এ বছরের এপ্রিল-মে মাসের দিকে, ভারতের জনবহুল প্রদেশ গুজরাটে, সরকারের পক্ষ থেকে যে কোভিড মৃত্যু ও শনাক্তের সংখ্যা বলা হচ্ছিল, তা সন্দেহজনকভাবে কম ছিল। কখনো কখনো বড় কোনো শহরে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র এক অঙ্কের ঘরেও দেখা গেছে, যদিও স্থানীয় হাসপাতাল ও শ্মশানগুলোতে স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। বেশির ভাগ রিপোর্টারের মতো যোগেন যোশীও জানতেন, সরকারি কর্তৃপক্ষের এই ডেটায় আস্থা রাখা যায় না। যোশী, বারোদা শহরের একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। তিনি কাজ করেন গুজরাটি সংবাদপত্র গুজরাট সমাচারে।
যোশী ভাবছিলেন, সত্যিকারের মৃত্যু সংখ্যা নিয়ে অনুসন্ধান করবেন কী করে? তাঁর অফিস থেকে মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বেই ছিল নর্মদা নদীর পাড়। পবিত্র এই স্থানটিকে স্থানীয় হিন্দুধর্মাবলম্বীরা ব্যবহার করেন তাঁদের প্রিয়জনদের অস্থি বিসর্জনের জন্য। “হুট করে মনে হলো, ওখানে কী হচ্ছে—গিয়ে দেখি না কেন” বলেন যোশী। মে মাসের ১৮ তারিখে তিনি চলে যান চানোদ গ্রামের একটি নদীর ঘাটে। সেখানে মানুষের যাতায়াত ও চলাফেরা দেখেই তিনি উপলব্ধি করতে পারেন, গুজরাটে কী ট্র্যাজেডি ঘটে চলেছে। পুরোহিত, মাঝি, ঘাটের রক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পারেন, মৃত্যুর ঘটনা দিন দিন বেড়েছে।
২২ মে, যোশীর সংবাদপত্রে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যায়: ১৫ মার্চ থেকে ১৮ মে সময়ের মধ্যে নদীর সেই জায়গায় ৩২ হাজারের বেশি অস্থি বিসর্জনের (হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার রীতি) ঘটনা ঘটেছে। এর অর্থ, দিনে গড়ে অন্তত ৪৯২ মৃত্যু। মহামারির আগে সংখ্যাটি ছিল ১৫০। এদিকে ১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত, গোটা রাজ্যের জন্য সরকারিভাবে মৃতের সংখ্যা জানানো হয়েছিল মাত্র ৪২১৮। দিনে গড়ে মাত্র ৫৯ জন। যোশী বলেন, “আমি সবাইকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব সম্পর্কে জানাতে চেয়েছিলাম। এবং সরকারি সংখ্যা-পরিসংখ্যান পুরোপুরিই ভিন্ন ধরনের ছিল।”
সরকার অস্বীকার করলেও, ভারতজুড়ে স্থানীয় ও আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টাররা কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মৃত্যু ও বিধ্বস্ততার চিত্র তুলে আনার জন্য নানা পদ্ধতি বের করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজ রাজ্য গুজরাটের সংবাদমাধ্যম বিশেষভাবে তৎপর ছিল সত্যিকারের মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা গণনাতে। সাংবাদিকেরা হাসপাতাল, মর্গ, শ্মশান ইত্যাদি নানা জায়গা থেকে তথ্য নিয়ে সৃজনশীলভাবে বলার চেষ্টা করেছেন: কীভাবে রাজ্য সরকার কোভিডের ভয়াবহতাকে হালকাভাবে নিয়েছে। সত্যিকারের চিত্র তুলে ধরে লেখা প্রতিবেদনগুলো প্রধানত আঞ্চলিক পর্যায়ের পাঠকদের জন্য তৈরি করা হলেও, সেগুলো দেশজুড়েই ভাবনার তরঙ্গ তুলেছে। রাজ্যের সীমানা পেরিয়েও এগুলো আরও অনেক পাঠক পেয়েছেন।
সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ
হাসপাতালের বাইরে রোগীরা অক্সিজেন মাস্ক মুখে অপেক্ষা করছেন, মৃত্যুর পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য মরিয়া হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন মৃত মানুষের স্বজনেরা—ভারতে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এমন চিত্র গোটা বিশ্বে সম্প্রচারিত হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারিতে ভারতে ৩ লাখ ৯৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পর ভারতেই শনাক্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি করোনায় আক্রান্ত রোগী। এবং দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়, মে মাসের শুরুর দিকে ভারত গড়েছে দৈনিক শনাক্তের নতুন রেকর্ড।
কোভিডে মৃতদের মধ্যে অনেক সাংবাদিকও আছেন। এনডব্লিউএমআই ইন্ডিয়ার একটি হিসাব অনুযায়ী, ভারতে এখন পর্যন্ত ৫০০ সাংবাদিক মারা গেছেন। গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েই কাজ করছেন দেশটির সাংবাদিকেরা। একই সঙ্গে আছে সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণ ও হুমকির পরিবেশ। এটি আবার আসছে নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের কাছ থেকে।
রিপোর্টার্স উইদাউদ বর্ডারসের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৪২। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদি পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে “মিডিয়ার ওপর চাপ বেড়েছে। তাদের বাধ্য করা হচ্ছে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের মতো করে পরিচালিত হতে”।
স্বাধীন থিঙ্কট্যাংক রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর ভারতের প্রথম ও দুই মাসব্যাপী লকডাউনের সময় অন্তত ৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আরেকটি হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৬৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যেটি গত দশকের অন্য যেকোনো বছরের চেয়ে দ্বিগুণ।
“বর্তমান এই সরকারের আমলে যে সংবাদমাধ্যমই রাষ্ট্রের দুরবস্থার কথা তুলে ধরে, তাকেই দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দেওয়া হয়,” বলেছেন কল্পনা শর্মা। তিনি ভারতের গণমাধ্যম বিশ্লেষণ সাইট, নিউজলন্ড্রির জন্য কলাম লেখেন “ব্রোকেন নিউজ” শিরোনামে।
তবে সমালোচনামূলক বক্তব্য বা কাভারেজ নিয়ে সরকারের শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব থাকলেও দেশজুড়েই সাংবাদিকেরা প্রতিরোধ করছেন। রাজ্যগুলো যখন কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সত্যিকারের সংখ্যা জানাতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন রিপোর্টাররাই সত্যিকারের মৃত্যু সংখ্যা খুঁজে দেখার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই সাংবাদিকদের অনেকেই কাজ করেন ছোট, আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমে।
শর্মা ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “হাতে অনেক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ বড় সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেল (অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) সে ধরনের রিপোর্টিং করে না, যেমনটি আমরা দেখতে পাই কিছু আঞ্চলিক বা ছোট ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক রিপোর্টিং অবশ্যই জুতার তলা ক্ষয় করেই করতে হবে। মাঠপর্যায় থেকে রিপোর্টিং করার কোনো বিকল্প নেই।”
মৃতদেহ গণনা ও সত্যকথন
মহামারির মধ্যে সাংবাদিকেরা অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও কাজ চালিয়ে গেছেন এবং সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। নির্ভুল সরকারি ডেটা না থাকা সত্ত্বেও তাঁরা গল্প বলার বিভিন্ন পদ্ধতি বের করেছেন। সরকারি কর্তৃপক্ষের ডেটায় যেসব গরমিল ছিল, তা তুলে ধরার জন্য সাংবাদিকেরা মৃতদেহের সংখ্যা গুনেছেন, শ্মশানঘাটে শেষকৃত্যের দিকে নজর রেখেছেন।
গুজরাটের সবচেয়ে বড় শহর আহমেদাবাদে, স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা সন্দেশের একদল সাংবাদিক দেখতে চেয়েছিলেন: সেখানকার শ্মশানগুলোতে কোভিড-১৯ প্রটোকল মেনে কত মৃতদেহ পোড়ানো হচ্ছে । এ জন্য তাঁরা এপ্রিলের এক রাতে ২১টি শ্মশানে ঘুরে দেখেছেন। সরকারি হিসাবে সেদিন মৃত্যু ছিল মাত্র ২৫। কিন্তু এই সাংবাদিকেরা শুধু হিন্দুদের জন্য নির্ধারিত শ্মশানগুলোতেই পেয়েছেন দুই শর বেশি মৃতদেহ। একই পত্রিকার আরেক দল সাংবাদিক মৃতদেহের সংখ্যা গোনার জন্য ১৭ ঘণ্টা কাটিয়েছেন একটি সরকারি কোভিড-১৯ হাসপাতালের বাইরে। ১৩ এপ্রিল, পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়, শুধু সেই একটি হাসপাতালেই রিপোর্টাররা ৬৪টি মৃতদেহ গুনেছেন। আহমেদাবাদের জন্য সেদিনের সরকারি সংখ্যা ছিল: ২০।
ভারতের অন্যতম বড় হিন্দি ভাষার দৈনিক, দৈনিক ভাস্করের জাতীয় পাতার সম্পাদক ওম গৌর যখন শুনলেন যে, পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে গঙ্গা নদীর পাড় ধরে মৃতদেহ ভেসে উঠছে, তখনই তিনি কাজে নেমে পড়ার উদ্যোগ নেন। গৌর, ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য, উত্তর প্রদেশের ২৭টি জেলাজুড়ে ৩০ জন সাংবাদিকের একটি দল তৈরি করেন। ১৪ মে, তাদের পত্রিকার শিরোনাম ছিল: “গঙ্গার লজ্জা”। প্রতিবেদনে দেখানো হয়: কীভাবে ১,১৪০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রিপোর্টাররা খুঁজে পেয়েছেন দুই হাজারের বেশি মৃতদেহ। “মাঠপর্যায়ের সেই রিপোর্টিং থেকে ভয়াবহ এক চিত্র বেরিয়ে আসে। সেখানে পদে পদে ছড়ানো ছিল মৃতদেহ,” বলেন গৌর।
তিনি আরও বলেছেন, “৩৫ বছরের সাংবাদিকতার জীবনে আমি এ রকম কিছু কখনো দেখিনি।” পত্রিকাটিতে এসব খুঁজে পাওয়া বিষয় বিস্তারিত তুলে আনা হয়েছিল এবং পাঠক-দর্শকদের জন্য সেখানকার ছবি-ভিডিও দেওয়া হয়েছিল।
১৮ এপ্রিল উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদ জেলার কর্তৃপক্ষ সেদিনের কোভিড মৃত্যুর সংখ্যা দেখিয়েছিল মাত্র এক অঙ্কে। কিন্তু সেখানকার এক শ্মশানের বাইরে জ্বলতে থাকা চিতার সামনে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক লোকেশ রায় তুলে ধরেছিলেন সত্যিকারের চিত্র। হিন্দি টেলিভিশন চ্যানেল ভারত সমাচারের সম্প্রচারে তিনি বলেন, “সরকারি কর্তৃপক্ষের দেওয়া পরিসংখ্যান আর বাস্তবতায় যে অনেক ফারাক আছে, তার প্রমাণ এই জ্বলন্ত চিতাগুলো। এই মৃত্যুগুলো হয়তো কখনোই গোনায় ধরা হবে না।” রাই এরপর আরও বিস্তারিত তুলে ধরেছেন সরকারি তথ্যের গরমিল। তাঁর রিপোর্টে উঠে এসেছে: আগের দুই দিন সরকারের পক্ষ থেকে মাত্র দুটি কোভিড মৃত্যুর কথা বলা হলেও শুধু তাঁর রিপোর্টিংয়ের জায়গাটিতেই প্রতিদিন ৩৫ থেকে ৪০টি মৃতদেহ আনা হয়েছে। যেগুলোর অর্ধেকই ছিল কোভিডে মৃত্যু।
স্থানীয় মানুষেরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করায় এবং অনেক ছবি-ভিডিও পাঠানোয় সেটি যাচাই করার জন্য রাই ও তাঁর এক সহকর্মী সেখানে গিয়েছিলেন। রাই বলেছেন, “সরকার যদি তাদের ডেটার ব্যাপারে স্বচ্ছ থাকত, তাহলে আমাদের এভাবে ঝুঁকি নিয়ে সেখানে যেতে হতো না।”
এপ্রিলে শনাক্তের হার বাড়তে থাকলেও ভারতের বেশির ভাগ রাজ্যে সাংবাদিকদের সম্মুখসারির কর্মী হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। ৪৫ বছর না হলে তাঁরা টিকাও পাবেন না। ফলে এটি রিপোর্টারদের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি করেছে যে, আগে স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন নাকি পেশা-চাকরি। বাড়িতে ভাইরাস নিয়ে ফেরার ঝুঁকি সম্পর্কে উদ্বেগে থাকা এক সাংবাদিক বলেছেন, “আমার বস যে আমাকে মৃত্যু ও সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকা জায়গায় পাঠাচ্ছেন, এটা আমি শুরুতে পছন্দ করিনি। কিন্তু এটা আমার চাকরি। আর বসের নির্দেশ পেলে আমাকে অবশ্যই যেতে হবে।”
সত্যিকারের প্রভাব উন্মোচনে ডেটার ব্যবহার
সরকারের নিজের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের ডেটার মধ্যেও সংগতি ছিল না। উদাহরণ হিসেবে সন্দেশ বলেছে জেলা পর্যায়ের ডেটার সঙ্গে রাজ্য পর্যায়ের ডেটার গরমিলের কথা। দুই ক্ষেত্রেই পত্রিকার অনুসন্ধান করা সংখ্যার তুলনায় সংখ্যাটি অনেক কম ছিল। সত্য উন্মোচনের ক্ষেত্রে মৃত্যু সনদের ডেটা ব্যবহার করা আরেকটি ভালো উপায় হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় আগের বছরগুলোর তুলনায় একই সময়ে এই বছরে মৃত্যু সংখ্যার পার্থক্য ঘটেছে কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য মৃত্যু সনদের ডেটা ব্যবহার করেছে গুজরাটের একটি দৈনিক দিব্য ভাস্কর এবং ছয়টি রাজ্যজুড়ে প্রকাশিত হিন্দি দৈনিক অমর উজালা।
অমর উজালার সাংবাদিক রাজিব শর্মা ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “কর্তৃপক্ষ তথ্য গোপন করছিল এবং আমি এটি দেখাতে চেয়েছিলাম মৃত্যু সনদের তথ্য ব্যবহার করে। সেখানে দেখা যায়: গত বছরের তুলনায় এপ্রিল মাসে দ্বিগুণ মৃত্যু সনদ ইস্যু করা হয়েছে।” ১৭ মে প্রকাশিত রাজিব শর্মার একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গাজিয়াবাদে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ইস্যু করা মৃত্যু সনদের তুলনা। তাতে দেখা যায়, গত বছরের এপ্রিলে ইস্যু করা হয়েছিল ৪৪৬টি মৃত্যু সনদ। সেখানে এ বছরের এপ্রিলে সংখ্যাটি ৯৭৩। শর্মা এ-ও মনে করিয়ে দেন যে, “এই সংখ্যাও হয়তো বাড়বে। কারণ, লকডাউনের কারণে অনেকেই এখনো মৃত্যু সনদ নিতে আসতে পারেননি।”
“সত্যিকারের চিত্রটি যদি দেখানো যেত, তাহলে মানুষ পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে ভালোমতো বুঝতে পারত। কিন্তু তথ্য গোপন করে সেই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলা হয়েছে,” বলেন শর্মা।
গুজরাটের নর্মদা জেলার পত্রিকা লোক সত্তা জন সত্তায় কাজ করা ভিশাল মিস্ত্রি ও তাঁর সহকর্মীরা করোনাভাইরাস-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখার আরেকটি রাস্তা বের করেছিলেন। সেখানে কিছু সময়ের জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষ কোভিড পজিটিভ শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের বাড়ির বাইরে একটি বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছিল। এরপর স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ যখনই জানিয়েছে যে, একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ২৫ জন শনাক্ত হয়েছেন, তখন সাংবাদিকদের এই দল সেই এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখেছেন, সেখানে কতগুলো বাড়ির বাইরে কোভিড পজিটিভের নোটিশ টাঙানো আছে।
তবে, এত কিছু করেও দূরবর্তী গ্রামীণ এলাকাগুলোতে কী ঘটে চলেছে, তা জানা প্রায়ই অসম্ভব হয়ে যায়। অথচ সেখানেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা বিশেষভাবে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। গুজরাটের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে কাজ করা সন্দেশের সাংবাদিক জয়েশ থাকরার তাঁর দলের সদস্যদের বলেছিলেন: তাঁরা যেন সেই অঞ্চলের পাঁচজন গ্রামপ্রধানকে প্রতিদিন ফোন করে সেখানকার খবরাখবর শোনেন। মৃত্যু সংক্রান্ত খবর পাঠানোর ডেডলাইনও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন থাকরার। টানা ১৫ দিনের জন্য দুজন কর্মীকে নিয়োজিত করেছিলেন শোক সংবাদ লেখার কাজে। কারণ, এই সেকশনে পাতার সংখ্যা দুই বা তিন থেকে বেড়ে ক্রমেই সাত বা আটে চলে গিয়েছিল।
থাকরার নিজেও মাঠপর্যায়ে গেছেন দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এবং তাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য। এত ঝুঁকি নিয়ে তিনি কেন সেখানে গেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে থাকরার বলেছেন, “১০ বছর পর আমার সন্তান যদি জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি সে সময় কী করেছ?’ তাহলে আমি যেন কিছু জবাব দিতে পারি।”
ওয়াচডগ সাংবাদিকতার পুনর্জাগরণ?
কোভিড মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন করায় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে হাসপাতাল ও শ্মশানের কর্মীদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, যেন তাঁরা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলেন। সরকারি কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে সাংবাদিকদের কলও ধরেন না। অথবা কখনো কখনো ব্যক্তিগতভাবে কোনো সাংবাদিককে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। তাঁদেরকে “ইতিবাচক” প্রতিবেদন প্রকাশ করতে অনুরোধ করেন। কিছু ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা এমনকি শ্মশানঘাটে গিয়েও বসে থাকেন এবং দেখেন, কেউ মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলছেন কি না। মৃত্যু নিবন্ধনের ডেটাগুলোও জনসাধারণের দৃষ্টির বাইরে রাখা হয়।
কল্পনা শর্মা বলেছেন, যেসব সংবাদমাধ্যম আগে সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, তাদেরকেও এখন ওয়াচডগ ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। এমনকি বিজেপি নিয়ন্ত্রিত রাজ্যগুলোতেও। “এই সংকট রাজনীতির চেয়ে বড়। এবং আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন কোনো সম্পাদকই তা এড়িয়ে যেতে পারেন না,” বলেছেন শর্মা।
শুধু সরকারি কর্তৃপক্ষের থেকেই নয়, সাংবাদিকদের ওপর চাপ আসে তাঁদের নিজ নিজ কমিউনিটি থেকেও। ভারতের পূর্বের রাজ্য বিহারের গ্রামাঞ্চলের ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সৌরভ কুমার বলেছেন, কোভিড-১৯ নিয়ে রিপোর্টিং করার কারণে গ্রামে তাঁদের নিন্দার মুখে পড়ার ঝুঁকি নিতে হয়েছে। তবে তিনি এ-ও জানিয়েছেন, হিন্দি ভাষার সংবাদমাধ্যমগুলো এই ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। “আমি ভেবেছিলাম, কিছু সংবাদমাধ্যম সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করবে; কিন্তু তারাও সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করছে। কারণ, কেউই এই মহামারির প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি,” বলেছেন কুমার।
ইংরেজি ভাষার নিউজ সাইট নিউজক্লিকের প্রদায়ক হিসেবে কাজ করা কুমার বলেছেন, তাঁকে ও তাঁর সহকর্মীদের হেনস্তা করা এবং ভয়ভীতি দেখানোর ঘটনা প্রায়ই ঘটে। “আপনি যখন বিতর্কিত কোনো বিষয় নিয়ে রিপোর্টিং করবেন, তখন আপনার কাজকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। আপনার নামে মামলা দেওয়া হবে। বিহার ও উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্যে এগুলো বছরের ৩৬৫ দিনই ঘটে,” বলেছেন কুমার।
আরো পড়ুন
নতুন করোনাভাইরাস: খবর সংগ্রহ, রিপোর্ট তৈরি ও প্রকাশে যত রকম সতর্কতা দরকার
জিআইজেএন ওয়েবিনার: স্টেয়িং সেফ: হাও টু রিপোর্ট এ প্যানডেমিক
হিসেবের বাইরে থেকে যাওয়া কোভিড মৃত্যুকে তুলে আনবেন কী করে
ভাব্য দোরে একজন মুম্বাই-ভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে দ্য ক্যারাভান, কোয়ার্টজ, বিবিসি, ফরেন পলিসিসহ আরো অনেক জায়গায়। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ওমেনস মিডিয়া ফাউন্ডেশন-এর কিম ওয়াল গ্রান্টি।