গণমাধ্যম পরিস্থিতি
আল জাজিরা নেটওয়ার্ক এবং দোহা সেন্টার ফর মিডিয়া ফ্রিডমের মত প্রতিষ্ঠান কাতারে অবস্থিত। তবু দেশটিতে সমালোচনামূলক রিপোর্টিংয়ের সুযোগ নেই। দোহা সেন্টার দেশের বাইরে দারুণ সব কাজ করে। কিন্তু দেশের সীমানার ভেতরে তারা রীতিমত নখদন্তহীন।
সব মিলিয়ে, স্থানীয় গণমাধ্যম দেশটির সরকার বা ক্ষমতাসীন পরিবার নিয়ে সমালোচনা করে না। মিউনিসিপাল কাউন্সিল নির্বাচনের সময় কিছুটা সমালোচনা দেখা গেলেও তা নেহাতই সামান্য। ব্লক করে দেওয়ার আগ পর্যন্ত দোহা নিউজ ছিল দেশটির একমাত্র স্বাধীন গণমাধ্যম। সঠিক লাইসেন্স নেই – এমন অজুহাত দেখিয়ে তাদের ব্লক করা হয়। পরবর্তীতে মূল মালিক/সম্পাদকদের বাধ্য করা হয় প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দিতে। বাস্তবতা হল, ২০১২ সালের মে মাসে আল রাইয়্যান টিভি ছাড়া বহু বছর ধরে কোনো গণমাধ্যমকে লাইসেন্স দেয়নি, কাতার। সেখানে কিছু সংবাদভিত্তিক অনলাইন আছে, কিন্তু বিতর্কিত সাইবার ক্রাইম আইনের কারণে তারাও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না।
কাতারে যে তিনটি ইংরেজি এবং চারটি আরবি পত্রিকা আছে, তারা সবাই সেলফ-সেন্সরশিপ চর্চা করে। অভিবাসী শ্রমিক ইস্যু নিয়ে তাদের করা কোনো রিপোর্টেই গভীর বিশ্লেষণ বা পটভূমি থাকে না। অবশ্য আদালতের শুনানি এবং সরকারি প্রকাশনায় প্রবেশাধিকার আছে এইসব সংবাদপত্রের। তারা শুধু সরকারি প্রেস রিলিজ আক্ষরিকভাবে পুণঃপ্রকাশ করে। অবশ্য সংক্ষিপ্ত এই রিপোর্টগুলোও আপনার ভবিষ্যৎ অনুসন্ধানের জন্য দরকারি তথ্য যোগাতে পারে।
কাতারে ইংরেজি ভাষার প্রায় সব সাংবাদিক এবং বেশিরভাগ আরবি ভাষার সাংবাদিক নিজেরাই অভিবাসী। তারা সেখানে কাজ করেন দেশত্যাগ বা কারাবন্দী হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে। বেশিরভাগই অনেক অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে এখানে কাজ করতে আসেন। আপনি যদি অন্য কোন দেশ থেকে কাতারে সাংবাদিকতা করতে যান, তাহলে স্থানীয়দের সাথে কাজ করাই ভালো। শুধু ডিরেক্টর অফ পাবলিকেশন্স এর সাথে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হয়ে নিন, প্রকাশ্যে কোনো কিছু রেকর্ড করার অনুমতি আপনার আছে কিনা।
কাতার থেকে রিপোর্টিং করার আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তৈরি করা এই আইন (আইন বিষয়ক প্রতিষ্ঠান আল তামিমি অ্যান্ড কোম্পানির সহায়তায় অনুদিত):
“কন্টেন্ট ক্রাইম বিষয়ক আইনটি ‘মিথ্যা সংবাদ’ প্রকাশকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু আইনে এইসব শব্দের কোনো ব্যাখ্যা নেই। ফলে কোন ধরনের কন্টেন্ট স্থানীয় সাংবাদিক এবং সোশ্যাল মিডিয়া ইউজারদের বিপদে ফেলবে, তা অস্পষ্ট। এই আইনের আওতায় না পড়ার জন্য সংবাদ মাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমে কোনো সংবাদ প্রচার করার আগে তার উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া জরুরি।”
এত কিছুর পরও, জিসিসিভুক্ত অন্যান্য উপসাগরীয় দেশের তুলনায় কাতারে মানবপাচার ও জোরপূর্বক শ্রমের মত বিষয় কাভার করা সহজ। ২০২২ ফিফা বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার কারণে পুরো বিশ্ব তাকিয়ে আছে কাতারের দিকে।
খবরের সন্ধান পাবেন কোথায়?
আপনি বিদেশ থেকে কাতারে গেছেন, শ্রমিকদের নিয়ে রিপোর্ট করতে। কিন্তু অজানা-অচেনা পরিবেশে কোথায় খুঁজে পাবেন স্টোরি? জেনে নিন খবর খুঁজে পাওয়ার কিছু পদ্ধতি:
- কাতার সরকার শ্রমিকদের নিয়ে একটি সাময়িকী প্রকাশ করে। সেখানে গ্রিভেন্স কমিটির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত এবং কেইস স্টাডি থাকে।
- মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ট্রাফিকিং ইন পারসন রিপোর্ট দেখুন। এখানে বেশ কিছু ঘটনার বিশদ বিবরণ থাকে। সাধারণত উন্মুক্ত উৎসে এইসব তথ্য পাওয়া যায় না।
- ২০১৮ সালে ন্যাশনাল কমিটি ফর কমব্যাটিং হিউম্যান ট্রাফিকিং প্রতিষ্ঠা করে কাতার। তারা একটি বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। এখনো তাদের ওয়েবসাইট নেই।
- প্রশাসন, শ্রম এবং সমাজ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিভিন্ন আইন লংঘনকারী প্রতিষ্ঠানের একটি কালো তালিকা করে। এর মধ্যে মানব পাচারও থাকতে পারে। এই তালিকা সবার জন্য উন্মুক্ত নয়।
- বিদেশী শ্রমিক পাচারের ঘটনা নিয়ে শ্রমিকরা কোনো অভিযোগ করলে তা-ও চিহ্নিত করা সম্ভব। স্থানীয় মিডিয়াতে এমন রিপোর্ট খুঁজে না পেলেও, শ্রমিকরা যে দেশ থেকে এসেছেন, সেখানকার গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে পেতে পারেন।
- পাচার হওয়া অসহায় ও দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিকদের তথ্য পেতে পারেন তাদের দেশগুলোর দূতাবাসে।
- আগে বোঝার চেষ্টা করুন, কীভাবে পাচার ও জোরপূর্বক শ্রমের মত ব্যাপারগুলো সংঘটিত হয়। পাচারের ঘটনা চিহ্নিত করার জন্য শ্রমিকদের মূল দেশের শ্রম-অধিকার সংগঠনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। চুক্তি পরিবর্তন, মজুরি ছাড়াই চুক্তির চেয়ে বেশি কাজ করানো, চলাফেরায় বাধা বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা – এদের সবই জোরপূর্বক শ্রমের নির্দেশক।
শ্রমিকদের কোথায় পাবেন?
অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে রিপোর্ট করতে চাইলে, আপনি অবশ্যই তাদের সাথে কথা বলতে চাইবেন। কিন্তু তাদেরকে কোথায় পাবেন? নিম্ন আয়ের শ্রমিকরা সপ্তাহে মাত্র একদিন ছুটি পান। আর সেই দিনটি হল শুক্রবার। ছুটির দিনে আপনি তাদেরকে পাবেন করনিশে, আল ফারদান এক্সচেঞ্জ বাস টার্মিনালের আশপাশে, মুনতাজাহ পার্কের বাইরে এবং আল খোর এলাকায় অবস্থিত লুলু মলে।
নিচু আয়ের অভিবাসী শ্রমিকরা সাধারণত থাকেন শহরের কেন্দ্র থেকে ১০-২৫ কিলোমিটার দূরে। কিছু আবাসন প্রতিষ্ঠান এইসব ক্যাম্পে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে।
কাজের পরে তাদেরকে পেতে হলে, আপনাকে যেতে হবে লেবার সিটি, এশিয়ান টাউন এবং শিল্প এলাকা সানায়াসহ কিছু দূরবর্তী এলাকায়। মোয়াসালাত বাস সেবার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ ভালো। শহরের মূল টার্মিনাল থেকে বাসে উঠে আপনিও যেতে পারবেন সহজেই। সেখানে শ্রমিকদের সাথে দেখা করার এবং কথাবার্তা বলার সুযোগ পেতে পারেন। ছুটির দিনে শ্রমিকদের সাথে দেখা করার আরেকটি ভালো জায়গা হল মসজিদ।
মনে রাখবেন, এসব এলাকায় তারাই থাকেন, যারা তুলনামূলক ভালো কাজ করেন। কাতারের মূল যোগাযোগ গ্রিডের বাইরেও কিছু ক্যাম্প রয়েছে, কিন্তু সেখানে পৌঁছানো অনেক কঠিন। ওইসব জায়গায় পানি বা নিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই, তাই মানুষ পানির ট্যাংক এবং সেপটিক ট্যাংকের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।
ক্যাম্পে যাওয়ার সময় এই পরামর্শগুলো মনে রাখবেন:
- এলাকাটির সাথে পরিচিত, এমন কাউকে সাথে নিন।
- এইসব এলাকা (এমনকি মসজিদও) সিসিটিভি, গোয়েন্দা এবং টহল পুলিশের কঠিন নজরদারিতে থাকে। সতর্ক থাকুন।
- আপনি যদি নারী রিপোর্টার হন, তাহলে সেখানে যাওয়া মাত্রই বাধার মুখে পড়তে পারেন।
- ভারী যন্ত্রপাতি সাথে নিবেন না। এতে আপনি সহজেই লক্ষ্যে পরিণত হবেন।
- জেনে রাখুন, অনেক বহিরাগত সাংবাদিককে কাতারে আটক করা হয়েছে।
আরো কিছু পরামর্শ
- শ্রমিক অন রেকর্ডে কথা বলতে রাজি হলে, তাকে আগে সবকিছু জানান এবং অনুমতি নিন। এমন ভাষা ব্যবহার করুন যা তিনি বুঝতে পারেন।
- শ্রমিকদের গোপনীয়তা রক্ষা করুন। তাদের চেহারা বা কাতারের পরিচয়পত্র নম্বর প্রকাশ করবেন না।
- শ্রমিকের নিরাপত্তা বজায় রাখার একটি কৌশল হল তার পরিবার এবং দূতাবাসের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রিপোর্ট করা।
- সমাজকর্মী বা শ্রমিক পরিবারের সদস্য হলে আপনি ডিটেনশন সেন্টারে প্রবেশের অনুমতি পেতে পারেন।
গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের সহায়তায় গাইডটি তৈরি করেছে মাইগ্র্যান্ট-রাইটস। এই অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা। তাদেরকে টুইটারে ফলো করুন @MigrantRights