পুরো বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হুমকি-হামলা বেড়েই চলেছে। এর বিপরীতে নতুন ভাবনা-প্রযুক্তিতে নিজেদের সমৃদ্ধ করে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান এসেছে ১১তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্স (#GIJC19) থেকে।
১৩০টি দেশ থেকে দেড় হাজারেরও বেশি সাংবাদিক এসেছেন হামবুর্গের এবারের সম্মেলনে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের এই আন্তর্জাতিক মিলনমেলা এবারই হচ্ছে সবচেয়ে বড় আকারে। উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রতিবেদেক, সম্পাদক ও গবেষকরা সবাইকে বলতে শুনেছেন, অনেক দমনপীড়ণের মধ্যেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পরিসর আসলে বেড়েছে।
গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের (জিআইজেএন) নির্বাহী পরিচালক ডেভিড কাপলান তার স্বাগত বক্তব্যে বলেছেন, “স্বৈরশাসকরা যদি মনে করে যে, আমরা হারিয়ে যাচ্ছি, তাহলে তাদের জন্য বিস্ময়ই অপেক্ষা করছে।”
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা যারা করেন, তাদের জন্য একটি কার্যকর ও টেকসই পরিবেশ গড়ে তোলার কথা বারবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বক্তা-আলোচকরা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের প্রসঙ্গ সামনে এনেছেন। যার মধ্যে আছে: ভুয়া খবর বা গুজবের বিস্তৃতি, অতি-ডান রাজনৈতিক শক্তির পুনরুত্থান, গণমাধ্যমের ওপর কর্পোরেট হামলা এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ: এমন পাঠক-দর্শকের সংখ্যা বাড়তে থাকা যারা তথ্য-প্রমাণে বিশ্বাস করে না।
কাপলান বলেছেন, “[সাংবাদিকদের ওপর] হামলা রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। এমনকি সেসব দেশেও যেখানে আমরা নিজেদের নিরাপদ ভাবতাম। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশে আমরা আইনি হেনস্তার মুখে পড়েছি। স্বৈরশাসক হয়ে উঠতে চাওয়া প্রেসিডেন্টরা এগুলো করেছে। আর অনলাইনে কিছু মানুষ আমাদের ও আমাদের পরিবারের জীবন নরক বানিয়ে ফেলতে চেয়েছে। সামনের সারিতে থাকা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য খুব কঠিন সময় যাচ্ছে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও, আমরা আসলে শক্তিবৃদ্ধি করছি। আমাদের এখন এমন অনেক সাংবাদিক আছে যারা আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে কঠিন কঠিন লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। পুরো বিশ্বজুড়ে।”
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বৈশ্বিক সম্মেলনে পাঁচ দিনব্যাপী থাকছে ২৫০টিরও বেশি প্যানেল, ওয়ার্কশপ ও নেটওয়ার্কিং সেশন। যেখানে আলোচনা করবেন অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞরা। যাদের মধ্যে আছেন ১১জন পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী। এবারের সম্মেলন যৌথভাবে আয়োজন করেছে জিআইজেএন, জার্মানির নেটজোয়ার্ক রেশের্সে ও ইন্টারলিংক অ্যাকাডেমি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডায়ালোগ অ্যান্ড জার্নালিজম। হামবুর্গের এই সম্মেলনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ডেটা সাংবাদিকতার ওপর। ৬০টি সেশন থাকছে এই সংক্রান্ত কৌশল-দক্ষতা বৃদ্ধি নিয়ে। গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে একাডেমিক গবেষণা কৌশল এবং অলাভজনক নিউজরুমগুলোর জন্য টেকসই ব্যবসা কৌশল গড়ে তোলা।
হামবুর্গের সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম বিষয়ক মন্ত্রী কারস্টেন ব্রোসদা উদ্বোধনী অধিবেশনে উপস্থিত সাংবাদিক কমিউনিটির প্রতি চূড়ান্ত প্রত্যাশার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন: “আপনারা গণতন্ত্রকে চোখে চোখে রাখেন। আমরা যদি সত্যটা জানতে না পারি, সত্য খুঁজে বের করার জন্য অনেক লম্বা সফর করবে- এমন মানুষ যদি আমাদের না থাকে … তাহলে যৌক্তিক বিচার-বিবেচনা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমরা এমন অনেক উদাহরণ দিতে পারব যেখানে সমাজে অযৌক্তিক চিন্তাভাবনার ঝোঁক দেখা যাচ্ছে, অথবা স্বৈরতান্ত্রিক নেতারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।” জোসেফ পুলিৎজারের লেখা থেকে সেই বিখ্যাত উক্তিটিও সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ব্রোসদা, “প্রজাতন্ত্র ও গণমাধ্যমের উত্থান-পতন একই সুতোয় বাঁধা।”
অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা সত্ত্বেও আশা খুঁজে পাওয়ার দিকগুলো আলোচনা করেছেন বেশ কয়েকজন বক্তা।
ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)-এর স্ট্র্যাটেজিক ইনিশিয়েটিভস পরিচালক মারিনা ওয়াকার গেভারা বলেছেন, “আমার মনে হয়, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় আমরা একটা গণতন্ত্রায়ন দেখতে পাচ্ছি। যার মধ্যে লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যও আছে।” মেশিন লার্নিং টুলের ক্ষমতা থেকে নতুন আশা পাওয়া যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন মারিনা, “[কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা] সবসময় ঠিকঠাক কাজ করে না। এটা কোনো যাদুবিদ্যাও না। কিন্তু এটা ব্যবহার করে আমরা নিজেদের সময়টা আরো ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারি।”
পাকিস্তানের ইংরেজি ভাষার দৈনিক ডন-এর সম্পাদক জাফর আব্বাস মনে করেন, নিকট ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ায় সাংবাদিকতা করা আরো কঠিন হয়ে উঠবে। কিন্তু চাপের মুখে পড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকদের মধ্যে নতুন করে যে সংহতিবোধ জেগে উঠছে- তা দেখে তিনি আশাও খুঁজে পান।
সাংবাদিকতায় জোটবদ্ধ হওয়া ও সহযোগিতামূলক কাঠামোর ব্যাপক বিস্তার দেখে আশাবাদী হচ্ছেন অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক ড্রিউ সুলিভান। এসব কাঠামো থেকে রিপোর্টাররা অনেক শক্তিশালী নতুন পদ্ধতি পাচ্ছেন যা কাজে লাগছে তথ্য সংগ্রহ ও প্রভাববিস্তার- দুই ক্ষেত্রেই। “আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরে আমরা সহযোগিতামূলক নানা কৌশল-প্রযুক্তির একটা বিপ্লব দেখতে পারব। ফলে দূরদূরান্তের মানুষও আরো কার্যকরীভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারবে,” বলেছেন সুলিভান।
একইসঙ্গে তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তাও দিয়েছেন: “আমরা দেখব যে বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্র ও কোম্পানি সংবাদ তৈরি করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সংবাদ তৈরি করা হচ্ছে। চারিদিক থেকে এত এত সংবাদ আসবে যে আমরা [অনুসন্ধানী সাংবাদিক] কারা, কী করি- তা হারিয়ে যেতে বসবে। আমাদের এই সব তথ্যবিভ্রান্তি পেরুতে হবে। এজন্য দরকার হবে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল।”
সম্ভবত সবচেয়ে শীতল সতর্কবার্তাটি এসেছে ডের স্পিগেলের ন্যাশনাল ডেস্ক এডিটর কোরদুলা মায়ারের কাছ থেকে। তিনি মনে করেন, পশ্চিমা সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রভাব-পরিসরের বাইরে থেকে গেছে।
মায়ার বলেছেন, “যদি মানুষ তথ্য-প্রমাণকেই আর বিশ্বাস না করে, তাহলে আমরা সত্যিই হারিয়ে গেছি। জার্মানিতে মোট জনসংখ্যার পাঁচভাগের একভাগ মানুষ সাংবাদিকদের বিশ্বাস করে না। তাদের কেউ কেউ আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। যুক্তির কথা দিয়ে আমরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছি না। তবে কারো কারো কাছে এখনো পৌছানো যায়। আমাদের সব রকমের পদ্ধতি ব্যবহার করে সংবাদ নিয়ে আলোচনায় আসতে হবে। আমাদের স্কুলে স্কুলে যেতে হবে। দক্ষিণ জার্মানিতে আমরা এরই মধ্যে এরকম উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা কীভাবে কাজ করি সে সম্পর্কে জানাচ্ছি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।”
এরকম দৃঢ় সংকল্প নিয়ে হামবুর্গের সম্মেলনে এসেছেন আরও অনেকে।
ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্স অ্যান্ড এডিটর্সের নির্বাহী পরিচালক ডোগ হ্যাডিক্স বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রে আমরা এখন যে ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া শুরু করেছি, সেরকম চ্যালেঞ্জ অন্যান্য অনেক দেশের সাংবাদিকরা এরইমধ্যে মোকাবিলা করেছেন। আমি এখানে এসে সেসব দেশের সহকর্মী সাংবাদিকদের কাছে শিখতে চাই, কীভাবে তারা ভূয়া খবর, নিপীড়ক সরকার ও শাসকদের মোকাবিলা করেন? আমি আমার কেনিয়ার সহকর্মীদের কাছে জানতে চাই, কীভাবে তারা ক্ষমতাধর মানুষদের সামাল দেন? কীভাবে সেই সরকারের মুখোমুখি দাঁড়ান যারা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে চায়?”
গণতন্ত্র-বিরোধী পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান এসেছিল গত বুধবারের প্রাক-সম্মেলন অনুষ্ঠান থেকেও। ডার্ট সেন্টার ফর জার্নালিজম অ্যান্ড ট্রমা আয়োজন করেছিল একটি কর্মশালা, যেখানে রিপোর্টারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, কীভাবে তারা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব মোকাবিলা করবেন।
প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাঁড়াতে সাংবাদিকরা নিজেদের তৈরি করতে শিখছেন। ২৫ সেপ্টেম্বর বিবিসির ইন্টারনেট রিসার্চ বিশেষজ্ঞ পল মায়ার্সের মাস্টারক্লাস থেকে তারা শিখেছেন, কীভাবে ব্যবহার করতে হয় অনলাইন গবেষণার শক্তিশালী সব টুল।
প্যানেল, ওয়ার্কশপ ও নেটওয়ার্কিং সেশনের বাইরে, সম্মেলনের আগামী দিনগুলোতে নতুন কোলাবরেশন, প্ল্যাটফর্ম গঠনের ঘোষণা ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু রিপোর্ট প্রকাশের খবরও আসবে।
রোয়ান ফিলিপ এক দশক ধরে ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসের চিফ রিপোর্টার। একই সময়ে তিনি ফেলোশিপ করেছেন ওয়াশিংটন পোস্ট ও এমআইটি-তে। ২৭টি দেশ থেকে রিপোর্টিং করেছেন রোয়ান। ২০১৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকান সরকারের কাছে ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ৮টি নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর বিক্রির গোপন তৎপরতা চালিয়েছিল রাশিয়া। রোয়ানের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বড় ভূমিকা রেখেছে গত বছর সেই চুক্তি বাতিলের পেছনে। জিআইজেএন-এ নিয়মিত কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করেন রোয়ান।