ইদানিং টুইটারে কোনো কিছু নিয়ে সমালোচনা করার আগে আমি দুই বার ভাবি। কারণ সাংবাদিকদের ওপর ডিজিটাল হামলা বেশ প্রকট আকার ধারণ করেছে – তা সে অনলাইনে সংগঠিত হয়রানিই হোক, ডক্সিং (ক্ষতি করার জন্য ইন্টারনেট থেকে কারো একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করা) অথবা নানা রকমের ট্রলিংয়ের মাধ্যমে। নারী, বিশেষ করে ভিন্ন বর্ণের নারীদের জন্য হুমকিটা আরো বেশি। আমি নিজেও শ্বেতাঙ্গ নই, আর যে কোনো বিষয় নিয়ে আমার মজা করার যে স্বভাব তা-ও উদ্বেগের কারণ বটে। প্রায়ই ভাবি: এই টুইট-ই কি তাদের (তাদের মানে টুইটারের অচেনা, ছদ্মবেশী ট্রল বাহিনী) ক্ষেপিয়ে তুলবে? এবার কি আমিই ডক্সিংয়ের শিকার হবো?
দুই বছর আগে, ওপেননিউজের ডাকে সাড়া দিয়ে, আমি এবং কয়েকজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মিলে বার্তাকক্ষের জন্য একটি নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ গাইড তৈরির কাজ শুরু করি। উদ্দেশ্য ছিল, এমন পাঠ্যসূচি তৈরি করা, যার মাধ্যমে বার্তাকক্ষগুলো তাদের সাংবাদিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে পারবে। ইমেইলে আড়িপাতা (ফিশিং) থেকে শুরু করে সোর্সের সঙ্গে নিরাপদ যোগাযোগের উপায় পর্যন্ত, নানা বিষয় ছিল সেই গাইডে।
এই পাঠ্যসূচি, ডিজিটাল নিরাপত্তার মত জটিল বিষয়কে সহজে বুঝতে সাহায্য করবে সাংবাদিকদের। কর্মক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতেও ভূমিকা রাখবে অনেকটাই। আর অনলাইনে বিপদে পড়ার আগেই, নিজেকে রক্ষার পরিকল্পনা তৈরি করে নেয়া ভালো।
মনে রাখবেন, শুধু একটি প্রতিবেদনের জের ধরেই তথ্যচুরির শিকার হতে পারেন আপনি। হয়তো ভাবছেন – টুইটারে ফলোয়ার কম, তাই কেউ আপনার দিকে নজর দিবে না। ভুল করছেন। এখন যে কোনো প্রতিবেদনই মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যেতে পারে। আর যে সংবাদমাধ্যম রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে, অথবা যে সাংবাদিকরা তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা হামলাকারীদের নজরে পড়ে যেতে পারেন অপ্রত্যাশিতভাবে।
এখনো মানতে পারছেন না? পড়ুন মার্টিন শেল্টনের এই লেখা: হে সাংবাদিকগণ, আপনারাও ডেটা ব্রিচের শিকার হওয়ার যোগ্য। শেল্টন একজন ডিজিটাল নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ। তিনি কাজ করেন মূলত সাংবাদিকদের সাথে। এই বিষয় নিয়ে তিনি লেখালেখিও করেছেন অনেক।
ইন্টারনেট ও সাংবাদিকতার যোগসূত্র নিয়ে কাজ করেন, এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তাদের জিজ্ঞাসা করেছি, বার্তাকক্ষগুলো তাদের কর্মী ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকদের অনলাইন নিরাপত্তায় আরো উদ্যোগী হতে পারে কিভাবে? সেখান থেকেই জানা গেল, বড় সংবাদমাধ্যমগুলো এরই মধ্যে নিজেদের ডিজিটাল নিরাপত্তা দল তৈরি করতে শুরু করেছে। হয়রানির শিকার হলে ক্ষতি কিভাবে কমিয়ে আনা যায়, তার উপায় সম্পর্কে তারা রিপোর্টারদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে।
নিনা কাপুর, নিউ ইয়র্ক টাইমসের সিনিয়র ইনফরমেশন সিকিউরিটি অ্যানালিস্ট এবং ক্রিস্টেন কোজিনস্কি, নিউ ইয়র্ক টাইমসের ইনফরমেশন সিকিউরিটি ম্যানেজার:
নিউ ইয়র্ক টাইমসে সাংবাদিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা শেখান কাপুর ও কোজিনস্কি। ২০১৯ সালের শুরুতে, নিকার সম্মেলনের একটি সেশনে তারা প্রথমবারের মত নিজেদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন। সেখানে তাদের মূল বার্তা ছিল: আক্রমণের শিকার হওয়ার আগে নিজেই নিজেকে ডক্স করুন, যেন জানতে পারেন, আপনার কোন ব্যক্তিগত তথ্য ইন্টারনেটে রয়েছে।
কাপুর বলেন, “তথ্য খুঁজে পেতে বেশি কষ্ট হলে, ডক্সার হয়তো আপনাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কারো পেছনে লাগতে পারে।”
৯০ মিনিটের সেই কর্মশালায় তারা অংশগ্রহণকারীদের একটি “হোমওয়ার্ক” দিয়েছিলেন: নিজেদের ডক্স করা। তাঁদের আরেক পরামর্শ ছিল: কোনো সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেতে যাওয়া, এবং তাদেরকে এক বা দুই ঘন্টার এই অনুশীলনে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করা।
কোজিনস্কি বলেন, “ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকদের নিরাপত্তাও আমাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।” ভবিষ্যতে তাদের জন্যেও এসব রিসোর্স উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে কাপুর ও কোজিনস্কির। কাপুর বলেন, “কোনো ফ্রিল্যান্সার যদি যোগাযোগ করেন, আমরা তাদেরকে সহায়তা করব অবশ্যই।”
মার্টিন শেল্টন, নিরাপত্তা গবেষক, কাজ করেন সাংবাদিকদের সঙ্গে:
যেসব সাংবাদিক সোর্সের সঙ্গে নিরাপদ যোগাযোগ বা তথ্য বিনিময়ের সুরক্ষিত ব্যবস্থার মত বিষয় নিয়ে ভাবেন, তাদের জন্য বিশদ একটি গাইড লিখেছেন শেল্টন। তিনি বলছেন, নিজেকে ডক্স করা নিরাপত্তার প্রথম ধাপ মাত্র। পরবর্তী পদক্ষেপ: টাকা খরচ করে হলেও ওয়েব থেকে সেসব তথ্য সরিয়ে ফেলা। কিন্তু কে সেই টাকা কে দেবে? শেল্টন মনে করেন, টাকা বার্তাকক্ষ থেকেই আসা উচিৎ। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “পেশাগত এই বিপত্তি যখন তখন হতে পারে; বিশেষ করে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে।”
শেল্টন বলেন, বার্তাকক্ষগুলোর উচিৎ নিজেদের প্রযুক্তি অবকাঠামো পরখ করে দেখা; কিভাবে তথ্য আসছে বা যাচ্ছে, তা নিয়ে ভাবা। এটি তাদেরকে নিজ ব্যবস্থায় সম্ভাব্য দুর্বলতা খুঁজে পেতে, এবং তথ্য সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে।
কিন্তু যদি বলা হয়, এমন একটিমাত্র উপদেশ বা পরামর্শ দিন, যা সব সাংবাদিকের জন্য প্রযোজ্য! উত্তরে শেল্টন, কাপুর ও কোজিনস্কি – তিনজনই একই কথা বলেন: মাল্টি-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন, যা টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন নামে বেশি পরিচিত। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবস্থাপনা। সাংবাদিক বা বার্তাকক্ষ, সবার জন্যই এটি সুরক্ষার সহজতম পদক্ষেপ।
শেল্টন বলেছেন, “আমরা দেখছি বার্তাকক্ষের সঙ্গে তাদের সাংবাদিকদের সম্পর্ক ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। যে কেউই, যে কোনো সময় ফ্রিল্যান্সার হয়ে যেতে পারেন।” ফলে অনলাইনে নানা ডেটা ও অ্যাকাউন্ট সুরক্ষিত রাখার জন্য নিউজরুমের পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের পাশাপাশি, ব্যক্তি হিসেবেও সাংবাদিকদের উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ।
আরেকটি সহজ বিষয় আছে, যা অনেকেই পাত্তা দেন না: ডিভাইসের সফটওয়্যার আপডেট করা। শেল্টন বলেন, “আমার মনে হয় না, কেউ নিরাপত্তা সংক্রান্ত আপডেটগুলোকে খুব গুরুত্ব দেয়।”
ক্রিস গ্রান্ট, পলিগনের এডিটর ইন চিফ
ভক্স প্রোপার্টিজের ডিজিটাল নিরাপত্তা কৌশল নির্ধারণের বিষয়টি সমন্বয় করেন ক্রিস গ্রান্ট। তিনি জানান, ভক্স মিডিয়ায় সম্পাদকরাই সেসব প্রতিবেদন সনাক্ত করার চেষ্টা করেন, যার কারণে তাদের কোনো সাংবাদিক অনলাইনে হয়রানির শিকার হতে পারেন।
গ্রান্ট বলেন, “ মারপিট করতে গিয়ে মার খাওয়ার চেয়ে, অপ্রত্যাশিত ঘুষিতে ব্যাথা বেশি হয়। তাই হঠাৎ হতচকিত হওয়ার চেয়ে, আগেভাগে তৈরি থাকা ভালো।” এতে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই সম্পাদক চট করে দেখে নিতে পারেন, সেই রিপোর্টারের ব্যক্তিগত বিষয়গুলো।
গ্রান্টের মতে, সাংবাদিকরা যেন ভীতি ছাড়াই কাজ চালিয়ে যেতে পারেন, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিউজরুমের ওপরেই বর্তায়।
প্রয়োজনীয় রিসোর্সের জন্য ভক্স মিডিয়ার শীর্ষপর্যায়ের সঙ্গেও দেনদরবার করেন গ্রান্ট। তিনি বলেন, “আমরা অনেক ভালো কাজ করেছি। কিন্তু সমস্যা কমার বদলে, বরং বাড়ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি আরো হুমকি-হেনস্তা, হয়রানি ও পরিকল্পিত আক্রমণের ঘটনা।” এগুলো ঠেকাতে একজন ডিজিটাল নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু সব সংবাদমাধ্যমের এত খরচ করার সামর্থ্য নেই। গ্রান্ট বলেন, “সংবাদমাধ্যমগুলো যদি একসঙ্গে কাজ করার কথা ভাবতে পারে, সেটাই হবে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সত্যিকারের উপায়। ঝুঁকি বা হুমকি সনাক্ত করতে এবং উত্তম-চর্চা জারি রাখতে, তারা একে-অপরকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারে।”
আমান্ডা হিকম্যান, এআইআর-এ ফ্রিল্যান্স ফিউচার ইনিশিয়েটিভ-এর ডিরেক্টর
দুই বছর আগে, নিউজরুমের নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ গাইড তৈরির কাজে আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হিকম্যান। তিনি এখনো সাংবাদিক ও প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
হিকম্যানের মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুর্বল যে চর্চা দেখা যায়, তা হলো: একই পাসওয়ার্ড বারবার ব্যবহার করা বা একই পাসওয়ার্ড ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাত-আটরকমভাবে ব্যবহার করা। তিনি বলেন, “অনেকে ধরে নেয় তাদের কেউ খেয়াল করছে না। আমার কি সত্যিই দরজা বন্ধ করার দরকার আছে, সত্যিই কি কেউ বাইরের রাস্তায় হেঁটে হেঁটে দরজা পরীক্ষা করছে – বিষয়টি অনেকটা এরকম প্রশ্ন করার মতো।”
হিকম্যান অবশ্য স্বীকার করেছেন, পাসওয়ার্ডের নিরাপত্তা নিয়ে যেসব পরামর্শ পাওয়া যায়, তা দেখে অনেকে ঘাবড়ে যেতে পারেন। তিনি বলেন, “সব কিছু ঠিক রাখার কাজটি এতোই কঠিন যে, অনেকেই সেই চেষ্টা না করে, বরং হাল ছেড়ে দেন।” কিন্তু তার মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তার নিখুঁত ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেয়ে সাংবাদিকদের জন্য অনলাইন প্রাইভেসির সুরক্ষা এবং শক্তিশালী পাসওয়ার্ড বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
হিকম্যান ইদানিং কাজ করছেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকদের নিয়ে। নিউজরুমে পাকাপাকিভাবে কাজ করা সাংবাদিকদের চেয়ে তাদের নিরাপত্তা-ঝুঁকির ধরণ আলাদা।
বার্তাকক্ষের উচিত: নিজেদের রিসোর্স (প্রশিক্ষণ, সহায়তা ইত্যাদি) ফ্রিল্যান্স লেখক ও সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেয়া। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোনো গণমাধ্যম ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে প্রশিক্ষণ আয়োজন করে, সেখানে তারা ফ্রিল্যান্সারদেরও অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। হিকম্যানের আরেকটি পরামর্শ হলো: যে সম্পাদকরা সরাসরি ফ্রিল্যান্সারদের সঙ্গে কাজ করেন তাঁদের উচিত, প্রয়োজনীয় রিসোর্সগুলোর কথা মাথায় রাখা এবং কোনো ফ্রিল্যান্সার অনলাইনে হামলা-হুমকির মুখে পড়লে, সেগুলো তাদের সঙ্গে শেয়ার করা।
আরো কিছু রিসোর্স
আশা করছি এই লেখা ফ্রিল্যান্সার, বার্তাকক্ষে কাজ করা রিপোর্টার এবং সম্পাদকদের কাজে আসবে। এখান থেকেই কেউ হয়তো নিজের ব্যক্তিগত ডিজিটাল নিরাপত্তার চর্চা আরো উন্নত করার উপায় খুঁজে পাবেন, কেউ কর্মীদের জন্য নতুন প্রশিক্ষণ আয়োজনের চিন্তা করবেন, এখান থেকেই হয়তোবা তাদের মনে জন্ম নেবে নতুন নতুন প্রশ্ন।
নিচে, সাংবাদিকদের জন্য আরো কিছু রিসোর্স রইলো। এগুলোই যে পুরোপুরি নিরাপত্তা দেবে তা নয়, কিন্তু শুরুর জন্য যথেষ্ট।
রিসোর্স:
অনলাইন হ্যারাসমেন্ট ফিল্ড ম্যানুয়াল (পেন আমেরিকা)
ডিফাইনিং অনলাইন হ্যারাসমেন্ট (পেন আমেরিকা)
হোয়াট টু ডু? হোয়্যার টু গো? (ট্রলবাস্টারস)
হাও টু ডেটার ডক্সিং (নিম্যান রিপোর্টস)
ফিল্ড গাইড টু সিকিউরিটি ট্রেনিং ইন দ্য নিউজরুম
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ওপেননিউজ প্রজেক্ট সোর্স-এ। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
এমা কেরু গ্রোভাম নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক সাংবাদিক ও প্রযুক্তিবিদ। তিনি ওপেননিউজের নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ গাইড তৈরিতে কাজ করেছেন। এর আগে তিনি দ্য ডেইলি বিস্টের প্রোডাক্ট ম্যানেজার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজিং এডিটর ছিলেন। এছাড়া নিউ ইয়র্ক টাইমসে তিনি কাজ করেছেন স্টাফ এডিটর হিসেবে।