মার্কিন ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য রাশিয়া যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে, তা পুরো বিশ্বের কাছে উন্মোচিত হতে শুরু করে ২০১৭ সাল থেকে। বিভাজনের বীজ বুনতে, এই প্রচার-প্রচারণার প্রধান লক্ষ্যবস্তু করা হয় আফ্রিকান আমেরিকান ও ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের কর্মীদের।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কয়েকটি বড় ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার (বিএলএম) পেইজের পেছনে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আমি, ও সিএনএন-এ আমার সহকর্মীরা কয়েক মাস ধরে রিপোর্টিং করেছি। বিএলএম কর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময়, আমাকে মাঝেমধ্যেই এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে: “ফেসবুকে সবচে বড় ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার পেইজটি কে চালায়, জানো?”
শুনে অবাক হবেন, কেউই এই প্রশ্নের উত্তর জানতো না। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিএলএম অ্যাক্টিভিস্টরাও না। স্বাভাবিকভাবেই, কেউ কেউ সন্দেহ করছিলেন, এর পেছনে রাশিয়ার হাত থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে: রাশিয়ান বা আমেরিকান নয়, পেইজটি চালাচ্ছেন, আসলে অস্ট্রেলিয়ার এক শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি।
পেইজটির শিরোনাম ছিল: ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। দেখে যে কারো আসল-ই মনে হবে। ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত, এখানে ছিল সাত লাখ ফলোয়ার। পেইজটি থেকে পুলিশি বর্বরতা ও বৈষম্য সংক্রান্ত প্রতিবেদনের লিংক নিয়মিত শেয়ার দেওয়া হতো; আর্থিক অনুদানও সংগ্রহ করা হতো। এমনকি তাদের একটি অনলাইন দোকানও ছিল, যেখান থেকে নানা রকমের বিএলএম সামগ্রী বিক্রি করা হতো।
এমন একটি পেইজ নাম-পরিচয় গোপন রেখে চালানো হবে; তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিছু অ্যাক্টিভিস্ট এরকম পেইজের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করতে চান না, কারণ তাতে অনলাইন হয়রানি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির মুখে পড়ার আশঙ্কা থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে, ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজম ও বড় কিছু আন্দোলনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে এভাবে নাম-পরিচয় গোপন রেখে কোনো পেইজ চালাতে পারার ক্ষমতা। (রাশিয়াও ঠিক এই ব্যাপারটিরই ফায়দা নিয়েছে। এবং আরো বেশি করে সন্দেহ হয়েছে যে, এই বিএলএম পেইজের সঙ্গে তাদের সংযোগ আছে।)
রহস্যময় এই পেইজ নিয়ে যখন অনুসন্ধান শুরু করব ভাবছি, তখন আমার পরিচয় হয় অনলাইন অনুসন্ধানে দক্ষ ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, জেরেমি ম্যাসলারের সাথে। তিনি আমাকে অনেক সাহায্য করেন। বিএলএম পেইজটি থেকে যে ওয়েবসাইটগুলোর লিংক প্রায়ই শেয়ার দেওয়া হতো, সেই সাইটগুলোর ডোমেইন নিবন্ধন রেকর্ড খতিয়ে দেখেন ম্যাসলার। দেখা যায়: প্রায় সবগুলোই প্রাইভেট অবস্থায় নিবন্ধন করা হয়েছে। শুধু একটি ডোমেইনে পাওয়া যায় নাম-ঠিকানা। ২০১৬ সালে, কিছু সময়ের জন্য ডোমেইনটি রেজিস্ট্রেশন করা ছিল ইয়ান ম্যাককেই নামের এক অস্ট্রেলিয়ানের নামে।
ম্যাককেইয়ের সাথে যোগাযোগের পর ম্যাসলারকে বলা হয়, তিনি শখের বশে ডোমেইন কেনাবেচা করেন এবং এর সঙ্গে ঐ ফেসবুক পেইজের কোনো সম্পর্ক নেই। কয়েক মাস পরে যখন আমি নিজে তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি, তখন আমাকেও একই কথা বলেছিলেন মধ্যবয়সী ইউনিয়ন কর্মকর্তা, ম্যাককেই। কিন্তু ততদিনে আমরা বের করে ফেলেছি যে, তিনি ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু ওয়েবসাইটের ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন করেছেন।
এই পেইজ নিয়ে আমার নিজেরও সন্দেহ ছিল। বেশ কয়েকজন অ্যাক্টিভিস্ট আমাকে বলেছিলেন যে, তারাও এই পেইজ নিয়ে সংশয়ী। এতো কিছুর পরও, আমি শুরুতে ম্যাককেইয়ের ব্যাখ্যাটা অবিশ্বাস্য বলে উড়িয়ে দেইনি। ডোমেইন নাম কেনাবেচা খুবই লাভজনক হতে পারে, এবং অনেকেই এই ব্যবসা করেন। ম্যাককেই, ব্ল্যাক অ্যাক্টিভিজম ছাড়াও অন্যান্য আরো অনেক ধরনের ডোমেইন কেনাবেচা করেছেন। সব মিলিয়ে তার ব্যাখ্যাটাও বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিল। কিন্তু এরপর অদ্ভুত একটি ব্যাপার ঘটে। ম্যাককেইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলার কয়েক মিনিট পরেই, সেই ফেসবুক পেইজটি নামিয়ে নেওয়া হয়। ফেসবুকের পক্ষ থেকে না, যারা এটি চালাচ্ছিল, তারাই এটি নামিয়ে নিয়েছে। পেইজটি ডিলিটও করা হয়নি, শুধু অস্থায়ীভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হওয়ায়, আমি ও ম্যাসলার আরো খতিয়ে দেখা শুরু করি। ম্যাককেইয়ের সাথে আমার কথা হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পেইজটি আবার অনলাইনে সক্রিয় হয়। পেইজটির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল: এটি দীর্ঘ সময় ধরে অনলাইনে আর্থিক অনুদান সংগ্রহ করেছে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার (বিএলএম) আন্দোলনের কথা বলে।
যেমন, একটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে: তারা মেম্ফিস, টেনেসি-র আন্দোলনকারীদের সাহায্যের কথা বলে অনুদান সংগ্রহ করেছে। কিন্তু সেখানকার অ্যাক্টিভিস্টদের সাথে কথা বলে আমি জানতে পারি: তাদের কেউই জানে না, এই অনুদান সংগ্রহের বিষয়ে, বা এই অর্থ কোথায় যাচ্ছে। কেউ কেউ একে “প্রতারণা” বলে আখ্যা দিয়েছেন। অনেকে ফেসবুকের কাছে রিপোর্টও করেছেন, প্রতিষ্ঠানটি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এই পেইজের মাধ্যমে তোলা টাকা কোথায় গিয়েছে, তা জানার জন্য পেইজটি যেসব অনলাইন পেমেন্ট ও ফান্ডরাইজিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করি। এবং এর পরপরই এই প্ল্যাটফর্মগুলো, পেইজটিকে সরিয়ে ফেলতে শুরু করে। কারণ এটি তাদের নীতিমালা ভঙ্গ করেছে। কিন্তু এই অর্থ কোথায় গিয়েছে, তা আমাকে জানানো হয়নি কোম্পানিগুলোর প্রাইভেসি পলিসির কারণে। এই চ্যালেঞ্জের মুখে অনেককেই পড়তে হয়। প্রাইভেসি পলিসির কারণে, বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ও ডিজিটাল সার্ভিস, সাংবাদিকদের কাছে তাদের অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারীর নাম-পরিচয় সংক্রান্ত তথ্য উন্মোচন করে না।
তবে পরবর্তীতে, এই লেনদেন প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত, এমন এক সোর্সের কাছ থেকে আমি জানতে পারি, এগুলোর মধ্যে অন্তত একটি অ্যাকাউন্টের সঙ্গে একটি অস্ট্রেলিয়ান ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও আইপি অ্যাড্রেসের সংযোগ আছে। আরেকটি সোর্স জানায়: তারা এভাবে প্রায় এক লাখ ডলার তুলেছে। এই ধরনের তথ্য জানার জন্য এখন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ভেতরে সূত্র তৈরি করা খুবই জরুরি হয়ে গেছে। কারণ কোম্পানিগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে আপনাকে যে তথ্য জানাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি তথ্য আপনি জেনে নিতে পারবেন অভ্যন্তরীণ কোনো বিশ্বস্ত সূত্রের কাছ থেকে। শুধুই, উন্মুক্ত তথ্য দিয়ে আপনি হয়তো অনেক ঘটনাই উন্মোচন করতে পারবেন না।
আমি এসব তথ্য সামনে রেখে ফেসবুকের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাই। তাদের জানাই যে: পেইজটির সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সংযোগ বিষয়ক প্রমাণ আছে এবং আমরা জানি যে, পেইজ থেকে উত্তোলিত অর্থের কিছু পরিমাণ অস্ট্রেলিয়াতে গেছে। জবাবে ফেসবুকের এক মুখপাত্র আমাদের জানিয়েছেন, তাদের অনুসন্ধান থেকে “এমন কিছু পাওয়া যায়নি, যা ফেসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘন করে।”
আমাদের প্রতিবেদনটি প্রকাশের কিছু আগে, আমি বিষয়টি ফেসবুকের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকেও জানিয়েছিলাম। ফেসবুকের অনুসন্ধান এবং মুখপাত্রের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম। এগুলোর পর, ফেসবুক পদক্ষেপ নেয় এবং পেইজটি সরিয়ে ফেলে।
সিএনএন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করার পর, অস্ট্রেলিয়ান ওয়ার্কার্স ইউনিয়নও আলাদাভাবে অনুসন্ধান শুরু করে ম্যাককেইয়ের বিরুদ্ধে। এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই বরখাস্ত করা হয় ম্যাককেই ও সেখানকার আরেক কর্মকর্তাকে। তিনিও এই প্রতারণায় জড়িত ছিলেন।
ধাঁধার সমাধানে অনলাইন টুল
এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি ও ম্যাসলার বিভিন্ন ধরনের কৌশল ব্যবহার করেছি। আমরা অনেক নির্ভর করেছি ওয়েব্যাক মেশিনের মতো আর্কাইভ সাইটের ওপর। এখান থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি পেইজ থেকে পোস্ট করা সাইটগুলো এবং খোদ পেইজটির অতীত কর্মকাণ্ড কেমন ছিল। ম্যাসলার, ম্যাককেইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর থেকে, পেইজটির পেছনে থাকা ব্যক্তিরা এসব ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। তাদের এই চেষ্টা, আমাদের বরং উপকারেই এসেছিল।
ম্যাককেইয়ের নামে কোন কোন সাইট নিবন্ধন করা হয়েছে এবং সেখানে তার সঙ্গে যোগাযোগের কোন ঠিকানা দেয়া হয়েঝে – এমন তথ্য জানতে আমরা ডোমেইনটুল ডট কমের মতো টুল ব্যবহার করেছি। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে এই পেইজের পোস্ট প্রোমোট করার জন্য যেসব ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছিল, তা খতিয়ে দেখতে ম্যাসলার ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন ফেসবুক গ্রাফ সার্চ (এই টুলটি এখন আর পাওয়া যায় না)। ওপেন সোর্স অনুসন্ধান পদ্ধতি, এবং অনলাইন গবেষণার টুল ব্যবহার – এই অনুসন্ধানের জন্য নিশ্চিতভাবেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু এগুলোই একমাত্র বিষয় ছিল না।
ম্যাককেইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলা, বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য জানার জন্য নতুন সূত্র তৈরি করা – এ ধরনের প্রথাগত সাংবাদিকতার কৌশলও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই প্রতারণা উন্মোচনের ক্ষেত্রে।
আরো পড়ুন
তথ্য যাচাই নিয়ে আরো রিসোর্সের লিংক পাবেন জিআইজেএন রিসোর্স সেন্টারে। আর এই গাইডে পাবেন অনলাইনে অনুসন্ধানের আরো অনেক টুলের খবর।
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ডেটা জার্নালিজম ডট কমে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
ডনি ও’সুলিভান, কাজ করেন সিএনএন-এ। তার রিপোর্টিং মূলত প্রযুক্তি ও রাজনীতি যেখানে মিশেছে, সেই জায়গা নিয়ে। সিএনএন-এর বিজনেস টিমের সদস্য হলেও, তিনি তাদের অনুসন্ধানী ইউনিটের সাথে ঘনিষ্টভাবে কাজ করেন। বিশেষ করে মার্কিন নির্বাচনের সময় অনলাইনে ছড়ানো ভুয়া তথ্য ট্র্যাক ও খুঁজে বের করায় তিনি পারদর্শী।