২০১৭ সালের শীতে, টুইটারে স্ক্রল করতে করতে একটি পোস্টে চোখ আটকে যায় যুক্তরাজ্যের সাংবাদিক মেইভ ম্যাকক্লিনাহানের। পোস্টটি করেছিলেন সেই এলাকারই এক অধিবাসী। বিষয় ছিল: গৃহহীন এক ব্যক্তির মৃত্যু।
মর্মান্তিক এই ঘটনার খবর জেনে মন খারাপ হয় ম্যাকক্লিনাহানের। মনে হতে থাকে, এমন ঘটনা তিনি আগেও দেখেছেন। প্রাথমিক খোঁজাখুঁজির পর তিনি এমন বেশ কিছু পোস্ট খুঁজে পান, যেগুলোর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে: কোনো গৃহহীন ব্যক্তির নিঃসঙ্গ মৃত্যু, স্থানীয় কারও শোক এবং এমন ঘটনা ঘটছে দেশজুড়ে। কিন্তু এর সঙ্গে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া ডেটা ঠিক মিলছিল না। সেই থেকে ম্যাকক্লিনাহানের সন্দেহ হয়, একটা বড় কিছু ঘটে চলেছে; কিন্তু কেউই বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলোকে জুড়ে দেখছেন না।
তিনি বিষয়টি আরও তলিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেন এবং তাঁর সঙ্গী হন দ্য ট্রাস্ট ফর দ্য ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম, টিবিআইজের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ব্যুরো লোকালের সহকর্মীরা। তাঁদের অনুসন্ধান শুরু হয় একটি সাধারণ প্রশ্ন সামনে রেখে: ডেটা যদি বলে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা যতটা বলা হয় তার চেয়ে বেশি, তাহলে কি গৃহহীনদের মৃত্যুর বেলায়ও চিত্রটা একই?
প্রশ্নটি শুনতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, বাস্তবে তার উত্তর খুঁজে পাওয়া ততটাই কঠিন ছিল। ম্যাকক্লিনাহান কাজ শুরু করেন সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে। যাদের কাছেই গৃহহীনদের মৃত্যুর ডেটা আছে বলে মনে হয়েছে, তাদেরকেই তিনি ফোন করে গেছেন সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে। করোনার্স অফিস (যারা মৃত্যুর রেকর্ড রাখে) থেকে শুরু করে হাসপাতাল, পুলিশ, কাউন্সিল, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ- সব জায়গাতেই খোঁজ করেছেন ম্যাকক্লিনাহান। সবাই একই কথা বলেছে: এ ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তারপর তারা আরেক অফিস দেখিয়ে দিয়েছে।
এভাবে অগুনতি কল করার পর তিনি বুঝতে পারেন, আসলে কারও কাছেই উত্তর নেই। সম্প্রতি জিআইজেএন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ম্যাকক্লিনাহান বলেন, ‘আমি যখন আমার সম্পাদকদের একথা জানালাম, তখন সবাই খুব অবাক হন এবং আমরা বিষয়টিকে নিজেদের মিশনে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিই; আমরা নিজ উদ্যোগে তথ্য খুঁজে বের করব এবং ডেটার এই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করব।’ তাদের লক্ষ্য ছিল, এমন একটি ডেটাবেইস তৈরি করা, যেখানে গৃহহীনদের মৃত্যুর ১৮ মাসের ডেটা থাকবে। একই সঙ্গে তাঁরা মৃতদের গল্প তুলে আনবেন, যাতে সমস্যাটির বিস্তার সম্পর্কে ভালোভাবে জানা যায় এবং সমাধানের উদ্যোগ নিতে চাপ দেওয়া যায়। এই উদ্যোগ থেকেই জন্ম নেয়: ডাইং হোমলেস প্রজেক্ট। ১৮ মাসের এই অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এক হাজারের বেশি সাংবাদিক এবং এই ডেটাবেইসে লিপিবদ্ধ করা হয় পুরো দেশের ৮০০টি গৃহহীন মৃত্যুর ঘটনা।
প্রকল্পটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল: টিবিআইজের ব্যুরো লোকালের সাহায্য নেওয়া। এটি ১,৪২৬ জন সাংবাদিক, নাগরিক ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গড়া একটি সহযোগিতামূলক অনুসন্ধানী নেটওয়ার্ক। নেটওয়ার্কের সদস্যরা যেন গৃহহীন অবস্থায় মৃত্যুর ঘটনাগুলো রিপোর্ট করতে পারেন, সে জন্য সহজ একটি গুগল ফর্ম তৈরি করেছিলেন ম্যাকক্লিনাহান। যতটা সম্ভব বেশি মানুষকে এ বিষয়ে জানানোর জন্য টুইটারে ফর্মটির প্রচারণা চালিয়েছিল টিবিআইজে এবং পোস্ট করেছিল তাদের ওয়েবসাইটে।
নেটওয়ার্ক থেকে পাওয়া ডেটা বিশ্লেষণের পদ্ধতি সম্পর্কে ম্যাকক্লিনাহান বলেন, ‘সবার জন্য উন্মুক্ত একটি ডেটাবেইসে তথ্যগুলো যোগ করার আগে আমাকে প্রতিটি নাম আলাদা করে খেয়াল করতে হয়েছে। অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে সেগুলো মিলিয়ে ও যাচাই করে দেখতে হয়েছে। এটি বড় একটি কাজ ছিল। তবে একই জিনিস যেন দুবার না থেকে যায়, আমরা যেন তথ্যগুলো সংবেদনশীলতার সঙ্গে রিপোর্ট করতে পারি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নাম-পরিচয় গোপন রাখতে পারি- এসব বিষয় নিশ্চিত করার জন্য কাজটি অত্যন্ত জরুরি ছিল।’
ম্যাকক্লিনাহান, সহকর্মী চার্লস বোটো ও দলের বাকি সদস্যরা এই কাজের জন্য গোটা যুক্তরাজ্য ঘুরেছেন। লঙ্গরখানা ও গৃহহীন মানুষের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গিয়েছেন। তাদের সমস্যা বোঝার চেষ্টা করেছেন প্রত্যক্ষভাবে। তাঁরা স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে খোঁজ নিয়েছেন, বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা, চিকিৎসক ও গৃহহীনদের নিয়ে কাজ করা অন্যান্য মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া মৃত্যুগুলোর বিভিন্ন ঘটনা ডেটাবেইসে যোগ করেছেন। পুলিশ ও করোনোরদের কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করেছে দলটি। ম্যাকক্লিনাহান এই পদ্ধতিকে বর্ণনা করেছেন ‘আধা-ক্রাউডসোর্সড, আধা ধাঁধা মেলানো অনুসন্ধান’ হিসেবে।
সব তথ্য এক জায়গায় আসার পর সেগুলো বিশ্লেষণ এবং তার অর্থ বের করতে হতো দলটিকে। ম্যাকক্লিনাহান ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘ডেটা সংগ্রহের এই বহুবিধ বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রকল্পের শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, আমরা দুই শীতকালের মধ্যে কোনো সরাসরি তুলনা করব না। কারণ, আমরা এতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করিনি। এর বদলে, আমরা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি: এই মৃত্যুগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে কি না, হলেও সেটা কখন হয়েছে। এবং আমরা নজর দিয়েছি এসব মৃত্যুর সাধারণ কিছু কারণের দিকে।’
সন্দেহ নেই, পরিসংখ্যানই এই প্রতিবেদনের কেন্দ্রে ছিল। কিন্তু প্রকল্পটি সংখ্যা ও পরিসংখ্যানের সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়েছিল মৃত ব্যক্তিদের জীবনের গল্পকে স্মরণ ও তুলে ধরার মাধ্যমে। প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির আলাদা আলাদা গল্পের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে গৃহহীনদের সুরক্ষা দিতে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা। যুক্তরাজ্যে গৃহহীনতা নিরসনের জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আইনিভাবে দায়বদ্ধ। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, অনেকেই এই ব্যবস্থার ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ১৮ মাসের অনুসন্ধান শেষে ৮০০টি মৃত্যু লিপিবদ্ধ করার পর, ব্যুরো সেই ফলাফল তুলে দেয় মিউজিয়াম অব হোমলেসনেস-এর কাছে। তারা এখনো গল্পগুলো প্রকাশ করে যাচ্ছে।
ম্যাকক্লিনাহান অবশ্য এখানেই থেমে যাওয়ার লোক নন। এরপর তিনি একটি বইও লিখেছেন, নাম ‘নো ফিক্সড অ্যাবোড: লাইফ অ্যান্ড ডেথ অ্যামং দ্য ইউকে ফরগটেন হোমলেস’। এখানে তিনি দেখিয়েছেন, কাঠামোগত ব্যর্থতার কারণে যুক্তরাজ্যে কীভাবে গৃহহীনতা টিকে থাকছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে একটি পডকাস্টও করেছিলেন।
ম্যাকক্লিনাহান বলেন, ‘কয়েক মাস টানা অনুসন্ধানের পর তিনি দেখতে পান: গৃহহীনদের জন্য যে সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকার কথা ছিল, তা কমে গেছে বাজেট সংকোচনের কারণে। মানসিক স্বাস্থ্য, মাদক ও অ্যালকোহল সার্ভিসে অর্থ বরাদ্দ কমানো এবং এর সঙ্গে বাড়িভাড়া বেড়ে যাওয়া, বাসস্থানের স্বল্পতা ইত্যাদি সব বিষয় মিলে তৈরি হয়েছে একটি আদর্শ ঝোড়ো পরিস্থিতি।’
তিনি আরও যোগ করেছেন, ‘প্রয়োজন না হওয়া পর্যন্ত অনেক সেবাই আমাদের কাছে অদৃশ্য অবস্থায় থাকে। আমরা আশা করি যে, কোনো সমস্যায় পড়লে আমাদের সাহায্য দেওয়ার মতো ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু আমার রিপোর্টিং থেকে দেখা যায়, বাস্তবতা মোটেও এমন নয়।’
অনুসন্ধানটি মনোনীত হয় অ্যামনেস্টি মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ও ব্রিটিশ জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ডের জন্য। আর ম্যাকক্লিনাহান মনোনীত হন অরওয়েল পুরস্কারের জন্য। প্রতিবেদনটি ২০১৯ সালে রয়্যাল স্ট্যাটিসটিক্যাল সোসাইটির সেরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পুরস্কার জিতেছে। বিচারকেরা একে ‘সত্যিই দুর্দান্ত’ বলে রায় দিয়েছিলেন।
অনুসন্ধানটি শুরু হয়েছিল একটি সাধারণ প্রশ্ন থেকে এবং ডেটার ঘাটতি পূরণের লক্ষ্য সামনে রেখে। কিন্তু গৃহহীনতা একটি বৈশ্বিক সমস্যাও বটে। এবং বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে আগ্রহী, এমন রিপোর্টারদের জন্য এখানে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ম্যাকক্লিনাহান।
১. ডেটা নেই দেখেই থেমে যাবেন না
ম্যাকক্লিনাহানের মতে, কোনো অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ডেটার ঘাটতি থাকলে হতাশ হবেন না। বরং বাস্তবে, এটি সুযোগ হয়ে ধরা দিতে পারে। দ্য ডাইং হোমলেস প্রকল্প দেখিয়েছে: কোনো প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো ডেটা হাতে না থাকলেও নিরুৎসাহিত হওয়ার কিছু নেই। ম্যাকক্লিনাহান তাঁদের অনুসন্ধান পদ্ধতিকে বর্ণনা করেছেন ‘অসম্পূর্ণ বিজ্ঞান’ হিসেবে। কারণ, তাঁরা গৃহহীনদের তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি গুগল ফর্ম ব্যবহার করেছিলেন, যেটি পাঠানো হয়েছিল স্থানীয় রিপোর্টার, বিশেষজ্ঞ ও গৃহহীন মানুষদের নিয়ে কাজ করছে- এমন মানুষদের কাছে।
ফর্মটি ছিল খুবই সহজ-সাধারণ। এখানে মৃত ব্যক্তির নাম, বয়স ও গৃহহীন সেই মানুষটি কোথায় থাকতেন, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এসব তথ্যের মাধ্যমে গৃহহীনতার সেই অভিজ্ঞতার অনেক পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া গেছে।
ম্যাকক্লিনাহান ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘আমরা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই। ফলে ক্রাইসিস নামের একটি দাতব্য সংস্থার ব্যবহার করা সংজ্ঞাকে আমরা [গৃহহীনতার] সংজ্ঞা হিসেবে নির্ধারণ করেছি। এর মধ্যে আছেন এমন মানুষ, যাঁরা ঘরের বাইরে রাত কাটাচ্ছেন, অথবা জরুরি আবাসনকেন্দ্র, হোস্টেল ও বন্ধুদের বাড়িতে অস্থায়ীভাবে থাকছেন।’
তাঁরা একই সঙ্গে ১৮ মাস সময়পর্বের ডেটা সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যেখানে দুটি শীতকাল থাকবে। ডেটাসেটের সীমাবদ্ধতার কারণে দুই বছরের মধ্যে তুলনা করা কঠিন হয়ে গেছে। তবে ম্যাকক্লিনাহান জানান, আনুষ্ঠানিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা গেছে, গৃহহীনদের মৃত্যুর ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। এই অনুসন্ধান ও পদ্ধতিকে ভিত্তি করে গৃহহীন মৃত্যু নিয়ে নিজস্ব ডেটাবেইসও তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস (ওএনএস)।
২. জোট বেঁধে কাজ
ব্যুরো লোকালের নেটওয়ার্ক ও সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে তথ্য না পেলে এই অনুসন্ধান পরিচালনা সম্ভব হতো না। ম্যাকক্লিনাহান বলেন, ‘জোট হয়ে কাজ করাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, আমাদের নজর দিতে হয়েছে পুরো যুক্তরাজ্যে।’
এই ১৮ মাস জুড়ে, স্থানীয় রিপোর্টাররা এমন ৯৫টি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, যেখানে গৃহহীনদের মৃত্যুর কথা উঠে এসেছে। তার মানে ‘ইস্যুটি মানুষ ভুলে যেতে পারেনি এবং সেই মানুষদের গল্পও এর মধ্য দিয়ে উঠে আসছে, ঠিক যতটা সংবেদনশীলতা দিয়ে সেগুলো উঠে আসা উচিত ছিল। এ বিষয়ে আরও সচেতনতা বাড়ানোর জন্য টুইটারে #মেকদেমকাউন্ট হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেও প্রচার চালিয়েছে টিবিআইজে।
অনুসন্ধানটি জাতীয় পর্যায়েও সংবাদে পরিণত হয়। ম্যাকক্লিনাহান মনে করেন, রিপোর্টিংয়ের দ্বিমুখী তৎপরতা অনুসন্ধানটির প্রভাব তৈরিতে অবদান রেখেছে, ‘জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে একই সঙ্গে অনুসন্ধানগুলো প্রকাশ করার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত করতে চেয়েছি যেন প্রতিটি পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাইকে জবাবদিহি করা যায়। স্থানীয় রিপোর্টাররা যেন তাঁদের কাউন্সিলে গিয়ে বলতে পারেন ‘কীভাবে এতগুলো মৃত্যু ঘটল?’ ‘এ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক পর্যালোচনা হয়নি কেন? এই পরিস্থিতি বদলানোর জন্য আপনারা কী করতে যাচ্ছেন?’ এবং জাতীয় পর্যায়ে, আমরা বলতে পারি: ‘এটি খুবই লজ্জার বিষয় যে, বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশে, মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে ৮০০ মানুষ মারা যাচ্ছে গৃহহীন অবস্থায়।’ সহযোগিতা ও জোট হয়ে কাজ করা ছিল এই অনুসন্ধানের চালিকাশক্তি।
৩. তথ্য যাচাই করুন
ডেটা সংগ্রহের পদ্ধতিকে ‘অসম্পূর্ণ বিজ্ঞান’ হিসেবে বর্ণনা করলেও, ম্যাকক্লিনাহান খুবই সতর্কতার সঙ্গে সব তথ্য যাচাই করেছেন। যেন এই মৃত্যুগণনাটি যতটা সম্ভব যথার্থ হয় এবং এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে তিনি মন্তব্য করেন। তথ্য যাচাইয়ের অন্যতম পদ্ধতি ছিল প্রথাগত সরেজমিন রিপোর্টিং। ‘আমি নিজেই পুরো দেশ ঘুরেছি। বিভিন্ন এলাকার লঙ্গরখানা ও হোস্টেলের লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। গৃহহীনদের নিয়ে কাজ করেন এমন চিকিৎসক ও অন্যান্য মানুষের কথা বলেছি যেন তাঁরা আমাদের ডেটাবেইসে তথ্য যোগ করতে পারেন,’ বলেছেন ম্যাকক্লিনাহান।
অবশ্যই, ম্যাকক্লিনাহান নিজে প্রতিটি জায়গায় গিয়ে তথ্য যাচাই করতে পারতেন না। ফলে, ফর্মের মাধ্যমে আসা তথ্যগুলো যাচাই করার জন্য একটি পদ্ধতি তৈরি করে তাঁর দল। ম্যাকক্লিনাহান ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘এটি যদি কোনো নির্ভরযোগ্য সংবাদসূত্র থেকে আসে, তাহলে আমরা সেটি ডেটাবেইসে যোগ করে নিই। আমরা আমাদের স্থানীয় সাংবাদিকদেরও অনেক ভরসা করি এবং জানি যে, তিনি বিষয়টি পুরোপুরি খতিয়ে দেখেছেন। যদি এটি সাধারণ কোনো নাগরিকের কাছ থেকে আসে, তাহলে আমরা সেখানে যাই, গৃহহীন মানুষদের নিয়ে কাজ করে- এমন সরকারি সংগঠন ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলি এবং সব তথ্য দুবার যাচাই করি।’
এই প্রক্রিয়া শুধু তথ্য-যাচাইয়ের চর্চার ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, একই সঙ্গে এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা গেছে যে, প্রতিবেদনে ব্যবহার করা তথ্যে এমন সংবেদনশীল কিছু আছে কি না, যা থেকে অন্য কেউ ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন। ‘আমরা এসব সংগঠনের সঙ্গে বিশ্বস্ততার সম্পর্ক তৈরির ওপরই নির্ভর করেছি,’ বলেন ম্যাকক্লিনাহান।
৪. ঘটনার পেছনে থাকা মানুষের কথা সব সময় মনে রাখুন
অনুসন্ধানের শুরুর সময় থেকেই ম্যাকক্লিনাহান জানতেন যে, এটি ডেটার চেয়েও ব্যাপক বিষয়। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের এই ৮০০টি ডেটা পয়েন্টের প্রতিটি একজন মানুষকে নির্দেশ করে, যাঁর ভালোবাসার মানুষ ছিল, আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল, সমৃদ্ধ অতীত ছিল। আমি এক বছর ধরে অনেক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিয়েছি, আদালতে খোঁজ করেছি, মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেছি।’
দ্য ব্যুরো, তাদের ওয়েবসাইটে একটি পেজ তৈরি করেছিল, যেখানে এসব গল্পের কিছু কিছু অংশ তুলে ধরা হয়। এই বিষয়টিই বই লেখার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বলে জানান ম্যাকক্লিনাহান, ‘এই মানুষগুলোর যে গল্প আমরা শুনেছি, সেগুলো দারুণ, আকর্ষণীয়, এবং একই সঙ্গে হৃদয়বিদারক। এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণও বটে। কারণ, প্রত্যেক ব্যক্তি আলাদা আলাদাভাবে বলেছে যে, কীভাবে সমাজের সুরক্ষা ব্যবস্থা তাদের ব্যর্থ করে দিয়েছে।’
সেই ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্যগত গুরুত্ব ফুটে উঠেছে প্রতিবেদনটির মানবিক উপস্থাপনের মাধ্যমে। ম্যাকক্লিনাহান মনে করেন, যুক্তরাজ্যের বর্তমান গৃহহীনতা সমস্যার কারণ ও পরিণতি নির্ণয় এবং সমাধানের জন্য করণীয় ঠিক করতে গেলে, এটি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রত্যেক মৃত মানুষের পরিস্থিতিই আলাদা ছিল। ‘আমার মনে হয়, শুধু এই গল্পগুলো ভালোমতো তলিয়ে দেখার মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারব যে, কিছু মুহূর্ত ছিল যখন কারও কোনো হস্তক্ষেপ পাওয়া গেলে সাহায্য হতো। কিন্তু সেটি সেখানে ছিল না। এখান থেকে আমরা শিখতে পারি, কীভাবে এই ধরনের ঘটনা আবার ঘটা থেকে বিরত রাখা যায়,’ বলেন ম্যাকক্লিনাহান।
আবেগ জন্ম দেওয়া ছাড়াও দ্য ডাইং হোমলেস প্রজেক্ট বাস্তব অনেক প্রভাব ফেলেছে। ২০১৮ সালে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসে গৃহহীন অবস্থায় মৃত্যু হওয়া মানুষদের আনুষ্ঠানিক ডেটা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে ওএনএস ও স্কটিশ ন্যাশনাল রেকর্ডস অফিস। কাজের পদ্ধতি তৈরির জন্য তাদের সঙ্গে নিজেদের ডেটাবেজ শেয়ার করেছিল টিবিআইজে। এবং ‘পরামর্শ ও সহায়তার’ জন্য তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছে ওএনএস।
ওএনএস-এর স্বাস্থ্য বিশ্লেষণবিষয়ক ডেপুটি ডিরেক্টর বেন হাম্বারস্টোন সে সময় লিখেছিলেন: ‘কোনো সমস্যা সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে সমস্যাটি বোঝা। এবং এই ধরনের পরিসংখ্যান তৈরি করতে পারলে গৃহহীনতার বিষয়ে আরও ভালোভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে এবং আমাদের সমাজে গৃহহীন অবস্থায় মৃত্যু রোধ করা যাবে।’
গৃহহীন মৃত্যুর গণনাটি আনুষ্ঠানিকভাবে করার গুরুত্ব প্রসঙ্গে ম্যাকক্লিনাহান বলেছেন, ‘প্রথমবারের মতো যখন আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানটি পাওয়া যায়, তখন অনেকেরই মনে হয়েছিল, নাহ্, এই ইস্যু আর কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করা যাবে না। এরপর বিষয়টি নিয়ে বেশ তর্কবিতর্ক হয়। রাজনীতিবিদেরা বলতে শুরু করেন যে, যুক্তরাজ্যের মাটিতে এটি একটি মানবিক বিপর্যয় এবং এর পরিবর্তন দরকার।’
ক্রাইসিসের গবেষণা ও মূল্যায়ন দলের প্রধান ফ্রান্সেসকা আলবানিজের মতে, এই প্রকল্প দুটি বড় প্রভাব রেখেছে। প্রথমত, আনুষ্ঠানিক গণনা শুরু করেছে ওএনএস। ‘এই প্রকল্প নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে আনুষ্ঠানিক ডেটা সোর্স হিসেবে। আনুষ্ঠানিক এই ডেটা প্রকাশ করা হবে বার্ষিক ভিত্তিতে এবং গৃহহীন অবস্থায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ডেটা প্রকাশ করা হবে তাৎক্ষণিকভাবে,’ জানান আলবানিজ।
তাঁর মতে, টিবিআইজে এই প্রকল্পে যেভাবে মানবিক গল্পগুলো তুলে এনেছে, তা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আলবানিজ বলেন, ‘গৃহহীন অবস্থায় মৃতদের মানবিক গল্পগুলো বলার ক্ষেত্রে সত্যিই খুব প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছে প্রকল্পটি। আমরা যে এখানে মানুষের জীবন নিয়ে কথা বলছি এবং বছরে শত শত মানুষ গৃহহীন অবস্থায় মারা যাচ্ছে, যেগুলো চাইলেই রোধ করা সম্ভব ছিল- এই সচেতনতা ছড়ানোর ক্ষেত্রে এটি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।’
আরো পড়ুন
হাও পার্টনারশিপস আর বুস্টিং লোকাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম
জিআইজেএন রিসোর্স: পোভার্টি ডেটাবেজ
হানা কুগানস জিআইজেএন-এর সম্পাদনা সহযোগী। তিনি সিটি ইউনিভার্সিটি থেকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েছেন। হংকংয়ে, গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন বন্যপ্রাণী পাচার সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ে। কাজ করেছেন যুক্তরাজ্যের চ্যানেল ফোর-এর বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্যও। বর্তমানে তিনি আছেন লন্ডনে।