অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে কাজ করাটা এমনিতেই কঠিন; আর তিনি যদি হন নারী, তাহলে সঙ্গে যোগ করে নিতে পারেন জটিলতা ও হয়রানিসহ চ্যালেঞ্জের বাড়তি কিছু স্তর। অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে নারীদের কত রকমের চাপ সামাল দিতে হয়, তা ছিল একাদশ গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে আলোচনার অন্যতম বিষয়। গত সেপ্টেম্বরে, জার্মানির হামবুর্গে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।
পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় এই মিলনমেলা বসে প্রতি দুবছর পরপর। জিআইজেএন–এর সঙ্গে এবছর এই সম্মেলন আয়োজনের সহযোগী ছিল নেটওয়ার্ক রিসার্চ ও ইন্টারলিংক অ্যাকাডেমি। এবার ছিল রেকর্ডগড়া উপস্থিতি। ১৩০টি দেশ থেকে অংশ নিয়েছিলেন ১৭০০ সাংবাদিক। বক্তা ও অংশগ্রহণকারী; দুই ক্ষেত্রেই ছিল জেন্ডার সমতা। আয়োজক কমিটিতে ছিল নারীদের আধিক্য। কর্মক্ষেত্রে নারী সাংবাদিকদের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ছিল একাধিক সেশন। স্মারক বক্তৃতা পেশ করেন একজন নারী। আর সম্মেলনের পুরো সময়ে ছিল শিশু–দিবাযত্নের ব্যবস্থা।
গোটা বিশ্বেই নারী সাংবাদিকরা গুরুত্বপূর্ণ সব অনুসন্ধান করে চলেছেন। এই পরিসরে নারী রিপোর্টারের সংখ্যা বাড়ছে। কোথাও কোথাও তারা আছেন গুরুত্বপূর্ণ পদে। এত কিছুর পরও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনেক কিছু করা বাকি রয়ে গেছে। সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে নারীদেরকে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে চড়া মূল্য দিতে হয়। কাজ করতে হয় বেশি সময়, ভুগতে হয় উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায়। তাই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় নারীদের অনুপ্রেরণা–যোগানো কাজ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার আগে, তাদের পেশাগত চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কথা বলা বেশি জরুরি।
টিকে থাকার কৌশল
এবারের সম্মেলনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত সেশনগুলোর একটি ছিল ১০ জন নারী অনুসন্ধানী সাংবাদিককে নিয়ে। সেখানে তাঁরা অকপটে তুলে ধরেছেন নিজ নিজ অভিজ্ঞতা। আলোচনা করেছেন, সাংবাদিকতার বর্তমান হাল, সেখানে নারীদের অবস্থা, আর এমন পরিস্থিতিতে “টিকে থাকার কৌশল” নিয়ে।
আর কর্মক্ষেত্রে তারা যেসব তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, সেখানে যৌন সহিংসতাও আছে।
জাপানের সংবাদকর্মী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা শিওরি ইতো। কর্মজীবনে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক সিনিয়র সাংবাদিকের হাতে। সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হয়েছেন। নিজের জীবনের এমন অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেছেন ব্ল্যাক বক্স নামের একটি বইয়ে। জাপানের গণমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে পুরুষের আধিপত্য কতটা প্রবল, তার দুঃসহ বর্ণনা আছে বইটিতে। সম্মেলেনের সেই সেশনে তিনি জানান, সাংবাদিকতা ধরে রাখতে তাকে শেষপর্যন্ত ছাড়তে হয়েছে জাপান, এখনো চলছে অপপ্রচার, আর ধর্ষণের অভিযোগ যার বিরুদ্ধে সেই ব্যক্তিই উল্টো মামলা করেছেন ইতোর নামে।
এই লড়াইয়ে কেউই পাশে ছিলেন না ইতোর। যদিও আশা ছিল, অন্তত জাপানের গণমাধ্যমগুলো সংহতি জানাবে। তিনি অবশ্য এও বলেন, “গল্পটা হয়তো ব্যক্তিগত, আর সামাল দেয়াও কঠিন ছিল। কিন্তু এখন আমাদের হাতে নানা রকম টুল আছে, আর আছে অনুসন্ধান করার সামর্থ্য। এটাই আমাদের শক্তি।” ইতো জানান, ব্যক্তিজীবনে তিনি যে ট্রমার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, তা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং অন্য নারী সাংবাদিকদের সহমর্মিতা।
ফিনিশ ব্রডকাস্টিং কোম্পানি, ইল–এর অনুসন্ধানী সাংবাদিক মিন্না নুস–গালানের অভিজ্ঞতা আরেক রকম। তাকে প্রকাশ্যে “অনভিজ্ঞ মেয়ে রিপোর্টার” বলে ডাকা হত, যদিও গালানের বয়স প্রায় ৪০, আর অভিজ্ঞতাও ব্যাপক। এই সেশনে তিনি জানান – গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, দুর্নীতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের নানা সূচকে ফিনল্যান্ডের নাম ওপরের দিকে থাকলেও, নারীর প্রতি অবমাননার বিষয়টি সেখানে শেকড় গেড়ে বসে আছে। যেসব সমাজে নারী ও পুরুষকে সমান বলে মনে করা হয়, সেখানেও সেক্সিস্ট মন্তব্য ও আচরণ নিয়ে প্রতিবাদ করা কঠিন। সাম্প্রতিক মিটু আন্দোলন এটি আরো স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে।
নারীর প্রতি অবমাননা ও যৌন নিপীড়ন ছাড়াও, মানসিক চাপে ভোগার বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে তাদের গল্পে। সংঘাত বা সহিংসতার কাভার করতে গিয়ে, যে কোনো সাংবাদিকই ট্রমার শিকার হতে পারেন।
মেক্সিকোর কুইন্তো এলিমেন্তো ল্যাবের সহ–প্রতিষ্ঠাতা মার্সেলা তুরাতি জানিয়েছেন, তার নিজের এবং নারী সহকর্মীদের অভিজ্ঞতা। বলেছেন, মাদক যুদ্ধের শিকার হওয়া মানুষদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তারা কিভাবে সামলেছেন ভীতি, যন্ত্রণা, আর অন্তহীন দুঃস্বপ্ন।
নারী রিপোর্টাররা নিউজ ম্যানেজারদের কাছ থেকে ভয়ের বিষয়টি আড়াল করে যাচ্ছিলেন, যাতে কেউ তাদের দুর্বল না ভাবে। শঙ্কা ছিল, ভয়ের কথা জানালে অন্য বিটেও পাঠিয়ে দেয়া হতে পারে। হালকা হয়ে নিতে তারা প্রতিদিনই মদ্যপান করতেন, আর পানশালায় গিয়ে নিজেদের অনুভূতির কথা সহকর্মীদের বলে ফেলতেন। তুরাতি ও তার নারী সহকর্মীরা বুঝতে পারছিলেন, এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে, তাদেরকে আরো ভালো কৌশল বের করতে হবে।
এরপর তারা খোলামেলাভাবে নিজেদের মধ্যে কথা বলা শুরু করলেন, তাৎক্ষণিক বার্তা আদানপদানের জন্য নিজেদের মধ্যে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও খুলে নিলেন। নারী রিপোর্টারদের জন্য তারা তৈরি করলেন “ইমোশনাল ডেডলাইন,” যাতে গণকবরের সন্ধান বা এধরণের পীড়াদায়ক বিষয় নিয়ে কাজের সময় সাংবাদিকরা প্রয়োজনমত বিরতি নিতে পারেন। তারা সবাই মিলে দেখা করতেন শিশুবান্ধব জায়গায়; সনা বা তেমাজচ্যালেসে স্নান করতে যেতেন একসাথে, নির্ভার পরিবেশে সময় নিয়ে একে অপরের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতেন; একবার তো আধ্যাত্মিক সহযোগিতা পেতে শামানদেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মানসিক চাপ, যন্ত্রণা ও সহিংসতা সামলে ওঠার অনেক “নন–মাচো” পদ্ধতি আছে, যা নারী–পুরুষ সবার জন্যই প্রযোজ্য – তুরাতি শেষ করেন এই কথা বলে।
আসল গল্প
জার্মানি ভিত্তিক বাজফিড নিউজের রিপোর্টার জুলিয়ান লোফলার যৌন সহিংসতা নিয়ে রিপোর্টিং করতে গিয়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলেন, আর এই ক্লান্তি নিয়ে ভুগছিলেন অপরাধবোধে। এখান থেকেই রিপোর্টারদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার চিন্তা আসে তার মাথায়। তিনি গুরুত্ব দেন দুটি বিষয়ে – একজন নারী সাংবাদিককে অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হবে; এবং সব সময় চিন্তা করতে হবে নিজেকে রিপোর্টার হিসেবে সক্রিয় রাখতে হলে কী করতে হবে। লোফলারের অভ্যাস হলো, কোনো স্টোরির সাথে যারা জড়িত, তাদের তালিকা করে রাখা। প্রতিবেদন প্রকাশ হতেই, তালিকা ধরে স্টেকহোল্ডারদের কাছে সেটি পাঠিয়ে দেন তিনি। তারাই প্রতিবেদনটিকে আরো বড় পরিসরে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। এরপর তিনি অপেক্ষা করেন রিপোর্টের প্রভাব দেখার জন্য, যেখান থেকে গল্পটি আরো সামনে এগিয়ে যেতে পারে।
মানসিক চাপ, বেশি কাজের বোঝা, আর অস্থিরতার মত সমস্যা উঠে আসে মিরান্ডা প্যাট্রুচিচের কথায়ও।
“তোমরা কী আমার ইন্সটাগ্রাম স্টোরি শুনতে চাও, নাকি আমার আসল কাহিনী?” – প্যাট্রুচিচ তার কথা শুরু করেন এভাবে।
তিনি তুলে ধরেন, প্রতিদিন লম্বা সময় ধরে কাজ করে, আর কঠিন বিষয় নিয়ে একটানা দীর্ঘদিন অনুসন্ধান করতে করতে কিভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। এর জের ধরে স্মৃতিশক্তি হারানো, আতঙ্কিত হয়ে পড়া, মনোযোগ দিতে না পারা, অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়াসহ নানা উপসর্গ দেখা দিতে থাকে একে একে।
প্যাট্রুচিচ, বসনিয়া ভিত্তিক অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের অনুসন্ধানী রিপোর্টার ও আঞ্চলিক সম্পাদক। মধ্য এশিয়া নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনে কাজ করেছেন এবং বেশ কিছু পুরস্কার জিতেছেন। কিন্তু একই সময়ে মানসিক চাপ, লম্বা সময় ধরে কাজ করা ও নিজের ওপর অনেক বেশি প্রত্যাশা থাকায়, তাঁর মনে হয়েছিল তিনি “ভেঙেচুরে যাচ্ছেন”। সবচে বড় স্বীকৃতি ও সাফল্য পাওয়ার মুহূর্তে তাঁর এমনটা আরো বেশি মনে হত বলেও জানিয়েছেন। তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং সেখান থেকে ফিরে আসার জন্য তাঁকে ছয় মাসের ছুটি নিতে হয়েছিল। এখন তিনি শিখে গেছেন কিভাবে দ্রুতগতিতে কাজ করতে হয় এবং ঘুমিয়ে নিতে হয়। এটাও জেনেছেন, “সব সময়” নিখুঁত হওয়া সম্ভব নয়।
নুস–গালানও বলেছেন, অনুসন্ধান করতে গিয়ে কিভাবে মানসিক চাপ সামলাতে হয়। তিনি এই চাপের নাম দিয়েছেন “শিটস্টর্মস।” তাঁর পরামর্শ হচ্ছে: কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করার সময়, “সব কিছু লিখে রাখুন”; সমালোচনা আসবেই, কিন্তু তাকে শুধু নিজের মধ্যে রেখে দিবেন না। বাজে ভাষায় আক্রমণ করে লিখা ইমেইলগুলো নিউজ ম্যানেজার ও সহকর্মীদের সঙ্গে শেয়ার করুন। ভালো বসদের উচিৎ রিপোর্টারের ওপর এসব সমালোচনার বাজে প্রভাব প্রশমনের চেষ্টা করা। অন্য সহকর্মীরা এমন পরিস্থতিতিতে পড়লে, তাদের পাশে দাঁড়ান। আর দুর্দান্ত সব নারী অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কাজের কথা মনে করুন।
এই শেষ পরামর্শটা অনেকবারই উঠে এসেছে আলোচনায়।
জার্মানির নিউজরুমগুলোতে নারী সাংবাদিকদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হচ্ছে, তা খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন লোফলার। তিনি দেখেছেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নিয়ে একধরণের ছাঁচেঢালা মনোভাব কাজ করে অনেকের মধ্যে। তারা ধরে নেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা খুব অকুতোভয় হবেন, একা একা সমস্ত দুনিয়া ঘুরবেন, আর বড় বড় সব খবর নিয়ে হাজির হবেন, ইত্যাদি। এই ধারণা ভেঙে দেয়া খুব জরুরি বলে মনে করেন লোফলার। তিনি বার্তাকক্ষে সাংবাদিকদের সহায়তা করার জন্য পেশাদার মনোবিশেষজ্ঞের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেন। জোর দেন ছুটি কাটানো, কিছু সময় ইন্টারনেটের বাইরে থাকা, এবং বাগান পরিচর্যার মতো নিজের একান্ত কাজে সময় দেওয়ার প্রতি। তার মতে, সবারই “কিছু সময় থেমে থাকা” জরুরি।
মানসিক ও শারীরিক হুমকি থেকে নিজেকে রক্ষা করার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন আশা মুইলু। তিনি একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও কেনিয়ার সিটিজেন টিভির স্পেশাল প্রজেক্ট এডিটর।
বিপজ্জনক বিষয় নিয়ে রিপোর্টিংয়ের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন মুইলু। জানান, কারো সহযোগিতরা ছাড়া কাজ করতে গিয়ে তিনি কতবার গুরুতর বিপদে পড়েছিলেন। কয়েকবার এমন বিপদে পড়ার পর সচেতন হন তিনি। বলেন, এখান থেকে তার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো: বেপরোয়া হওয়া যাবে না।
“আমাকে না বলা শিখতে হয়েছে,” বলেন মুইলু। অনুসন্ধান করার জন্য যদি পর্যাপ্ত অর্থ না থাকে, তাহলে না বলুন। একা একা কাজ করবেন না (তিনি একজন ঘনিষ্ঠ পুরুষ সহকর্মীকে সাথে নিয়েছেন), কমিউনিটি গড়ে তুলুন আর নিজের নিরাপত্তার জন্য নিজেই দায়িত্ববান হন। মুইলুর ভাষায়, “শেষপর্যন্ত এটা আপনার জীবনের ব্যাপার। স্টোরিটা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আপনি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
নিজের সাথে কথা বলুন
আলেহান্দ্রা জানিক ফন বেরট্রাব, মেক্সিকোর কুইন্তো ইলিমেন্তো ল্যাবের সহ–প্রতিষ্ঠাতা। তিনি “চিন্তাশীলতাকে” খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। তার পরামর্শ– থামুন, অনুসন্ধানের প্রতিটি পর্যায় নিয়ে সতর্কভাবে চিন্তা করুন, আপনার নিজের মন কী বলছে শুনুন, তাতেই মনোযোগ দিন। তিনি বলেন, অনুসন্ধানের মাঝপথে যখনই কোনো সফলতা আসে, উদযাপন করুন, তা–সে যত ছোটই হোক। অনুসন্ধানে চড়াই–উৎরাই আসবে, তাকে বরণ করে নিতে হবে এভাবেই।
কম্পিউটারের সামনে অনেক ডেটা, নথিপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করাটা জরুরি। কিন্তু বেরট্রাবের মতে, “দারুন ঘটনাগুলো পাবেন চলার পথেই”— সেশনে আসা সবার জন্য এটাই ছিল তার আন্তরিক পরামর্শ। তিনি মনে করেন, যেসব নারী সাংবাদিকদের সন্তান নেই, তাঁরা প্রায়ই বেশি করে কাজ করেন, কারণ তাঁদের সন্তানের দেখভাল করার জন্য থামতে হয় না। কিন্তু এই বেশি কাজ নিয়েও সতর্ক হবার পরামর্শ তার।
অবশ্য, মা হয়ে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার চ্যালেঞ্জও অনেক।
এপির পুলিৎজারজয়ী রিপোর্টার মার্থা মেনডোজা বলেছেন তাঁর “একান্ত আলাপচারিতার” অভিজ্ঞতা। তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে একান্তে কথা বলেন পেশাগত কাজ ও মাতৃত্বের বিষয়টি একসঙ্গে সামাল দেওয়ার উপায় নিয়ে। মার্থার নিজের সন্তানরা এখন বড় হয়ে গেছে। কিন্তু যখন তারা ছোট ছিল, তখন তিনি প্রায়ই তাদের সঙ্গে নিয়ে চলে যেতেন বিভিন্ন রিপোর্টিংয়ের কাজে। অবশ্য সেটা যদি বিপজ্জনক না হয়, তাহলেই। কারো সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তিনি সন্তানকে রাখতেন স্থানীয় কোনো বেবিসিটারের কাছে। আবার কখনো কখনো সন্তানকে নিজের কাছেই রেখেই সারতেন সাক্ষাৎকার নেওয়ার কাজ।
সন্তানকে নিয়ে যখন ফেসবুকের তৎকালিন ভাইস প্রেসিডেন্ট শেরিল স্যান্ডবার্গের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি মেনডোজাকে বলেছিলেন, “ বিশ্বাসই হচ্ছে না আপনি বাচ্চা সঙ্গে করে এসেছেন।” স্যান্ডবার্গ তাঁর কন্যাশিশুকে একটি বই আর একটি টি–শার্টও উপহার দিয়েছিলেন। মেনডোজা জানিয়েছেন, জীবনসঙ্গীর সহায়তা ছাড়া (যিনি ঘরে থেকে বাচ্চাদের দেখাশোনা করেন) তিনি নিজের কাজ এভাবে করে যেতে পারতেন না। তার মতে, পেশাগত কাজ ও পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য করার অনেক উপায় থাকলেও, শেষপর্যন্ত অফিসের সহকর্মীদের সহায়তা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
অবশ্যই, কর্তৃপক্ষ এবং প্রতিষ্ঠানের সমর্থন পাওয়াও সমান জরুরি।
যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস নিউজের সিক্সটি মিনিট অনুষ্ঠানের প্রযোজক, ওরিয়ানা জিল ডি গ্রানাডোস তাঁর নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রশংসা করেন। বলেন, সেখানে প্রযোজকদের অর্ধেকই নারী, আর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের অনেক সহযোগিতা করা হয়। প্রতিবেদনের জন্য নারী–ঘনিষ্ট বিষয়বস্তু বাছাই এবং নারীদের সাক্ষাৎকার গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করার মত বিষয় নিয়েও কথা বলেন তিনি।
নারীকর্মী নিয়োগে ফিলিপািইনের র্যাপলারের ইতিহাস বেশ পুরনো। প্যাট্রিসিয়া ইভানজেলিস্তা তাদেরই একজন। তিনি র্যাপলারকে বর্ণনা করেছেন “একটা মাতৃতান্ত্রিক পরিবার” হিসেবে। সেখানে ইভানজেলিস্তা কাজ করেছেন মাদকবিরোধী যুদ্ধ নিয়ে, যা এক পর্যায়ে বেশ পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে।
তিনি নিজ প্রতিষ্ঠানের নিউজ ম্যানেজারদের বর্ণনা করেছেন, “খুব ভালো, দেখভালকারী আন্টি হিসেবে – আপনি মানসিক আঘাত, চাপ, এমনকি পিরিয়ডজনিত জটিলতায় ভুগলেও তারা সেটি বুঝতে পারেন। তাঁরা এও বুঝে যান, কখন আপনার বিশ্রাম বা ছুটি দরকার হবে।” ইভানজেলিস্তা জানান, র্যাপলারের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নীতিমালা বেশ কঠোর, যৌক্তিক; আপনি তারওপর আস্থা রাখতে পারেন। তাঁর পরামর্শ ছিল খুব পরিস্কার: রিপোর্টারদের এমন নিউজ ম্যানেজার দরকার, যারা সাংবাদিকসুলভ তীক্ষ্ণ দৃষ্টির পাশাপাশি সহযোগিতার মনোভাব ও যত্নবান হওয়ার সংস্কৃতি লালন করবে।
৯০ মিনিটের এই লাইটনিং রাউন্ড দেখতে দেখতেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এখান থেকেই আমরা বুঝতে শেখে “একটু বিশ্রাম নেবার জায়গা” কতটা জরুরি, জানতে পারি আরো অনেক কিছু। বেরট্রাব স্বীকার করেন, যখন তাঁকে এই সেশনে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন তিনি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: “কেন নারীদের জন্য একটা আলাদা সেশন দরকার হলো?” কিন্তু পরে তিনি অবাক হয়ে দেখেছেন, নারীরা একে–অপরের কাছ থেকে কত কিছু শিখতে পারে। ইতোও বলেছেন, সেশনটি তাঁকে অনেক শক্তি জুগিয়েছে।
এখান থেকে আমাদের সবারই শেখার আছে। (এই সেশনের পুরো ভিডিওটি পাবেন এখানে।)
বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক
একই দিনে ছিল একটি নেটওয়ার্কিং সেশন। তাতে অংশ নিয়েছিলেন ১০০–র বেশি নারী সাংবাদিক। সেশিনটি আমি সঞ্চালনা করি, নম্রতা শর্মার সঙ্গে যৌথভাবে। তিনি নেপালের সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম–এর প্রেসিডেন্ট। সে সময় নম্রতা আমাকে বলেছিলেন, তিনি “অংশগ্রহণকারীদের অনুভূতি ও পারস্পরিক আস্থার বিষয়টি দেখে অভিভূত।” তিনি বলেছেন, “এখানে যারা অংশ নিয়েছেন সবাই নিশ্চিতভাবে একটা বিষয়ে একমত। আর তা হলো: নারী সাংবাদিকদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, এবং পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় নিজেকে আরো যোগ্য প্রমাণ করতে হয়। আমরা কত অভিজ্ঞ বা যোগ্যতাসম্পন্ন, তাতে কিছু যায় আসে না।”
নেটওয়ার্কিং সেশনে গুরুত্বপূর্ণ যেসব বিষয় উঠে এসেছে, এগুলো তার মধ্যে অন্যতম:
- জেন্ডার বৈষম্য ও অসমতা বিদ্যমান এবং ব্যাপকভাবে;
- সংবাদ ব্যবস্থাপনায় নারী নেতৃত্বের অভাব রয়েছে;
- অনলাইন–অফলাইন, দুই ক্ষেত্রেই নারী সাংবাদিকদের হয়রানির শিকার হতে হয়
- নারীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে বাস্তব সমস্যা অনেক;
- যৌন হয়রানি, নিপীড়ন ও বৈষম্য প্রতিরোধে নীতিমালার অভাব রয়েছে প্রতিষ্ঠানে;
- জেন্ডার সমতা অর্জনের জন্য সক্রিয় উদ্যোগ ও তার প্রয়োগ প্রয়োজন এবং তাতে উত্তমচর্চা ও উন্নতমান নিশ্চিত করতে হবে।
- ভাষার ব্যবহারও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। তথাকথিত “নারীদের ইস্যু” বিবেচনায় নিতে হবে, এবং তাদেরকে “সফট স্টোরি” ক্যাটেগরিতে ঠেলে দেওয়া যাবে না।”
- এসব ইস্যুকে সামনে আনতে নারী সাংবাদিকদের অ্যাসোসিয়েশন ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে;
- অবস্থার পরিবর্তনে বিভিন্ন টুলের প্রচলন ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে; যেমন, সুইজারল্যান্ডে নারী সাংবাদিকদের নিয়ে জরিপ, যা পরিবর্তনের পক্ষে অকাট্য প্রমাণ তুলে এনেছে;
তালিকাটা দেখে লম্বা মনে হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, দুই সেশনে উপস্থিত নারীরা – এবং আরো অনেকে – নারী রিপোর্টারদের অবস্থা উন্নয়নের জন্য খুব মন দিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন।
জেন্ডার বিষয়ক তথ্য এবং প্রাসঙ্গিক খবর শেয়ার করার জন্য একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার দাবি এসেছে জোরালোভাবে। এটা এমন জায়গাও হতে পারে যেখানে নারী অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কর্মকাণ্ড আরো বেশি প্রচার পেতে পারে, উদযাপিত হতে পারে। আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, জিআইজেএন এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছে।
পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে পারি, জিআইজেএন সম্প্রতি নারী সাংবাদিকদের জন্য একটি গাইড প্রকাশ করেছে। এখানে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক নানা নেটওয়ার্কের খবর, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, বৈষম্য ও নিপীড়ন, মেন্টরশিপ, অনুদান, ফেলোশিপ, পুরস্কার, নারী বিশেষজ্ঞ এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় নারীর বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই গাইড আরো উন্নত করা সম্ভব। নতুন বিষয়, সুপারিশ বা পরামর্শ সম্পর্কে জানালে, তাকে স্বাগত জানাবে জিআইজেএন।
আমাদের সম্মেলনে এবং সম্মেলনের বাইরে অন্যান্য কাজে, কিভাবে নারীদের আরো ভালোভাবে তুলে ধরা যায়, সেই ভাবনাও জানাতে পারেন। (আমাদের মেইল করুন এই ঠিকানায়: hello@gijn.org)
অ্যান কোক, জিআইজেএন–এর প্রোগ্রাম ডিরেক্টর। এর আগে প্রায় ২০ বছর কাজ করেছেন বিবিসি নিউজ–এ। ইংলিশ ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৭ সাল পর্যন্ত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল–এর পরিচালক ছিলেন।