বিশ্বজুড়ে ওয়াচডগ সাংবাদিকতাকে শক্তিশালী করতে ডেভিড কাপলানের কৃতিত্ব ভুলবার নয়। গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাকালীন নির্বাহী পরিচালক হিসেবে তিনি ২০১২ সালে শ’ খানেক অনুসারী নিয়ে একটি উদ্যোগ থেকে বেড়ে ওঠা ৯০টি দেশে প্রায় ২৪৪টি সংগঠনের সমন্বয়ে একটি “নেটওয়ার্ক অব নেটওয়ার্ক”-এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
২০০৩ সালে শুরু হওয়া জিআইজেএনের প্রতিষ্ঠাকালীন ৩০টি সদস্য সংস্থার প্রতিনিধিদের একজন কাপলান ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমবারের মত সংস্থাটির পূর্ণকালীন নির্বাহী পরিচালক হন।
ডিসেম্বরে ঘোষিত তাঁর অবসর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে কার্যকর হবে (জিআইজেসি২৩-এর সমাপনী পর্বে)। দ্বিধা বিভক্ত একটি বিশ্বে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ নিয়ে ওয়ান-ইফরা তাঁর ভাবনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল।
ওয়ান-ইফরা: বিশ বছর আগে গণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আপনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় বিনিয়োগের নজির স্থাপন করেছিলেন। আজ সেই বার্তায় যদি কোনো পরিবর্তন আসে, তবে কী সেই পরিবর্তন? আজকের বিশ্ব মঞ্চে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের প্রতি আপনার বিদায়ী বার্তা কী?
ডেভিড কাপলান: ১৫ বছর আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বিকাশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা একটি বিশেষ ক্ষেত্র ছিল। গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল অন্যান্য ক্ষেত্রে: মান বাড়ানো, সংকটে সাড়াদান, স্বাস্থ্য, নির্বাচন, জেন্ডার সম্পর্কিত প্রতিবেদন তৈরি। এগুলো সবই মূল্যবান লক্ষ্য, তবে ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত থেকে যায় জবাবদিহিমূলক সাংবাদিকতা — অনুসন্ধানী প্রতিবেদন — যেখানে অধিক ঝুঁকি, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রভাবও ব্যাপক।
সক্ষমতা তৈরি ও স্বাধীন গণমাধ্যমের ক্ষমতায়নে যে কোনো ধরনের বড় উদ্যোগে অনুসন্ধানী উপাদান যুক্ত করা কতটা জরুরি – ডেটা, কেইস স্টাডি ও প্রকল্পের পর প্রকল্পের মধ্য দিয়ে আমরা তা দেখিয়েছি।
ওয়াচডগ রিপোর্টাররা সামনে থেকে জবাবদিহিতার ঘাটতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার তুলে ধরেন। আর এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা স্বৈরাচার ও দুর্নীতিগ্রস্তদের ক্ষমতার রাশ টানতে কার্যকর ভূমিকা রাখছেন। ক্রমবর্ধমান দাতা গোষ্ঠীর সমর্থনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কমিউনিটির প্রচুর পরিশ্রমের ফলে ওয়াচডগ রিপোর্টিং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে৷ গত এক দশকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় নজর দিয়ে অলাভজনক সংস্থাগুলোতে জিআইজেএনের নিজস্ব সদস্যপদ ৩১টি দেশের ৪৯টি সংগঠন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০টি দেশে ২৪৪টি সংগঠনে।
কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের সাফল্যই আমাদের ভোগায়। এখন আরও অনেক দেশে আমাদের আরও সাংবাদিক রয়েছে, যাঁরা আরও ভালো টুল ও সোর্স কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাসীনদের কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলেন। চ্যালেঞ্জ সামলানোয় অনভ্যস্ত স্বৈরশাসকেরা অনেক সময় বিষয়টি ভালভাবে নেন না আর যার পরিণতি হলো, আমরা প্রায় সর্বত্রই হুমকির মুখে থাকি — এমনকি সেখানেও, যে দেশগুলোতে আমাদের পেশা তুলনামূলক নিরাপদ বলে মনে করি।
তবে আমরা কোথাও যাচ্ছি না – আপনি এই জিনটিকে বোতলে পুরতে পারবেন না। জনস্বার্থ, জবাবদিহিমূলক সাংবাদিকতা করার পদ্ধতি ও চর্চা এখন ডজনখানেক ভাষায় পাওয়া যায়, আর সব বাধা সত্ত্বেও আমাদের মর্যাদা বাড়ছে বৈ কমছে না।
ওয়ান-ইফরা: বৈশ্বিক গণমাধ্যমের জন্য প্রযুক্তিগত আধিপত্য ও আস্থার ঘাটতির এই সংকটকালে, আপনার ছেড়ে যাওয়া সম্পর্কে কী ভাবছেন?
ডি.কে.: প্রযুক্তি একইসঙ্গে আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু ও বন্ধু। আমরা দেখেছি, ডিজিটাল রূপান্তরের কারণে গণমাধ্যমে হাজার হাজার কর্মী চাকরি হারায় এবং ইন-ডেপথ রিপোর্টিংয়ের অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বসে যায়। বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী নজরদারি প্রযুক্তির বিস্তার সোর্স ও আমাদের নিজেদের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ঠেলে দিয়েছে। তবে একই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের অভূতপূর্ব নেটওয়ার্ক গঠন, নিরাপদ যৌথ উদ্যোগ ও প্রচুর ডেটা বিশ্লেষণ – আমাদের ক্ষমতায়িত করেছে। আজকের দিনে, এ সময়ে বেইজিং ও মস্কোতেও কোনো কিছু গোপন রাখা বেশ কঠিন। একটি থাম্ব ড্রাইভে আমরা পুরো ব্যাংকের রেকর্ড ফাঁস করতে পারি, যুদ্ধাপরাধ শনাক্ত করতে স্যাটেলাইট চিত্র ব্যবহার করতে পারি এবং সীমানা পেরিয়ে এমনভাবে কাজ করতে পারি যা বছরখানেক আগেও ছিল অকল্পনীয়।
গণমাধ্যমের প্রতি আস্থার সংকট একটি সমস্যা, তবে আমি মোটেও ভীত নই। এটা ঠিক যে গণমাধ্যম সাক্ষরতার বিকাশ এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য সামাল দেয়ার পথে অনেক বাধা রয়েছে। তবে আমাদের কমিউনিটিকে অনুসন্ধানে মনোযোগ ধরে রাখতে হবে। এক কথায়, পৃথিবীতে পর্যাপ্ত অনুসন্ধানী সাংবাদিক নেই। এটি অনেকটা ত্রুটি শনাক্তে ডাক্তার ছাড়া রোগ নিরাময়ের চেষ্টার মতো।
ওয়ান-ইফরা: গত দুই দশকে গণমাধ্যমে, বিশেষ করে সাংবাদিকদের কাজে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটেছে। নাগরিক সাংবাদিকতার প্রসার বৃদ্ধি এবং ওপেন সোর্স টুলের সব ধরনের অ্যাক্সেসের সঙ্গে কমিউনিটি বড় হয়েছে। এই পরিবেশে মান, নৈতিকতা ও সততার ভিত্তিতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে টিকিয়ে রাখার সেরা উপায় কী?
ডি.কে.: আমরা আমাদের পেশায় গণতন্ত্রের চর্চায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি — বেসরকারি সংস্থার কর্মী, বিশেষজ্ঞ, এমনকি সংক্ষুব্ধ নাগরিকেরাও কিছু দুর্দান্ত অনুসন্ধান করে। তবে আপনার মানদণ্ড ঠিক রাখতে হবে, ন্যায্যতা বজায় রাখতে হবে আর সর্বোপরি যথার্থতার মূল্য দিতে হবে। জরুরি বিষয় হলো, আমরা আমাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি রিপোর্টিংয়ের বিশ্বায়ন করি। সাংবাদিকতার শিক্ষাবিদরা এই অঞ্চলগুলোতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছেন, এবং তাঁরা মূল্যবান অংশীদার হয়েছেন, কারণ আমরা পৃথিবীর আনাচে কানাচে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছড়িয়ে দিয়েছি। আদিবাসী জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে দ্বীপ দেশ পর্যন্ত আমরা এমন সব অঞ্চলে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি যেখানে আমরা আগে কখনও যেতে পারিনি।
আর আমরা ইংরেজির পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষায় রেফারেন্সের সংকলন তৈরির জন্য কঠোর পরিশ্রম করছি। কেবল গত দু’বছরে জিআইজেএন ৩৪টি ভাষায় রিপোর্টিং গাইড ও টিপ শিট অনুবাদ করেছে।
ওয়ান-ইফরা: আপনি অসংখ্য স্টোরির তত্ত্বাবধান করেছেন। কোন স্টোরিটি আপনাকে নাড়া দিয়েছে, এবং কেন?
ডি.কে.: আমি সাংবাদিকতা ভালোবাসি। আমি যখন এমন একটি পেশা সম্পর্কে জানতে পারলাম যেখানে ভ্রমণের পর্যাপ্ত সুযোগ আছে, মানুষের গল্প সংগ্রহ করা যায় এবং অন্যদের পড়ার জন্য লেখা যায়, আমি লেগে গেলাম। আমার কর্মজীবনের অনেকটা সময় অপরাধ নিয়ে লেখালেখি করেছি। কীভাবে কিছু মানুষ এ ধরনের দায়মুক্তি ও অপরাধমূলক আচরণ করতে পারে, আর বাকি জগতের প্রতি কোন দায়বদ্ধতা তাদের মনে কাজ করে না, তা আমাকে বরাবরই অবাক করে। তাদের জবাবদিহি করার একটি অসম্ভব তাড়না কাজ করে।
রাশিয়ার লুটপাট নিয়ে ১৯৯৮ সালে ইউএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টের জন্য করা একটি কভার স্টোরি আমার মনে বিশেষভাবে দাগ কেটেছে। এটিকে বলা হতো ডার্টি ডায়মন্ডস, আর রাশিয়ার ফোর্ট নক্সের নিজেদের কর্মকর্তাদের নিয়মতান্ত্রিক লুটপাট ছিল এই স্টোরির বিষয়বস্তু। সেই স্টোরিতে সবকিছুই ছিল — বড় বড় পুলিশ কর্মকর্তা, ভয়ঙ্কর দুর্বৃত্ত, দুর্দান্ত একটি স্টোরি লাইন, এবং আমরা যে সময়ে বাস করি, তা নিয়ে একটি বিস্তৃত রাজনৈতিক বার্তা। ২০১০ সালে আইসিআইজে পরিচালনাকালে অ্যাসবেস্টস নিয়ে একটি আন্তঃসীমান্ত অনুসন্ধান, ডেঞ্জার্স ইন দ্য ডাম্প হলো আরেকটি স্টোরি। পশ্চিমা দেশগুলোতে অ্যাসবেস্টস ইন্ডাস্ট্রি নিষিদ্ধ হওয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অ্যাসবেস্টসের আবর্জনা ফেলা হচ্ছে, যা থেকে ক্যান্সারের নতুন মহামারি চোখ রাঙাচ্ছে, অথচ তা প্রতিরোধ করা যেত। আমরা সেই প্রকল্প একাধিক ভাষায় অনুবাদ করেছি আর আমি নিশ্চিত যে আমরা কিছু জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রেখেছি।
ওয়ান-ইফরা: অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার আশা, আশঙ্কা ও ভবিষ্যদ্বাণী কী?
ডি.কে.: আমাদের পেশায় হয়রানিমূলক মামলা, রাজনৈতিক চাপ ও ভয় দেখানো, আমাদের শারীরিক নিরাপত্তার প্রতি হুমকি, কারাবাস, ব্যাপক নজরদারি, তহবিলের ঘাটতিসহ অসংখ্য হুমকি সামলাতে হয়। পাকিস্তানের ডন পত্রিকার সম্পাদক জাফর আব্বাস যেমনটি বলেছেন, “তারা আর সাংবাদিকদের হত্যার চেষ্টা করছে না, বরং সাংবাদিকতাকে হত্যার চেষ্টা করছে।”
এটি বলছি ঠিকই, কিন্তু আমি মনে প্রাণে একজন আশাবাদী মানুষ। গত ২০ বছরে আমরা অসাধারণ অগ্রগতি করেছি, আর আমরা পালিয়ে যাচ্ছি না। আমাদের দক্ষতা কাজে লাগাতে নতুন মডেল নিয়ে আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি, আর সাংবাদিকতার মানও এগিয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকায় আমাদের সহকর্মীরা যে ধরনের বিশ্বমানের কাজ করছেন, এক প্রজন্ম আগেও আমরা এমনটি খুব কমই দেখেছি। বিষয়টি উৎসাহজনক। আর এজন্যই আমরা এই অভূতপূর্ব সমর্থন দিয়ে থাকি। স্বাস্থ্যসেবা ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক নীতির মতই ওয়াচডগ সংবাদ মাধ্যমের উন্নতি কতটা জরুরি, উন্নয়ন কমিউনিটি এখন তা বুঝতে পারে। আমাদের কাজে অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনদাতাদের স্থলে গ্রাহক, সদস্য ও দাতারা জায়গা করে নিচ্ছে।
সাধারণ মানুষ যে নিজ জনগোষ্ঠী, নিজ দেশ, নিজ পরিবেশে কী ঘটছে, তা জানতে আগ্রহী, বিষয়টি পরিষ্কার। আর তাদের সহায়তায় প্রয়োজন একটি অনুসন্ধানী গণমাধ্যম।
তাই আমরা মাত্র শুরু করছি।
সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশ করে ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজ পাবলিশার্স (ওয়ান-ইফরা)। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
আরও পড়ুন
২০২৩ সালের গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্স সুইডেনের গোথেনবার্গে
ডেটা জার্নালিস্টস অফার টুলস ফর দ্য ফিউচার
হাও ক্যান উই বিল্ড আ নিউ ফিউচার ফর জার্নালিজম দ্যাট বিলংস টু অল অব আস?
লুসিন্ডা জর্ডান একাধারে সাংবাদিক, সম্পাদক, লেখক, গণমাধ্যম প্রশিক্ষক এবং আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল ভিত্তিক গণমাধ্যম পরামর্শক।