গণমাধ্যমের পরিবেশ
ওমানের সংবিধান বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করলেও সেখানে রয়েছে সুনির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা। ১৯৮৪ সালের প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন আইনের মাধ্যমে দেশটিতে ক্ষমতাসীন পরিবারের সমালোচনা করার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। হূমকি, জরিমানা ও আটক এড়াতে সেখানকার সাংবাদিকদের মধ্যে সেলফ-সেন্সরশিপের চর্চা বেশ লক্ষণীয়।
সাংবাদিকতা করার জন্য সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমগুলোকে সরকার থেকে অনুমতিপত্র নিতে হয়। প্রেস আইন লঙ্ঘন করলে সেই অনুমতি প্রত্যাহার করা হতে পারে। বিদেশী সাংবাদিকদেরও পাবলিকেশনস অ্যান্ড পাবলিশিং বিভাগ থেকে অনুমতি নিতে হয়। এছাড়া টেলিকমিউনিকেশনস আইন, ২০০২ এর মাধ্যমে অনলাইন গণমাধ্যমের ওপরও আরোপ করা হয়েছে বাড়তি বিধি-নিষেধ।
সাংবাদিকদের জন্য সতর্কবার্তা: দেশটিতে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে করা সকল প্রকার যোগাযোগের ওপর নজরদারি করা হয় এবং তাতে “শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা লঙ্ঘন হলে” বিচারের আওতায় আসতে পারে।
কোথায় খুঁজবেন স্টোরি
ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং ফিলিপাইন্স দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করুন। তারা আপনাকে জোরপূর্বক শ্রমের ওপর ভালো স্টোরি খুঁজতে সাহায্য করবে। দূতাবাসগুেলো অনেক সময় উন্মুক্ত আলোচনা আয়োজন করে। সেখানে অসন্তুষ্ট শ্রমিকরা এসে তাদের সমস্যার কথা বলেন এবং সমাধান চান। উন্মুক্ত আলোচনায় সাংবাদিকরাও উপস্থিতি থাকতে পারেন। তবে প্রোটোকল বিষয়ক বিধি-নিষেধের জন্য আপনাকে ঢুকতে নাও দেওয়া হতে পারে। যদি আপনি ঢুকতে পারেন, তাহলে বেশি কথা না বলে, বরং শুনুন। সেখানে শ্রমিকদের ফোন নাম্বার নিয়ে রাখুন। দরকার মনে হলে ফোনে কিছু ছবিও তুলে নিতে পারেন। স্টোরির জন্য তাদের সাথে পরে ফোনে যোগাযোগ করুন।
মাথায় রাখবেন:
- ওমানজুড়ে অভিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক ক্লাবগুলোতে গেলে অসংখ্য স্টোরি খুঁজে পাবেন।
- নির্মানখাত জোরপূর্বক শ্রমের ঘটনার অনেক বড় উৎস। মাস্কাট, সোহার, নিজওয়া, ইবরি, ইবরা ও সালালাহ এলাকার শ্রমিক ক্যাম্পগুলো ঘুরে দেখুন। অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে স্টোরির জন্য আপনার প্রধান গন্তব্য, এসব ক্যাম্প।
- ওমানের সরকারি ওয়েবসাইট এবং সংশ্লিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচুর তথ্য ও সূত্রের সন্ধান পেতে পারেন। যেমন: ন্যাশনাল সেন্টার ফর স্ট্যাটিস্টিক্স অ্যান্ড ইনফরমেশন, মিনিস্ট্রি অফ ম্যানপাওয়ার (টুইটার), রয়াল ওমান পুলিস (টুইটার) এবং হিউম্যান রাইটস কমিশন।
শ্রমিকদের সাক্ষাৎকার
সমাজকর্মী, বিশেষত, ভারতীয় আর বাংলাদেশী সমাজকর্মীরা আপনাকে জোরপূর্বক শ্রম দেওয়া শ্রমিকদের সম্পর্কে জানাতে ও তাদের কাছে নিয়ে যেতে পারবে। তারা শ্রমিক ক্যাম্পে আপনাকে সঙ্গ দিতে এবং আপনার স্টোরিতে সাহায্য করতে পারে। কথা বলতে আগ্রহী, এমন কোনো শ্রমিক খুঁজে পাওয়ার পর তার সাথে ফোনে সময় নির্ধারণ করুন। শুক্র ও শনিবার এজন্য আদর্শ সময়, কারণ সে সময় কর্তৃপক্ষের কেউ সাধারণত শ্রমিক ক্যাম্পে আসেনা। আরো ভালো হয় যদি শ্রমিকদের সাথে তাদের ক্যাম্পের বাইরে কোনো চায়ের দোকান বা শান্ত কোনো জায়গায় দেখা করতে পারেন। সবচেয়ে ভালো পরামর্শ হলো: খুব বেশি আওয়াজ না করা, পরিচয় গোপন রাখুন এবং মানুষের সাথে মিশে যান।
আরো কিছু পরামর্শ:
- দল বেঁধে শ্রমিকদের সাথে দেখা করবেন না। এতে মানুষ এবং পুলিশের চোখে পড়ে যাবেন। সর্বোচ্চ পাঁচ-ছয় জন হতে পারে।
- বড় ক্যামেরা সাথে নিবেন না। এতে সন্দেহ তৈরি হবে এবং কেউ পুলিশেও খবর দিতে পারে। ফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করুন বা শ্রমিকদের বলুন ক্যাম্পের ভেতরের ছবি তুলে আপনাকে পাঠাতে।
- ক্যাম্পে যাওয়ার আগে শ্রমিকদের বলুন অন্য শ্রমিকদের ফোন নাম্বার এবং বেতনের স্লিপ বা অন্যান্য সব নথি-পত্র নিয়ে আসতে। আপনার যদি বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় না-ও থাকে, অন্তত আপনি তাদের নথি-পত্র বা তার ছবি তুলে নিতে পারবেন।
- ক্যাম্পে ঢুকুন পরিকল্পনা করে। আপনি কিসের ছবি তুলতে চান, কার সাথে কথা বলতে চান এবং কতক্ষণ ক্যাম্পে থাকতে চান, তার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করুন। আধ ঘণ্টার ভেতরে ক্যাম্পের কাজ শেষ করার চেষ্টা করুন। নির্জন এলাকায় চলে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
- স্থানীয় কেউ বা প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শক যদি হঠাৎ চলে আসে, তাহলে শান্ত থাকুন। কোনো ঝামেলায় না গিয়ে চুপচাপ চলে যাওয়ার চেষ্টা করুন। আতঙ্কিত হয়ে গেলে তা আপনাকে বড় ধরণের ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে।
- নিজের প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিক নথি-পত্র সাথে রাখুন। প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ছাড়া মাঠ পর্যায়ের রিপোর্টিং খুবই বিপদজনক। আপনি যদি বিদেশী সাংবাদিক হয়ে থাকেন ,তাহলে প্রেস কার্ড আছে, এমন কাউকে খুঁজে নিন যিনি বিপদে সাহায্য করতে পারবেন।
- চলাচলের জন্য নির্ভরযোগ্য যানবাহন ব্যবহার করুন। ক্যাম্পগুলো সাধারণত বেশ দূরে হয়, আর ভেঙে ভেঙে যাতায়াত করলে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। রাস্তায় কারো সাহায্য পাওয়ার সুযোগ খুবই কম এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম সাহায্য আসে পুলিশের কাছ থেকে। ঝামেলা এড়াতে একটি চার চাকার গাড়ি আর ট্যাংক ভর্তি তেলই যথেষ্ট।
বার্তাকক্ষে ফিরে এসে
- যদি শ্রমিকদের সাক্ষাৎকার ফোনে নেওয়া হয়, তাহলে সেটি রেকর্ড করুন।
- হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বেতনের স্লিপ, চিঠি এবং ছবির মতো আনুষ্ঠানিক নথি-পত্র সংগ্রহ করুন।
- আনুষ্ঠানিক সোর্সের জন্য দূতাবাস এবং সমাজকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করুন। দূতাবাস সাহায্য করলে তা সাংবাদিকের নিরাপত্তার জন্য বেশ সহায়ক হবে।
- শ্রমিকরা অতিরঞ্জিত অনেক কিছু বলতে পারে। তাই তথ্য যাচাই খুবই জরুরী।
- প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সাথেও যোগাযোগ করুন। যদি তারা অভিযোগ করে যে রিপোর্টাররা তাদের কোনো জবাব দেওয়ার সুযোগ দেয়নি, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান আপনার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। তথ্য মন্ত্রণালয় এ ধরণের অভিযোগ খুব গুরুত্বের সাথে নিয়ে থাকে।
- স্টোরিতে সরকারি কর্মকর্তাদের মন্তব্য থাকাও জরুরী। বেশিরভাগ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেই তাদের ইমেইল ঠিকানা রয়েছে। তাদেরকে ইমেইলের জবাব দিতে অন্তত ৭২ ঘণ্টা সময় দেওয়া উচিৎ। আপনি যদি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাদের জবাব ছাড়াই আপনার স্টোরি প্রকাশ করে ফেলেন, তাহলে তারা পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে সাথে সাথে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে।
- তথ্য, রেকর্ডিং বা ছবি মুছে ফেলবেন না। ভবিষ্যতে কর্মকর্তারা সেগুলো চাইতে পারে।
স্থানীয় সাংবাদিক হলে
আপনি যদি ওমান-ভিত্তিক সাংবাদিক হন, তাহলে সরকারের সরাসরি সমালোচনা না করলে হয়ত বিপদে পড়বেন না। একটু “হালকা” সুরে লিখলে স্টোরি প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে, এবং আপনার চাকরি বা নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবে না। আক্রমণাত্মক শিরোনাম এড়িয়ে চলার ব্যাপারে আপনার সম্পাদককে পরামর্শ দিন। আপনাকে সাহায্যকারী শ্রমিকরা চিহ্নিত হয়ে গেলে তারা বিপদে পড়তে পারে। তাই আপনার স্টোরির বিষয় বেশি গুরুতর হলে তাদের নাম উহ্য রাখুন এবং অস্পষ্ট ছবি ব্যবহার করুন।
কোন খবর, কীভাবে সংগ্রহ করবেন?
প্রতিবাদের ঘটনা
খুব বেশি না ঘটলেও, শ্রমিকরা মাঝে মাঝে কাজের পরিবেশ আর অন্যায্য বেতন নিয়ে প্রতিবাদ করে। সাধারণত ক্যাম্প বা রাস্তার মত প্রতিবাদের স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ প্রহরা দেখা যায়। তখন সাংবাদিকদের সেখানে ঢোকার চেষ্টা না করাই শ্রেয়। অতীতে যারা এমন পরিস্থিতির ওপর রিপোর্ট করার চেষ্টা করেছে, তারা বাধার মুখে পড়েছে।
তবে আপনি পথচারীর বেশে গিয়ে ছবি তোলার এবং ক্যাম্পের ভেতরে বা অন্য পথচারীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে পারেন এবং পরে তাদের সাথে ফোনে কথা বলতে পারেন। শ্রমিকদের দাবী এবং কর্তৃপক্ষের বক্তব্য যাচাইয়ের মতো রিপোর্টিং প্রোটোকলগুলো প্রয়োজনীয়, এবং এগুলো আপনার নিরাপত্তায় সাহায্য করবে।
মাথায় রাখুন, আপনার ক্যামেরা জব্দ করা এবং ছবি মুছে ফেলা হতে পারে। তাই, আলাদা একটি ফোনে ছবি তোলার চেষ্টা করুন। সাথে একজন সহকর্মী রাখলে কাজে সুবিধা হবে।
অবৈধ শ্রমিক
ওমানের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলেই কেবল তালিকা-বহির্ভূত শ্রমিক দেখা যায়। তাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের। তারা প্রায় বসবাসের অযোগ্য স্থানে জীবন যাপন করে, খাবারও পায় খুব অল্প।
ক্ষেত্র বিশেষে, তাদের ঘরে সাক্ষাৎকার নেওয়া নিরাপদ হতে পারে, তবু সাংবাদিকদের মনে রাখা উচিৎ, যেকোনো সময় সেখানে পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাদের ধরে নিয়ে যেতে পারে। অভিযানের সময় স্বভাবতই পুলিশ সাংবাদিকদের কথা শুনবে না। থানায় যাওয়ার পরেই কেবল এর মীমাংসা হতে পারে।
মানব পাচার
ওমানে মানব পাচার নিয়ে স্টোরি করা খুবই কঠিন। এমনকি, স্থানীয় শ্রমিকদেরও প্রতিবেশী দেশ থেকে ওমানে পাচার করা হচ্ছে, তবু ওমানের সরকার বিষয়টি অনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে না। আপনার সামনে যদি মানব পাচারের কোনো ঘটনা আসে, তাহলে আপনার রিপোর্ট করার ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্ক হওয়া উচিৎ।
তারওপর, পাচারকৃত স্থানীয় শ্রমিকদের সাথে কথা বলা প্রায় অসম্ভব। কর্তৃপক্ষ তাদের ঘরে থাকতে বাধ্য করতে পারে বা তাদের উদ্ধার করে দূতাবাসের আশ্রয়ে রাখা হতে পারে। যেহেতু আশ্রয়স্থলগুলো অলিখিতভাবে সরকারের ইচ্ছার ওপরেই চলে, তাই স্বভাবতই সেখানে সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। যেহেতু, পাচারকৃত স্থানীয় শ্রমিকদের উদ্ধার করার দায়িত্ব দূতাবাসগুলোর নিজেদের না, তাই তারা সমাজকর্মীদের নিয়োগ করে। উদ্ধারকৃত শ্রমিকদের সাক্ষাৎকারের ব্যপারে সমাজকর্মীরা সাহায্য করতে পারে। বেশিরভাগ সময় দূতাবাসের অজান্তেই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হয়। তাই বেশি সময় দেওয়া হয় না। সাক্ষাৎকারের সময় নির্ধারণের জন্য অতিরিক্ত সতর্ক থাকা উচিৎ।
মাথায় রাখুন এই বিষয়গুলো:
- কখনো ওমানের ভেতরে উদ্ধারকৃত শ্রমিকের পরিচয় প্রকাশ করবেন না। এতে তারা মারাত্মক বিপদে পড়তে পারে। ছবি প্রকাশ করলেও উদ্ধারকৃত শ্রমিকের পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না।
- উদ্ধারকৃত ব্যক্তির দেশের দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
- আপনি যদি স্থানীয় সাংবাদিক হন, তাহলে এমনভাবে স্টোরিটি লিখুন, যাতে সরকারের সরাসরি সমালোচনা না হয়।
গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের সহায়তায় গাইডটি তৈরি করেছে মাইগ্র্যান্ট-রাইটস। এই অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা। তাদেরকে টুইটারে ফলো করুন @MigrantRights