অষ্টম গ্লোবাল শাইনিং লাইট অ্যাওয়ার্ডের চূড়ান্ত দৌঁড়ে জায়গা করে নিয়েছে ১১টি দেশের মোট ১২টি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। বিরূপ পরিস্থিতি বা প্রচন্ড চাপের মধ্যে থেকে উন্নয়নশীল বা উত্তরণের পথে থাকা দেশের সাংবাদিকরা যেসব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেন, তাকে সম্মান জানাতেই এই পুরস্কার দেয়া হয়।
এবার চূড়ান্ত প্রতিযোগী নির্বাচিত করার কাজটি বেশ কঠিন ছিল বিচারক প্যানেলের জন্য। রেকর্ড ২৯১টি আবেদনের মধ্য থেকে তারা সেরাদের বাছাই করেছেন। এসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে।
বিচারকরা বলেছেন: “গ্লোবাল শাইনিং লাইট অ্যাওয়ার্ডে এবার জমা পড়া চমকপ্রদ প্রতিবেদনগুলো এটাই প্রমাণ করে, চরম প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বেশ দাপটের সাথেই টিকে আছে। বাড়তে থাকা নিরাপত্তা ঝুঁকি আর মামলা-হামলার ভেতরেও সাহসী ও কঠিন রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে তারা ক্ষমতাকে জবাবদিহি করে যাচ্ছেন।”
“এই অনুসন্ধানী রিপোর্টগুলো এসেছে সাংবাদিকতার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন এলাকাগুলো থেকে — যেমন আজারবাইজান, মিশর, মেক্সিকো, ফিলিপাইন. রাশিয়া, দক্ষিণ সুদান, ভেনেজুয়েলা,” বলেন জিআইজেএনের নির্বাহী পরিচালক, ডেভিড ই. কাপলান। “এই সাংবাদিকরা যা করেছেন, তা এক কথায় অসাধারণ।”
প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে আসছে সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখে, ২০১৯ গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম করফারেন্সে। তারা একটি সম্মাননা এবং ২০০০ মার্কিন ডলার পাবেন পুরস্কার হিসেবে।
এই অ্যাওয়ার্ডের পৃষ্ঠপোষক গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক। এটি ৭৭টি দেশের ১৮২টি সংগঠনের একটি জোট। সদস্যরা সবাই বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উন্নয়নে কাজ করেন।
প্রতিবেদনের ব্যাপকতা ও বৈচিত্র্যের কথা মাথায় রেখে, এবারই প্রথম দুইটি ক্যাটাগরিতে এই পুরস্কার দেয়া হচ্ছে: বড় গণমাধ্যম (যাদের কর্মী সংখ্যা ১০ এর বেশি) এবং ছোট গণমাধ্যম (যাদের কর্মী সংখ্যা ১০ জনের কম)। এবার চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার জন্য বিবেচিত ১২টি রিপোর্ট হচ্ছে:
ফাইনালিস্ট: ছোট গণমাধ্যম
“কার ওয়াশ” এবং “হোয়াইট কলারস”, আইডিএল রিপোর্টেরোস (পেরু+).
দল পরিচিতি: কার ওয়াশ সিরিজে ছিলেন: গুস্তাভো গরিত্তি, রোমিনা মেলা, হার্নান পি. ফ্লোরিন্দেজ, রোসা লরা, মার্গো দেসাউতেজ। হোয়াইট কলারস সিরিজে ছিলেন:গুস্তাভো গরিত্তি, রোমিনা মেলা, হার্নান পি. ফ্লোরিন্দেজ, রোসা লরা, মার্গো দেসাউতেজ, প্যাট্রিসিয়া মেয়রগা, ক্রুজ সিলভা, লুই মিগুয়েল পুরিজাগা।
ব্রাজিলের শীর্ষ কন্সট্রাকশন কোম্পানী ওডব্রেখটের ঘুষ কেলেংকারি নিয়ে সবার আগে রিপোর্ট করে পেরুর আইডিএল রিপোর্টেরোস। “অপারেশন কার ওয়াশ” নামের সেই দুর্নীতির নেটওয়ার্ক বিস্তৃত ছিল গোটা ল্যাটিন আমেরিকা জুড়ে এবং তার বাইরেও; জড়িয়ে পড়েন প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে বড় সরকারি কর্মকর্তা আর রাজনীতিবিদরাও। এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাদের সাংবাদিকরা পেরুর শীর্ষ বিচারকদের দুর্নীতির আরেকটি বড় স্টোরি খুঁজে পায়। “হোয়াইট কলারস” শিরোনামের সেই সিরিজের কারণে দেশটির বিচার ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংষ্কার আনা হয়।
“ওএলপি: দ্য মাস্ক অফ অফিশিয়াল টেরর ইন ভেনেজুয়েলা,” রানরান ডট ইএস এবং কানেক্টাস ডট ওআরজি (ভেনেজুয়েলা)
দল পরিচিতি: রোনা রিস্কেজ, লোরেনা মেলিন্দেজ, লিসেথ বুন, কারমেন রিয়েরা, হুয়ান কার্লোস হার্নানদেজ, আবরাহান মোনকাদা, ড্যানিয়েলা আগুইলার।
দুইটি গণমাধ্যমের এই যৌথ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, অপারেশন লিবারেশন অ্যান্ড প্রোটেকশন অব দ্য পিপল বা ওএলপি নামে পরিচিত অভিযানের নামে, টানা দুই বছর ধরে গরীব অধ্যুষিত এলাকায় কীভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যায় মেতে উঠেছে ভেনেজুয়েলার সরকারি বাহিনী। সরকারি তথ্য না থাকায়, রিপোর্টাররা নিজেরাই ৫৬০জন ভিক্টিমের একটি বিশদ ডেটাবেইস তৈরি করেন, এই প্রতিবেদনের জন্য।
“দ্য কান্ট্রি উইথ ২০০০ গ্রেভস,” দ্য কালেক্টিভ, “হোয়্যার ডু দ্য ডিসাপিয়ার্ড গো” এবং কুইন্টো এলিমেন্টো ল্যাব (মেক্সিকো)
দল পরিচিতি: আলেহান্দ্রা গুইলেন, মারসেলা তুরাতি, মাগো টোরিস, ডেভিড ইডস এবং আরো অনেকে।
এই অনুসন্ধানটি চলে একটানা দেড় বছর ধরে। মেক্সিকোর এক দল স্বাধীন সাংবাদিক এখানে তুলে ধরেন, প্রায় এক দশক ধরে চলা মাদকবিরোধী নীতির কারণে কীভাবে হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছে এবং তাদেরকে দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গোপন সমাধিস্থলে কবর দেয়া হয়েছে। তারা দেখতে পান, ২০০৬ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে, গড়ে প্রতি দুই দিনে একটি করে, এমন অন্তত ২০০০ সমাধির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
“দ্য প্রফিটিয়ার্স,” আফ্রিকা আনসেনসরড (দক্ষিণ সুদান)
দল পরিচিতি: জন –অ্যলান নামু, এলিজাহ কানয়ি, স্যামুয়েল মুনিয়া
তিন পর্বের এই তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে, সুদানের ক্ষমতাসীন এলিটরা কীভাবে গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে দেশটি থেকে কোটি কোটি ডলার মুনাফা করেছে এবং সেই টাকা কেনিয়াসহ পূর্ব আফ্রিকার অন্য দেশে বিনিয়োগ করেছে। এইসব ব্যক্তিরা কোন পদ্ধতিতে টাকা পাচার করেছেন এবং সরকার, অন্য দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী ও সেনা কর্মকর্তাদের সহায়তা নিয়ে তারা কীভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন তাও তুলে এনেছেন সাংবাদিকরা।
ফাইনালিস্ট: বড় গণমাধ্যম
“ওয়ারমঙ্গারস,” আরিজ ও ডয়েচে ভেলে (মিশর)
দল পরিচিতি: সাদা আবদ এলকাদের, আসিল সারিহ, সামেহ এলাবুদি।
এই তথ্যচিত্রটি তুলে ধরেছে, মিশরের মানবপাচারকারীরা কীভাবে, ইয়েমেন ও সিরিয়ার গরীব শরণার্থীদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কিডনি বিক্রি করে দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ধাপের সাথে জড়িত মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিকরা। মিশরের আইনকে পাশকাটাতে মানবঅঙ্গ পাচারের এই নেটওয়ার্ক কী ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে, তা-ও উঠে এসেছে রিপোর্টে।
“দ্য আজারবাইজানি লন্ড্রোম্যাট,” অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি) এবং আজারবাইজানের বেশকিছু গণমাধ্যম (আজারবাইজান)
দল পরিচিতি: ইলগার আগা, রোমান আনিন, আনাবা বাবিনেচ, সোফি বেলে, এত্তিলা বিরো, জন ব্রাতানিচ, আনুস্কা ডেলিচ, রিকার্ডো গিনেস, পাভলা হলকোভা, খাদিজা ইসমাইলোভা, এলেনা লোগিনোভা, মিরান্ডা প্যাট্রুসিচ, মদিনা মামাদোভা, পল রাদু, আতানাস চোবানভ, জনি রেট, ক্যারোল কারবেজ , ড্রাগানা পেকো, নাদিয়া শিয়াব, ফ্রেডরিক লিন্ডেনবার্গ, এমি গাই, লায়ন সামারবেল, ইলিয়া লোজোভস্কি, জোডি ম্যাকফিলিপস, ড্রিউ সুলিভান, বার্গিট ব্রুয়ার, লেইলা কামদিচ, রোক্সানা জিপা, আনা পেনারিয়ু এবং অজানা অনেক আজারবাইজানী সাংবাদিক।
সহযোগিতামূলক এই আন্তসীমান্ত অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, আজারবাইজানের ক্ষমতাসীন এলিটরা কীভাবে জটিল একটি মুদ্রাপাচার স্কিম থেকে লাভবান হয়েছেন। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা ব্যাংকের নথি থেকে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যে নিবন্ধিত চারটি ছায়া কোম্পানীর মাধ্যমে তারা ২৯০ কোটি মার্কিন ডলার পাচার করেছেন, মাত্র দুই বছরে।
“দ্য ক্রেমলিন কুক’স টয়স,” ফনটানকা ডট আরইউ এবং নোভায়া গেজেটা (রাশিয়া)
“পুতিনের পাচক” নামে পরিচিত রুশ ধনকুবের ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনকে নিয়ে কয়েকটি দুর্দান্ত অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছেন ডেনিস কোরোতকভ। পুতিনের অনুগত গণমাধ্যম এবং সেন্ট পিটার্সবার্গের কুখ্যাত ট্রল ফ্যাক্টরি চালাতেন এই প্রিগোঝিন। এই অনুসন্ধানে কোরোতকভ দেখিয়েছেন – রাশিয়া সরকারের পক্ষে সিরিয়া, পূর্ব ইউক্রেইন এবং অন্যান্য এলাকায় যুদ্ধ করতে গিয়ে, কীভাবে প্রিগোঝিনের অর্থায়নে পরিচালিত আধাসামরিক বাহিনী ওয়াগনারের ভাড়া করা যোদ্ধারা প্রাণ হারিয়েছেন।
“মার্ডার ইন ম্যানিলা,” র্যাপলার (ফিলিপিন্স)
দল পরিচিতি: প্যাট্রিসিয়া ইভানজেলিস্তা, কার্লো গ্যাবুকো, লিয়ান বুয়েন, র্যাম্বো তালাবং, চে হফিলেনা।
ধারাবহিক এই প্রদিবেদন তুলে ধরেছে, ২০১৬ সালে ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে দেশটির প্রেসিডেন্ট রড়রিগো দুতের্তের তথাকথিত মাদকবিরোধী অভিযানের নামে কীভাবে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। র্যাপলারের ছয় মাসব্যাপী এই অনুসন্ধানে শক্তিশালী ইঙ্গিত রয়েছে, যে পুলিশের ভাড়া করা একটি গোষ্ঠীই বিচার বহির্ভূত হত্যা ঘটাচ্ছে।
“দ্য ব্রাদারহুড অব কিলার্স অ্যান্ড কপস,” নোভায়া গেজেটা এবং অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (রাশিয়া)
দুই বছর ধরে চলা এই অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, রাশিয়ার এক নম্বর খুনী হিসেবে পরিচিত আসলান গাজিয়েভের অপরাধী দলের সাথে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা কতটা গভীরভাবে জড়িত। এমনকি অনেক পুলিশ কর্মকর্তা সেই গ্যাংয়ের সদস্যও।
“#গুপ্তালিকস,” ডেইলি ম্যাভেরিক (স্করপিও ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট), আমাবুনগানে সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম, নিউজ ২৪, ওপেনআপ, এবং ফাইনান্স আনকভার্ড (দক্ষিণ আফ্রিকা)
দল পরিচিতি: আদি ইয়াল, অ্যাড্রিয়ান ব্যাসন, এঞ্জেলিক সেরাও, অ্যান্টোয়নেট মুলার, ব্রানিস্লাভ “ব্রাঙ্কো” ব্রিকিচ, ক্রেগ ম্যাককুনে, লেস্টার ফ্রিমন (ছদ্মনাম), লিওনেল ফল, মারিয়ান থাম, মিকাহ রেড্ডি, পলি ভ্যান উইক, পিটার–লুই মাইবার, রেবেকা ডেভিস , রিচার্ড পপলাক, স্যালি ইভান্স, স্টেফান্স ব্রামার, স্টিফেন “স্যাম” সোল, সুসান কমরি, টাবেলো টিমসে।
নব্বইয়ের দশকে ভারত থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পাড়ি জমান গুপ্তা পরিবারের তিন ভাই। অল্প দিনেই গড়ে তোলেন সম্পদের বিশাল সাম্রাজ্য। যৌথ এই অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমার ঘনিষ্ঠ এই ব্যবসায়ী পরিবার কীভাবে দক্ষিণ আফ্রিকাকে জিম্মি করে জনগণের টাকা সরিয়ে নিয়েছে নিজেদের কোম্পানিতে। গুপ্তালিকস প্রকাশ হওয়ার কিছুদিন পর জ্যাকব জুমা পদত্যাগ করেন। এই অনুসন্ধানটি এগিয়েছে গুপ্তা পরিবারের ফাঁস হওয়া অসংখ্য ইমেইলের সূত্র ধরে।
“অপারেশন ১৩৬,” কোবরাপোস্ট (ইন্ডিয়া)
এই অনুসন্ধানে সাংবাদিক পুষ্প শর্মা নিজের পরিচয় লুকিয়ে ভারতের বড় বড় গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিদের সাথে দেখা করেন। তিনি জানতে চান, প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা পেলে উগ্র হিন্দুত্ববাদী কন্টেন্ট প্রচার করবে কিনা। তাদের বেশিরভাগই রাজি হন। সেই কথোপকথনই তুলে ধরা হয় রিপোর্টে।
“স্পেশাল কোল্যাটেরাল ড্যামেজ,” পাবলিকা (ব্রাজিল)
দল পরিচিতি: রিপোর্টার নাতালিয়া ভিয়ানা এবং ফটোগ্রাফার নোয়াহ ফ্রিডম্যান–রুডোভস্কি।
এই ধারাবাহিকে উঠে এসেছে, অপরাধ দমনে ব্রাজিলের সেনাবহিনীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহনের কারণে, অভিযানে নিহত বেসামরিক মানুষের পরিবারের সদস্যরা কীভাবে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।