ভুয়া-তথ্য কোনো সীমানা মানে না। এক দেশ থেকে অন্য দেশে তার অবাধ বিচরণ। কখনো ভিডিও, কখনো বা অপ্রাসঙ্গিক মিম – এমন নানা উপায়ে তারা ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশে, ক’দিন পরপর ফিরে ফিরে আসে।
ভুয়া-খবর ছড়ানোর পদ্ধতিতে মিল যেমন আছে, তেমনি অঞ্চলভেদে কিছু বৈচিত্র্যও আছে। ভুয়া-তথ্য ছড়ানোর পদ্ধতি প্রায়ই নির্ভর করে নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত অবস্থার ওপরে। একারণে, ভুয়া খবর সামাল দিতে যাচাইকারীদের দেশভেদে আলাদা টুলও প্রয়োজন হতে পারে।
হামবুর্গে, ১১তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে এসেছিলেন সেনেগাল, তুরস্ক ও ভারতের ফ্যাক্টচেকাররা। সেখানে তারা ব্যাখ্যা করেছেন নিজ নিজ দেশে প্রচলিত ভুয়া-তথ্য যাচাইয়ের কৌশল ও পদ্ধতি নিয়ে।
তারা কথা বলেছেন, রিভার্স ইমেজ সার্চ, ভিডিও ভেরিফিকেশনসহ তথ্য যাচাইয়ের প্রয়োজনীয় টুল নিয়ে। সেখানেই দেখা গেছে, দেশ ভেদে ভুয়া-তথ্য যাচাইয়ের টুলও কতটা আলাদা হতে পারে।
তুরস্ক
তুরস্কে ভুয়া রাজনৈতিক লিফলেট বিতরণের প্রবণতার কথা জানিয়েছেন তথ্য যাচাই প্ল্যাটফর্ম তেয়িত-এর সম্পাদক গুলিন কাভুস। সাধারণত প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল বা নেতাদের নিয়ে মজা বা তাদের হেয় করার জন্য এগুলো ছড়ানো হয়। কাভুস বলেছেন, “আমরা একে বলি বিষম প্রচারণা। তুরস্কে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার সময় এটি খুবই সাধারণ একটা পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার শুরু ২০১৬ সাল থেকে।”
এই লিফলেটগুলোর সত্যতা যাচাই করা কঠিন। ফলে তেয়িত ফিরে গেছে প্রথাগত রিপোর্টিং পদ্ধতিতে: রাস্তায় গিয়ে তারা এগুলো নিয়ে সরাসরি কথা বলেছেন মানুষের সাথে। লিফলেটটি প্রচারের সাথে কোনো দল জড়িত কিনা, তা যাচাইয়ের জন্য তারা ফোন দিয়েছেন পার্টি অফিসে।
কাভুস জানিয়েছেন, তুরস্কে ভুয়া রাজনৈতিক তথ্য ছড়ানোর আরেকটি প্রচলিত উপায় হলো ছবি ওলটপালট করা। রাজনীতিবিদদের ছবিতে নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা ফাতেউল্লাহ গুলানের মতো বিতর্কিত ব্যক্তির ছবি জুড়ে দেয়া হয়। তার পর বলা হয়, সেই বিতর্কিত ব্যক্তির সঙ্গে নেতাটির যোগাযোগ আছে। এভাবে মূলত, বিরোধী রাজনীতিকদের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়।
এসব কারণে তুরস্কের তথ্য যাচাইকারীদের কাছে ইয়ানডেক্স বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। রাশিয়ান এই সার্চ ইঞ্জিনে শক্তিশালী ফেসিয়াল রিকগনিশন অপশন আছে। ছবি সার্চের জন্য কাভুসের দ্বিতীয় সেরা পছন্দ মাইক্রোসফটের সার্চ ইঞ্জিন বিং। কারণ এখানে ছবির নির্দিষ্ট অংশ ধরে সার্চ করা যায়। যেমন, কোনো ব্যক্তির পরিচয় জানতে, আপনি শুধু তার মুখটুকু ধরে খুঁজতে পারবেন।
রাজনৈতিক মিছিল বা সমাবেশে কত মানুষ হয়েছে, তা নিয়ে নানা বিভ্রান্তিকর দাবি ছড়ানো হয় তুরস্কে। এমন খবর যাচাইয়ের জন্য ফোরস্কয়ার নামের একটি টুল ব্যবহার করে তেয়িত। এই লোকেশন শেয়ারিং অ্যাপ দিয়ে তারা আগে যাচাই করেন, ইভেন্টটি কোথায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারপর, ওপেন সোর্স প্ল্যাটফর্ম ম্যাপ চেকিং ব্যবহার করে তারা হিসেব করেন, সর্বোচ্চ কত মানুষ সেই জায়গায় একত্রিত হতে পারে। এভাবে তেয়িত বের করে, জনসভায় মানুষের সংখ্যা কতটা বাড়িয়ে বলা হয়েছে।
ভারত
ভারতীয় তথ্য-যাচাই প্রতিষ্ঠান বুম, ইন্ডিয়াস্পেন্ড ও ফ্যাক্টচেকার-এর প্রতিষ্ঠাতা গোভিন্দ ইথিরাজ। তাঁর মতে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রে ভুয়া তথ্যের ব্যাপক বিস্তার ঠেকানো একটি প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশজুড়ে বেশ কয়েকটি ভাষা প্রচলিত। তাই ভুয়া তথ্যের সঙ্গে পাল্লা দেওয়াটাও বেশ কঠিন। (বুম প্রকাশিত হয় তিনটি ভাষায়: ইংরেজি, হিন্দি ও বাংলা।)
ভুয়া তথ্যের এই বিস্তার মোকাবিলার জন্য কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কাজ করছে ইথিরাজের দল। ফেসবুকের মালিকানাধীন মেসেজিং সেবা হোয়াটসঅ্যাপে ছড়ানো বার্তার মধ্যে সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা ধরণ খুঁজে বের করার উপায় নিয়ে তারা গবেষকদের সাথেও কাজ করছেন। ইথিরাজ জানান, “এখন ভারতে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর অন্যতম প্রধান বাহন হোয়াটসঅ্যাপ।”
২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত, হোয়াটসঅ্যাপে ছড়ানো ছেলেধরা গুজবের কারণে গণপিটুনিতে মারা গেছে অন্তত ৩৩ জন। তথ্য যাচাই কর্মকাণ্ডের পরিণতি যে জীবন-মৃত্যুর নির্ধারক হয়ে উঠতে পারে, সে সম্পর্কেও ভালোই সচেতন ইথিরাজ। ফলে বাড়তি কিছু সাবধানতা তাদের অবলম্বন করতে হয়। প্রথাগত রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। ইথিরাজ বলেন, “আমরা অনেক স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কাজ করি। তাই সরেজমিন অনুসন্ধানেও যেতে হয়। যদি সেখানে সহিংসতার হুমকি থাকে, তাহলে আমরা স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলি। [প্রতিবেদন প্রকাশের আগে] তাদের পরামর্শ নিই।”
সেনেগাল
যা দিয়ে কোনো ঘটনা যাচাই করা হবে, সেই ডেটার ঘাটতিই সেনেগালের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এমনটাই জানিয়েছেন ডাকারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আফ্রিকা চেক-এর ফরাসী-ভাষা সম্পাদক সাম্বা ডিয়ালিম্পা বাদজি। তার দল যখন সেনেগালে মানসিক স্বাস্থ্যের পরিসংখ্যান খোঁজ করছিল, তখন বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশটিতে এমন কোনো ডেটা নেই। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে একটি দাবির সত্যতা যাচাই করার সময় তারা দেখতে পান, এখানেও তথ্য অসম্পূর্ণ।
ডেটার অবস্থা গোটা আফ্রিকায় কমবেশি এক। তাই কাজ করতে গিয়ে কোনো ডেটা পেলেই, তা পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় আফ্রিকা চেক। ২০১৬ সালে, তারা চালু করেছে ইনফো ফাইন্ডার। এখানে কৃষি ও স্বাস্থ্যসহ ১৪টি বিষয়ের ওপর নির্ভরযোগ্য ডেটা পাওয়া যায়। এই মাসে, টুলটির ফরাসী সংস্করণ ছেড়েছে আফ্রিকা চেক। ইনফোথেক নামের ফরাসী সংস্করণ চালু হয়েছে সেনেগাল ও আইভরি কোস্ট থেকে আসা তথ্য দিয়ে।
তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের একটা ডেটাবেজ তৈরি করা, যেন সাংবাদিক ও গবেষকরা এসব তথ্য আরো তলিয়ে দেখতে পারে। ডিয়ালিম্পা বাদজি বলেছেন, “কেউ যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয়, যেমন স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে চান, তাহলে তারা ইনফোথেকে গিয়ে, সংশ্লিষ্ট গবেষণাগুলো খুঁজে নিতে পারেন। আরো গভীরে যেতে চাইলে, বিশেষজ্ঞদের সাহায্যও নিতে পারেন।”
শার্লট আলফ্রেড একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও সম্পাদক। তিনি রিপোর্টিং করেছেন মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। হাফিংটন পোস্ট, দ্য করেসপন্ডেন্ট, গার্ডিয়ান, নিউজ ডিপলি, জিট অনলাইন, এল দিয়ারিও এবং ফার্স্ট ড্রাফটের মত জায়গায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে।