সাপ্লাই চেইন, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় সরবরাহ শিকল। এটি হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট পণ্য উৎপাদন, বিতরণ ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোর একটি নেটওয়ার্ক। এই শিকলে থাকতে পারে কাঁচামাল সরবরাহকারী থেকে শুরু করে, সেই কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদনকারী, উৎপাদিত পণ্য গুদামে সংরক্ষণকারী, বাজারে বিতরণকারী এবং শেষ পর্যন্ত পণ্যটি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া খুচরা বিক্রয়কারী পর্যন্ত সব ধরনের প্রতিষ্ঠান। পোশাক, ইলেকট্রনিকস, যানবাহন, খাদ্য বা ওষুধ—পণ্য যেমন হতে পারে বৈচিত্র্যময়, সরবরাহ চেইনও ঠিক তেমনই।
পণ্য—তা সে কৃষিজাত হোক বা শিল্প—কোথা থেকে আসে বা কোথায় যায়, তার অনুসন্ধান হতে পারে রিপোর্টারদের জন্য কাজের দারুণ ক্ষেত্র। এ ধরনের অনুসন্ধান থেকে বেরিয়ে আসে জোরপূর্বক শ্রম, পরিবেশগত অপরাধ, দুর্নীতি, এমনকি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও।
তবে গুরুতর চ্যালেঞ্জ হলো, এত কিছুর মধ্যে সংযোগ খুঁজে বের করাটা।
কোনো ভোগ্যপণ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষিজমি, প্রাকৃতিক সম্পদের খনি বা শিল্পকারখানায় কাজের পরিবেশ কেমন এবং তাদের সঙ্গে সরবরাহ চেইনের সম্পর্ক কী, তা উন্মোচন করতে গেলে আপনার দরকার হবে অনেক ধরনের অনুসন্ধানী টুল।
আপনার হাতে সেই সব টুল, গবেষণার উপকরণ, রিপোর্ট এবং নানা রকম তথ্যের উৎসের খবর তুলে দিতেই জিআইজেএন তৈরি করেছে সাপ্লাই চেইন রিসোর্স পেইজ। এর বাইরেও যদি জানতে চান, পড়ে নিন জিআইজেএনের প্রাসঙ্গিক এই রিসোর্সগুলো:
বিষয়টি সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানতে চাইলে, পড়তে পারেন: লার্নিং কাস্টম ল্যাঙ্গুয়েজ টু ট্র্যাক শিপমেন্ট। অষ্টম এশিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে এটি উপস্থাপন করেছিলেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার শিক্ষক জিয়ানিনা সেনিনি। তিনি এখানে তুলে ধরেছেন কাস্টমস কোডের ব্যবহার, বিল অব লেডিং, জাহাজ অনুসরণ এবং কীভাবে পণ্যবাহী কনটেইনার ট্র্যাক করতে হয়।
এ ছাড়া দেখতে পারেন জিআইজেনের এই ভিডিও, যেখানে এপির সাংবাদিক মার্থা মেনডোজা বলেছেন, তারা মৎস্যশিল্পে দাসপ্রথার চল নিয়ে কীভাবে অনুসন্ধান করেছেন।
অনুসন্ধান হতে পারে বহুমুখী
সরবরাহ চেইন নিয়ে রিপোর্টিং করাটা নানা কারণেই চ্যালেঞ্জিং। কারণ, এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে প্রতারণা ও গোপনীয়তা। নিজেদের আড়াল করতে চাওয়া সরবরাহ নেটওয়ার্কের কর্মকাণ্ড উন্মোচন করতে গেলে দরকার হয়, উদ্ভাবনী দক্ষতা ও লেগে থাকার মানসিকতা। সরবরাহ চেইন অনেক সময় হতে পারে জটিল এবং একাধিক দেশে বিস্তৃত। ফলে সামগ্রিক চিত্র তুলে আনতে গিয়ে আপনার দরকার হতে পারে অন্য দেশের সাংবাদিকদের সহযোগিতা। এসব কারণে এ ধরনের অনুসন্ধানী প্রকল্পগুলো হয়ে উঠতে পারে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।
পণ্য সরবরাহের শিকলটিকে বুঝতে হলে আপনাকে তার প্রতিটি সংযোগ চিহ্নিত করতে হবে। অনুসন্ধানে এই কাজটিই সবচেয়ে কঠিন। শিকলের জোড়াগুলোকে খুঁজে বের করতে যেসব তথ্য দরকার হয়, তা পাওয়া যায় বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সোর্স বা উৎস থেকে। পানজিভা, পিয়ার্স বা ইনিগমার মতো বাণিজ্য-তথ্যের দরকারি সেই উৎসগুলোর ঠিকানা মিলবে জিআইজেএনের এই টুলকিটে।
সরবরাহ চেইনে ছোট-বড় নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান থাকে। একেবারে নিচের দিকের ছোট কোম্পানিগুলোর মালিক কারা, তা খুঁজে বের করাও আপনার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ অনেক দেশেই করপোরেট মালিকানার তথ্য প্রকাশসংক্রান্ত আইনগুলো দুর্বল। মালিকানার তথ্য খোঁজার জন্য সাংবাদিকেরা ওপেন করপোরেটস, ইনভেস্টিগেটিভ ড্যাশবোর্ড এবং বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস রিসোর্স সেন্টারের মতো কিছু প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন। আমাদের রিসোর্স তালিকায় তাদের পরিচিতিও তুলে ধরা হয়েছে।
সমসাময়িক উন্মোচন
জটিলতা যতই থাকুক, তার গভীরে গিয়ে সমস্যাকে তুলে আনাই সাংবাদিকদের কাজ। সরবরাহ চেইন নিয়েও এমন অনেক অনুসন্ধান হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে তেমনই কিছু উদাহরণ।
২০১৯ সালে গার্ডিয়ান ও দ্য ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ নিউজের সঙ্গে জোট বেঁধে পরিবেশবিধ্বংসী মাংস ব্যবসার খবর প্রকাশ করেছিল রিপোর্টার ব্রাজিল। মারফ্রিগ একটি ব্রাজিলিয় মাংস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। তারা ফাস্ট ফুডের দোকানে মাংস সরবরাহ করে। সাংবাদিকেরা অনুসন্ধান করে বের করেন, প্রতিষ্ঠানটি যে খামার থেকে গবাদিপশু কেনে, তারা গরু পালনের নামে অবৈধভাবে বনভূমি ধ্বংস করছে। (দেখুন সেই প্রতিবেদন)
২০১৯ সালে ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ নিউজের সংগ্রহ করা তথ্যের সঙ্গে নিজেদের তথ্য মিলিয়ে দেখেছিল জার্মানির সংবাদপত্র ওয়েল্ট এম জোনট্যাগ। তারা হিসেব করে দেখায়, জার্মানির রেস্তোরাঁ ও রিটেইল চেইনশপগুলোতে বছরে গড়ে ৪০ হাজার টন গরুর মাংস লাগে। আর এই মাংস তারা আমদানি করেছে ব্রাজিলীয় প্রতিষ্ঠান জেবিএস, মারফ্রিগ ও মিনার্ভার কাছ থেকে।
২০১৬ সালে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সাংবাদিকেরা উন্মোচন করেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মৎস্যশিল্পে দাসপ্রথার করুণ চিত্র। এই রিপোর্টের কারণে মুক্তি পেয়েছিল দুই হাজারের বেশি আধুনিক ক্রীতদাস, যারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি কোম্পানির হয়ে সাগরে মাছ ধরতেন। এপির সাংবাদিকেরা খুঁজে বের করেন, এই সামুদ্রিক মাছগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোন সুপারমার্কেটে যায়, এবং কারা সেই মাছ দিয়ে পোষা প্রাণীর খাদ্য তৈরি করে। এই অনুসন্ধানী সিরিজের জন্য, ২০১৬ সালে পাবলিক সার্ভিস ক্যাটাগরিতে পুলিৎজার পুরস্কার জেতে এপি।২০১৮ সালের জুনে সাড়া জাগানো আরেকটি অনুসন্ধান প্রকাশ করে এপি। এবার তারা দেখায়, কীভাবে বিদেশি জলসীমা থেকে ধরে আনা ইয়েলোফিন টুনা বিক্রি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে, যদিও মার্কিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দাবি ছিল, মাছগুলো নেহাতই সাধারণ ও সামুদ্রিক। এই অনুসন্ধানে এপির সাংবাদিকেরা আমেরিকার সবচেয়ে বড় মাছের বাজারে নজরদারি করেছেন, মাছবাহী ট্রাক অনুসরণ করেছেন, স্বাদ বুঝতে একজন বাবুর্চিকে সঙ্গে নিয়েছেন, মাছের ডিএনএ টেস্ট করিয়েছেন এবং তিনটি মহাদেশের জেলেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। মার্কিন এই কোম্পানির সরবরাহ চেইন খুঁজতে গিয়ে সাংবাদিকেরা পেয়েছেন বিদেশি জলসীমায় কাজ করা অভিবাসী জেলেদের। তাদের মুখ থেকেই উঠে আসে, “শ্রম আইন লঙ্ঘন, চোরাচালান এবং হাঙর, তিমি ও ডলফিন হত্যার গুরুতর অভিযোগ ।”
এবার নজর দেওয়া যাক পোশাকশিল্পের দিকে। এই খাতের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা অনেক, বিভিন্ন দেশে তদন্তও হয়েছে।
২০১৬ সালে বিবিসি একটি অনুসন্ধান করে। তারা দেখায়, তুরস্কে শরণার্থী হয়ে আসা সিরীয় শিশুদের দিয়ে পোশাক তৈরি হচ্ছে মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার এবং অনলাইন রিটেইলার আসোসের জন্য। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসের রিপোর্টার নাটালি কিট্রোয়েফ ও ভিক্টোরিয়া কিম, ২০১৭ সালে লিখেছিলেন এই প্রতিবেদন: ১৩ ডলারের একটি শার্টের নেপথ্যে ঘণ্টায় ৬ ডলার পাওয়া শ্রমিক। লেখার উপশিরোনাম ছিল, “কম মজুরিতে পোশাক বানিয়ে দায় এড়াচ্ছে ফরেভার ২১ এবং অন্য রিটেইলাররা।”
কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের চিপ তৈরিতে ব্যবহার হয় কোবাল্ট। এটি উত্তোলন করা হয় খনি থেকে। কঙ্গোর কোবাল্ট খনিতে কভাবে শিশুশ্রম ব্যবহার হচ্ছে, তা নিয়ে ২০১৮ সালে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে সিবিএস নিউজ। এ জন্য কঙ্গোর সেই খনিতে যান তাদের রিপোর্টার ডেবোরা পাট্টা। সিবিএস-এর সেই রিপোর্টে বলা হয়, “কঙ্গোর কোবাল্ট খনিতে কাজের পরিবেশ নিয়ে এতই স্পর্শকাতরতা ছিল যে, প্রতি একশ ফুট পরপর সিবিএস নিউজের দলকে থামানো হয়েছে; নিরাপত্তারক্ষীরা বারবার কাগজপত্র দেখতে চেয়েছে; যদিও আগেই অনুমতি নেওয়া ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।”
কঙ্গোতে যারা কোবাল্ট কেনাবেচা করে, তারা কখনো প্রশ্ন করেনি—এই কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে কি না। গোপন একটি ক্যামেরা ব্যবহার করে ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছিল সিবিএস। বড় বড় কোম্পানি দাবি করে, তারা এজাতীয় কোবাল্ট ব্যবহারই করে না।
ওয়ালমার্টের চীনা কারখানাগুলো কীভাবে পরিবেশ দূষণ করছে, তা তুলে এনেছিলেন অ্যান্ডি ক্রোল। ২০১৩ সালে মাদার জোনসের একটি আর্টিকেলে তিনি উপসংহার টানেন, কোম্পানির অডিটররা যেন কিছুই দেখছেন না।
মূল্যবান হতে পারে এনজিও যোগাযোগ
সরবরাহ চেইন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সাংবাদিকেরা প্রায়ই স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর সাহায্য নেন। তাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকে। একেকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে একেক খাতের তথ্য পাওয়া যায়। যেমন সিফুড, তৈরি পোশাক, খনিজ দ্রব্য, ইলেকট্রনিক পণ্য ইত্যাদি। অনুসন্ধানের জন্য প্রাথমিক তথ্য আসতে পারে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট, ইউনিয়ন, কমিউনিটি গ্রুপ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকেও।
সরবরাহ চেইন নিয়ে এনজিওগুলো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান করেছে। ২০১৮ সালের মে মাসে গ্রিনপিসের একটি রিপোর্ট ছিল সমুদ্রে মাছ ধরার পরিস্থিতি নিয়ে। সমুদ্রে দুর্দশা নামের এই রিপোর্টে দেখানো হয় করুণ কর্মপরিবেশ এবং তাইওয়ানে দূর থেকে বসে মাছ ধরার ক্ষতিকর পদ্ধতি। ২০১৮ সালের জুনে, ট্রেড ইউনিয়নগুলোর বৈশ্বিক জোট এবং শ্রম ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো প্রকাশ করে আরেকটি রিপোর্ট। সেখানে দেখানো হয় এইচএন্ডএম এর পোশাক সরবরাহ চেইনে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার চিত্র।
কখনো কখনো, সাংবাদিকেরা সরাসরি কাজ করেন অ্যাকটিভিস্টদের সঙ্গেও।
দক্ষিণ আফ্রিকার সংবাদমাধ্যম, কার্তে ব্লস কাজ করেছিল অস্ত্র চোরাচালান বিশেষজ্ঞ ক্যাথি লিন অস্টিনের সঙ্গে জোট বেঁধে। তাঁরা গন্ডার শিকারের ঘটনাস্থলগুলো ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছিলেন ব্যবহৃত বুলেট-গোলাবারুদ, যা তৈরি হয়েছে চেক রিপাবলিকে। চার পর্বের এই সিরিজ প্রযোজনা করেন জাশা সোয়েনডেনওয়াইন। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই অনুসন্ধানী প্রকল্পে রিপোর্টিং করা হয় মোজাম্বিক, পর্তুগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। নজরদারি এবং সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের। খুঁজে বের করা হয় সরকারি নথিপত্র এবং ব্যবহার করা হয় গোপন ক্যামেরা।
করপোরেট আইনের সুবিধা নিন
সরবরাহ চেইন নিয়ে গবেষণার জন্য আপনাকে করপোরেট আইন বুঝতে হবে। এসব আইনের কারণেই প্রতিষ্ঠানের মালিক ও শীর্ষ নির্বাহীরা নিয়ন্ত্রণে বা চাপে থাকেন।
করপোরেট আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য এমন আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও আইন ক্রমেই বাড়ছে। বিভিন্ন দেশের সরকার এবং এনজিওগুলোর উদ্যোগে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসার নানা পদ্ধতিও তৈরি হচ্ছে। তেমনই কয়েকটি এনজিও – নো দ্য চেইন, টার্নিং পয়েন্ট এবং করপোরেট হিউম্যান রাইটস বেঞ্চমার্ক।
করপোরেশনগুলো যেন তাদের সরবরাহ চেইনে থাকা সমস্যা খুঁজে বের করে এবং তা সমাধান করে, সে জন্য তাদের ওপর চাপ অব্যাহত আছে। আর এই কাজে তাদের সহায়তার জন্য গড়ে উঠছে অনেক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। রিপরিস্ক তাদের অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্য: “স্বতন্ত্র তথ্যপ্রযুক্তি টুল ব্যবহারের মাধ্যমে, রিপরিস্ক প্রতিদিন ৮০ হাজারের বেশি সংবাদমাধ্যম ও স্টেকহোল্ডারদের থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই ও মূল্যায়ন করে। কোনো সমস্যা বা ঝুঁকি দ্রুত চিহ্নিত করার জন্য, ১৫টি ভাষায় চালানো হয় এই যাচাই ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়া।”
কিন্তু তাদের কাছ থেকে খুব বেশি স্বচ্ছতা আশা করবেন না। এই পরামর্শকেরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে দায়বদ্ধ। সরবরাহ চেইন নিয়ে এসব করপোরেট রেকর্ড সংবাদমাধ্যমের কাছে পৌঁছায় না বললেই চলে। তবে সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে কিছু প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকদের তথ্য দিয়ে সাহায্য করে।
২০১০ ক্যালিফোর্নিয়া ট্রান্সপারেন্সি ইন সাপ্লাই চেইন অ্যাক্ট এবং যুক্তরাজ্যের ২০১৫ মডার্ন স্লেভারি বিলের মতো কিছু আইনের কারণে এখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চেয়ে বেশি তথ্য প্রকাশ করে।
এভাবে, সামনের দিনগুলোতে হয়তো স্বচ্ছতা আরও বাড়বে, এবং তার প্রতিফলন দেখা যাবে দোকানে রাখা পণ্যের তাকে।
প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বের কিছু অংশে এমন দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে যেখানে ক্রেতারা তাদের ফোন দিয়ে মোড়ক স্ক্যান করে দেখে নিতে পারছেন – পণ্যটি কোথায়, কারা, কোন পরিস্থিতিতে তৈরি করেছে। কিন্তু এ ধরনের প্রক্রিয়া আরও বিস্তৃত আকারে বাস্তবায়ন এখনো অনেক দূরের ব্যাপার।
খবরের প্রতিক্রিয়া
সংবাদমাধ্যমের কাভারেজ এই ইস্যুতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
২০১৭ সালে স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণার শেষটা করা হয়েছিল এভাবে: “এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (ইএসজি)-কে ঘিরে সংবাদমাধ্যমের নেতিবাচক প্রতিবেদন একটি প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট রিস্ক বাড়ায়।”
কখনো কখনো সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা শ্রমিকদের জীবনও বাঁচায়। এপির সাংবাদিক মার্থা মেনডোজা ও তাঁর সহকর্মীরা মিলে ১৮ মাস ধরে একটি অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন। যার ফলে ইন্দোনেশিয়ার জেলে নৌকায় ক্রীতদাসের মতো কাজ করা দুই হাজার মানুষ মুক্তি পেয়েছিলেন।
এমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমাগত ঘটতে থাকে। তাই ফলোআপ করাটা জরুরি। সাংবাদিক ও গবেষক নিকোলাস পোপ বলেন, “কখনো কখনো বিষয়টি আমাদের চোখের আড়ালেই রয়ে যায়।” তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন এভাবে: “সাধারণত দেখা যায়, বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য সরবরাহ করে, এমন কোনো কারখানায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রকাশ পেলে (ধরা যাক শিশুশ্রম নিয়ে), সত্যিকারের কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে বরং সেখান থেকে সরে পড়ে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি। তারা বড় বড় ঘোষণা দেয়। বলে, এসব তারা জানত না এবং অবিলম্বে সেই সরবরাহকারী কারখানার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করবে। তাদের আশা থাকে, কেলেঙ্কারিটা যেন এভাবে সবার অগোচরে চলে যায়।”
কিন্তু কাহিনি এখানেই শেষ হয় না। এমন ছোট ছোট কারখানার সঙ্গে বড় একটি ব্র্যান্ড চুক্তি বাতিল করলে হাজারো শ্রমিক তাদের জীবিকা হারান। এঁদের সহায়তায় কেউই কিছু করে না। যে সাংবাদিকেরা এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো উন্মোচন করছেন, তাঁদের এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, নিপীড়নের শিকার শ্রমিকদের এই দুরবস্থার অবসান ঘটানোর জন্য বড় ব্র্যান্ডগুলোই যেন পদক্ষেপ নেয়। কারণ, দাম ও পণ্য হস্তান্তরের সময় নিয়ে ব্র্যান্ডগুলো যে চাপ তৈরি করে, তা-ই সমস্যার প্রধান কারণ, বিশেষত তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে।
সরবরাহ চেইন নিয়ে রিপোর্টিং বিপজ্জনকও হতে পারে। যেমন: ইন্দোনেশিয়ার দুর্গম অঞ্চলে পাম তেল উৎপাদন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে হুমকি ও শারীরিক নিপীড়নের মুখে পড়েছেন সাংবাদিকেরা। তুর্কমেনিস্তানের তুলা শিল্পে জোরপূর্বক শ্রম নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে কারাগারে বন্দি হয়েছেন গ্যাসপার মাতালেভ। ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইট ফোরাম ও দ্য ইনডিপেনডেন্ট সূত্রে জানা গেছে, তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
এই গাইড সম্পাদনা করেছেন জিআইজেএন রিসোর্স সেন্টারের পরিচালক টবি ম্যাকিনটশ। তিনি ছিলেন ওয়াশিংটনভিত্তিক রিপোর্টার এবং ৩৯ বছর ধরে ব্লুমবার্গ বিএনএ-এর সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। অলাভজনক ওয়েবসাইট ফ্রিডমইনফো ডট ওআরজি-এর সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। এখানে তিনি কাজ লেখালেখি করেছেন বিশ্বজুড়ে তথ্য অধিকারের ব্যবহার নিয়ে। তথ্য অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, এফওআইএনেট-এর পরিচালনা পর্ষদেও ছিলেন তিনি।