অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সহজ নয়, আর ২০২০ সালে তা আরও কঠিন ছিল বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জন্য। এই বছর দেশটিতে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজারের বেশি সাংবাদিক। কিন্তু ভাইরাস ছিল লড়াইয়ের মাত্র একটি দিক। চাকরি হারানো, বেতন কমে যাওয়া, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা—এমন নানান ক্ষেত্রে লড়াই করতে হয়েছে তাদের। তার ওপর, বার্তাকক্ষে ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয় এবং সেলফ-সেন্সরশিপ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম ৯ মাসে অন্তত ৮০০ জন এই আইনে মামলার শিকার হয়েছেন। সংস্থাটি বলেছে, “দেশটির গুরুত্বপূর্ণ সব সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা ক্রমাগত শিকার হচ্ছেন এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের।”
এত কিছুর পরও জিআইজেএন বাংলা বুলেটিনের জন্য মাসের আলোচিত রিপোর্ট খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখেছি: অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে। পরিবর্তনটি খেয়াল করেছেন তরুণ প্রতিবেদক ইরানি বিলকিস খানও।
সম্প্রতি একটি ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ”অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অগ্রগতি হচ্ছে বেশ।” কারণ, তাঁর দেখায়, “এবারের ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি পুরস্কারের সাধারণ ক্যাটাগরিতেও বেশির ভাগ রিপোর্ট ছিল অনুসন্ধানমূলক; অনুসন্ধানী ক্যাটাগরিতেও রিপোর্ট জমা পড়েছে বেশি।”
আর তাঁদের অনুসন্ধান সামনে এনেছে: সরকারি টাকা খরচে অনিয়ম ও অপচয়, অভিবাসী শ্রমিকদের দাসের মতো জীবন, জলবায়ু পরিবর্তন ও শিল্পদূষণের কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চরম স্বাস্থ্যঝুঁকি, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি, কোভিডের কালেও করপোরেট লোভের বিস্তৃতি—এমন অনেক বিষয়।
চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গেলে হয়তো সব রিপোর্টকে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মানের বিচারে নিখুঁত বলা যাবে না। কিন্তু সাংবাদিকদের নিরন্তর চেষ্টা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের, বাঁচিয়েছে করের টাকা এবং জবাবদিহির আওতায় এনেছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতাবানদের। ২০২০ সালে বাংলায় ও বাংলাভাষী অঞ্চল নিয়ে দেশি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত তেমন কিছু প্রতিবেদন আমরা তুলে এনেছি এখানে। প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হয়েছে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে।
যে জলে জীবন জ্বলে (জাগোনিউজ ২৪ ডটকম)
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার শত শত মানুষ প্রতিদিন গোসল করেন, কাপড় পরিষ্কার করেন; এমনকি খাওয়ার পানিও সংগ্রহ করেন লবণাক্ত সব পুকুর থেকে। এক দশক আগে, ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে এই এলাকার মিঠাপানির সব উৎসই ডুবে যায়। উন্মুক্ত, এমনকি ভূগর্ভস্থ সব উৎসও হয়ে পড়ে লবণাক্ত। তারপর থেকে পরিস্থিতি ক্রমে খারাপই হয়েছে। এতটুকু সবারই জানা। কিন্তু এই লবণাক্ত পানির কারণে কীভাবে অসংখ্য নারী ও শিশু আক্রান্ত হচ্ছেন, তা অজানাই ছিল জাগোনিউজ ২৪-এর সাংবাদিক জেসমিন পাপড়ির অনুসন্ধানের আগে। চার মাসের এই অনুসন্ধানে, তিনি দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা সাতক্ষীরার উপকূলবর্তী গ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে, অন্তত ৬০ জন নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, যাঁদের ২৫ জনই লবণাক্ততার কারণে রোগে আক্রান্ত হয়ে জরায়ু ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কাজটির জন্য তিনি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে গিয়েছেন, উন্মুক্ত নথি সংগ্রহ করেছেন এবং চিকিৎসক ও স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে খতিয়ে দেখেছেন: নোনা পানির কারণে নারী ও এমনকি ছোট শিশুরাও কীভাবে জননাঙ্গের মারাত্মক সংক্রমণে ভুগছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন: বিষয়টি এমন নয়, জরায়ু অপসারণই রোগের সঠিক চিকিৎসা। কিন্তু দরিদ্র সংসারে কর্মক্ষম থাকার তাগিদ এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের ভাষায় “সঠিক নির্দেশনার অভাবে” তারা জরায়ু ফেলে দেওয়ার আপাত-সহজ পথটি বেছে নিচ্ছেন বলে রিপোর্টে উঠে আসে।
স্যানিটাইজারে বিষ (একাত্তর টিভি)
করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে হাত পরিষ্কার রাখার কার্যকর একটি উপায় অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার। ফলে মহামারির মধ্যে পণ্যটির চাহিদা ছিল গগনচুম্বী। বাংলাদেশে শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলো তাদের উৎপাদন বাড়িয়েছে এবং নতুন অনেক কোম্পানিও তৈরি হয়েছে এই চাহিদা পূরণের জন্য। কিন্তু এই পণ্যগুলো কতটা মানসম্পন্ন, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল একাত্তর টিভির অনুসন্ধানী সাংবাদিক পারভেজ নাদির রেজার। বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য তিনি বেশ কিছু হ্যান্ড স্যানিটাইজারের নমুনা সংগ্রহ করেন এবং সেগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে পরীক্ষা করান। সেখান থেকে দেখা যায়: নামী একটি ব্র্যান্ড তাদের হ্যান্ড স্যানিটাইজারে মিথানল ব্যবহার করেছে। অ্যালকোহলের এই ধরন ত্বকের জন্য ক্ষতিকর এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির স্বীকৃত উপাদান ইথানল ও আইসোপ্রোপাইল অ্যালকোহলের চেয়ে সস্তা। এই কোম্পানি হাত-জীবাণুনাশক বাজারের বড় অংশ দখল করে আছে। আরও নিশ্চিত হতে এই সাংবাদিক শীর্ষ ব্র্যান্ডসহ মোট ১৮ ধরনের হ্যান্ড স্যানিটাইজারের নমুনা নিয়ম মেনে সংগ্রহ করেন এবং বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চে (বিসিএসইআর) আবার পরীক্ষা করান। এখান থেকেও আগের ফল সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। দেখা যায়: আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর জের ধরে কোম্পানিটির গুদামে অভিযান চালায় কর্তৃপক্ষ। তাদের জরিমানা করে এবং বাজার থেকে নির্দিষ্ট চালানের সব হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রত্যাহার করে নেওয়ার নির্দেশ দেয়।
হাসপাতালে ভুয়া পরীক্ষা (চ্যানেল টোয়েন্টিফোর)
করোনাভাইরাস সংশ্লিষ্ট আরেকটি অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে: কীভাবে ঢাকাভিত্তিক রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে পরিচালিত হচ্ছিল ভুয়া কোভিড-১৯ পরীক্ষা। অনুসন্ধানটি করেছে চ্যানেল ২৪-এর অনুসন্ধানী দল সার্চলাইট। এখানে সাংবাদিকেরা দেখিয়েছেন: প্রতিদিন এক শর বেশি রোগীর কোভিড পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করলেও পরীক্ষার জন্য সরকারি পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে সামান্যই। আর বাকিদের দেওয়া হয়েছে ভুয়া ফলাফল ও সনদ। একই সঙ্গে তারা এই পরীক্ষার জন্য চড়া ফি নিয়েছে, যদিও তা করার কথা ছিল বিনা মূল্যে। অনুসন্ধান থেকে আরও দেখা যায়: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, প্রতিষ্ঠানটিকে “কোভিড-১৯ চিকিৎসার বিশেষ হাসপাতাল” বলে অনুমোদন দিলেও তাদের লাইসেন্সের বৈধ মেয়াদ ছিল না। অথচ একাধিক মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা সরকারের সঙ্গে তাদের চুক্তির অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। এই হাসপাতালের মালিক ছিলেন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারকা, সাংবাদিক, বড় সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তোলা সেলফি পোস্ট করতেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। শেষ পর্যন্ত, বোরকা পরে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় হাসপাতালটির মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়।
অর্ডার বাতিল (দ্য ডেইলি স্টার)
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক রপ্তানি। এই কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, যাদের বেশির ভাগই নারী। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির গোড়ার দিকেই খবর আসতে থাকে, বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ বাতিল করছে। যার ফলে ঝুঁকির মুখে পড়ছে রপ্তানিকারক এবং শ্রমিকেরা। সমস্যাটি কতটা গুরুতর এবং এই শিল্পে তার প্রভাব কী হবে, তা বোঝার জন্য ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে দ্য ডেইলি স্টার। তারা দেখতে পায়: মহামারি শুরুর প্রথম তিন মাসে ১,৯৩১ টি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ৩৭০ কোটি ডলার সমপরিমাণ ক্রয়াদেশ পিছিয়েছে, স্থগিত রেখেছে অথবা বাতিল করেছে। এদের বেশির ভাগই ছিল উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের। এই প্রতিবেদনের জন্য রিপোর্টাররা এমন ২০ জন রপ্তানিকারকের সাক্ষাৎকার নেন, যাঁরা কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য আগেই টাকা খরচ করে ফেলেছেন, ব্যয় নির্বাহের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন এবং আদেশ বাতিলের পর শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। মে মাসের শেষ থেকে আবার কিছু কিছু অর্ডার পুনঃস্থাপন করা শুরু করে কিছু ক্রেতা। কিন্তু ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়: তাদের অধিকাংশই অর্থ পরিশোধের বিষয়টি পিছিয়ে দিতে চেয়েছেন ছয় মাস বা এক বছরের জন্য। কেউ কেউ বিশাল আকারের ডিসকাউন্ট বা ছাড় চেয়েছেন, এরই মধ্যে তৈরি হয়ে যাওয়া পণ্যের জন্য। বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন রিপোর্টাররা। এবং সেখান থেকে তাঁরা দেখেছেন, বড় ব্র্যান্ডগুলো “কমপ্লায়েন্স মানতে উদাসীন”।
লকডাউনে বন্দি শ্রমিক (আল-জাজিরা)
করোনাভাইরাস লকডাউনের সময় মালয়েশিয়ায় অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হয়েছে, তা নিয়ে গত ৩ জুলাই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আল-জাজিরার ১০১ ইস্ট। তাতে দেখা যায়, মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ কীভাবে অভিবাসী শ্রমিকদের কাঁটাতারের বেড়ায় বন্দি করে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করছে, আঙুলের ছাপ নিচ্ছে এবং বৈধ কাগজ না থাকলে গ্রেপ্তার করে নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। সাংবাদিকেরা দেখেছেন: কীভাবে কাজ হারানো শ্রমিকেরা বাধ্য হচ্ছেন মানবেতর পরিস্থিতির মধ্যে থাকতে, তাঁদের অনেকেই ঠিকমতো খেতে পাচ্ছেন না এবং বেঁচে থাকার জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে অন্যদের সাহায্যের ওপর। এই অনুসন্ধানে রায়হান কবির নামের এক বাংলাদেশি অভিবাসীকে দেখানো হয়। তিনি সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন, তাঁর এক বন্ধুকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময়, পুলিশ কতটা অমানবিক আচরণ করেছে। এই ঘটনার কিছু ভিজ্যুয়াল প্রমাণও তিনি সরবরাহ করেন। বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও সরকারের সমালোচনা করায় পরে কবিরকে গ্রেপ্তার করে দেশটির পুলিশ এবং তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা তীব্র ক্ষোভ জন্ম দেয় বাংলাদেশে, এবং কবিরকে স্বাগত জানানো হয় নায়কোচিত মর্যাদায়। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনও তাঁকে গ্রেপ্তারের নিন্দা জানায়। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর আল-জাজিরার সাংবাদিকদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করে মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষ এবং তাদের কার্যালয়ে তল্লাশি চালানো হয়। আর অধিকার সংগঠনগুলো কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করার অভিযোগ তোলে।
প্রবাসে নির্যাতিত নারী শ্রমিক (নিউজ ২৪)
২০১৬ সাল থেকে চার শর বেশি বাংলাদেশি নারী অভিবাসী শ্রমিক মারা গেছেন বিদেশের মাটিতে, যাঁদের এক-তৃতীয়াংশই সৌদি আরবে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রচারিত হওয়া এই অনুসন্ধানে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করেছে নিউজ২৪, যেখানে অভিবাসী নারী শ্রমিকেরা কর্মক্ষেত্রে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন। কিছু ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা মনে করছেন: তাঁদের প্রিয়জন মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বেশি বেতনে চাকরি ও হজ করার সুযোগের মিথ্যা আশা দেখিয়ে, প্রতারক রিক্রুটিং এজেন্টরা তাঁদের বিদেশে পাঠিয়েছেন। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: কীভাবে নারী শ্রমিকদের মারধর করেন তাঁদের নিয়োগকর্তারা, তাঁদেরকে বিক্রি করা হয় হাত থেকে হাতে এবং ধর্ষণ থেকে পালিয়ে দেশে ফেরার পর নিজ পরিবারও মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। উঠে আসে, দিনরাত কাজ করানোর পরও অনেক ক্ষেত্রেই তাদেরকে প্রতিশ্রুত মজুরি দেওয়া হয়নি। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে সাফল্যের মুখ দেখেছেন, এমন নারীদের দেখানো হয় এই প্রতিবেদনে। বেরিয়ে আসে: অভিবাসী নারীদের ভাগ্য কেমন হবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে তাঁদের নিয়োগকর্তার আচরণের ওপর; আর কেন দুই দেশের কর্তৃপক্ষই তাঁদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
পরিচয় চুরি (যমুনা টিভি)
প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরির ঘটনা বিশ্বের অনেক জায়গাতেই ঘটে। কিন্তু পরিচয়পত্রের সুরক্ষিত ডেটাবেস থেকে একজন ব্যক্তির পরিচয় চুরির ঘটনা বাংলাদেশে আগে কখনো শোনা যায়নি। ফলে যমুনা টিভির অনুসন্ধানী দল, ইনভেস্টিগেশন ৩৬০, যখন এমন একটি অপরাধী চক্রের খবর উন্মোচন করে, তা দেখে অনেকেই অবাক হন। একটি পরিবারের সব সদস্যের পরিচয় চুরি করে, তাদের মূল্যবান সম্পত্তি বিক্রি করেছিল এই চক্র। জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন ব্যবস্থার ফাঁকফোকর বের করতে টানা সাত মাস ধরে কাজ করেছে এই অনুসন্ধানী দল। তারা তুলে আনেন চক্রের সদস্যদের পুরোনো পরিচয়পত্র থাকার পরও নতুনটি ইস্যুু করার সময় বায়োমেট্রিক তথ্য যাচাই হয়নি। আর স্থানীয় কর্মকর্তারাও স্থানীয় জনপ্রিতিনিধিদের কাছ থেকে পাওয়া পরিচয় সনদকে বিশ্বাস করেছেন যাচাই ছাড়াই। বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি অপরিহার্য। ভোট তো বটেই, বিভিন্ন সেবা পেতেও এটি কাজে লাগে। এ বছরের সেপ্টেম্বরে প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর অভিযুক্ত প্রতারকদের গ্রেপ্তার করা হয়, এবং কর্তৃপক্ষ ঘটনার তদন্ত শুরু করে।
দুর্নীতির চড়া দাম (দীপ্ত টিভি)
ওপরের ছবিতে গুটিকতক বাঁশ আর টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরের কাঠামোটি দেখছেন? এদের একেকটির দাম কত হতে পারে, আন্দাজ করুন। ২ কোটি টাকা! সেটিও জমির দাম ছাড়াই। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু সরকারি উচ্চমাধ্যমিক স্কুল তৈরির একটি প্রকল্পে এমন দামই ধরা হয়েছে। ২০২০ সালের মার্চে দীপ্ত টেলিভিশনের প্রতিবেদক আসিফ জামানের অনুসন্ধানে এমন চিত্র বেরিয়ে আসে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রস্তাবিত স্কুলের জন্য এই জমি বাছাই করেছেন প্রকল্প পরিচালক নিজে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের যোগসাজশে। আর আরেকটি জমির জন্য মালিকের সঙ্গে মধ্যস্বত্বভোগীদের বাড়তি টাকা ভাগাভাগির একটি চুক্তিপত্রও সই হয়েছে, সেটি অধিগ্রহণের আগেই। এমন তিনটি জমিতে বাড়তি খরচ ধরার সচিত্র প্রমাণ উঠে এসেছে প্রতিবেদনটিতে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এভাবে জমি ও জমির ওপর গড়ে তোলা স্থাপনার অস্বাভাবিক দাম দেখিয়ে, প্রকল্পের খরচ সাড়ে চার শ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে শিক্ষা অধিদপ্তর; যে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও স্কুলে ঝরে পড়া কমানো। উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়া বাংলাদেশে একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফলে জনগণের দেওয়া করের টাকার অপচয় হচ্ছে।
যে হত্যার বিচার হয় না (প্রথম আলো)
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্টার আহমেদ জায়িফ এই রিপোর্টে অনুসন্ধান করেছেন, এমন সাতটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ নিয়ে, যেগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিহিত করে “ক্রসফায়ারে” মৃত্যু বলে। তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নেন এবং প্রতিটি ঘটনাসংশ্লিষ্ট তদন্ত প্রতিবেদন খতিয়ে দেখেন। এভাবেই বেরিয়ে আসে: ন্যায়বিচারের জন্য এই পরিবারগুলো পুলিশ, আদালত, মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন জায়গায় ধর্না দিয়েও কোনো সাড়া পায়নি। এ ধরনের ঘটনায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কেমন, তা খতিয়ে দেখা হয়েছে এই অনুসন্ধানে। দেখা গেছে: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ গ্রহণ করতে চায় না; বরং এমন মামলা দায়ের করে, যেখানে দাবি করা হয়, সেই ব্যক্তি বন্দুকযুদ্ধ বা দুই অপরাধী চক্রের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে মারা গেছেন। কিন্তু তারা এ ধরনের ভাষ্য প্রমাণেও ব্যর্থ হয়েছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এমন মাত্র দুটি ঘটনার তদন্ত করেছে এবং তাদের সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। আদালতে অভিযোগ দায়েরের পর আরেকটি ঘটনার তদন্ত করেছিল ১১টি সংস্থা, কিন্তু ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকেই নিরপরাধ বলা হয়েছে। সাক্ষাৎকারের সময়, শীর্ষ কর্মকর্তারা এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার কথা অস্বীকার করেন। বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আক্রমণের শিকার হওয়ার পর আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালিয়েছে।” বাংলাদেশে সব সরকারের আমলেই বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে, কিন্তু বেশির ভাগ ঘটনাতেই ভুক্তভোগীরা বিচার পাননি। ঝুঁকির কারণে এমন ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাও দেশটিতে খুবই বিরল। আর এই সাহসই প্রতিবেদনটিকে আলাদা করেছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী, জিআইজেএন-এর বাংলা ভাষার সম্পাদক। পাশাপাশি তিনি জিআইজেএন-এর সদস্য সংগঠন, গণমাধ্যম উন্নয়ন সংস্থা, এমআরডিআই-এর হেড অব প্রোগ্রাম অ্যান্ড কমিনউনিকেশনস হিসেবে কাজ করছেন। সাংবাদিকতায় তাঁর রয়েছে ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা, যার বড় অংশই টেলিভিশনে।