অনেক সাংবাদিকই এখন গুগলে সার্চ করতে গিয়ে শব্দের দু’পাশে উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করেন। কারণ, এভাবেই তাঁরা গবেষণায় যোগসূত্র খুঁজে পেতেন দ্রুত। তবে অনলাইন সার্চ বিশেষজ্ঞ হেঙ্ক ফন এস সতর্ক করে বলেছেন, ইদানিং সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়ার পরও গুগল প্রায়ই তা আমলে নেয় না।
যেমন, “Saint Kitts” “Taylor Swift” লিখে সুনির্দিষ্টভাবে সার্চ করলে ক্যারিবিয়ান দ্বীপটির সঙ্গে এই মার্কিন সঙ্গীত শিল্পীকে যুক্ত করে প্রায় ৪০০,০০০ ফলাফল আসে। কিন্তু বাস্তবতা হল, সর্বসাকুল্যে এমন মাত্র দুটি অনলাইন সংযোগ রয়েছে যার সঙ্গে দ্বীপটি থেকে বিক্রি হওয়া সেলিব্রিটি পণ্যের সম্পর্ক পাওয়া যায়।
সম্প্রতি ১০১টি দেশের ৬৪২ জন সাংবাদিকের অংশগ্রহণে গুগল সার্চ নিয়ে জিআইজেএনের একটি মাস্টারক্লাস ওয়েবিনারে ফন এস বলেন, “সবাইকে খুশি করতে” গিয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গুগলের সার্চ অ্যালগরিদমে পরিবর্তন এসেছে, আর তাই মাঝে মাঝে আপনার সার্চ করা সুনির্দিষ্ট টার্ম উপক্ষো করে বা তার বিকল্প টার্ম হাজির করে, এই অ্যালগরিদম জনপ্রিয় টার্মগুলোর প্রতি একধরনের “পক্ষপাত” দেখায়। ফন এস হলেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ওপেন সোর্স সাংবাদিকতা প্রশিক্ষকদের একজন, আর তিনি হুপোস্টেডহোয়াট? টুলের সহ-নির্মাতা ছিলেন। এই টুল, তারিখ ধরে ফেসবুক পোস্ট সার্চ করতে পারে।
তিনি বলেছেন, গুগল এখন ফলাফলের জন্য “সংকেতের শক্তির” দিকে ঝুঁকছে। তাই, সাংবাদিকেরা যা খুঁজছেন সেটি পেতে হলে, গুগলকে তার ভেতরকার পক্ষপাত থেকে সরে আসতে বাধ্য করতে হবে।
ফন এস আরও বলেন, আগের মতো সার্চকে সংকুচিত না করে সাংবাদিকেরা বরং সার্চে বাড়তি, সুনির্দিষ্ট শব্দ এবং গুগল “ডর্কস” (সার্চ হ্যাকিং ফর্মুলা) ব্যবহারের চেষ্টা করে দেখতে পারেন। এতে ভালো ফলাফলের সংখ্যা বাড়তে পারে৷
তিনি আরও দেখিয়েছেন, গুগল ইমেজে রঙের নাম এবং গুগল অ্যালগরিদম নিজে যে শব্দ ব্যবহার করে, সেসব শব্দ ব্যবহারের মতো কৌশল কাজে লাগিয়ে গবেষকেরা কীভাবে সাগর সেঁচে মুক্তো বের করতে পারেন।
বিভিন্ন পাবলিক প্রেজেন্টেশন ও জিআইজেএনের ওয়েবিনারে সবসময় একটি বিষয়ে জোর দেন ফন এস। আর সেটি হলো অনলাইন সার্চের সময় সাংবাদিকদের ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হবে। তাঁর পরামর্শ: আক্ষরিক ও পারিপার্শ্বিক – দুভাবেই ভাবতে হবে; কিন্তু কোনো ব্যক্তিকে প্রশ্ন করার সময় যেভাবে ভাবেন, সেভাবে নয়।
একটি সহজ উদাহরণ: ধরুন, আপনি একটি মানচিত্র সার্চ করছেন, তাহলে (সার্চে) “map” শব্দটি ব্যবহার না করে, বরং, যে কোনো মানচিত্রে সচরাচর দেখা যায় এমন শব্দ – যেমন “scale” ব্যবহার করুন।
তাঁর প্রিয় কৌশলের একটি হলো “ছেঁটে ফেলা।” এই কৌশলে আপনি যে শব্দগুলো গুগলের ফলাফলে চান না, সার্চের সময় সেই শব্দের (বা শব্দগুচ্ছ) আগে বিয়োগ চিহ্ন দিতে পারেন। ধরুন, আপনি ইউটিউবে একটি ভিডিও পেয়েছেন, কিন্তু আপনি দেখতে চান আর কোথায় এটি পোস্ট করা হয়েছে এবং কোথায় প্রথম পোস্ট করা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে সার্চে ভিডিওর ইউআরএলটি লিখে, তার সঙ্গে এই ফর্মুলা যোগ করতে পারেন: -site:youtube.com। (তাহলে সেটি ইউটিউব বাদ দিয়ে বাকি সব উৎসের ভিডিও দেখাবে।) একইভাবে, অনেক সময় একটি শব্দ দিয়ে সার্চ করলে দেখা যায়, তার সঙ্গে মিল থাকা কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির নাম দিয়ে সার্চ-ফলাফল ভরে গেছে। এমন পরিস্থিতি এড়াতে বিয়োগ চিহ্ন ব্যবহার করে অপ্রয়োজনীয় বিখ্যাত নাম বাদ দিতে পারেন; যেমন -putin।
অনেক রিপোর্টারের কোডিং দক্ষতা নেই এবং তারা ইউআরএল-এ অসংখ্য ক্যারেক্টার দেখে ভয় পান। তিনি এমন ভয় কাটিয়ে ওঠার পরামর্শ দিয়েছেন এবং উল্টো সেটির সুবিধা নিতে উৎসাহ দিয়েছেন। যেমন, তিনি বলেছেন, “হুপোস্টেডহোয়াট?” দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সার্চের ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা ফেসবুকের লম্বা লিঙ্কটি দেখে নিতে পারেন, যা সাধারণত এভাবে শুরু হয়: https://www.facebook.com/search/posts/?… কিন্তু ধরুন, আপনি পোস্ট দেখতে চান না, বরং সেই একই সার্চের ফলাফলে ছবি বা ভিডিও দেখতে চান। তখন সেই লিংকে গিয়ে “posts” শব্দের পরিবর্তে “photos” বা “videos” এর মতো অন্যান্য শব্দ বসিয়ে চেষ্টা করতে পারেন।
ফন এস বলেছেন, কয়েক বছর আগেও গুগলে কি-ওয়ার্ড সার্চই “বেশি করা হতো”, কিন্তু এখন সেই কি-ওয়ার্ডের বদলে প্রায় ক্ষেত্রেই “একই ধরনের তবে বেশি জনপ্রিয়” শব্দ ফলাফলে জায়গা করে নিচ্ছে।
তিনি জানান, তিনি এমনিতে গুগল সার্চের বড় ভক্ত। তবে ওয়েবিনারে অংশগ্রহণকারীদের সামনে সার্চ অ্যালগরিদমের সংকেতজনিত সমস্যা তুলে ধরতে তিনি কয়েকটি সার্চ টার্মের সঙ্গে ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্র সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের নাম ব্যবহার করে দেখান।
সেই ছোট ক্যারিবিয়ান দ্বীপের জ্বালানিতে রুশ নিষেধাজ্ঞার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করে ফন এস দেখিয়েছেন যে সার্চের শুরুতে ও উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে দ্বীপের নাম এভাবে – “Saint Kitts” Putin gas supply – বসানো হলেও সার্চ ফলাফলে দ্বীপটি উপেক্ষিত থাকে। (“Kitts” শব্দ দিয়ে সার্চ করেও ফলাফলের লিংকগুলোতে এর সঙ্গে মিলে এমন কিছুই দেখায় না)। “আপনি যা টাইপ করেছেন গুগল কেন এটিকে আমলে নেয় না?” ফন এস প্রশ্ন করেন। “কারণ এটি সংকেত দেখছে [শব্দ নয়]। এটি যখন দেখে আপনার দেওয়া সংকেতটি দুর্বল, তখন নিজে থেকেই আপনাকে একটি শক্তিশালী সংকেত দেয়ার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে গুগল মনে করছে, সবচেয়ে শক্তিশালী সংকেত হলো ‘gas,’ ‘Putin,’ এবং ‘supply,’ – কিন্তু সেন্ট কিটস? – [না]। সংবাদেও এই দ্বীপ সংশ্লিষ্ট কিছু নেই, আর গুগল আমাদের খুশি করতে চায়।”
গুগল সার্চের কয়েকটি সমাধান
“আজকাল, আপনি যত বেশি কি-ওয়ার্ড ব্যবহার করবেন, তত বেশি ফলাফল পাবেন – যা শুনে অযৌক্তিক মনে হতে পারে,” ফন এস ব্যাখ্যা করে বলেন। “(সার্চের ক্ষেত্রে) আমরা যত সুনির্দিষ্ট হবো, গুগল তারচেয়ে বেশি সুনির্দিষ্ট হবে, আর সাধারণ সার্চের চেয়ে বেশি ফলাফল দেখাবে৷ গুগলে আমরা যত কার্যকর ফর্মুলা টাইপ করব, তত বেশি ফলাফল পাব।”
এই পরামর্শ কীভাবে কাজে লাগাবেন:
- সার্চ অপারেটর ও গুগল ডর্কের শক্তিকে কাজে লাগান। ফন এস দেখিয়েছেন, সার্চে – supreme court new york gun law – এই কম্বিনেশনের শব্দ ব্যবহার করে আপনি যে ফল পাবেন, তার চেয়ে অনেক কার্যকর ফল পাবেন যদি এই সুনির্দিষ্ট টার্ম যোগ করেন, যেমন: supreme court new york gun law filetype:pdf ৷
- একক শব্দের দু’পাশে উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করুন। ফন এস দেখিয়েছেন, একক শব্দের দু’পাশে উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করলে সার্চ ইঞ্জিন কম জনপ্রিয় একক টার্ম এড়াতে পারে না।
- গুগলকে ছোট ছোট অনুচ্ছেদগুলোর মধ্যে যোগসূত্র খুঁজতে বাধ্য করুন। ফন এস একটি শক্তিশালী “কৌশল” ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। ধরুন, আপনি এমন একটি অনুচ্ছেদ খুঁজছেন যেখানে দুটি জিনিসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে, সেই দুটি শব্দের মাঝখানে AROUND (বড় হাতের অক্ষরে) লিখে, তার পাশে একটি সংখ্যা লিখুন। এই সংখ্যাটি হল, কোনো বাক্য বা শিরোনামে শব্দ দুটির মধ্যকার দূরত্ব, অর্থ্যাৎ একটি শব্দ অপরটি থেকে যত শব্দ দূরে আছে সেই সর্বোচ্চ সংখ্যাটি ব্যবহার করুন। এই অ্যারাউন্ড-এর পরে কোনো স্পেস না দিয়ে বন্ধনীতে সংখ্যাটি দিতে হবে৷ একটি শক্তিশালী সার্চ হতে পারে এমন: “grace mugabe” AROUND(7) “dubai” (এখানে আপনি গুগলকে বলছেন, গ্রেস মুগাবে শব্দ দুটির আগে বা পরে ৭টি শব্দের মধ্যে দুবাই শব্দটি থাকলে, তা খুঁজে বের কর)। ফন এস, তাঁর নিজ দেশ নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে ওয়াশিংটন পোস্টের এক অনুসন্ধানী রিপোর্টারের যোগসূত্র বের করতে এই এই উদাহরণটি ব্যবহার করেছিলেন: “Beth Reinhard” AROUND(12) “Netherlands”। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “গুগলকে শোনাতে হবে চিৎকার করে, নয়তো এটি নিজে থেকে ‘অ্যারাউন্ড’ শব্দটি খোঁজা শুরু করবে।”
- একটি নথির মত করে ভাবুন। মানুষ ভাবতে পারে যে, একটি মিশন বিবৃতিতে “মিশন স্টেটমেন্ট” শব্দগুচ্ছ লেখা থাকবে; তবে ফন এসের মতে, সেখানে গুগল হয়তো ”ভাবতে” পারে এধরনের বর্ণনায় সচরাচর কোন শব্দ বেশি থাকে – যেমন, “is to be” এবং “ambition”। তাঁর পরামর্শ? আপনি যে ধরনের নথি খুঁজছেন, আগে তার কয়েকটি নমুনা খুঁজে বের করুন এভাবে, যেমন: mission statement filetype:pdf – তারপর উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে বিভিন্ন শব্দ দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করুন, এবং তার সঙ্গে আপনার কাঙ্খিত প্রতিষ্ঠানও জুড়ে দিন – যেমন: site:amazon.com।
- ফেসবুক গ্রুপ খুঁজে পেতে কি-ওয়ার্ডের সঙ্গে “inurl” ডর্কও বসিয়ে দেখুন। ফন এস এই ফর্মুলাটি দেখিয়েছেন: “SEARCHTERM” inurl:groups site:facebook.com। এভাবে সার্চ করলে সামাজিক মাধ্যম থেকে এমন সব গ্রুপ খুঁজে বের করা যায়, যা এমনিতে পাওয়া কঠিন। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটলে ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারির দাঙ্গায় জড়িত থাকতে পারে, এমন গ্রুপ নিয়ে অনুসন্ধান করতে চাইলে আপনি এভাবে সার্চ করতে পারেন: “stop the steal” inurl:groups site:facebook.com।
- আপনি হয়তো অনেক চেষ্টা করেও গুগল ইমেজ সার্চে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট ছবি খুঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু আপনার যদি জানা থাকে, সেই ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে কী কী রঙ থাকতে পারে, (যেমন, একটি চেইন রেস্তোরাঁর ব্র্যান্ড রঙ) – তাহলে কি-ওয়ার্ডের পরে সেই রঙগুলোর নাম টাইপ করে দেখতে পারেন (যেমন: সবুজ সাদা)। সার্বিয়ার একজন বিশেষ রাজনীতিবিদ সেন্ট কিটসের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দেখা করেছেন কি না – সেই ছবি খুঁজতে গিয়ে দেশটির পতাকার রং এবং দেশটির সাইট এক্সটেনশন ব্যবহার করেছেন ফন এস: Nikola Selaković green red site:kn।
- বিকল্প সার্চ হিসেবে, তিনি এমন শব্দগুচ্ছ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন যা অ্যালগরিদম নিজেই ব্যবহার করে – যেমন “Image may contain: KEYWORD,” অথবা: “May be an image of KEYWORDS” site:facebook.com৷
“আগে অপ্রয়োজনীয় তথ্য এড়ানোর সবচেয়ে ভালো উপায় ছিল উদ্ধৃতি চিহ্নের (বাক্যাংশের শুরুতে ও শেষে) ব্যবহার, কিন্তু এখন আর তা নয়,” বলেন ফন এস৷ “একটি নথির মত করে ভাবুন। কৌশল কাজে লাগান। বিশেষ করে অনুসন্ধানী রিপোর্টারদের জন্য এগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এরইমধ্যে আপনার মনে হচ্ছে যে সেগুলোর মধ্যে এক ধরনের যোগসূত্র আছে।”
আরও পড়ুন
অনলাইনে অনুসন্ধানের জন্য দৃশ্যের মতো করে ভাবা কেন জরুরী
অনলাইনে ভুয়া তথ্য, ভুয়া খবর ও ভুয়া পণ্যের বেচাকেনা যে টুল দিয়ে অনুসন্ধান করেন ক্রেইগ সিলভারম্যান
টিপস ফর মাইনিং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম উইথ হেঙ্ক ভন এস
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএনের প্রতিবেদক। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমস পত্রিকার সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। বিদেশি প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের ২৪টির বেশি দেশে সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন।