগুলো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান করেছে। ২০১৮ সালের মে মাসে গ্রিনপিসের একটি রিপোর্ট ছিল সমুদ্রে মাছ ধরার পরিস্থিতি নিয়ে। সমুদ্রে দুর্দশা নামের এই রিপোর্টে দেখানো হয় করুণ কর্মপরিবেশ এবং তাইওয়ানে দূর থেকে বসে মাছ ধরার ক্ষতিকর পদ্ধতি। ২০১৮ সালের জুনে, ট্রেড ইউনিয়নগুলোর বৈশ্বিক জোট এবং শ্রম ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো প্রকাশ করে আরেকটি রিপোর্ট। সেখানে দেখানো হয় এইচএন্ডএম এর পোশাক সরবরাহ চেইনে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার চিত্র। 

কখনো কখনো, সাংবাদিকেরা সরাসরি কাজ করেন অ্যাকটিভিস্টদের সঙ্গেও।

দক্ষিণ আফ্রিকার সংবাদমাধ্যম, কার্তে ব্লস কাজ করেছিল অস্ত্র চোরাচালান বিশেষজ্ঞ ক্যাথি লিন অস্টিনের সঙ্গে জোট বেঁধে। তাঁরা গন্ডার শিকারের ঘটনাস্থলগুলো ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছিলেন ব্যবহৃত বুলেট-গোলাবারুদ, যা তৈরি হয়েছে চেক রিপাবলিকে। চার পর্বের এই সিরিজ প্রযোজনা করেন জাশা সোয়েনডেনওয়াইন। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই অনুসন্ধানী প্রকল্পে রিপোর্টিং করা হয় মোজাম্বিক, পর্তুগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। নজরদারি এবং সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের। খুঁজে বের করা হয় সরকারি নথিপত্র এবং ব্যবহার করা হয় গোপন ক্যামেরা।
করপোরেট আইনের সুবিধা নিন
সরবরাহ চেইন নিয়ে গবেষণার জন্য আপনাকে করপোরেট আইন বুঝতে হবে। এসব আইনের কারণেই প্রতিষ্ঠানের মালিক ও শীর্ষ নির্বাহীরা নিয়ন্ত্রণে বা চাপে থাকেন। 

করপোরেট আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এমন আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও আইন ক্রমেই বাড়ছে। বিভিন্ন দেশের সরকার এবং এনজিওগুলোর উদ্যোগে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসার নানা পদ্ধতিও তৈরি হচ্ছে। তেমনই কয়েকটি এনজিও – নো দ্য চেইন, টার্নিং পয়েন্ট এবং করপোরেট হিউম্যান রাইটস বেঞ্চমার্ক।

করপোরেশনগুলো যেন তাদের সরবরাহ চেইনে থাকা সমস্যা খুঁজে বের করে এবং তা সমাধান করে, সে জন্য তাদের ওপর চাপ অব্যাহত আছে। আর এই কাজে তাদের সহায়তার জন্য গড়ে উঠছে অনেক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। রিপরিস্ক তাদের অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্য: “স্বতন্ত্র তথ্যপ্রযুক্তি টুল ব্যবহারের মাধ্যমে, রিপরিস্ক প্রতিদিন ৮০ হাজারের বেশি সংবাদমাধ্যম ও স্টেকহোল্ডারদের থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই ও মূল্যায়ন করে। কোনো সমস্যা বা ঝুঁকি দ্রুত চিহ্নিত করার জন্য, ১৫টি ভাষায় চালানো হয় এই যাচাই ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া।”

কিন্তু তাদের কাছ থেকে খুব বেশি স্বচ্ছতা আশা করবেন না। এই পরামর্শকেরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে দায়বদ্ধ। সরবরাহ চেইন নিয়ে এসব করপোরেট রেকর্ড সংবাদমাধ্যমের কাছে পৌঁছায় না বললেই চলে। তবে সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে কিছু প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকদের তথ্য দিয়ে সাহায্য করে। 

সরবরাহ চেইন অনেক সময় হতে পারে জটিল এবং একাধিক দেশে বিস্তৃত। ফলে সামগ্রিক চিত্র তুলে আনতে গিয়ে আপনার দরকার হতে পারে অন্য দেশের সাংবাদিকদের সহযোগিতা।২০১০ ক্যালিফোর্নিয়া ট্রান্সপারেন্সি ইন সাপ্লাই চেইন অ্যাক্ট এবং যুক্তরাজ্যের ২০১৫ মডার্ন স্লেভারি বিলের মতো কিছু আইনের কারণে এখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চেয়ে বেশি তথ্য প্রকাশ করে।

এভাবে, সামনের দিনগুলোতে হয়তো স্বচ্ছতা আরও বাড়বে, এবং তার প্রতিফলন দেখা যাবে দোকানে রাখা পণ্যের তাকে। 

প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বের কিছু অংশে এমন দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে যেখানে ক্রেতারা তাদের ফোন দিয়ে মোড়ক স্ক্যান করে দেখে নিতে পারছেন – পণ্যটি কোথায়, কারা, কোন পরিস্থিতিতে তৈরি করেছে। কিন্তু এ ধরনের প্রক্রিয়া আরও বিস্তৃত আকারে বাস্তবায়ন এখনো অনেক দূরের ব্যাপার।
খবরের প্রতিক্রিয়া 
সংবাদমাধ্যমের কাভারেজ এই ইস্যুতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। 

২০১৭ সালে স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণার শেষটা করা হয়েছিল এভাবে: “এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল অ্যান্ড গভর্ন্যান্স  (ইএসজি)-কে ঘিরে সংবাদমাধ্যমের নেতিবাচক প্রতিবেদন একটি প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট রিস্ক বাড়ায়।” 

কখনো কখনো সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা শ্রমিকদের জীবনও বাঁচায়। এপির সাংবাদিক মার্থা মেনডোজা ও তাঁর সহকর্মীরা মিলে ১৮ মাস ধরে একটি অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন। যার ফলে ইন্দোনেশিয়ার জেলে নৌকায় ক্রীতদাসের মতো কাজ করা দুই হাজার মানুষ মুক্তি পেয়েছিলেন।

এমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমাগত ঘটতে থাকে। তাই ফলোআপ করাটা জরুরি। সাংবাদিক ও গবেষক নিকোলাস পোপ বলেন, “কখনো কখনো বিষয়টি আমাদের চোখের আড়ালেই রয়ে যায়।” তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন এভাবে: “সাধারণত দেখা যায়, বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য সরবরাহ করে, এমন কোনো কারখানায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রকাশ পেলে (ধরা যাক শিশুশ্রম নিয়ে), সত্যিকারের কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে বরং সেখান থেকে সরে পড়ে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি। তারা বড় বড় ঘোষণা দেয়। বলে, এসব তারা জানত না এবং অবিলম্বে সেই সরবরাহকারী কারখানার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করবে। তাদের আশা থাকে, কেলেঙ্কারিটা যেন এভাবে সবার অগোচরে চলে যায়।”

কিন্তু কাহিনি এখানেই শেষ হয় না। এমন ছোট ছোট কারখানার সঙ্গে বড় একটি ব্র্যান্ড চুক্তি বাতিল করলে হাজারো শ্রমিক তাদের জীবিকা হারান। এঁদের সহায়তায় কেউই কিছু করে না। যে সাংবাদিকেরা এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো উন্মোচন করছেন, তাঁদের এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, নিপীড়নের শিকার শ্রমিকদের এই দুরবস্থার অবসান ঘটানোর জন্য বড় ব্র্যান্ডগুলোই যেন পদক্ষেপ নেয়। কারণ, দাম ও পণ্য হস্তান্তরের সময় নিয়ে ব্র্যান্ডগুলো যে চাপ তৈরি করে, তা-ই সমস্যার প্রধান কারণ, বিশেষত তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে।

সরবরাহ চেইন নিয়ে রিপোর্টিং বিপজ্জনকও হতে পারে। যেমন: ইন্দোনেশিয়ার দুর্গম অঞ্চলে পাম তেল উৎপাদন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে হুমকি ও শারীরিক নিপীড়নের মুখে পড়েছেন সাংবাদিকেরা। তুর্কমেনিস্তানের তুলা শিল্পে জোরপূর্বক শ্রম নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে কারাগারে বন্দি হয়েছেন গ্যাসপার মাতালেভ। ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইট ফোরাম ও দ্য ইনডিপেনডেন্ট সূত্রে জানা গেছে, তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

এই গাইড সম্পাদনা করেছেন জিআইজেএন রিসোর্স সেন্টারের পরিচালক টবি ম্যাকিনটশ। তিনি ছিলেন ওয়াশিংটনভিত্তিক রিপোর্টার এবং ৩৯ বছর ধরে ব্লুমবার্গ বিএনএ-এর সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। অলাভজনক ওয়েবসাইট ফ্রিডমইনফো ডট ওআরজি-এর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। এখানে তিনি কাজ লেখালেখি করেছেন বিশ্বজুড়ে তথ্য অধিকারের ব্যবহার নিয়ে। তথ্য অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, এফওআইএনেট-এর পরিচালনা পর্ষদেও ছিলেন তিনি।

নিখোঁজের খোঁজে: গুম, অপহরণ ও হারানো মানুষ নিয়ে অনুসন্ধানের গাইড

English

এই বিশ্বে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ নিখোঁজ হয়ে যান। ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন মিসিং পিপল বলছে, এসব ঘটনার বেশির ভাগের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র; বিশেষ করে মাদক পাচারকারীরা।  এ ছাড়া বন্য প্রাণী চোরাচালান, মানব পাচার, প্রাকৃতিক সম্পদ চুরি—এমন আরও অনেক অপরাধী চক্র মানুষের এভাবে হারিয়ে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে।

এমন অপরাধ ঠেকাতে সাংবাদিকদের বড় ভূমিকা আছে; বিশেষ করে যেসব জায়গায় রাষ্ট্র ও আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে। সেটি হতে পারে লেখালেখির মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করে, অথবা ঘটনার গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে।সবচেয়ে ডাকসাইটে অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ড, সাধারণত হয় বিশ্বজোড়া। তারা খুবই সুসংগঠিত, আর তাদের কারবারও বেশ নিয়মতান্ত্রিক। তাদের চোখে পড়বে আমাদের চারপাশে, নিত্যদিনের জীবনে; কখনো কখনো তারা ঢুকে পড়ে সিস্টেমের একেবারে গভীরে; তাদের দেখা যায় গুরুত্বপূর্ণ সব সামাজিক সংগঠনে।

যখন সব জায়গায় দুর্নীতি প্রবলভাবে জেঁকে বসে, তখন সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর কারণে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এসব মানুষ নিয়ে কোনো অনুসন্ধান হয় না। জাতীয় বা আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষকে তারা প্রায়ই চুপ করিয়ে রাখে অর্থের বিনিময়ে। আবার কখনো অপরাধী গোষ্ঠীর ক্ষমতা ও ব্যাপ্তি এতই বড় হয়ে ওঠে যে, কোথাও অপরাধের কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। যেসব গুমের সঙ্গে কোনোভাবে রাষ্ট্র জড়িত;  যেখানে একজন মানুষকে কেউ তুলে নিয়ে গেছে, গোপনে আটকে রেখেছে অথবা মেরে ফেলেছে এবং লাশটাকে লুকিয়ে ফেলেছে—তাদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য।

এই অপরাধের ধরন অনেক রকম হতে পারে: একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, একসঙ্গে অনেক মানুষের গুম হয়ে যাওয়া, অথবা নির্দিষ্ট সময়ে পরস্পর সংযুক্ত একাধিক ঘটনা। অনেকে আবার নিখোঁজ হন নিজের ইচ্ছাতেও।

এমন অপরাধ ঠেকাতে সাংবাদিকদের বড় ভূমিকা আছে; বিশেষ করে যেখানে রাষ্ট্র ও আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে। সেটি হতে পারে লেখালেখির মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করে, অথবা ঘটনার গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে। কিন্তু নিখোঁজ ব্যক্তিদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে একজন সাংবাদিক নিজেও এ ধরনের অপরাধের শিকার হতে পারেন। তাঁরা কোনোভাবেই ঝুঁকির বাইরে নন।

এসব কারণে সংঘবদ্ধ অপরাধ ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের নিয়ে অনুসন্ধান করার কাজটি হয়ে ওঠে জটিল ও সূক্ষ্ম। এই বিষয় নিয়ে কাজ করতে গেলে একজন সাংবাদিককে সব সময় সতর্ক থাকতে হয় এবং চিন্তা করে এগোতে হয়। বিশ্বের অনেক দেশেই হারিয়ে যাওয়া মানুষ নিয়ে বড় বড় অনুসন্ধান হয়েছে। আমরা এই গাইডে তুলে ধরেছি তেমন কিছু উদাহরণ, গবেষণাসূত্র, প্রাসঙ্গিক সংগঠনের পরিচিতি এবং মাঠপর্যায়ে রিপোর্টিংয়ের পরামর্শ।

গাইডটি প্রকাশিত হয়েছে জিআইজেএন ও রেজিলিয়েন্স ফান্ড আয়োজিত “ডিগিং ইনটু ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স” ওয়েবিনার সিরিজের অংশ হিসেবে। এই সিরিজের বিষয় ছিল সংঘবদ্ধ অপরাধ ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের নিয়ে অনুসন্ধান। এটি দেখতে পাবেন ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষায়। ফরাসি ভাষায় আয়োজিত ওয়েবিনারে উঠে এসেছে নির্দিষ্ট কিছু ঘটনার কথা। এবং বিভিন্ন ভাষায় প্রচারিত হয়েছে: কীভাবে খুঁজবেন নিখোঁজদের।

সূচিপত্র

কেস স্টাডি
দরকারি গাইড ও সংগঠন
রিপোর্টিং টিপস

ঘটনাস্থল সম্পর্কে জানুন
নিরাপদ থাকা ও রাখা
তথ্য দেবে কারা
সূত্র খুঁজবেন কী করে
সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ
যখন কাজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে
মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের নিয়ে কাজ
নিজের যত্ন

কেস স্টাডি
নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষদের নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বাছাই করা হয়েছে এখানে।

সার্চিং উইথ দ্য মাদারস অব মেক্সিকো’স ডিজঅ্যাপিয়ার্ড (২০২০)। এই প্রতিবেদনে, মেক্সিকোতে গুম বা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য নিউ ইয়র্কা, যারা এখনো হারানো স্বজনকে খুঁজে পেতে মরিয়া।
মিসিং ইন ফ্রান্স: দ্য প্লাইট অব ভিয়েতনামিজ চিলড্রেন হু আর ট্রাফিকড ইনটু ইউরোপ (২০২০)। ভিয়েতনামের শিশুরা কীভাবে নিখোঁজ হচ্ছে, তা নিয়ে এই অনুসন্ধান করেছেন সাংবাদিকেরা। এতে দেখা গেছে, ফ্রান্সের একটি বিমানবন্দর থেকে তুলে নিয়ে এই শিশুদের ইউরোপের অন্য দেশে পাচার করা হয়েছে।
রুয়ান্ডায় গণহত্যা, ফ্রান্সে আত্মগোপন ও পিছে লেগে থাকা এক সাংবাদিক (২০২০)। এই লেখায় জিআইজেএন কথা বলেছে থিও এঙ্গেলবার্টের সঙ্গে। যিনি বেশ কয়েক বছর ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে খুঁজে বের করেছিলেন রুয়ান্ডার সাবেক সেনা কর্মকর্তা অ্যালোয়েস নিউইরাগাবোকে। যিনি দীর্ঘ সময় ধরে আত্মগোপন করে ছিলেন।
সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে যেভাবে বেরিয়ে এলো ২০০০ গুপ্ত কবর (২০১৯)। তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগ, ডেটা বিশ্লেষণ ও পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নিয়ে মেক্সিকোতে নিখোঁজ হওয়া মানুষদের ওপর অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন মার্সেলা তুরাতি ও তাঁর দল। এই লেখায় তিনি সেই অনুসন্ধান নিয়ে কথা বলেছেন জিআইজেএন-এর সঙ্গে।
মিসিং অ্যান্ড মার্ডারড: দ্য আনসলভড কেসেস অব ইনডিজিনাস ওমেন অ্যান্ড গার্লস (২০১৭-১৮)। সিবিসি নিউজের এই পুরস্কারজয়ী পডকাস্টে উন্মোচিত হয়েছে, কানাডার আদিবাসী নারীদের ব্যাপক হারে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাগুলো কেন অমীমাংসিত থেকে গেছে।
জোনাস বার্গোস: ট্র্যাপড ইন আ ওয়েব অব লাইভস (২০১৩)। ফিলিপিনো বিদ্রোহী জোনাস বার্গোসকে নিয়ে এই অনুসন্ধান করেছেন র‌্যাপলারের গ্লোরিয়া গ্লেন্ডা।
দ্য সার্চ: মিসিং অ্যান্ড মার্ডারড ইনডিজিনাস ওমেন (২০১৯)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আদিবাসী নারীদের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া নিয়ে এই তথ্যচিত্র তৈরি করেছে আল-জাজিরা।
দ্য এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স অব দ্য আয়োজিনাপা স্টুডেন্টস (২০১৭)। ডেটা মাইনিং ও থ্রিডি ইন্টারঅ্যাকটিভ মডেলিং ব্যবহার করে ২০১৪ সালে মেক্সিকোতে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ৪৩ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে অনুসন্ধান করেছে ফরেনসিক আর্কিটেকচার ।
হাউ দ্য ইউএস ট্রিগার্ড আ ম্যাসাকার ইন মেক্সিকো (২০১৭)। মেক্সিকোর আলেন্দে-তে মাদক সংশ্লিষ্ট গণহত্যা  এবং এর ফলে কয়েক শ মানুষ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া নিয়ে এই রিপোর্ট করেছিলেন জিনজার থম্পসন ও আলেক্সান্দ্রা জানিক ভন বারট্রাব।
হোয়াই আর ১০,০০০ মাইগ্রেন্ট চিলড্রেন মিসিং ইন ইউরোপ? (২০১৬)। এখানে শিশু পাচার ও হারিয়ে যাওয়া অভিবাসীদের নিয়ে তৈরি ইউরোপোলের পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখেছে বিবিসি।
দ্য রুম অব বোনস (২০১৫)। এল সালভাদরে তিন দশকের সামাজিক অস্থিরতা ও সহিংসতার মধ্যে চার মা খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁদের সন্তানদের মৃতদেহ। এমন এক পরিস্থিতি নিয়ে নির্মিত হয়েছে এই তথ্যচিত্র।
লস্ট গার্লস অব ইন্দোনেশিয়া অ্যামং ৬১,০০০ ডেড অ্যান্ড মিসিং মাইগ্রেন্টস (২০১৮)। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ইন্দোনেশিয়ার সেসব মেয়ের কথা, যাদের বিদেশে চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ঘরছাড়া করা হয়েছে এবং আর কখনো দেখা যায়নি।

দরকারি গাইড ও সংগঠন
ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন মিসিং পিপল (আইসিএমপি) বিশেষভাবে নজর দেয় নিখোঁজ ব্যক্তিদের মামলাগুলোর দিকে। এই বিষয় সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আইনকানুন সম্পর্কে তাদের ভালো দখল আছে।

অফিস অব দ্য ইউনাইটেড নেশনস হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর) কাজ করে অভিবাসী ও অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে হওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে। গুম বা অপহরণের শিকার হয়ে যাঁরা হারিয়ে গেছেন, তাঁদের জন্য একটি কমিটিও আছে এই প্রতিষ্ঠানের।
অভিবাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের কেউ মারা গেছে কি না কিংবা নিখোঁজ হয়েছে কি না, তার খবর রাখছে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)-এর দ্য মিসিং প্রজেক্ট।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও বলপূর্বক নিখোঁজ বা গুম হওয়া ব্যক্তিদের ঘটনা নিয়ে কাজ করে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স জার্নালিস্টস গাইড টু অর্গানাইজড ক্রাইম। এই গাইড থেকে জানা যাবে, সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র কীভাবে সাংবাদিকদের কাজ বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) নিখোঁজ সাংবাদিকদের নিয়ে বেশ কিছু অনুসন্ধান ও রিপোর্ট করেছে।
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) নিখোঁজ সাংবাদিকদের নিয়ে প্রকাশিত সব প্রতিবেদন এক জায়গায় সংরক্ষণ করে। এবং তাদের এই বিষয়ে তাদের একটি ডেটাবেসও আছে।
মেক্সিকোতে, ডেটা ব্যবহার করে গণকবর খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে হিউম্যান রাইটস ডেটা অ্যানালাইসিস গ্রুপ (এইচআরডিএজি)। তারা গুম বা অপহরণের কারণে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে অনুসন্ধান করে এবং নির্দিষ্ট দেশ ধরে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
আর্জেন্টাইন ফরেনসিক অ্যানথ্রোপোলজিস্টস টিম (ইএএএফ), নিখোঁজ ব্যক্তিদের শনাক্ত ও খুঁজে বের করতে বিজ্ঞানভিত্তিক ফরেনসিক কৌশল ব্যবহার করে।
ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেডক্রস (আইসিআরসি) বিশ্বজুড়ে গুম বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার দিকেও নিবিড় নজর রাখে।

রিপোর্টিং টিপস
এলাকাটি সম্পর্কে জানুন
কোনো নির্দিষ্ট কেস নিয়ে কাজ করার সময়, সেই এলাকা সম্পর্কে ভালোমতো জেনে নেওয়া জরুরি। এতে করে আপনি কাজের ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা নিতে পারবেন। একই সঙ্গে বুঝতে পারবেন: সেখানে কী ধরনের সংগঠিত অপরাধী চক্র সক্রিয় আছে এবং কারা জড়িত থাকতে পারে। একই ধরনের ঘটনা আগেও ঘটলে, সেই মামলাগুলো থেকে আপনার অনুসন্ধান শুরু করতে পারেন।  সেই এলাকায় আগে কাজ করেছে, এমন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলুন। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে খোঁজাখুঁজি করুন এবং সেখানকার অপরাধ জগতের কর্মকাণ্ড বোঝার চেষ্টা করুন।

বিশ্বস্ত কোনো সূত্রের সঙ্গে যোগাযোগ না করে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যাবেন না। এবং প্রয়োজন হলে কীভাবে দ্রুত সেই এলাকা ছেড়ে যাবেন, তার একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তৈরি রাখুন।

নিরাপদ থাকা ও রাখা
সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র নিয়ে অনুসন্ধান শুরুর সময়, আপনার নিজের ও সূত্রদের নিরাপত্তার দিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এ জন্য আপনার প্রয়োজন হবে একটি শক্তিশালী নিরাপত্তা পরিকল্পনা। প্রথমত, আপনাকে ঠিক করতে হবে: আপনি কী ধরনের অনুসন্ধান করতে চান এবং আপনিই এই নির্দিষ্ট অনুসন্ধানটি করার জন্য সঠিক সাংবাদিক কি না।

এরপর, আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে: আপনি কীভাবে নিরাপদে তথ্য সংরক্ষণ করবেন এবং আপনার দল ও সাক্ষাৎকারদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আপনার কম্পিউটার বা ফোনে সংবেদনশীল কোনো তথ্য নিয়ে চলাচল করবেন না। কোথাও যাওয়ার সময় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে: আপনি কোথায় যাচ্ছেন, তা যেন আপনার দলের অন্য সদস্যরা জানেন। কোনো বিপদের মুখে পড়লে কীভাবে তাঁদের সতর্কসংকেত দেবেন, তা-ও আগে থেকে ঠিক করে রাখুন।

অনুসন্ধান প্রকাশিত হওয়ার পর সোর্সদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তারা হয়তো আপনার এই কাজের জন্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তাদেরকে হামলার লক্ষ্য বানানো হতে পারে। বিষয়-সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর (যেমন: কোনো এনজিও) সঙ্গে জোট বেঁধে কাজ করলে আপনার সূত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সহজ হতে পারে। তখন আপনিও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, কখন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করলে ভালো হয়। সাধারণভাবে, আপনার প্রতিবেদনে সূত্রের এমন কোনো ব্যক্তিগত তথ্য রাখবেন না, যাতে করে তিনি বা তাঁর স্বজনেরা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন। বিশেষভাবে, এমন ছবি ও ভিডিও-র ব্যাপারে সতর্ক থাকুন, যেখান থেকে বোঝা যেতে পারে: কারা আপনার সূত্র এবং তারা কোথায় আছে। সাক্ষাৎকারদাতা কেমন পোশাক পরে ছিলেন, সেখান থেকেও তাঁর পরিচয় সম্পর্কে ধারণা মিলতে পারে। আরও তথ্য লুকিয়ে থাকতে পারে আপনার ছবির মেটাডেটায়।
তথ্য দেবে কারা
অন্য যেকোনো অনুসন্ধানের মতো, এখানেও আপনাকে শুরু করতে হবে সূত্র চিহ্নিত করা ও গড়ে তোলা দিয়ে। কী ঘটেছিল—এই প্রশ্ন সামনে রেখে যাবতীয় তথ্য সবার আগে এক জায়গায় করুন। তারপর আপনার কাজ শুরু করুন। বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে আপনি প্রাথমিক তথ্য পেতে পারেন:

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন
আদালতের নথিপত্র
তথ্য অধিকার আইনের আবেদন
প্রত্যক্ষদর্শী
এনজিও
আইনজীবী
পুলিশ
নিখোঁজ ব্যক্তির বন্ধুবান্ধব ও পরিবার

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের কাছে স্থানীয় অপরাধ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য থাকে। হয়তো দেখবেন, সেই এলাকায় অপরাধী চক্রগুলো কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কেও তাদের জানাশোনা আছে। আবার কখনো কখনো নিখোঁজ ব্যক্তিকে রক্ষা করার জন্য তার প্রিয়জনেরা অনেক তথ্য বাদ দেয় বা গোপন করে। সব খুঁটিনাটিই সাংবাদিকদের বিবেচনা করতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। গুম বা অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে কাজ করবে। তবে তাদের দেওয়া সেই তথ্যগুলো আপনাকে যাচাই করে নিতে হবে বিশ্লেষণী দৃষ্টি দিয়ে।

অন্যান্য স্থানীয় সূত্র

আপনার অনুসন্ধানের এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে, এমন ব্যক্তিরা হয়তো আরও বেশি খোলামেলা কথা বলতে আগ্রহী হবে। কারণ, তাদের ঝুঁকি তুলনামূলক কম। এমন সূত্র ও তথ্যদাতাদের একটি ম্যাপ তৈরি করে নিলে আপনার সুবিধা হতে পারে। কারাগারের বন্দিরাও আপনার গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারে। কারণ, অপরাধী চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাদের আছে। তবে তাদের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিটি তথ্য সব সময় ক্রসচেক করে নেওয়া উচিত।

সোশ্যাল মিডিয়া

ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত (নিখোঁজ বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি) মানুষদের কর্মকাণ্ড নজরে রাখার ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে প্রায়ই অনেক সহায়তা পেতে পারেন। এখান থেকে আপনি সেই অঞ্চলের অপরাধী কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও অনেক প্রাসঙ্গিক তথ্য পেতে পারেন। মাঠপর্যায়ের সূত্রদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা তথ্য যাচাই করে নেওয়ারও একটি ভালো মাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়া।

সূত্র খুঁজবেন কোথায়
কিছু ক্ষেত্রে, নিখোঁজ ব্যক্তিরা তাঁদের সোশ্যাল নেটওয়ার্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বা সূত্র রেখে যান। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের মধ্যে তাঁরা শেষ কার সঙ্গে কথা বলেছেন, তা খুঁজে বের করার মাধ্যমে আপনি আপনার কাজ শুরু করতে পারেন, বিশেষভাবে আধুনিক দাসপ্রথা ও মানব পাচারের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে।

আপনি যদি নিখোঁজ ব্যক্তির সেলফোন বা অন্য কোনো মোবাইল ডিভাইস ট্র্যাক করতে পারেন, তাহলে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য পাবেন। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের তথ্য থেকেও বেরিয়ে আসতে পারে যে নিখোঁজ ব্যক্তিটি কোথায় আছেন বা তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছে।

আরও তথ্য পাওয়ার জন্য এবং নতুন সূত্রদের আকৃষ্ট করার জন্য, আপনি প্রাথমিক কিছু তথ্য দিয়েও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু এ-ও মাথায় রাখবেন: এমন প্রতিবেদন বাড়তি ঝুঁকিও তৈরি করবে।
সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ
কখনো কখনো আপনার অনুসন্ধান চলার সময়ই কর্তৃপক্ষ বা অন্য কোনো গ্রুপ একটি মৃতদেহ খুঁজে পেতে পারে। আপনি যে নিখোঁজ ব্যক্তিকে নিয়ে অনুসন্ধান করছেন, মৃতদেহটি তারই কি না, তা যাচাই করে দেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি লাশের গায়ে থাকা জামাকাপড় বা ট্যাটুর বর্ণনা মিলে যায়, বা তার সঙ্গে সঠিক শনাক্তকরণ কাগজপত্র পাওয়া যায়, তারপরও আপনার সেটি ভালোমতো যাচাই করা উচিত। কারণ, দুজন মানুষের মধ্যে একই রকম শারীরিক বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে বা তাদের জামাকাপড় ও শনাক্তকরণ কাগজপত্র বদলে দেওয়া হতে পারে। আদর্শ পদ্ধতি হলো: প্রতিবেদন প্রকাশের আগে আপনি ফরেনসিক ভেরিফিকেশন করিয়ে নেবেন।

অনেক দেশেই, পুলিশ খুব বিশদভাবে তদন্ত করে না এবং তাদের বাজেট, সক্ষমতা বা ইচ্ছার ঘাটতি থাকে। তাদের কাছে প্রায়শই কোনো ডিএনএ ল্যাব বা জটিল মামলা নিয়ে কাজ করার মতো পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ থাকে না। এমন জায়গায় তদন্তের ফলাফল বাইরের কোনো বিশেষজ্ঞকে দিয়ে যাচাই করে নেওয়ার চেষ্টা করুন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বা সরকারি তদন্তকারীদের কাছ থেকে যেসব ফরেনসিক প্রমাণ ও বিশ্লেষণ পাবেন, সেগুলোর ব্যাপারে সংশয়ী থাকুন। এখানে কোনো স্বার্থের সংঘাত বা দুর্নীতির সংযোগ থাকতে পারে, যা হয়তো ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে।
কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ
কিছু ক্ষেত্রে, সাংবাদিকদের সতর্ক থাকতে হবে কর্তৃপক্ষের ব্যাপারেও। মাথায় রাখতে হবে যে, তাদেরও অপরাধীদের সঙ্গে সংযোগ থাকতে পারে। ঘটনা আসলেও এমন কি না, তা জানার সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন এবং অন্য যেকোনো সূত্রের মতো তাদের কথাগুলোও যাচাই করে নিন। তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেও আপনি সহায়ক নথিপত্র পেতে পারেন।

তবে কিছু ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে সহায়ক ভূমিকাতেও দেখা যায়। সেসব ক্ষেত্রে এমন কোনো তথ্য প্রকাশের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন, যার কারণে তাদের অনুসন্ধান বাধাগ্রস্ত হতে পারে বা নিখোঁজ ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যেতে পারে।

মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের নিয়ে কাজ
এ ধরনের অনেক প্রতিবেদনের কেন্দ্রে থাকে স্বজন হারানোর কষ্ট। তাই আপনাকে অবশ্যই সংবেদনশীল হতে হবে। নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবার বা প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলার সময় ভাষার ব্যবহার নিয়ে সতর্ক থাকুন। যদি কোনো পরিবার বিশ্বাস করে, হারানো ব্যক্তিটি এখনো জীবিত, তাহলে তাদের সঙ্গে “অতীতকাল সূচক ভাষায়” তা কথা বলবেন না।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সততা ও স্বচ্ছতা থাকা জরুরি। কথা বলার আগেই পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে দেওয়া উচিত, সাংবাদিক হিসেবে আপনি একই বিষয় নিয়ে অন্য কোনো সোর্স—যেমন অপরাধী চক্রের সদস্য বা এমন কারও সঙ্গে কথা বলেছেন কি না। এতে সেই পরিবারটি বুঝতে পারবে, ভবিষ্যতে কী হতে পারে। তবে যাচাই করা হয়নি, এমন কোনো তথ্য তাদের সঙ্গে শেয়ার করবেন না। তাদের কোনো মিথ্যা আশা দেবেন না।

আগে সংঘবদ্ধ অপরাধের শিকার হয়েছেন, এমন কোনো মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সময় খুবই স্পষ্টভাবে বলুন: আপনি কে এবং কী করছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সেই ব্যক্তির নতুনভাবে ট্রমার শিকার হওয়ার ঝুঁকিও থাকে। এবং সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে, তাঁরা হয়তো ভয় পেয়ে আবার লুকিয়ে যেতে পারেন। সোর্সরা যেন বিপদে না পড়েন, সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন।

সাংবাদিক হিসেবে আপনার সীমাবদ্ধতার কথা খেয়াল রাখুন। এবং রাখতে পারবেন না, এমন কোনো ওয়াদা করবেন না। কীভাবে কোনো ভিকটিমের সাক্ষাৎকার নেবেন, তা আগে থেকেই ভেবে নেওয়াটা জরুরি। কীভাবে এমন ভিকটিম ও সারভাইভারদের সঙ্গে কাজ করতে হয়, তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শ পাবেন ডার্ট সেন্টারের এই টিপশিটে। আরও পড়ুন: ভুক্তভোগী ও বেঁচে ফেরাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ক্ষেত্রে মেক্সিকান সাংবাদিক মার্সেলা তুরাতির পরামর্শ।
নিজের যত্ন
নিখোঁজ খোঁজ করার কাজটা হয়ে উঠতে পারে ক্লান্তিকর, হতাশাজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ। কিছু ক্ষেত্রে, গণকবরে গিয়েও খোঁজাখুঁজি করতে হতে পারে সাংবাদিকদের, দেখতে হতে পারে বীভৎস সব দৃশ্য। অথবা এমন কোনো ভিকটিমের সঙ্গে কাজ করতে হতে পারে, যার ওপর চালানো হয়েছে ভয়াবহ শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন।

এই ঘটনাগুলো প্রচণ্ড মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। আপনি যদি খুব শক্ত মনেরও হন, তবু ট্রমা কাটিয়ে উঠতে বাইরের কারও সহায়তা দরকার হতে পারে। সহকর্মী, বন্ধু ও ভালো থেরাপিস্টের সাপোর্ট নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে, আপনি এমন কাজের জন্য নিজেকে আগেভাগেই তৈরি রাখতে পারেন।

গাইডটি তৈরি করেছেন জিআইজেএন-এর সম্পাদনা সহযোগী হানা কুগানস। তিনি সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। হংকংয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন বন্য প্রাণী পাচারসংক্রান্ত অপরাধ নিয়ে। কাজ করেছেন যুক্তরাজ্যের চ্যানেল ফোর-এর বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্যও। বর্তমানে আছেন লন্ডনে।

এই গাইডে অবদান রাখার জন্য মার্সেলা তুরাতিকে বিশেষ ধন্যবাদ। তুরাতি একজন ফ্রিল্যান্স অনুসন্ধানী সাংবাদিক, যিনি নিখোঁজ মানুষ, বলপূর্বক গুম, অভিবাসীদের গণহত্যা, গণকবর এবং সহিংসতার ঘটনা অনুসন্ধানের জন্য বিখ্যাত।

গাইডটি প্রকাশিত হয়  ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এবং আরও কিছু রিসোর্স যোগ করে ডিসেম্বর ২০২০-এ  হালনাগাদ করা হয়।

জলবায়ু সংকট: অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য আইডিয়া

English

জলবায়ু পরিবর্তন গোটা বিশ্বের জন্যই বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কথা মাথায় রেখেই এই রিসোর্স পেজ তৈরি করেছে জিআইজেএন। এর উদ্দেশ্য হলো, বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নতুন নতুন ধারণা সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরা, যেন তাঁরা বেশি করে রিপোর্ট করতে পারেন।  

এই রিসোর্স পেজে তিনটি ভাগ। 

প্রথম ভাগে, আমরা তুলে ধরেছি গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রবন্ধ। তাতে পাওয়া যাবে, কীভাবে অনুসন্ধান করতে হয়, সম্ভাব্য বিষয় কী হতে পারে এবং রিপোর্ট করতে গেলে কী মাথায় রাখতে হবে।

দ্বিতীয় ভাগে, আমরা জড়ো করেছি কিছু মন্তব্য প্রতিবেদন। এতে প্রাধান্য পেয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সমসাময়িক সাংবাদিকতার সমালোচনা। পরামর্শ রয়েছে, কীভাবে রিপোর্টিং আরও উন্নত করা যাবে।

তৃতীয় ভাগে, পাওয়া যাবে জলবায়ু নিয়ে সাংবাদিকদের জন্য দরকারি তথ্য ও রিসোর্সের লিংক।
প্রথম ভাগ: অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও জলবায়ু পরিবর্তন
জলবায়ু পরিবর্তন: যেভাবে অনুসন্ধান করবেন এই শতাব্দীর সবচেয়ে জরুরি স্টোরি; লিখেছেন আর্থ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক জেমস ফান। এখানে তিনি তুলে ধরেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কত রকমের অনুসন্ধানী রিপোর্ট করা যায়।

এখানে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পরামর্শ:

গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রধান উৎস হিসেবে কয়লা, তেল ও খনিজ গ্যাস উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো হতে পারে আপনার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রধান বিষয়বস্তু।
আরও অনেক ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিয়ে সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। তাদের নিয়ে গভীর ও বিশ্লেষণী প্রতিবেদন করুন।
নজর রাখুন, গোষ্ঠীস্বার্থ কীভাবে প্রভাব ফেলছে বিভিন্ন দেশের সরকারি নীতিমালায়। রিপোর্ট করুন সেই নীতিগুলো নিয়ে। প্রশ্ন তুলুন, “সরকার কি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার চেষ্টা করছে, নাকি পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে?”
“শুধু নিজ দেশে কী ঘটছে, সেদিকে নজর রাখাই যথেষ্ট নয়। খতিয়ে দেখুন, আপনার সরকার অন্য দেশের পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে।”
সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করুন, আইনকানুনের প্রয়োগ ঠিকভাবে হচ্ছে কি না। 
গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন মোকাবিলায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে নজরে রাখুন।
জলবায়ু পরিবর্তনের নিয়ে প্রভাব বিষয়ে আরও বেশি বেশি রিপোর্ট করুন।
অনুসন্ধান করুন  জলবায়ু নিয়ে অ্যাকটিভিস্ট গ্রুপগুলো কী করছে, তাদের লক্ষ্য কী এবং তারা কোথা থেকে টাকা পাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ ও অভিযোজনের ক্ষেত্রে সমাধানের উদ্যোগগুলোকেও অনুসন্ধানের আওতায় আনুন।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ বা অভিযোজনের জন্য সামনে কী কী করা দরকার, তা-ও খতিয়ে দেখুন।

দ্য মিডিয়া আর কমপ্লেসেন্ট হোয়াইল দ্য ওয়ার্ল্ড বার্নস। লেখাটির উপশিরোনাম ছিল: “১.৫ ডিগ্রির পৃথিবীর পক্ষে লড়াই করা সাংবাদিকদের জন্য নতুন একটি গাইড।” ২০১৯ সালে প্রবন্ধটি লিখেন দ্য নেশনের পরিবেশবিষয়ক সাংবাদিক মার্ক হার্টসগার্ড এবং কলাম্বিয়া জার্নালিজম রিভিউর প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক কাইল পোপ। তাঁরা বলেন, “এখন পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যত রিপোর্ট হয়েছে, সেগুলো দেখে মনে হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমই এই ইস্যুর গুরুত্ব পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। ব্রেকবিহীন একটি ট্রেন আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। এর নাম জলবায়ু পরিবর্তন। এটি কোনো আতঙ্ক ছড়ানোর বিষয় নয়; এটি বৈজ্ঞানিক তথ্য।”

তাঁদের পরামর্শ:

পাঠকদের দোষ দেবেন না। আর শিশুদের কথা শুনুন।
জলবায়ু নিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ ডেস্ক গড়ে তুলুন, কিন্তু রিপোর্ট যাতে একঘেয়ে না হয়।
বিজ্ঞান সম্পর্কে জানুন।
কোনো এক পক্ষের কথায় ভজে যাবেন না। 

ক্ষমতাকেন্দ্রিক মনোভাব পরিহার করুন।
দুর্দশাগ্রস্তদের সাহায্য করুন।
সমাধান নিয়ে কথা বলুন।
কারও দিকে আঙুল তুলতে ভয় করবেন না।

২০১৯ সালে শীর্ষ সাংবাদিক, বিজ্ঞানী ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের এক জায়গায় করেছিল কলাম্বিয়া জার্নালিজম রিভিউ ও দ্য নেশন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল “বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির নিচে ধরে রাখার যে লক্ষ্য নিয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাংবাদিকতার একটি গাইড বানানো।” এখানে দেখুন পাঁচ ঘণ্টার সেই টাউন হল মিটিং-এর ভিডিও। লন্ডনভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হুয়ান মেয়রগা টুইটারে, তার স্প্যানিশ অনুবাদও প্রকাশ করেছিলেন। এই সম্মেলন থেকেই শুরু হয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প, যার নাম: কভারিং ক্লাইমেট নাও।

এখানে দেখুন সেই সম্মেলন নিয়ে সিজেআর-এর সারমর্ম। লিখেছেন জন ওসোপ। এই সম্মেলন নিয়ে অন্যদের মতামত ছিল এ রকম:

বলিভিয়ার আম্বিয়েদাল ডে ইনফরমেসিয়ন-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক এদুয়ার্দো ফ্রাঙ্কো বার্টন বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলেন জিআইজেসি১৯-এ। এবং নিজের বক্তব্যের সারমর্ম টেনেছিলেন সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে। দেখুন সেই টিপশিট। 
লিটারারি হাব-এর কোরিন সেগাল লিখেছেন, ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য জার্নালিস্টস হু আর ট্রায়িং টু সেভ ইউ;
ডেপল বিশ্ববিদ্যালয়ে কলেজ অব কমিউনিকেশনের সহযোগী অধ্যাপক জিল হপকে লিখেছেন: এক্সপার্টিজ অব ক্লাইমেট চেঞ্জ কমিউনিকেশন রিসার্চার্স নিডেড ইন #কাভারিংক্লাইমেটনাও;
নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে কমিউনিকেশন, পাবলিক পলিসি অ্যান্ড আরবান অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক এবং এনভায়রনমেন্টাল কমিউনিকেশন জার্নালের প্রধান সম্পাদক ম্যাথিউ সি. নিসবেট লিখেছেন: সায়েন্স, পাবলিকস, পলিটিকস: দ্য ট্রাবল উইথ ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি জার্নালিজম।

দ্য মিডিয়া ইজ ফেইলিং অন ক্লাইমেট চেঞ্জ – হিয়ার ইজ হাও দে ক্যান ডু বেটার অ্যাহেড অব ২০২০; গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এই লেখায় কিছু পরামর্শ দিয়েছেন এমিলি হোল্ডেন: 

সংখ্যায় কম হলেও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভাবে, এমন কনজারভেটিভদের দিকে দৃষ্টি দিন।
নির্বাচনে দাঁড়ানো প্রার্থীরা সামনে না আনলেও আপনারা সামনে আনুন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে আসুন স্থানীয় নিউজ স্টোরি হিসেবে।
সমাধানের দিকে মনোযোগ দিন।
লিখুন বা বলুন খুব সাবধানতার সঙ্গে।

কলাম্বিয়া জার্নালিজম স্কুলের ডক্টোরাল ক্যান্ডিডেট রোসলিন্ড ডোনাল্ড তাঁর দ্য ক্লাইমেট ক্রাইসিস ইজ আ স্টোরি ফর এভরি বিট প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনকে নিউজরুমের প্রতিটি ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তাঁর তালিকায় আছে: স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, রাজনীতি, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিবাসনের সম্পর্ক, জাতীয় নিরাপত্তা, খেলাধুলা, খাদ্য ও কৃষি। লেখাটি ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল কলাম্বিয়া জার্নালিজম রিভিউয়ে। একই বিষয়ে ২০১৯ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া একটি বক্তৃতা নিয়ে লেখা এই প্রবন্ধও দেখতে পারেন: এইট নিউজরুম বিটস ইউ ডিডন্ট নো কভারড ক্লাইমেট চেঞ্জ।

১০টি “বেস্ট প্র্যাকটিসের” তালিকা তৈরি করেছে কভারিং ক্লাইমেট নাও। সহযোগিতামূলক এই প্রকল্পের অংশীদার হিসেবে আছে ৪০০টি সংবাদমাধ্যম। 

১.