সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন এবং ওমান – মধ্যপ্রাচ্যের এই ছয়টি দেশে এক কোটিরও বেশি অভিবাসী শ্রমিক কাজ করেন। এই দেশগুলো গাল্ফ কোঅপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) নামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোটের সদস্য।
উপসাগরীয় অঞ্চলে মোট শ্রমিকের ৬৭ শতাংশই অভিবাসী। এদের মধ্যে কয়েকটি দেশ শ্রম আইন সংশোধন করেছে, কিন্তু তেমন কেউই বাস্তবায়ন করেনি।
এসব দেশে শ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার হন ব্যাপকভাবে – কখনো চুক্তি ভঙ্গ বা ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্রের কারণে, কখনোবা মানব পাচারকারী, দালাল এবং মালিকপক্ষের মাধ্যমে। স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক, কোনো গণমাধ্যমই নিবিড়ভাবে বিষয়টি কাভার করেনি। এ অঞ্চলের যে সাংবাদিকই মানব পাচার বা বলপূর্বক শ্রমের মত বিষয় কাভার করতে গিয়েছেন তাদের তথ্যে ঘাটতি ছিল, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা এসেছে এবং নিরাপত্তা হূমকির মুখে পড়েছে। কেউ কেউ আটক হয়েছেন, আবার কেউ হয়েছেন দেশ থেকে বিতাড়িত।
দেশ ও বিষয়ভিত্তিক গাইড
এসব কারণে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সহযোগিতায় জিআইজেএন উপসাগরীয় অঞ্চলে মানব পাচার এবং বলপূর্বক শ্রম বিষয়ক সাংবাদিকতার সেরা পদ্ধতি, টুল এবং বিভিন্ন ধাপ নিয়ে এই সহায়িকা তৈরি করেছে। এটি মোটাদাগে সাতটি অনুচ্ছেদে বিভক্ত:
- জিসিসি রিপোর্টিং গাইড – অভিবাসী শ্রমিক ও মানব পাচার বিষয়ক সাংবাদিকতার এই দেশ-ভিত্তিক গাইড তৈরি করেছে মাইগ্র্যান্ট-রাইটস.ওআরজি। এই বিষয়ে রিপোর্ট করতে গেলে ছয়টি দেশের কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে, তা পাওয়া যাবে এখানে।
- পাচারের কেস স্টাডি – মানবপাচার এবং বলপূর্বক শ্রম নিয়ে ১০টি প্রতিবেদন। উপসাগরীয় অঞ্চলে সাধারণত এমন বিষয়ই বেশী দেখা যায়।
- পরিসংখ্যান ও গবেষণা – কোথায় খুঁজবেন তথ্য? পাচার, বলপূর্বক শ্রম এবং অনিয়মিত অভিবাসন সংক্রান্ত তথ্যের উৎস এবং এক নজরে বেশ কিছু দরকারী গবেষণা।
- প্রয়োজনীয় পাঠ্য – মধ্যপ্রাচ্যে পাচার, বলপূর্বক শ্রম এবং অনিয়মিত অভিবাসনের গতিপ্রকৃতি বুঝতে যা যা পড়া দরকার।
- বিশেষজ্ঞ কোথায় খুঁজবেন – মানব পাচার, বলপূর্বক শ্রম এবং অনিয়মিত অভিবাসন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ যেখানে পাবেন।
- মূল পরিভাষা – মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচার এবং বলপূর্বক শ্রম কাভার করার জন্য দরকারি পরিভাষা।
- শব্দকোষ – উপসাগরীয় অঞ্চলে মানব পাচার, বলপুর্বক শ্রম এবং অনিয়মিত অভিবাসন সংক্রান্ত শব্দকোষ। অভিবাসন বিষয়ক আরো শব্দের অর্থ জানতে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের শব্দকোষ দেখুন।
স্টোরি খুঁজে পাবেন কোথায়?
- মানব পাচার ও বলপূর্বক শ্রমের স্টোরি মিলবে সবখানে। খবরের ভালো উৎস, স্থানীয় প্রতিষ্ঠান এবং দূতাবাস।
- নতুন পাস হওয়া অথবা সম্প্রতি কার্যকর হওয়া আইন স্টোরি শুরু করার আরেকটি জায়গা। এসব আইনের বাস্তবায়ন নিয়ে শ্রমিক, মালিক, নিয়োগদাতা বা সরকারী কর্মকর্তাদের বিস্তারিত সাক্ষাৎকারসহ প্রকৃত ফলো-আপও খুব একটা চোখে পড়ে না। শ্রমিকদের ওপর মজুরি সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং কাফালা (স্পনসরশিপ) সংস্কারের প্রভাবও হতে পারে প্রতিবেদনের বিষয়।
- শ্রমিকদের আটকে রাখার স্থানও তথ্যের উৎস হতে পারে, যদি ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন।
- প্রতিদিন যাদের সাথে দেখা হয়, তাদের সাথে আলাপ শুরু করুন। সন্ধান পেতে পারেন স্টোরির।
- বলপূর্বক শ্রম কী, তা বোঝার চেষ্টা করুন। মনে রাখাবনে, যে খবরটি সাদা চোখে অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে, তাতেও সুনির্দিষ্ট প্যাটার্ন থাকতে পারে। সেই প্যাটার্ন চিহ্নিত করতে শিখুন। যেমন, শ্রমিকরা যেখানে থাকেন সেখানে যদি রোগ ছড়িয়ে পড়ে অথবা অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, তাহলে তাদের জীবন-জীবিকায় এর প্রভাব পড়বে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের দুর্দশার প্রকৃত চিত্র চাপা পড়ে যায়, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মত খবরের আড়ালে।
যেভাবে নিশ্চিত করবেন নিরপেক্ষ কাভারেজ
- অভিবাসীদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন রিপোর্টে উঠে আসে, তা নিশ্চিত করুন। সেই তথ্য অবশ্যই আগে যাচাই করে নিন। মনে রাখবেন, অভিবাসীরা ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন। তারা কাজও করেন ভিন্ন ভিন্ন খাতে। তাই তাদের মতামত বা গল্পও হয়তো আলাদা হবে। ধরা যাক, অভিবাসী সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা নিয়ে আপনি রিপোর্ট করছেন। এমন ক্ষেত্রে শুধু সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তির ওপর নির্ভর না করে, অভিবাসীদের দৃষ্টিভঙ্গিও জানুন।
- মনে রাখবেন, পাচার বা অন্য কোনো ভীতিকর ঘটনার শিকার ব্যক্তিরা বেশীরভাগ সময়ই ধারাবাহিকভাবে ঘটনা বর্ণনা করতে পারেন না। এমনকি তাদের কথায় ঘটনাটিও বদলে যেতে পারে। এর মানে এই না যে তারা মিথ্যা বলছেন।
- সাক্ষাৎকার গ্রহণ বা ছবি তোলার আগে তাঁরা বুঝতে পারে এমন ভাষায় অনুমতি নিন। যেহেতু মৃত ব্যক্তির অনুমতি নেওয়া যায়না, এ কারণে আত্মহত্যা করেছেন বা মারা গেছেন এমন কারো ছবি তুলবেন না।
- নির্যাতিত শ্রমিকদের ব্যাপারে বিশেষভাবে যত্নশীল হোন।
- নিগ্রহের শিকার অভিবাসীদের ছবি কোনো স্টোরি নয়। আহত শ্রমিকের ছবি মাত্র তিন বাক্যের ক্যাপশন দিয়ে প্রকাশ করার মানে, তার ভীতিকর অভিজ্ঞতার সাথে একরকমের অবিচার করা।
- ভাষা ব্যবহারে সতর্ক থাকুন। ইংরেজী এবং আরবি – দুই ভাষারই অভিবাসীদের মানবেতরভাবে দেখার এবং অত্যন্ত নেতিবাচক ছকে ফেলে দেয়ার প্রবণতা আছে। আমাদের শব্দকোষে পাবেন অভিবাসন পরিভাষার সবচেয়ে কার্যকর ব্যবহার সম্পর্কে পরামর্শ।
যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকবেন
- আপনার নিজের এবং তথ্যদাতার নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ, বিশেষ করে সেই তথ্যদাতা যদি হন অভিবাসী বা তাদের সহায়তাকারী।
- কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র বা বিশেষ ভিসা নিশ্চিত করুন।
- মানহানির মামলা থেকে বাঁচার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগকে প্রতিক্রিয়া জানাতে অনুরোধ করতে ভুলবেন না।
- শ্রমিকের গোপনীয়তা রক্ষা করুন। কোনো অভিবাসী শ্রমিকের বৈধ কাগজপত্র না থাকলে বা নিয়োগকর্তার হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়ার শংকা থাকলে ছদ্মনাম ব্যবহার করুন। বিপর্যস্ত শ্রমিককে নিয়ে রিপোর্ট করতে গেলে, তিনি সাহায্য পাওয়ার বা পুনর্বাসিত হওয়ার আগে প্রতিবেদন প্রকাশ করা উচিৎ হবেনা। শ্রমিকের পাসপোর্ট নাম্বার বা জাতীয় পরিচয় পত্র বিষয়ক তথ্য প্রকাশ করবেন না।
- যোগাযোগের জন্য আপনি এবং সোর্স – দু’জনই এনক্রিপশন ব্যবহার করুন। সিগনাল এবং হোয়াটসঅ্যাপ দুটোই এনক্রিপটেড।
- আপনি যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আপনার নামে বা স্থানীয় প্রকাশনায় প্রকাশ করতে অপারগ হন, তাহলে আন্তর্জাতিক অথবা শ্রমিকের নিজ দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশের চেষ্টা করুন। কারণ গল্পটি সবার জানা দরকার।
তথ্য ও পরিসংখ্যান
- মনে রাখবেন, অভিবাসন সংক্রান্ত বৈশ্বিক ডেটায় মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। কারণ এই অঞ্চলে জরিপ করা কঠিন এবং এই দেশগুলোতে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে।
- আরো মনে রাখতে হবে, অনেক তথ্যে শ্রম, বলপূর্বক অভিবাসন এবং উদ্বাস্তুদেরকে আলাদাভাবে দেখায় না।
- কোনো পরিসংখ্যান এক নজর দেখেই গ্রহণ করবেন না। উপাত্তে পাচারের ঘটনার সংখ্যা কিভাবে সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে বা শ্রমিকদের অভিযোগের সংখ্যা হিসাব করার ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, তা ভালো করে খেয়াল করুন।
- এই দেশগুলোর ইংরেজি ভাষার সংবাদের ওপর চোখ রাখুন। প্রায়ই এসব সংবাদে অঞ্চল-ভিত্তিক জনসংখ্যা, অভিবাসনের জনপ্রিয় গন্তব্য, নির্দিষ্ট দেশে শ্রমিকদের করা অভিযোগের পরিমাণ – এমন সব পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। এরকম কিছু পেলে সেই সাংবাদিকের সাথে যোগাযোগ করুন। দেখুন, তারা আপনাকে সোর্সের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয় কিনা।
গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের সহায়তায় গাইডটি তৈরি করেছে মাইগ্র্যান্ট-রাইটস। এই অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা। তাদেরকে টুইটারে ফলো করুন @MigrantRights