সাংবাদিকদের প্রিয় টুল নিয়ে জিআইজেএন-এর চলমান সিরিজের জন্য, এবার আমরা কথা বলেছি লিসেথ বুনের সঙ্গে। ভেনেজুয়েলা-ভিত্তিক এই সাংবাদিক অনলাইন সাইট রানরান ডট ইএস-এর অনুসন্ধানী ইউনিট সমন্বয় করেন। ২০১০ সালে সাংবাদিক ও জনমত সংগঠকদের ওপর সরকারি দমন-পীড়ন বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই সংবাদমাধ্যমের জন্ম হয়। ব্লগ হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও এখন এটি হয়ে উঠেছে দুর্নীতি উন্মোচন ও অনুসন্ধানী কন্টেন্টের একটি জনপ্রিয় সংবাদ ওয়েবসাইট।
বুন জিআইজেএনকে বলেন, “আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী হিসেবে আমি ভেনেজুয়েলার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে থিসিস করেছি। এক দশক ধরে রিপোর্টার হিসেবেও কাজ করেছি। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে আমি সত্যিই কখনো অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরুর কথা ভাবিনি।” সেন্সরশিপ ও সংবাদমাধ্যমের ওপর হয়রানির কারণে তাঁর আগের একটি অনুসন্ধানী দল ভেঙে যায় বলেও জানান বুন। “আমি যে মিডিয়া করপোরেশনে কাজ করতাম, সেটি একটি রহস্যময় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এবং সম্পাদকীয় অবস্থানও চলে যায় ক্ষমতাবানদের সমর্থনে,” বলেন তিনি।
২০০৪ সালে রানরান ডট ইএস-এর হয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন বুন। সেখানে দুই অভিজ্ঞ সাংবাদিক, তামোয়া কাসাডিয়া ও নাতালি আলভারে-র সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয় তাঁর। দুজনকেই শ্রদ্ধা করতেন বুন এবং আগেও তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল সাইটটির অনুসন্ধানী ইউনিট গঠনের জন্য।
রানরান ডট ইএস-এ আসার পর, তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘন, স্বর্ণ পাচার, অবৈধ খনি পরিচালনা, ও পরিবেশগত অপরাধ নিয়ে বেশ কিছু অনুসন্ধান করেছেন। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি রিপোর্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছে। ভেনেজুয়েলার ভেতরে তো বটেই, তার বাইরেও কলম্বিয়ার কনসেহো দে রেদাসিয়ন ও কানেক্টাস এবং পেরুর কনভোকা, ও মোঙ্গাবের মতো মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে জোট বেঁধে কাজ করে তাঁর অনুসন্ধানী দল। অংশ নেয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক প্রকল্পেও। যেমন: পানামা পেপার্স, ফিনসেন ফাইলস, সুইস কানেকশন, লাভা হাতো (অপারেশন কার ওয়াশ), ভিহিলা লা পানদেমিয়া (দেখুন মহামারি), ও তিয়েরা দে রেসিসটেন্সিয়া (প্রতিরোধের দেশ)।
বুনের সমন্বয় করা একটি অনুসন্ধান ২০২০ সালে ভেনেজুয়েলার শীর্ষ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পুরস্কার জিতেছিল। আইপিওয়াইএস ভেনেজুয়েলা এই পুরষ্কার দিয়ে থাকে। “কানাইমা: স্বর্গে স্বর্ণের বিষ”, শীর্ষক এই অনুসন্ধানে উন্মোচন করা হয়: কীভাবে কানাইমা ন্যাশনাল পার্ক থেকে অবৈধভাবে স্বর্ণ উত্তোলন করা হচ্ছে এবং পর্যটকবাহী বিমানে করে সেগুলো ক্যারিবীয় দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ভেনেজুয়েলার তিন অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম— রানরান ডট ইএস, এল পিতাসো ও তালকুয়াল-এর মধ্যে যে জোট [আলিয়ানজা রেবেলদে ইনভেস্টিগা (এআরআই)] আছে, সেটিও পরিচালনা করেন বুন।
এখানে থাকছে বুনের কয়েকটি প্রিয় টুলের কথা:
সিম্যাপ
“সিম্যাপ টুলটি আমি খুঁজে পাই বছর ছয়েক আগে। তারপর থেকে এটি ব্যবহার করে যাচ্ছি। ছবিতে বিভিন্ন নেটওয়ার্ক তুলে ধরা এবং বিভিন্ন ব্যক্তি, কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্কের জট খুলতে (ও উন্মোচন করতে) অনেক সাহায্য করেছে টুলটি। সিম্যাপ খুব সাধারণ, বৈচিত্র্যময় এবং সহজেই ব্যবহার করা যায়। অনেক মানুষের মধ্যে সম্পর্ক শনাক্ত করতে গিয়ে যখন বোঝা যায় না যে কোথা থেকে শুরু করতে হবে, এমন পরিস্থিতিতে আমি এই টুলটি ব্যবহারের পরামর্শ দেব। এটি একটি প্রাথমিক খসড়া বা স্কেচ ডায়াগ্রাম ধরে কাজ শুরু করে।
“টুলটির দুর্বলতা হলো: কোডের মাধ্যমে এটিকে ওয়ার্ডপ্রেসে এমবেড করা যায় না। বিষয়গুলো ভিজ্যুয়ালি আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ডিজাইন বা ইনফোগ্রাফিকসের সাহায্য নিতে হয়।”
নিচের এই অনুসন্ধানগুলোতে লিসেথ টুলটি ব্যবহার করেছেন:
ভেনেজুয়েলার সরকারি নির্মাণ কাজে ওডব্রেখট কেলেঙ্কারির সময় এই ব্যক্তিরা ক্ষমতায় ছিলেন
কম্পট্রোলার জেনারেলের কার্যালয়ে স্বজনপ্রীতি
বাছবিচার ছাড়াই মিলিয়ন ডলারের ঠিকাদারি কাজ দেওয়া হয়েছে ভেনেজুয়েলার এক পরিবারকে
লুসিড
“ফ্লো ডায়াগ্রাম তৈরির জন্য আমি এই টুলটি ব্যবহার করি। এর মাধ্যমে বিভিন্ন করপোরেশন, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির মধ্যকার সম্পর্ক বুঝতে পারা যায় এবং ম্যাপ ভিজ্যুয়ালাইজ করা যায়। এখানে বেশ কিছু টেমপ্লেট ও আকর্ষণীয় গ্রাফিক রিসোর্স আছে, যেগুলোর মাধ্যমে আমি তথ্যকে আলাদা ও শ্রেণিভুক্ত করতে পারি। তবে মাথায় রাখতে হবে: ফ্রি ভার্সনে আপনি সীমিত কিছু অপশন পাবেন। বেশি কাজ করতে চাইলে আপনাকে কিছু টাকা খরচ করতে হবে।
ভেনেজুয়েলার ফিনসেন ফাইলস অনুসন্ধানের সময় এই টুলটি ব্যবহার করেন লিসেথ। দুবাই থেকে ভেনেজুয়েলায় সম্ভাব্য অর্থ পাচার নিয়ে অনুসন্ধানেও তিনি এটি ব্যবহার করেছেন।
কুমু
“কুমু একটি শক্তিশালী টুল, যার মাধ্যমে আমি বড় আকারের ডেটা নিয়ে কাজ করতে পারি; এবং সিস্টেমিক ডায়াগ্রাম ও জটিল ম্যাপ নেটওয়ার্কও তৈরি করতে পারি। এখানে আপনি নিজেই ধাপে ধাপে বড় ডায়াগ্রাম তৈরি করতে পারবেন। সেখানে ক্রমাগত কন্টেন্ট যোগ করতে করতে ডেটাবেজ তৈরি, অথবা আগের কোনো ডেটাবেজ ইমপোর্ট করতে পারবেন। এখানে আপনি ছবি, লোগো, গ্রাফিকস, এমনকি ভিডিও-ও যোগ করার অপশন পাবেন। এই সব কিছুর ফল দাঁড়ায় অত্যন্ত নান্দনিক, এবং সেগুলো কোড দিয়ে ওয়েবপেজে এমবেড করা যায়। এছাড়াও আপনি প্রজেক্টগুলো পাবলিক বা প্রাইভেট অবস্থায় রাখার সুযোগ পাবেন। একইসঙ্গে একা ও দল বেঁধে কাজের সুযোগও আছে। টুলটি ব্যবহার শুরুর আগে অবশ্য কিছু প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে।”
শর্টহ্যান্ড
প্রথম দেখায় হয়তো মনে হবে, এটি সাধারণ কিছু টেমপ্লেট-সংবলিত ডিজাইন প্রোগ্রাম, খুবই সীমাবদ্ধ এবং একঘেঁয়ে। কিন্তু ঘটনা মোটেই এমন নয়। রানরান ডট ইএস ও অ্যালিয়াঞ্জা রেবেল্ডে ইনভেস্টিগায় আমরা অনেক লম্বা সময় ধরে টুলটি ব্যবহার করছি ভিজ্যুয়ালাইজেশন ডিজাইন করার জন্য। পেইড ভার্সনটিতে অনেক বৈচিত্র্যময় ও ইন্টারঅ্যাকটিভ ডিজাইন আছে। যে ব্যাপারটি সত্যিই ভালো লাগে, তা হলো: এখানে আপনি দল বেঁধেও কাজ করতে পারবেন।”
লিসেথ নিচের অনুসন্ধানগুলোতে টুলটি ব্যবহার করেছেন:
ভেনেজুয়েলার কেন্দ্রীয় ব্যাংক: যেখানে সংকুচিত হয় ভেনেজুয়েলার স্বর্ণ
দুর্নীতির সাগরে পেত্রোলেস ভেনেজুয়েলার সাঁতার
ডেটাবেজ
আলেফ: “আমার জন্য এটি প্রায় নিয়ম হয়ে গেছে যে, সাধারণ কয়েকটি গুগল সার্চের পর আমি অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত সম্ভাব্য নামগুলো নিয়ে চলে যাই আলেফ ডেটাবেজে। অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি)-এর বানানো এই সার্চ ইঞ্জিনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিপুল পরিমাণ পাবলিক রেকর্ড আছে।”
অফশোর লিকস: “ওসিসিআরপি-র আলেফের মতো আইসিআইজের অফশোর লিকস ডেটাবেজেও আমি নাম সার্চ করি। এখানে বিভিন্ন করপোরেশন, ব্যাংক, ব্যক্তি ও কোম্পানি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। ডেটাবেজটিতে নতুন তথ্যও যুক্ত হয়। যখনই কনসোর্টিয়াম নতুন কোনো ফাঁস হয়ে যাওয়া নথি হাতে পায়, তখনই ডেটাবেজটির কলেবর বেড়ে যায়। অনুসন্ধানের সময় এই সার্চ ইঞ্জিনে অবশ্যই খোঁজ চালাতে হবে।”
ওপেন করপোরেটস: “সাইটটি নিজেদের বর্ণনা করে করপোরেট জগতের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত ডেটাবেজ হিসেবে। আমারও তাই মনে হয়। আপনি যদি কোনো কোম্পানিকে নিয়ে গবেষণা করেন, এবং এর সঙ্গে কারা জড়িত জানতে চান, তাহলে এই প্ল্যাটফর্মে খোঁজ করাটা জরুরি। এখানে বিভিন্ন দেশে নিবন্ধিত হওয়া কোম্পানি, এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মানুষ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।”
ইমপোর্ট জিনিয়াস: “এটি বৈশ্বিক বাণিজ্যের একটি ডেটাবেজ, যেখানে আমদানি-রপ্তানির রেকর্ড ছাড়াও পণ্যের ওজন ও চালানের ডলার-মূল্য সহ অনেকরকম তথ্য পাওয়া যায়। আরও থাকে কোম্পানির নাম, উৎস দেশ, পণ্যের ধরন এবং কর সংক্রান্ত তথ্য। কিন্তু এসব উন্মুক্ত ডেটা পেতে হলে আপনাকে একটি সাবস্ক্রিপশন ফি দিতে হবে।
আকাশ ও সমুদ্রপথে অনুসন্ধান
অনুসন্ধানের কাজে আকাশ ও সমুদ্রপথে নজর রাখার জন্য দুটি উপকারী টুল: মেরিন ট্রাফিক ও ফ্লাইটরাডার২৪। এখানে আপনি বিমান ও তেলবাহী ট্যাংকারের মডেল, শ্রেণিবিভাগ ও রেকর্ড দেখতে পারবেন।
লিসেথ ও তাঁর দল এই ধরনের টুল ব্যবহার করেছেন নিচের অনুসন্ধানগুলোতে:
২০১৮ সালে ভেনেজুয়েলা থেকে দুবাই ও তুরস্কের উদ্দেশে ৩৩টি বিমান ছেড়ে গেছে ৭৩ টন স্বর্ণ নিয়ে
কিউবার কথা বলে ভেনেজুয়েলার তেলবাহী জাহাজের করস্বর্গে যাত্রা
আলাপচারিতার শেষ দিকে, বুন কথা বলেন তাঁর দেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে: “সাধারণভাবে সাংবাদিকতাকে যেসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হয়, ভেনেজুয়েলার অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে মহামারি ও ভেনেজুয়েলায় চলমান সংকটের প্রেক্ষাপটে বিষয়গুলো আরও গুরুতর হয়ে উঠেছে। অবশ্য সেন্সরশিপ, উন্মুক্ত তথ্যের ঘাটতি, মেধাবী সাংবাদিকদের দেশত্যাগ এবং নানা রকম দমনপীড়নের পরও সাংবাদিকসুলভ অনুসন্ধানের বিকাশ থামানো যায়নি; বরং উল্টোটিই দেখা গেছে।”
তিনি বলেন, “প্রযুক্তি ও সহযোগিতার এই যুগে, আমরা ক্রমাগত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যম ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জোট বেঁধে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি। একসঙ্গে কাজ করতে পারায় অনুসন্ধানের ফলাফলগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও কোনো সীমানার বাধা থাকছে না।”
আরও পড়ুন
জিআইজেএন রিসোর্স: ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন টুলস
হোয়াই ডায়নামিক ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন ইজ কি টু কভারিং ক্লাইমেট চেঞ্জ
হোয়াই জার্নালিস্টস নিড টু থিংক লাইক ডিজাইনারস
গ্রাফিক্স না জেনেও কীভাবে বানাবেন ইনফোগ্রাফ? এই যে ৫টি টুল!
আন্দ্রেয়া আরজাবা একজন সাংবাদিক ও জিআইজেএন স্প্যানিশ ভাষার সম্পাদক। রিপোর্টার ও গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে, আন্দ্রেয়া নিবেদিতভাবে কাজ করছেন লাতিন আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত লাতিন কমিউনিটির জীবনযাত্রা নিয়ে। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ওমেনস মিডিয়া ফাউন্ডেশনের ফেলো। কাজ করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ইয়ং জার্নালিস্টস প্রোগ্রামের অংশ হিসেবেও।