ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির জন্য যাঁরা ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, তাঁদের কর্মকাণ্ড উন্মোচন করা একটি বিপজ্জনক কাজ। সিপিজের হিসাবে, ১৯৯২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন দুর্নীতি কাভার করতে গিয়ে। এটি তাঁদের প্রধান, অথবা অন্যতম বিট ছিল।
চলতি মাসে পেগাসাস প্রজেক্ট প্রকাশের মধ্য দিয়ে এই ঝুঁকির বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। ১৭টি বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমের সহযোগিতামূলক এই রিপোর্টিং প্রকল্পের মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছে ফাঁস হয়ে যাওয়া হাজারো ফোন নম্বরের একটি তালিকা, যেগুলো ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের বিভিন্ন সরকারি গ্রাহকেরা নির্বাচন করেছিল সম্ভাব্য নজরদারির জন্য। এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত গ্রুপগুলো থেকে জানা গেছে: নজরদারির সম্ভাব্য লক্ষ্যের মধ্যে ছিলেন অন্তত ১৮০ জন সাংবাদিক।
সিপিজের কাছে পাঠানো এক বিবৃতিতে, এই তালিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেছে এনএসও গ্রুপ। তারা বলেছে, শুধু সতর্ক সরকারি গ্রাহকেরাই তাদের কাছ থেকে পেগাসাস স্পাইওয়্যার কিনতে পারে। তা-ও অপরাধ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্য।
ফাঁস হওয়া ফোন নম্বরের তালিকা বিশ্লেষণে যেসব গণমাধ্যম জড়িত ছিল, সেগুলোর একটি অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি)। গত ২৯ জুলাই তাদের ওয়েবসাইটে এমন ১২২ জন সাংবাদিকের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়।
ওসিসিআরপির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রকাশক ড্রিউ সুলিভান সম্প্রতি এক ভিডিও কলে সিপিজেকে বলেছেন, এই সাংবাদিকদের সবাই-ই যে দুর্নীতি নিয়ে কাজ করেন, তা নয়। তবে ওসিসিআরপির সঙ্গে দুর্নীতিবিষয়ক রিপোর্টিং করা বেশ কিছু সহযোগীর নাম এই তালিকায় পাওয়া গেছে। যেমন, আজারবাইজানের স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, মেয়দান টিভি এবং হাঙ্গেরির অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম, ডিরেক্ট৩৬-এ কাজ করা সাংবাদিক।
সুলিভান বলেছেন, “যারা প্রশাসনের (যেগুলো প্রায়ই স্বৈরতান্ত্রিক ধরনের হয়ে থাকে) নানা সমস্যার দিকে নজর দিয়েছে, তাদেরকে অনেক দেশে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কারণ, তারা সরকারকে জবাবদিহির অধীনে আনার চেষ্টা করেছিল।”
দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা এমন অন্তত চারজন রিপোর্টারের দিকে বেশ কয়েক বছর ধরে নজর রেখেছিল সিপিজে। সম্ভাব্য স্পাইওয়্যার ভিকটিম হিসেবে পেগাসাস প্রজেক্টে নাম এসেছে মেক্সিকো, মরক্কো, আজারবাইজান ও ভারতের এই চার সাংবাদিকের। এই অন্তর্ভুক্তি তাঁদের ওপর দমন-পীড়নের গল্পগুলোতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে: বিভিন্ন দেশের সরকার ক্রমাগত এমন সব বিতর্কিত প্রযুক্তিতে আগ্রহী হচ্ছে, যেগুলো দুর্নীতিবিষয়ক সাংবাদিকতা বন্ধ করার টুল হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে।
পেগাসাস প্রজেক্ট কীভাবে এই চার সাংবাদিকের ঘটনায় নতুন আলো ফেলেছে, তা রইল নিচে:
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সেসিলিও পিনেদা বির্তো মেক্সিকোতে খুন হয়েছেন
আমরা যা জানি: নিজের একটি ফেসবুক পেজে অপরাধ ও দুর্নীতি নিয়ে ক্রমাগত লেখালেখি করায় মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন এবং প্রাণঘাতী হামলার শিকার হয়েছেন পিনেদা। শেষ পর্যন্ত, ২০১৭ সালে স্থানীয় একটি কার ওয়াশে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে বছর মেক্সিকোতে রিপোর্টিংয়ের জন্য এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ছয়জন সাংবাদিক।
নতুন তথ্য: মৃত্যুর এক মাস আগে পিনেদার ফোন নম্বর নির্বাচন করা হয়েছিল সম্ভাব্য নজরদারির জন্য। গার্ডিয়ানের রিপোর্ট থেকে জানা যায়: সাংবাদিকদের একটি কেন্দ্রীয় সুরক্ষাসংক্রান্ত আলাপের সময় পিনেদা বলেছিলেন, তিনি ঝুঁকি-হুমকি এড়াতে পারবেন; কারণ, সম্ভাব্য আততায়ীরা তাঁর অবস্থান কখনোই জানবে না।
সরকারের প্রতিক্রিয়া: মেক্সিকান কর্মকর্তারা এই মাসে জানিয়েছেন, ২০০৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে, আগের দুই প্রশাসন নজরদারির প্রযুক্তিতে ব্যয় করেছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। যার মধ্যে এনএসও গ্রুপের সঙ্গে কিছু চুক্তিও আছে বলে জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে স্পাইওয়্যার প্রয়োগ প্রসঙ্গে জানতে চেয়ে প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস মানুয়েল লোপেজ ওবরাদর-এর মুখপাত্র হেসুস রামিরেজ কুয়েভাস এবং মেক্সিকোর কেন্দ্রীয় প্রসিকিউটর অফিসের সোশ্যাল কমিউনিকেশন ডিরেক্টর রাউল তোভারের কাছে ইমেইল করেছিল সিপিজে। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
লে ডেস্ক রিপোর্টার ওমর রাদি, মরক্কোতে কারাবন্দি
আমরা যা জানি: ১৯ জুলাই, ২০২১ তারিখে—যখন পেগাসাস প্রজেক্টের প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হচ্ছে—তখন মরক্কোর একটি আদালতে ছয় বছরের কারাদণ্ডের সাজা শোনানো হচ্ছিল রাদি নামের এক সাংবাদিককে। অনেকেই মনে করেন, রায়টি ছিল প্রতিহিংসামূলক। এক বছর আগেও একবার কারাগারে পাঠানো হয়েছিল রাদিকে, এবং সম্ভবত অবৈধ ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে তাঁর অনুসন্ধান ঠেকাতে। একই রকম পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন মরক্কোর দুই সাংবাদিক তৌফিক বুয়াশরিন ও সোলায়মান রাইসুনি। তাঁরা যথাক্রমে ১৫ ও ৫ বছর কারাদণ্ডের সাজা ভোগ করছেন। রাদির বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল যৌন অপরাধের অভিযোগ। দেশটির অনেক সাংবাদিক সিপিজেকে বলেছেন, এগুলো আসলে তাঁর প্রতি জনসমর্থন কমানোর কৌশল।
নতুন তথ্য: ২০১৯ ও ২০২০ সালে রাদির ফোনে ফরেনসিক বিশ্লেষণ চালিয়ে সেখানে পেগাসাস স্পাইওয়্যার শনাক্ত করেছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ফরবিডেন স্টোরিজের প্রতিবেদন সূত্রে এখন আমরা জানি যে, বুয়াশরিন ও রাইসুনির ফোনও নির্বাচন করা হয়েছিল স্পাইওয়্যারের সম্ভাব্য লক্ষ্য হিসেবে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া: রয়টার্স জানিয়েছে, মরক্কোর সরকার এক আইনজীবীকে নির্দেশ দিয়েছে পেগাসাস প্রজেক্টের সঙ্গে জড়িত গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে ফ্রান্সের আদালতে মানহানির মামলা করার জন্য। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চেয়ে গত জুলাইয়ে মরক্কোর আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ে ইমেইল করেছিল সিপিজে; কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। স্পাইওয়্যার প্রসঙ্গে মন্তব্য চেয়ে এর আগেও মরক্কোর তথ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল সিপিজে। কিন্তু সেগুলোও সফল হয়নি।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক খাদিজা ইসমাইলোভা, আজারবাইজানে কারাবন্দি ছিলেন
আমরা যা জানি: ইসমাইলোভা, আজারবাইজানের একজন গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানী সাংবাদিক। সরকারের উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতি এবং সেগুলোর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের পরিবার ও ব্যবসার সম্পর্ক নিয়ে তিনি অনেক তথ্য উন্মোচন করেছেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সাজানো কিছু মামলার ভিত্তিতে তাঁকে সাড়ে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ৫৩৮ দিন কারাভোগের পর অবশেষে মুক্তি পান ইসমাইলোভা।
নতুন তথ্য: ইসমাইলোভার ফোন নম্বর পেগাসাস প্রজেক্টের তালিকায় শনাক্তের পর সেটির একটি ফরেনসিক বিশ্লেষণ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এবং সেখানে তারা ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বেশ কয়েকবার পেগাসাস স্পাইওয়্যারের অস্তিত্ব পেয়েছে। ইসমাইলোভা এরপর পেগাসাস প্রজেক্টের তালিকায় থাকা অন্য আজারবাইজানি ফোন নম্বরগুলোও খতিয়ে দেখতে শুরু করেন। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি নম্বর তাঁর ভাগ্নে, এক বন্ধু ও ট্যাক্সিচালকের বলে জানিয়েছে ওসিসিআরপি।
সরকারের প্রতিক্রিয়া: গত ২৮ জুলাই, আজারবাইজানের সিকিউরিটি সার্ভিসের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিল সিপিজে। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। গত সপ্তাহে, মেয়দান টিভির সাংবাদিক সেভিঞ্জ ভাগিফজিলজির বিরুদ্ধে নজরদারির অভিযোগ সম্পর্কেও মন্তব্য জানতে চেয়েছিল সিপিজে। কিন্তু সেটিরও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির সাংবাদিক পরাঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা, ভারতে আইনি হয়রানির শিকার
আমরা যা জানি: সাংবাদিক ও লেখক পরাঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা এবং একাডেমিক জার্নাল ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে কাজ করা তাঁর আরও তিন সহকর্মীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মানহানি মামলা চলছে ২০১৭ সাল থেকে। সম্প্রতি করোনা মহামারির মধ্যে দেশের আরেক প্রান্তে গিয়ে শুনানিতে হাজির না থাকায় তাঁকে গ্রেপ্তারের হুমকিও দেওয়া হয়েছে। আদানি গ্রুপ কীভাবে সরকারি নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এই মামলা করেছে আদানি গ্রুপ। এটি ছাড়াও গুহ ঠাকুরতার বিরুদ্ধে আরও বেশ কিছু আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সিপিজের কাছে যেটিকে তিনি বর্ণনা করেছেন সাংবাদিকদের ভয়ভীতি দেখানো ও হেনস্তা করার কৌশল হিসেবে।
নতুন তথ্য: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ফরেনসিক বিশ্লেষণে গুহ ঠাকুরতার ফোনে পেগাসাস স্পাইওয়্যারের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে ২০১৮ সালের শুরু থেকে। মুম্বাইয়ের দৈনিক, দ্য ফ্রি প্রেস জার্নাল-এ প্রকাশিত একটি ব্যক্তিগত ভাষ্যে গুহ ঠাকুরতা বলেছেন, সে সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও সরকারি দল ভারতীয় জনতা পার্টির সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনৈতিক প্রচার বিষয়ে লেখালেখি করছিলেন। এবং ভারতীয় একজন ধনী ব্যবসায়ীর বিদেশি সম্পত্তি নিয়েও অনুসন্ধান করছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না, কেন তাঁর ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া: ভারতের জাতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু সূত্রে জানা যায়, তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব, পেগাসাস-সংক্রান্ত এসব উন্মোচনকে বলেছেন “ভারতীয় গণতন্ত্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা,” এবং ভারতে কোনোভাবেই অবৈধ নজরদারি সম্ভব নয়। প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে বৈষ্ণবের দপ্তরের ঠিকানায় ইমেইল পাঠিয়ে কোনো সাড়া পায়নি সিপিজে। তবে সাবেক এক সরকারি কর্মকর্তা সিপিজে-কে বলেছেন, ভারতে পেগাসাস স্পাইওয়্যার “আছে এবং ব্যবহার করা হয়”, এবং ২০২০ সালে স্পাইওয়্যারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ঘটনা অনুসন্ধানের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। সিপিজে এ বছরের জানুয়ারিতে এই বক্তব্যের সতত্য নিশ্চিত করার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা কারও বক্তব্য পায়নি।
ম্যাডেলিন আর্প-এর এই লেখা আদিতে প্রকাশিত হয়েছিল কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস-এর ওয়েবসাইটে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
পেগাসাস প্রজেক্টে সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছে জিআইজেএন-এর সদস্য সংগঠন ফরবিডেন স্টোরিজ। এটি একটি ফ্রান্স-ভিত্তিক অলাভজনক সংগঠন।
আরও পড়ুন
টিপস টু আনকভার দ্য স্পাই টেক ইওর গভর্নমেন্ট বাই
হাও জার্নালিস্টস ক্যান ডিটেক্ট ইলেকট্রনিক সার্ভেলেন্স
মেক্সিকো ওয়েজ সাইবার ওয়ারফেয়ার এগেইন্সট জার্নালিস্টস
জিআইজেএন’স গাইড টু পার্টনারশিপ অ্যান্ড কোলাবোরেশন
ম্যাডেলিন আর্প, সিপিজে-র প্রযুক্তি বিষয়ক পরামর্শক সম্পাদক। ফ্রিডম হাউজের ফ্রিডম অন দ্য নেট প্রতিবেদনের ডিজিটাল নিরাপত্তা ও অধিকার অংশ তিনি সম্পাদনা করেছেন পাঁচটি সংস্করণে। এর আগে কাজ করেছেন সিপিজে-র এশিয়া বিষয়ক গবেষক হিসেবে।