জলবায়ু পরিবর্তন কি আদৌ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিষয়? এমন প্রশ্ন আপনার মনে দেখা দিতেই পারে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি আমাদের অনেকের কাছেই খটোমটো বিজ্ঞান মনে হয়। এ কারণে বন্যা, খরা, ঝড়, নদী-ভাঙ্গন, মহামারী আর বিপন্ন জীববৈচিত্র্যের সাথে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক খুঁজতে আমরা বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হই।
কিন্তু জলবায়ূ পরিবর্তনই ২১ শতকের সবচেয়ে বড় স্টোরি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সমাজের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। ফলে তাদেরকেই সবচে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কিন্তু লাভবান হয় সম্পদশালী ভোক্তাশ্রেণী, জ্বালানি কোম্পানি, ভারী শিল্প, পরিবহন এবং কাঠের ব্যবসার সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ এরাই সবচে বেশি গ্রীনহাউজ গ্যাস ছড়ায়। পরিবেশ দূষণের জন্য আমাদের আর সবার চেয়ে তারাই বেশি দায়ী।
জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর নিছক পরিবেশের বিষয় নয়। এর সাথে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন জড়িত। আর এই সামাজিক ন্যায়বিচারই যুগে যুগে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাই পরিবেশ নিয়ে রিপোর্টিংয়ের সময়, টাকা কোথায় যাচ্ছে শুধু সেদিকে নজর না দিয়ে, বরং কতটা দূষণ হচ্ছে, এর জন্য কারা দায়ী, সেখান থেকে কারা লাভবান হচ্ছে এবং কে হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্থ – এমন বিষয়েও আমরা খোঁজখবর করি।
কয়েক দশক আগেও জলবায়ূ পরিবর্তন সম্পর্কে সবার ধারণা ছিল অস্পষ্ট। একে নিতান্তই পরিবেশের বিষয় বলে মনে করা হত। কিন্তু এখন আর সেই অষ্পষ্টতা নেই। এখন বিষয়টিকে অবধারিত এক বৈশ্বিক ঘটনা হিসেবে দেখা হয় – যা অর্থনীতি, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, জীবনযাপন, খাবারের যোগান, এমনকি রাজনীতি পর্যন্ত – আমাদের জীবনের প্রতিটি দিককে কোনো না কোনো ভাবে প্রভাবিত করছে। ফলে এটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিষয় হিসেবে আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
এখানে জলবায়ূ পরিবর্তন নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ১০টি সম্ভাবনাময় পথের কথা তুলে ধরা হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস সম্পাদকের মতে, “আমাদের সময়ে সবচেয়ে জরুরী স্টোরি এগুলোই।” এসব নিয়ে কোথাও কোথাও অনুসন্ধান হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই তা অনুপস্থিত।
জীবাশ্ম জ্বালানি
গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী মূলত কয়লা, জ্বালানি তেল আর গ্যাসভিত্তিক শিল্প। এ কারণে তাদের নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হওয়া জরুরী। এরিমধ্যে বড় জ্বালানি কোম্পানি নিয়ে একাধিক ভালো অনুসন্ধান হয়েছে। যেমন, এক্সনকে নিয়ে গভীর এই অনুসন্ধানের জন্য ইনসাইডক্লাইমেট নিউজ মনোনীত হয়, পুলিৎজার পুরষ্কারের ফাইনালিস্ট হিসেবে। কিন্তু এমন আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। বিশ্বের সবচে বড় জ্বালানি কোম্পানিগুলোকে নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে সৌদি এরামকো, সিনোপেক, চীনা ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম, কুয়েত পেট্রোলিয়াম – এমনকি তাদের চেয়েও বড় প্রতিষ্ঠান লুকঅয়েল, টোটাল এবং এনির কথা, যারা ব্যক্তিমালিকানাধীন হয়েও রাষ্ট্রগুলোতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
তাই মানুষের জানা উচিত, এইসব প্রতিষ্ঠান বা তাদের এসোসিয়েশনগুলো নিজেদের পছন্দমত আইন প্রণয়ন, সরকারি ভর্তুকি আর নীতিমালার জন্য কোথায় তদ্বির করছে। জানা দরকার, তারা নিজেদের পক্ষে কথা বলার জন্য কোন রাজনীতিবিদকে টাকা দিচ্ছে; কীভাবে ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে; জলবায়ূ পরিবর্তন প্রতিরোধে আনা আইন ঠেকিয়ে দিচ্ছে; পরিবেশবিরোধী গ্রুপগলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে, এবং বিজ্ঞানীদের গবেষণাকে অগ্রাহ্য করছে।
আমাদের আরো যাচাই করা উচিত, “কার্বন বাবল”, অর্থাৎ জ্বালানি মজুত বেশি দেখিয়ে, তারা প্রতিষ্ঠানের সম্পদমূল্য বাড়িয়ে তুলছে কিনা। এই প্রবণতা ভবিষ্যতে নতুন আর্থিক সংকট জন্ম দিতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পদমূল্য নির্ধারিত হয়, তাদের খনিতে কত তেল-গ্যাস বা কয়লা মজুত আছে, এর উপর ভিত্তি করে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেন, জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাব এড়াতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানি মজুতের একটি বড় অংশই “অব্যাবহৃত সম্পদ” হিসেবে মাটির নিচে রেখে দিতে হবে, কখনোই তোলা যাবে না। এমনটি হলে এসব প্রতিষ্ঠানের শুধু যে সম্পদ কমে যাবে তা নয়, বরং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্যে তাদের তৈরি পণ্যকে দায়ী করা হতে পারে, ঠিক যেভাবে মাস্টার সেটেলমেন্ট এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে সিগারেট কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বড় অংকের জরিমানা আদায় করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
সাধারণভাবে, কয়লা কোম্পানিগুলো গণমাধ্যমের সর্বোচ্চ নজর পেয়েছে, কারণ কয়লা জীবাশ্ম জ্বালানিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণকারী। নানা সময়ে তেলের সংযোগলাইন এবং খনিখনন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। কেননা তাদের কার্যক্রম থেকে নানা পরিবেশগত বিপদ যেমন বিস্ফোরণ, সংযোগ লাইন ছিদ্র হয়ে যাওয়া বা পানিতে দূষণ ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে।
কিন্তু প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে গণমাধ্যমে ততটা আগ্রহ দেখা যায় না। কারণ গ্যাস পোড়ানোকে ”কম ক্ষতিকর” ভাবা হয়। এমনও বলা হচ্ছে, এই গ্যাসকে “ব্রিজ ফুয়েল” হিসেবে ব্যবহার করে আমরা নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে পা বাড়াবো। কিন্তু তারপরও গ্যাসভিত্তিক শিল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে। প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধানতম বর্জ্য হল মিথেন। এটি একটি গ্রীনহাউজ গ্যাস। কার্বন ডাই অক্সাইডের মত দীর্ঘ সময় ধরে এটি পরিবেশে থাকে না, কিন্তু বাতাসকে উত্তপ্ত করার বেলায় এটি কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায় চার গুন শক্তিশালী। গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ প্রতিষ্ঠানগুলো ইদানিং বেশি মিথেন গ্যাস নির্গমন করছে, এমন প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তারা মিথেন লিকেজের পরিমান কমিয়ে আনার জন্য তৈরি আইনকে কোনো না কোনোভাবে প্রতিহত করছে। বিষয়টি নিয়ে কমবেশি সব দেশেই রিপোর্টিং হতে পারে।
অন্যান্য দূষণপ্রবণ শিল্প
জীবাশ্ম জ্বালানির পোড়ানোই জলবায়ূ পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। কিন্তু আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের নিয়ে অনুসন্ধান হওয়া জরুরি। অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা পণ্যের সরবরাহ চেইন অনুসরণ করে এগুলেই বুঝতে পারবেন কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান কী পরিমাণ গ্রীনহাউজ গ্যাস পরিবেশে ছড়াচ্ছে। তেমনই কয়েকটি শিল্পখাতের কথা এখানে আলাদা করে না বলা হচ্ছে।
কৃষি, পশুসম্পদ ও বন
বিশ্বে বিষাক্ত গ্যাস নির্গমনের সিকিভাগই হয় মূলত কৃষি, বনজসম্পদ এবং জমির ব্যবহারে পরিবর্তনের কারণে। অথচ এই দিকে গণমাধ্যমের ততটা মনোযোগ নেই। শিল্প হিসেবে কৃষি পুরোটাই নির্ভর করে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর। রাসায়নিক সার তৈরি করতে প্রচুর পরিমানে প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়াতে হয়। এটি বাতাসে গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের অন্যতম প্রধান উৎস। মাটির ব্যাকটেরিয়ায় আটকে থাকা তাপকে গ্যাস হিসাবে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যেও এমন সার দায়ী। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কৃষি আর খাদ্য নিরাপত্তা। তাই, সাংবাদিকরা খতিয়ে দেখতে পারেন, পরিবেশবান্ধব কৃষি প্রযুক্তি থাকার পরও কেন তার ব্যবহার নেই।
পশুসম্পদের পরিচর্যাও অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। শুনতে হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু গরুর বায়ুত্যাগও এই বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে (নাসার তথ্য অনুযায়ী, গরু যে ঢেঁকুর তোলে, সেখান থেকে আরো বেশি মিথেন গ্যাস বের হয়)। মানব-সৃষ্ট গ্রীনহাউজ গ্যাসের ৮ শতাংশই আসে গরুর দুধ ও মাংস উৎপাদন শিল্প থেকে। এছাড়া গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের যেসব বন একসময় “কার্বন শোষক” হিসেবে ব্যবহৃত হত – যারা কার্বন ধরে রাখত – তাদেরকেও উজাড় করে দেওয়া হচ্ছে গবাদি পশু পালন এবং সয়াবিন (বিশেষ করে আমাজন) ও পাম তেল চাষের মাধ্যমে (দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায়)।
এই সমস্যার সমাধানের উপায়গুলো সাংবাদিকরা বাতলে দিতে পারেন – আমাদের খাবার কোথা থেকে আসছে, এটি কীভাবে তৈরি ও পরিবহন হচ্ছে এবং সেই প্রক্রিয়া গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনে কী ভূমিকা রাখছে – তা অনুসন্ধানের মাধ্যমে।
পরিবহন
ব্যক্তিপর্যায়ে আমরা কোন ধরনের যানবহণ ব্যবহার করছি – সেই সিদ্ধান্তও জলবায়ূ পরিবর্তন রোধে ভূমিকা রাখতে পারে। বিমান চলাচল এবং ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কতটা দায়ী, এ নিয়ে কমবেশি রিপোর্ট হয়েছে। এর বাইরেও অনেক বিষয় আছে যা নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। যেমন, বিমান বা জাহাজ চলাচল সার্বিকভাবে জলবায়ুর উপরে কী প্রভাব ফেলছে এবং এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত আইনী কাঠামো আছে কিনা, তা-ও রিপোর্টিংয়ের বিষয় হতে পারে। একইভাবে আবাসন নীতিমালা নিয়েও অনুসন্ধান হতে পারে। কারণ এর সাথে যোগাযোগব্যবস্থার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
সিমেন্ট ও ভারিশিল্প
জলবায়ূ পরিবর্তনের ওপর শিল্পের প্রভাব অনুসন্ধানের পুরনো বিষয়। কিন্তু খুব কম লোকই জানেন, সিমেন্ট শিল্প একাই বিশ্বের ৮ শতাংশ গ্রীনহাউজ গ্যাস উৎপাদনের জন্য দায়ী। যদি সব সিমেন্ট কারখানা বিশ্বের একটি দেশে অবস্থিত হত, তাহলে সেই দেশটি একাই ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনের ক্ষেত্রে তিন নস্বর অবস্থানে থাকত। এবার চিন্তা করে দেখুন – ইস্পাত, রাসায়নিক, এসি অথবা ফ্রিজ তৈরির কারখানার মত বাদবাকি শিল্পগুলো কী করছে।
আবাসন ও নির্মাণ
রিয়েল এস্টেট ব্যবসা এই আলোচনায় বিশেষ গুরুত্বের দাবীদার। এই কারণে না যে তারা প্রচুর কংক্রিট ব্যবহার করে, বরং আবাসন নীতির সাথে সম্পর্কিত পরিবহন ব্যবস্থা (যার সাথে গ্যাস নির্গমনের সম্পর্ক আছে)। রিয়েল এস্টেট এবং অবকাঠামো নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত জলবায়ু সুরক্ষা নীতিমালায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। নজর দেয়া দরকার, আমাদের সরকারগুলো এই বিষয়ে কোন সুরে কথা বলছে।
জীবাশ্ম জালানিখাতের মতই আবাসনখাতও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে অবজ্ঞা করে আসছে। কিন্তু তাদের ভূমিকা নিয়ে ততটা কথাবার্তা হয় না। নর্থ ক্যারোলাইনা ও ফ্লোরিডাসহ বেশকিছু এলাকায় দেখা গেছে, নির্মাণখাত কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিজ্ঞাননির্ভর মডেলকে এড়িয়ে গিয়ে বিধ্বংসী নীতিমালা তৈরিতে উৎসাহ যুগিয়েছে।
তাই উপকূলীয় এবং বন্যাপ্রবণ এলাকায় রাস্তা, ব্রিজ ও বাঁধসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মানের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা আসলে কী করছেন, সেদিকে সাংবাদিকদের নজর দেয়া উচিত। অনেক সময় তারা ভবন তৈরি করে, সেটি চটজলদি বিক্রি করে দেন। কিন্তু সেই অবকাঠামোটি কোনদিন বিলীনও হয়ে যেতে পারে। বিষয়টি অনেকটা “কার্বন বাবল” এর মত। এক্ষেত্রেও উপকূলবর্তী অঞ্চলে আবাসন ব্যবসায় ধ্বস নামতে পারে, যদি ক্রেতারা বুঝতে পারেন এই খাত ঝুঁকিতে আছে। আরো গভীরে যেতে চাইলে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা নগরপরিকল্পনাবিদদের সাথে কথা বলতে পারেন। জলবায়ু ঝুঁকির বিষয়টি কীভাবে নীতিমালায় প্রতিফলিত হচ্ছে – এই প্রশ্নের উত্তর তারাই দিতে পারবেন।
সরকারি নীতি-সহায়তা ও ভর্তুকি
এরপরে আছে সরকারি খাত। সরকার সাধারণত বিভিন্ন নীতি-উদ্যোগের মাধ্যমে বেসরকারিখাতকে সহায়তা করে। ইদানিং সাংবাদিকরা তাদের রিপোর্টে তুলে আনছেন, কীভাবে জ্বালানি কোম্পানিগুলো সরকারী নীতিকে প্রভাবিত করছে। কিন্তু নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে তারা কীভাবে বাধা দিচ্ছে অথবা নিজেদের উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে তারা দূষণবিরোধী আইন ও প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে দুর্বল করে ফেলছে – এমন অনেক বিষয়ই এখনো উন্মোচিত হয়নি।
গ্রীনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির জন্য দায়ী জ্বালানি কোম্পানিগুলোকে সরকার কীভাবে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে – এই বিষয়টি এখনো খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। অন্তত একটি সমীক্ষা বলছে, সেই সহায়তার পরিমান বছরে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এই হিসাব অন্য দূষণবান্ধব প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া সরকারী সহায়তাকে বাইরে রেখে। ফলে সরকার ভর্তুকির মাধ্যমে অবস্থাকে আরো করুণ করে তুলছে। যেমন, কোনো কোনো দেশে মাছ ধরার ট্রলারের জন্যে সস্তায় পেট্রোল দেয় সরকার। কিন্তু এটি আবার মাছের জন্যেই হুমকিস্বরুপ। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, সরকার কী আসলে জলবায়ু পরিবর্তনকে রুখতে চায় নাকি তার বিপরীত?
বিদেশী সহায়তা, বিনিয়োগ ও রপ্তানি
সাংবাদিকদের এখন আর শুধু নিজের দেশ নিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। দেখতে হবে, তাদের সরকারগুলো অন্য দেশে গিয়ে কী করছে। যেমন: আমেরিকা যেমন নিজের দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে, এখন অন্য দেশে কয়লা রপ্তানি করছে। চীনও নিজের দেশে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনছে, তারা বিশ্বে অন্তত ২০০ কয়লাভিত্তিক প্রকল্প চালাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর জোট ওইসিডি, এভাবে ধনী দেশ থেকে কয়লা রপ্তানি বাধা দেয়ার জন্য একটি নীতি তৈরি করেছিল। কিন্তু অভিযোগ আছে তারা সেটিকে কার্যকর করছে না। একইভাবে, বহুজাতিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলো প্যারিস চুক্তি অনুসরণ করার কথা বলেছিল। তারা এই নোংরা উন্নয়ন থেকে সরে আসারও ঘোষণা দিয়েছিল। এখন এসব বিষয়ও আমাদের নজরদারিতে আনা উচিত।
আইন ভেঙ্গে দূষণ ও মিথ্যা তথ্য প্রদান
অনেক সময় ভালো নীতি প্রণয়নের পরও সরকার সেটি কার্যকর করতে হিমশিম খায়। বেশিরভাগ গ্রীনহাউজ গ্যাস খালি চোখে দেখা যায়না আর গন্ধহীন। ফলে মালিকপক্ষ এসব নির্গমনের কথা বেমালুম চেপে যান এবং সরকারের কাছে মিথ্যা রিপোর্ট জমা দেন। সম্প্রতি জানা গেছে, বিশ্বখ্যাত কিছু গাড়ি কোম্পানি তাদের গাড়ীতে আলাদা সফটওয়্যার বসিয়ে দূষণের মাত্রার ভূয়া তথ্য প্রকাশ করছিল। এই কোম্পানিগুলোই আবার গ্যাস নির্গমনের মাত্রা শিথিল করার জন্য সরকারের কাছে তদ্বির করছিল।
একসময় খবর বেরিয়েছিল বিশ্বের ওজন স্তর খুব দ্রুত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, কারণ চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো শীতাতপ যন্ত্রে নিষিদ্ধ সিএফসি ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে। পরে গ্যাস নির্গমনের তথ্য নিয়ে প্রতারলনার একই ধরনের অভিযোগ আসতে থাকে অন্য দেশ থেকেও। এমন আরো অনেক ঘটনা বেরিয়ে আসবে যখন সবাই গ্রীনহাউজ গ্যাসের ব্যাপারে সচেতন হবে। এইসব ক্ষেত্রে গ্যাস মাপা, সঠিক রিপোর্ট করা এবং তা যাচাই করার পদ্ধতি (এম আর ভি) নিয়ে জাতিসংঘের জলবায়ু চুক্তি বিষয়ক আলোচনায় ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল। তাই যখন কোনো দেশ দাবি করছে, সেখানে গ্যাস নির্গমন কমছে, তখন প্রশ্ন ওঠে গ্যাস নির্গমন কমছে না বাড়ছে “ সেটি মাপার দায়িত্ব” পালন করছে কে?
কার্বন ক্রেডিট এবং অফসেট স্কিম
গ্রীনহাউজ গ্যাসের নির্গমন যেমন নজরে রাখতে হবে, তেমনি “কার্বন ক্রেডিট” নামে পরিচিত নির্গমনরোধী উদ্যোগের দিকেও সমান মনোযোগ দিতে হবে। এর মাধ্যমে যেসব প্রতিষ্ঠান বেশি কার্বন নির্গমণ করছে, তারা ক্ষতিপূরণ দেয় এবং সেই টাকায় অন্য কোথাও কার্বন সংরক্ষণ বা নির্গমনরোধী প্রকল্পে সহায়তা করা হয়। যেহেতু পরিবেশ বৈশ্বিক একটি বিষয়, তাই এরকম উদ্যোগকে যৌক্তিক বলে মনে করেন অনেকেই। কিন্তু সমালোচকদের মতে, এর মধ্য দিয়ে দূষণকারীরা আরো বেশি লাগামহীন হয়ে পড়ে। এ ধরনের কিছু কিছু প্রকল্পকে প্রকৃতিবিনাশী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও সামান্য উপকার পাওয়া গেছে; কিন্তু অনেক জায়গায় লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়েছে। সুযোগ নিতে গিয়ে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধোঁকার আশ্রয়ও নিয়েছে। এখানেও প্রশ্ন উঠেছে: এসব পদক্ষেপ যে গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনে “ভারসাম্য” আনবে, সেটি কে ঠিক করছে? উত্তরটি একেক দেশের বেলায় একেকররকম। কিন্তু কার্বন ক্রেডিট নিয়ে রিপোর্টিংয়ের শুরু হতে পারে, এসব প্রকল্প অনুমোদন দেয়া সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাকে জববাবদিহির আওতায় আনার মধ্য দিয়ে।
খবরের পাতায় যা উপেক্ষিত
জলবায়ু সংক্রান্ত সাংবাদিকতা অনেক সময় বেশ জটিল হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। প্রযুক্তি দিনে দিনে উন্নত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তারপরও এটা বলা মুশকিল যে সেই দুর্যোগটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হয়েছে। বড়জোর এটা বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তার প্রভাব বা তীব্রতা বেড়েছে।
সবমিলে, গণমাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে খুব ভাল কাজ হচ্ছে। এখন আমরা এর “পরোক্ষ প্রভাব” নিয়ে অনেক রিপোর্ট দেখতে পাই, যেমন, জলবায়ু অভিবাসন এবং সম্পদের অভাব কীভাবে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তরপূর্ব আফ্রিকায় সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে। এইধরনের সাংবাদিকতা অন্যান্য অঞ্চলেও হওয়া উচিত। মধ্য আমেরিকাসহ কিছু অঞ্চলে এই বিষয়ে এখনো তেমন রিপোর্টিং হচ্ছে না। যেমন, সমুদ্রে এসিডের মাত্র বৃদ্ধি বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গণস্বাস্থ্যে কী প্রভাব পড়ছে, এমন বিষয় নিয়ে আরো অনুসন্ধান হওয়া দরকার। আবার কোনো কোন ক্ষেত্রে এর প্রভাবকে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে দেখানো হয়েছে।
জলবায়ু বা দুর্যোগের বাইরেও আরো অনেক বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করতে পারেন সাংবাদিকরা। যেমন, ক্যালিফোর্নিয়ায় জঙ্গলে কয়েক বছর ধরে দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে। বলা হয়, এর সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে। কিন্তু এজন্য বন-ব্যবস্থাপনা এবং সেখানে অপরিকল্পিত আবাসন গড়ে তোলা-ও যে দায়ী, সেটি খবরে ততটা আসে না। এমন পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানী এবং ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ঘটনার সত্যিকার চিত্র পাওয়া যেতে পারে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে শুধু যে উপকূলের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন তা নয়। উপকূল থেকে দূরে, স্থলভাগের গভীরের মানুষও সমানভাবে আক্রান্ত হতে পারেন বন্যা বা পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে। বলা হয়, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে, জেট স্ট্রিম বা পশ্চিম থেকে পূর্বমুখী বায়ূপ্রবাহ দূর্বল হয়ে পড়ছে। এর প্রভাবে দক্ষিণের অঞ্চলেও ঠান্ডা বেড়ে যাচ্ছে। অথচ এই অঞ্চল ঘটনার উৎসের চেয়ে অনেক দূরে।
একটা জিনিস মাথায় রাখা জরুরি: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণায় আপনি যে ফলাফল দেখতে পান, তার বেশিরভাগই অনুমাননির্ভর। এই অনিশ্চয়তা হয়ত আপনার রিপোর্টের দাবিকে কিছুটা দুর্বল করবে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক তথ্যনির্ভর লেখা, পাঠকের কাছে আপনার বিশ্বস্ততা বাড়বে। গবেষণার পদ্ধতিগত দূর্বলতা নিয়ে কথা বললে আপনি নিজেও সাংবাদিক এবং তথ্যের উৎস হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।
ছবি: শাটারস্টক
পরিবেশবাদী সংগঠন ও কর্মী
পরিবেশবাদী সংগঠন এবং তাদের কর্মীরাও অনুসন্ধানের বাইরে নন। খতিয়ে দেখা দরকার, তাদের উদ্দেশ্য কী বা তারা কোথা থেকে টাকা পাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত গণমাধ্যম মূলত নজর দিয়েছে “ক্লাইমেট ডিনায়ার” বা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে অস্বীকার করা গ্রুপগুলোর দিকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ীদের টাকায় চলা কিছু বেসরকারি সংগঠন আছে। এদের কাজই হল, গবেষণার নামে পরিবেশ ও গণস্বাস্থ্য নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো। এটি সবচেয়ে বেশি ঘটে তামাক কোম্পানিগুলোর বেলায়। অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে কালো টাকা অর্থায়নের সুযোগ রেখে তৈরি একটি আইন, তাদের সাহায্য করছে টাকা যোগাতে।
এবার নজর দেয়া যাক, “অন্যপক্ষ”, অর্থ্যাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সোচ্চার সংগঠনগুলোর দিকে। এদেরকেও জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত, প্রশ্ন করা উচিত, তাদের টাকা কোথা থেকে আসছে। অবশ্য বিশ্বের ৯৭ ভাগ বিজ্ঞানীই মনে করেন, জলবায়ুর পরিবর্তন সত্য এবং তা মানুষের দ্বারাই সংগঠিত হয়েছে। জাতিসংঘের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ (আইপিসিসি) বলছে, দিন দিন বিষয়টি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এ কারণে পরিবেশবাদী গ্রুপগুলোর প্রতি জনসমর্থন বেশি।
বিজ্ঞানীদের ব্যাপারে সাংবাদিকদের করণীয় কী? ক্লাইমেট ডিনায়ারদের দাবি অনেক বিজ্ঞানী পক্ষপাতদুষ্ট। কারণ তারা জলবায়ু পরিবর্তনের পক্ষে টাকার বিনিময়ে গবেষণা করেন। তাদের কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দফায় দফায় চেষ্টা হয়েছে। ২০০৯ সালে একবার তো, অনেক বিজ্ঞানীর ইমেইল-ই হ্যাক করা হয়েছিল। তবে সেখানে দেখা যায়, তারা স্বাভাবিক নিয়মেই গবেষণা করছেন। জলবায়ু বিজ্ঞানের বিরোধীরা বরাবরই সেই গবেষণা পদ্ধতিকে হেয় করতে চেয়েছেন। (ইমেইল ফাসকারীরা কিন্তু এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে।)
পিয়ার রিভিউ বা পর্যালোচনা বরাবরই বিশ্বাসযোগ্য সত্য বের করে আনতে সহায়তা করে। যেমন, আইপিসিসি বলেছিল ২০৩৫ সালে হিমালয়ের বরফ গলতে শুরু করবে। তখন অনেকে প্রতিবাদ করেছিল। পিয়ার রিভিউর মাধ্যমে সেই ভুল সংশোধনও হয়েছিল। বেশকিছুদিন ধরেই বলা হচ্ছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার কমে গেছে বা থেমে গেছে। পরে জানা গেল বাস্তবে তেমনটা নয়। আসলে, তথ্যের ঘাটতির কারণে পরিসংখ্যানে এমনটা দেখা গেছে। তাই সাংবাদিকদের উচিত নতুন নতুন গবেষণার বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকা এবং বিশ্বাসযোগ্য গবেষকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা।
নজর রাখুন সমাধানেও
এখন পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মানুষ ততটা সচেতন নয়। এই মনোভাব যদি না বদলায়, আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ংকর প্রভাব এড়াতে পারব না। তাই সাংবাদিকদের উচিত সমাধানের উদ্যোগ নিয়েও নিজেদের অনুসন্ধান জারি রাখা। কারণ সমাধানের উদ্যোগ ব্যর্থ হলে, মানুষের মনোভাবও নেতিবাচক হবে। এখন নবায়নযোগ্য শক্তি – যেমন সৌর , বায়ূ বা জিওথার্মাল বিদ্যুৎ প্রকল্প – আগের চেয়ে সাশ্রয়ী। কিন্তু অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পের মত সেখানেও দূর্নীতি বা সম্পদের অপব্যবহার হতে পারে।
জল এবং পরমাণু বিদ্যুতের মত বিকল্প উৎস নিয়ে বিতর্ক আছে। বৈশ্বিক দৃষ্টিকোন থেকে গ্রহনযোগ্য হলেও, এ ধরনের প্রকল্প স্থানীয় পরিবেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। বড় বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো হয় জলবিদ্যুতে। কিন্তু এসব বড় বড় বাঁধ, বিপুল পরিমানে মিথেন গ্যাস নির্গত করে। যার ফলে পানির তলায় থাকা উদ্ভিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যান্য প্রকল্পের মত, এইসব বিকল্প শক্তির উৎস তৈরিতে এবং তা পরিচালনায় ব্যাপক পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি লাগে। আসলে, কোনো প্রকল্পের জীবনচক্র পুরোপুরি বিশ্লেষণ করা ছাড়া, জলবায়ুর ওপর তার প্রভাব মূল্যায়ন করা কঠিন।
সমস্যা সমাধানের আরো কিছু বিকল্প আছে, যা বিবেচনায় নিতে হবে:
জৈব জ্বালানি
বলা হত, শস্য থেকে তৈরি জৈব জ্বালানি (যেমন ভুট্টা থেকে তৈরি বায়োইথানল) পরিবেশের জন্য ভালো। কারণ, এগুলো থেকে কম কার্বন নির্গত হয়। তাই একে দেখা হত, জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে। কিন্তু নানা কারণে এই ধারণা ধোপে টেকেনি। বেশিরভাগ জ্বৈব জ্বালানি প্রকল্পে বড় আয়তনের জমি ও প্রচুর পানি দরকার হয়। এতে খাদ্য নিরাপত্তাও ঝুঁকিতে পড়ছে। তাছাড়া এর উৎপাদনও ব্যয়বহুল।
জৈবজ্বালানি আগে প্রাণীর বর্জ্য থেকে তৈরি হত, যাকে আমরা জৈবগ্যাস নামে চিনি। বলা হয়, এটি জ্বালানির তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন উৎস। অনেকেই মনে করেন – ফেলে দেয়া খাবার, সেলুলোজ বা ছত্রাক থেকে তৈরি করা গেলে, হয়ত এই জৈব জ্বালানি ভবিষ্যতের জন্যেও খুব কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তখন জমি এবং পানির প্রবাহও কম লাগবে। কেউ কেউ এসব থেকে বিমানের জ্বালানি তৈরিরও পরামর্শ দেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, নতুন নতুন এই বিকল্প যতটা না কাজের, তার চেয়ে অনেক বেশি নামে। এদিকেও সাংবাদিকদের নজর রাখতে হবে।
কার্বন অপসারণ ও সংরক্ষণ
কার্বন সংরক্ষণের (কার্বনকে বাতাসে মিশতে না দিয়ে মাটি বা অন্য কোনো উপায়ে ধরে রাখা) দক্ষতাই আগামী দিনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এখন কার্বন ধরে রাখার জন্য বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে, বনকে রাখা হচ্ছে সুরক্ষিত। তাছাড়া বাড়তি উদ্যোগ হিসেবে নেওয়া হচ্ছে বনায়ন কর্মসূচি। এসব উদ্যোগ বন রক্ষা এবং বনাঞ্চল হ্রাস কমাতে বড় অবদান রাখছে। কিন্তু বাতাসে কার্বন কমাতে এর ভূমিকা খুব একটা পরিষ্কার নয়। অনেকসময় তা বনের অধিবাসীদের জন্য ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হতে পারে।
এছাড়া নির্গত গ্যাস থেকে কার্বন অপসারণ করে তাকে নতুন করে ব্যবহারের নানা উদ্যোগ আছে। জীবাশ্ম জ্বালানি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই সিসিএস (কার্বন নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণ) পদ্ধতি ব্যবহারে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এই পদ্ধতিতে, তেল বা কয়লা পোড়ানোর সময় নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস থেকে কার্বন আলাদা করে ফেলা হয়। তারপর সেই কার্বনকে আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা হয় কিংবা ভূগর্ভে পাঠিয়ে দেয়া হয়। “স্বচ্ছ-কার্বনমুক্ত” জ্বালানি উৎপাদনের কথা বলছে যেসব কোম্পানি, তারা মূলত এই সিসিএস পদ্ধতিই ব্যবহার করছে।
কিন্তু, সিসিএসের সফলতা এখনো সন্দেহের উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। কারণ এই পদ্ধতিতে ব্যাপক আয়োজন দরকার হয়। এটি ব্যয়বহুলও বটে। এছাড়া বাতাস থেকে কার্বন আলাদা করার আরো কিছু পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত পরীক্ষামূলক পর্যায়েই আছে। এখানেও একই প্রশ্ন: কার্বন অপসারণের বিশাল এই খরচ কে বহন করবে?
সামনে আমাদেরকে কার্বন অপসারণ এবং সংরক্ষণের দিকেই এগোতে হবে। কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর নামে এরিমধ্যে অনেক সময় অপচয় হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবলোয় সই করা প্যারিস চুক্তিতে যে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে কার্বন নিয়ন্ত্রণ করার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। তাই আমাদের সামনে উপায় হল, “ঋণাত্মক নির্গমন” যা সম্ভব কেবলমাত্র কার্বন অপসারণের মাধ্যমে। তাই এদিকটাতেও নজর দিতে হবে।
জলবায়ু অভিযোজন
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বিশ্বের মানব সম্প্রদায়কে যে বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তা একরকম ভীতিকর। এজন্য যে প্রতিরোধ-শক্তি বা যত রিপোর্টিং দরকার, তা অল্প কথায় বলে শেষ করা যাবে না। তারপরও কিছু কিছু বিষয়ে সবসময় সজাগ থাকতে হবে। যেমন, সুপেয় পানির সংকট। পানির প্রাপ্যতা, অভাব এবং বন্যা-ঝড়-খরায় তার ভূমিকাও রিপোর্টের বড় বিষয় হবে সাংবাদিকদের জন্য। একইভাবে গণমাধ্যমের মনোযোগে থাকবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার পূর্ব প্রস্তুতি এবং সামলে ওঠার খবর।
আমরা জানি, সামনে লাখো কোটি ডলার খরচ হবে জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে অভিযোজনের প্রয়োজনে – সমুদ্রে বাঁধ আর বেলাভূমি তৈরিতে। কিন্তু সেই টাকা কতটা দক্ষতার সাথে খরচ হবে, এ নিয়েও সন্দেহ আছে। সাংবাদিকদের এদিকেও মনোযোগ দিতে হবে। দেখতে হবে, রাজনীতিক এবং পরিকল্পনাবিদরা কোন সমাধান বেছে নিচ্ছেন, যে প্রতিরোধ তৈরি হবে তা কি “ভারি” না “হালকা”; যে অবকাঠামো তৈরি হবে, সেটা কি সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা ২ ফুট বাড়বে ধরে নিয়ে তৈরি হচ্ছে, নাকি ৫ ফুট বাড়বে ধরে নিয়ে। সমাধানের প্রতিটি বিকল্প বেছে নেয়ার কার্যকারণ রিপোর্টের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
তবে ভবিষ্যতে, জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়া বড় বিষয় হয়ে উঠে আসবে। শুধু এখানে যত ক্ষতি হবে, তার কাছে বাকি সব কিছু ফিকে মনে হবে। কেবল মাত্র সম্পদশালী অঞ্চলের মানুষেরাই এই ক্ষতি সামাল দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ খরচ করতে সক্ষম হবেন। সমাধানের আরেকটি উপায় হল, আগাম পরিকল্পনা করে মানুষকে সরিয়ে নেয়া। কিন্তু সেই পরিকল্পনা-ও যে সব সময় সফল হবে তা নয়। বরং অনেক জায়গাতেই ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। সাংবাদিকদের তাই লেগে থাকতে হবে। দেখতে হবে, এমন পরিস্থিতিতে কাদেরকে বাঁচানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, ধনীদের নাকি গরীবদের।
জিও–ইঞ্জিনিয়ারিং
জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে, জলবায়ুর পরিবর্তন থেকে রক্ষা করতে গোটা পৃথিবীর বায়ূস্তর নিয়ে বিশালাকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এখন কয়েক ধরনের পরীক্ষা চলছে, কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে। দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, মানুষ এই পৃথিবীর গঠন-কাঠামো নিয়ে কতটা কারিগরী করতে পারে। এখন পর্যন্ত ফলাফল খারাপই মনে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি থেকে বাঁচতে হয়ত কোনো দিন – কোনো দেশ, ব্লক, কোম্পানি বা তার চেয়েও শক্তিশালী কেউ সত্যিকার অর্থেই সফলভাবে জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োগ করবে।
ভূ-প্রকৌশলের তেমন একটি পদক্ষেপ হল, পৃথিবীর বায়ূস্তরে এরোসল ছড়িয়ে দেয়া। ভাবা হচ্ছে, সূর্যের আলোর তেজ কমাতে বায়ূমন্ডলে সোলার-শেডস বা ছাউনি তৈরির কথাও। কিন্তু সূর্যের আলো কমে গেলে তাতে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে কৃষি উৎপাদনের। সমুদ্রের অম্লতা বৃদ্ধি রুখতেও, এই উদ্যোগ কোনো কাজে আসবে না। বিশ্বপর্যায়ে এ জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। তাই এখনো এসব নিয়ে তেমন আলোচনা হচ্ছে না।
পৃথিবী নিয়ে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা শুনতে অবাক লাগছে? ২০ বছর আগেও ”জলবায়ু অভিযোজন” শব্দটির কথা বলাই যেত না। সবাই মনে করতেন, জলবায়ু পরিবর্তনের মূল সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যেই অভিযোজনের কথা বলা হয়। এখন জিও-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। অনেকেই একে “নৈতিক সমস্যা” হিসেবে দেখেন। কিন্তু সংকট যত গভীর হবে, হয়ত জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে মানুষের মনোভাবও তত দ্রুত বদলে যাবে। তাই সাংবাদিকদের খোঁজ রাখা দরকার, চলমান কোন পরীক্ষাটি, কবে বা কখন তত্ত্ব থেকে বাস্তবে রুপ নিচ্ছে।
এতক্ষণ ধরে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার যে সম্ভাব্য তালিকা দেয়া হল, তা দেখে লম্বা মনে হতে পারে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন সবকিছুকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। এটি সাগরতল থেকে আকাশের চূড়া, অর্থনীতি থেকে সমাজ – সব জায়গাতেই প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
আমরা নিজেরাই কীভাবে আমাদের চারপাশকে বদলে ফেলছি – তা হয়ত বুঝিয়ে বলতে পারেন বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ এবং পরিবেশবাদীরা। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে আমাদের কাজ হবে নিয়ত পরিবর্তনশীল জলবায়ুর এই বিজ্ঞানকে সাধারণের কাছে সহজবোধ্য করে তুলে ধরা, বিশ্বের নানা প্রান্তে গিয়ে মানুষের ওপর তার প্রতিক্রিয়া খুঁজে বের করা। আর এ কারণেই, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সময়ের সবচে গুরুত্বপূর্ণ স্টোরি।
জেমস ফান হলেন আর্থ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক। এটি জিআইজেএনের সদস্য প্রতিষ্ঠান ইন্টারনিউজের একটি উদ্যোগ। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলির গ্রাজেুয়েট স্কুলে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সাংবাদিকতা বিষয়ে শিক্ষকতা করেন।