বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে নতুন করোনাভাইরাস। এই সংকট মোকাবিলায় কী ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা জানতে এবং কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে বিশ্বজুড়ে কাজ করে চলেছেন সাংবাদিকরা।
১০ মার্চ, এই লেখা প্রকাশের সময় পর্যন্ত, বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১,১৪,৪৫২ জন। মারা গেছেন ৪,০২৬ জন। এই তথ্য জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড মেডিসিনের কোভিড-১৯ মানচিত্র থেকে নেয়া। এই মুহূর্তে, রোগটি নিয়ে উত্তর যত, প্রশ্ন তার চেয়ে বেশি। চীনের উহান থেকে শুরু হয়ে এই রোগ এখন ছড়িয়ে পড়েছে একশর বেশি দেশে।
থমাস আব্রাহাম, স্বাস্থ্য বিষয়ক অভিজ্ঞ সাংবাদিক। তিনি সংক্রামক রোগ ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক পরামর্শক। টুয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি প্লেগ: দ্য স্টোরি অব সার্স নামের বইটি তার লেখা। খুব সম্প্রতি লিখেছেন, পোলিও: দ্য ওডিসি অব ইর্যাডিকেশন। এর আগে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের সম্পাদক ছিলেন। বিদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন দ্য হিন্দু-র হয়ে। এখন অধ্যাপনা করেন হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ সেন্টারে।
জিআইজেএন-এর জন্য আমরুতা বিয়াতনাল সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্রাহামের। এখানে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কোন প্রশ্নগুলো তোলা উচিৎ।
জিআইজেএন: এই মুহূর্তে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের ভূমিকা কী হওয়া উচিৎ?
থমাস আব্রাহাম: আমাদের প্রধান ভূমিকা সংবাদের খোঁজ করা এবং প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সেটি রিপোর্ট করা। করোনাভাইরাস মহামারিতে, যা সহজ আমরা তা-ই করছি; শুধু বড় বড় মানুষের সাক্ষাৎকার নিচ্ছি। তারা যা বলছেন, সেটাই হয়ে উঠছে প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু। সমস্যা হলো, তারা শুধু সেটাই বলছেন, যা তারা নিজেরা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। কিন্তু এর মানে এই নয়, সাধারণ মানুষও তাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছে।
আমাদের উচিৎ, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে সব কিছু ব্যাখ্যা করা। আসলেই কী ঘটছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। দেখে মনে হচ্ছে, এটি [কোভিড-১৯] নিয়ে রিপোর্টিং করা বেশ সহজ। কারণ অন্য অনেক অসুখের তুলনায় এখন এ বিষয়ে বেশি তথ্য আসছে। আমরা প্রতিদিন আপডেট পাচ্ছি, সংবাদ সম্মেলন হচ্ছে, মানুষ নানারকম কথা বলছে। ফলে অনেকের কথাই আপনি উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করতে পারছেন। সব কিছু মিলিয়ে প্রতিবেদন বানানো খুব সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু কঠিন হচ্ছে রোগের গতিপ্রকৃতি বুঝতে পারা বা বোঝার চেষ্টা করা। প্রতিদিনকার পরিসংখ্যানগুলোর অর্থ কী? কিভাবে মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ? নতুন কেউ সনাক্ত হওয়ার মানেই কি তিনি মারা যাচ্ছেন? সাংবাদিক হিসেবে, প্রথম যে কাজটি আমাদের করা দরকার, তা হলো: এই সব কিছুকে পরিস্থিতি-প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা। ব্যাপারটি সহজ নয়। কারণ মানুষ শুধু সংবাদ সম্মেলনগুলোর খোঁজ রাখছে, আর শিরোনামে আসা তথ্যগুলো দেখছে। প্রেস রিলিজ কোনো প্রতিবেদন নয়। এটি থেকে একটি প্রতিবেদনের শুরু হতে পারে মাত্র।
প্রেস রিলিজের মাধ্যমে সরকারকে উদ্দেশ্য করে অনেক বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, “দ্রুত কিছু করো।” কিন্তু সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে না, তার অর্থ কী। সংখ্যা-পরিসংখ্যানগুলো আসলে কী অর্থ বহন করছে, সেগুলো পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা এবং কোন প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তা জানা – এসব বিবেচনায় নিতে পারলেই কেবল, সেটি হয়ে ওঠে কার্যকর সাংবাদিকতা।
জিআইজেএন: এই মুহূর্তে কি স্পষ্ট কোনো ফাঁক দেখতে পাচ্ছেন আপনি?
থমাস আব্রাহাম: একটি উদাহরণ দেই। হংকংয়ে ৬৯ বছর বয়সী এক নারী সংক্রমণের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। তিনি ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিল্লিতে ছিলেন। তাঁর ডায়রিয়া হয়েছিল এবং হংকং পৌঁছানোর পর তার পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। যদি তিনি এই পুরো মাস ভারতেই থেকে থাকেন, তাহলে পরিস্কারভাবেই এই সংক্রমণটি ভারত থেকে হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই প্রশ্ন উঠে , এই সময়ে দিল্লিতে আরো কোনো সংক্রমণের রিপোর্ট এসেছিল কিনা। যদি তেমন কিছু পাওয়া না যায়, তার অর্থ কী দাঁড়ায়? এর মানে, সেখানে নজরদারির অবস্থা খুব খারাপ এবং রোগটি ছড়াচ্ছে।
এই বোঝাপড়ায় আসার পর, আপনি আরো প্রশ্ন তুলতে শুরু করবেন। কে আপনাকে কী বলছে, সেটি কোনো ব্যাপার না। আপনি কী জানতে চান, সেটিই আসল বিষয়। আর এখান থেকেই আপনি পাবেন আরো আকর্ষণীয় প্রতিবেদনের ধারণা। নাহলে শুধু বলতে হবে, “ভারতে আজ ২৩ জন নতুন রোগীর খবর জানা গেছে।”
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, এমনই। সংখ্যা-পরিসংখ্যানগুলো দেখে কোনো নির্দিষ্ট প্রবণতা খোঁজ করা, বিশেষ ঘটনাগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। এবং তারপর মানুষের কাছে গিয়ে জানতে চাওয়া যে, আপনি এগুলো কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
এই ব্যাপারগুলো এখন ঘটছে না বললেই চলে। এজেন্ডা তৈরি হয়ে যাচ্ছে সংবাদ সম্মেলন থেকে।
আরেকটি বড় ব্যাপার হচ্ছে: গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া ২০ শতাংশ মানুষদের কী ঘটছে? তারা কোথায় যাবে? হাসপাতালে কতগুলো আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর আছে? যারা এরিমধ্যে আইসিইউ-তে আছে, তাদের অবস্থা কী? এই প্রশ্নগুলো সাংবাদিকদের করা উচিৎ। এরকম আরো অনেক কিছু আছে করার মতো এবং এগুলো করাও সম্ভব।
জিআইজেএন: চীন যেভাবে এই ভাইরাসের সংক্রমন মোকাবিলা করছে, সে বিষয়ে খবরের মনোযোগ সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
থমাস আব্রাহাম: বেশিরভাগ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাই মনোযোগ দিয়েছে চীনের এই লুকোছাপা নিয়ে। যেটি আমার খুব ভালো কোনো স্টোরি বলে মনে হয় না। সবাই একমত যে, চীন বিষয়টি ভালোভাবে সামলাতে পারেনি। কিন্তু ব্যাপার সেরকম না। মানুষের মধ্যে এরকম ধারণা আছে যে, তারা আক্রান্তদের সংখ্যা লুকোচ্ছে। একেবারে শুরুর পর্যায়ে, কেউই এসম্পর্কে খুব ভালোমতো জানত না। এমনটাই জানা যাচ্ছিল যে, মানুষ নিউমোনিয়া জাতীয় কোনো অসুখ নিয়ে হাসপাতালে আসছে। আর তখন ছিল শীতকাল। নিউমোনিয়ার মৌসুম ছিল তুঙ্গে। নিশ্চিত করে বলা কঠিন ছিল যে, এদের মধ্যে ছোট একটি অংশের অসুখ অন্য কারণে তৈরি হয়েছে। তাদের রিপোর্ট রিশ্লেষণ না করে এটি বলা কঠিন ছিল। সেই বিশ্লেষণ শেষ হতে এক সপ্তাহের মতো সময় লেগেছে।
চীন তো চীনই। তারা বিভিন্ন বিষয় ধামাচাপা দেয়। কিন্তু এবার তারা তেমন কিছু করেনি। তারা যা বলেছে, তা হলো: এ সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য সরকারের তরফ থেকে আসতে হবে এবং আমরা চাই না চিকিৎসকরা এ নিয়ে কথা বলুক। সত্যি বলতে, ভারতের পরিস্থিতি তো এরচেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। আসলে, চীনের গোপনীয়তা নিয়ে প্রতিবেদন লেখাটা সহজ। আর এসব লিখতে গিয়ে আপনি সত্যিকারের ঘটনাগুলো আড়ালে রাখছেন। সেই সময়ের সত্যিকারের প্রতিবেদন হতে পারত যে, এটি কতটা গুরুতর- সে বিষয়ে খোঁজ করা। আমাদের কতটা উদ্বিগ্ন হওয়া দরকার? এবং, এই অসুখে মৃত্যুহার কেমন? হাসপাতালে যেতে হতে পারে কত শতাংশ মানুষকে?
জিআইজেএন: সার্স থেকে পাওয়া কোন শিক্ষার দিকে আমাদের নজর দেওয়া উচিৎ?
থমাস আব্রাহাম: আমি সার্স ভাইরাস ছড়ানোর সময়টির মধ্য দিয়ে গেছি। ফলে জানি এটা কেমন ছিল। মানুষ যখন হঠাৎ পড়িমরি করে জরুরি বিভাগগুলোতে ছুটছিল, তখন দেখা গেল পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্র কাজ করছে না। এখন প্রশ্নটা তুলতে হবে এই জায়গায়: “আমাদের কাছে কি এই যন্ত্রপাতি যথেষ্ট পরিমাণে আছে? এগুলো কারা বানায়? কোথায় কোথায় এগুলো বিতরণ করা হয়? এই বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দেওয়া শুরু করলে, জনসাধারণও সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ শুরু করবে। ফলে সরকারও পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।
এটি কোনো জটিল বিজ্ঞানের বিষয় নয়। এটি আসলে কেউ কী বলছে, সেখানে থেমে না গিয়ে, কোনো বিষয়কে তার যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া। এটিই সব সাংবাদিকতার পদ্ধতি। ক্রমাগত প্রশ্ন করতে থাকা: তাহলে কী, তাহলে কী? সামনের দিকে নজর রাখাও এই পদ্ধতির আরেকটি অংশ। যদি আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায়, তাহলে এক্স, ওয়াই, জেড-এরও পরিবর্তন অবশ্যই ঘটবে। সত্যিই কি তেমনটি ঘটছে?
জিআইজেএন: কোনো কাভারেজ কী আপনার বিশেষ নজর কেড়েছে?
ব্যাখ্যামূলক সাংবাদিকতার ভালো কিছু নজির দেখা গেছে। আমরা এই ভাইরাসের সংক্রমণ সম্পর্কে এত কিছু জানছি সাংবাদিকদের জন্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: এটিকে আমরা আরো কত সামনে এগিয়ে নিতে পারি? আমরা কি গল্পগুলো সামনে আনতে পারব? এগুলোই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করবে বলে আশা করা হয়।
জিআইজেএন: কোন বড় ভুলটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের এড়ানো উচিৎ?
থমাস আব্রাহাম: বড় যে ভুলটি এড়ানো দরকার, তা হলো: চট করে কোনো উপসংহারে পৌঁছে যাওয়া। তাড়াহুড়ো করবেন না। মৌলিক বিষয়গুলি বোঝার জন্য আরো সময় দিন। কথা বলার জন্য সঠিক মানুষ খুঁজে বের করুন। স্বাস্থ্য বিষয়ে খুব বেশি কাজ না করা কোনো রিপোর্টার হয়তো স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে জড়িত যে কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন, যে কোনো চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে চিকিৎসা সংক্রান্ত মানুষজন এতই বিশেষায়িত হয়ে পড়েছেন যে, দেখা যাবে সেই রিপোর্টার হয়তো এমন কারো সঙ্গে কথা বলছেন, যিনি ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানেন না। তাহলে কিভাবে সঠিক মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া যাবে? বিজ্ঞানে কোথায় কী অগ্রগতি হচ্ছে, তা জানা এখন বেশ খুব কঠিন নয় — ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও খুঁজে পাওয়া সহজ।
আর মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞান খুব দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। একই সঙ্গে এখানে অনেক অনিশ্চয়তাও থাকছে। কারণ আপনি খুব অল্পই জানছেন। এও জেনে রাখা দরকার, বিজ্ঞানীরাও প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। আরেকটি যে বড় জিনিস মাথায় রাখা দরকার তা হলো: আগামীকালই অনেক কিছু বদলে যেতে পারে। এটি সাংবাদিকদের শেখার জন্য অনেক বড় একটি সুযোগ। এবার এই বিষয়গুলো জেনে ফেলতে পারলে, পরবর্তী মহামারীর জন্য আপনি অনেক ভালোভাবে প্রস্তুত থাকবেন। আগামীতেও এমন কিছু নিশ্চিতভাবে দেখা যাবে।
আমরুতা বিয়াতনাল দিল্লি ভিত্তিক সাংবাদিক। তিনি ডেভেক্স-এর একজন সহযোগী সম্পাদক। বিশেষভাবে কাজ করেন জেন্ডার, স্বাস্থ্য ও নাগরিকত্ব নিয়ে।