আধুনিক এই যুগেও বিশ্বের প্রায় চার কোটি মানুষ দাসত্বের জালে বন্দী। সংখ্যাটি হতভম্ব করে দেওয়ার মতো। গোপন এই ব্যবসার স্বরুপ উন্মোচনে, স্বাভাবিকভাবেই অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কিছু অনুসন্ধানী সাংবাদিক। তেমনই চারজন রিপোর্টার তাঁদের পরামর্শ আর অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত দশম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্স এর “এক্সপোজিং হিউম্যান ট্রাফিকিং অ্যান্ড ফোর্সড লেবার” সেশনে।
তাঁরা হলেন ট্রান্সপারেন্টেম এর অনুসন্ধান বিষয়ক পরিচালক টিম স্যান্ডলার, এপি’র রিপোর্টার মার্থা মেনডোজা, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মালিয়া পোলিতজার এবং ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টিং এর সম্পাদক এমানুয়েল মায়াহ্। সেশনটিতে তারা তুলে ধরেন, কীভাবে সোর্সদের সাথে যোগাযোগ এবং মাঠে অনুসন্ধান করতে হবে।
মানব পাচার এমনিতেই ভয়াবহ বিষয়, এ কারণে কোনো ভূক্তভোগী নিরাপদ এবং কথা বলার মতো মানসিক অবস্থায় আছে কিনা, তা জানা বেশ কঠিন।
গবেষণা কীভাবে করবেন?
স্থানীয় এনজিওর সাথে যোগাযোগ করুন। দাসত্বের পরিস্থিতি থেকে বেঁচে ফিরে এসেছেন, এমন অনেকেই এনজিও চালান। স্যান্ডার্স পরামর্শ দিচ্ছেন, সম্ভব হলে এমন প্রতিষ্ঠানের সাথেই যোগাযোগ করতে। মেনডোজা তাঁর পুলিৎজার-জয়ী প্রতিবেদন “সিফুড ফ্রম স্লেভস”-এ দেখান, দাসদের তৈরি সিফুড কিভাবে এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় সুপারমার্কেটে যাচ্ছে। এই তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছিলেন ক্রাউডসোর্স এর মাধ্যমে।
“আমরা প্রতিটি ত্রাণ-সহায়তা, সামাজিক সেবা এবং শ্রম বিষয়ক প্রতিষ্ঠানে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছি, আপনাদের এই মানুষগুলো কোথা থেকে এসেছে? তারা কোথায় থাকতো?”, বলেন মেনডোজা। এই এনজিওরাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে দলটিকে, যেখানে দুই হাজার দাসকে আটকে রাখা হয়েছিলো।
স্থানীয় সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন ঘেঁটে দেখুন। “যখন স্থানীয় সংবাদপত্রে আপনি বিদেশে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখবেন, সেখান থেকে আপনি ধারণা পাবেন দালাল কারা এবং তারা কত টাকা বেতন দেওয়ার কথা বলছে” বলেন স্যান্ডলার।
তাঁর অভিজ্ঞতা বলে, বিজ্ঞাপনের সেই চাকরি পাওয়ার জন্য মানুষ প্রায়ই পরিবার এবং বন্ধুদের কাছ থেকে “অস্বাভাবিক পরিমাণ অর্থ” ধার করে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর বুঝতে পারেন, বিজ্ঞাপনের চাকরি আর বাস্তবতা এক নয়। এভাবে তাঁরা ধার পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ঋণের ফাঁদে বন্দী হয়ে পড়েন।
প্রযুক্তি ব্যবহার করুন। স্যাটেলাইট ছবি, ড্রোনে তোলা ছবি এবং ব্যাঞ্জো এর মতো ভূ-অনুসন্ধান ব্যবস্থা আপনার সন্দেহকে দৃঢ় বিশ্বাসে বদলে দিতে পারে। এসব প্রমাণ দেখে আপনার সম্পাদকও রাজি হবেন, আপনাকে অনুসন্ধানের জন্য মাঠে পাঠাতে। মেনডোজা ডিজিটালগ্লোব নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিয়েছিলেন, যারা প্রতিদিন “পৃথিবীর প্রতিটি জায়গার” ছবি তোলে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে তিনি কিছু ছবি চেয়েছিলেন। তারা ছবিগুলো দিতে রাজি হয়, যার ফলে মাছবাহী জাহাজ নিয়ে অনুসন্ধান এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়। এভাবেই “সিফুড ফ্রম স্লেভস” সফল হয়।
ডিজিটালগ্লোব সাংবাদিকদের অনুরোধে বিনামূল্যে স্যাটেলাইট ছবি দেওয়া শুরু করেছে।
শিশুশ্রমের শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য, স্যান্ডলারের পরামর্শ:
চাষাবাদের মৌসুমে নজর রাখুন (আপনি যদি তুলার মৌসুম বা তামাকের মৌসুমের দিকে নজর দেন, সতর্কভাবে খেয়াল করলে আপনি সেখানে শিশুদের খুঁজে পাবেন,” জানান তিনি); সন্দেহজনক এলাকার দায়িত্ববান শিক্ষকদের জিজ্ঞেস করুন (তারা হয়তো স্কুলে লম্বা অনুপস্থিতি বা ক্লান্তি বা লাঞ্ছনার চিহ্ন খেয়াল করে থাকতে পারেন); স্থানীয় চিকিৎসক বা নার্সদের সাথে যোগাযোগ করুন, যারা হয়তো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করা শিশুদের চিকিৎসা করছেন।
যখন অনুসন্ধানের মাঠে
গোপন ক্যামেরার প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন করুন। আপনি তখনই গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করবেন, যখন বিষয়টি জনস্বার্থের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্য সব বিকল্প চেষ্টা করে সেই ছবি পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। আপনি যে সব কৌশল ব্যবহার করেছেন তা-ও দর্শক বা পাঠককে জানাতে হবে। গোপন ক্যামেরা ব্যবহারের আগে এই ব্যাপারগুলো যাচাইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন স্যান্ডলার।
কেন এমনটি করতে হলো তা “মানুষের সামনে উন্মোচন করুন এবং এটি নীতিবিরুদ্ধ কিনা, সে সিদ্ধান্ত তাদের নিতে দিন,” বলেন স্যান্ডলার।
কোনো কোনো জায়গায় অবৈধ অনুপ্রবেশ, ব্যক্তি-গোপনীয়তা বা মানহানির জন্য আদালতে অভিযুক্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। এই আইনী জটিলতাগুলো বিবেচনা করুন।
সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ – ধরা পড়ে গেলে কীভাবে বের হয়ে আসবেন, সেই কৌশল নির্ধারণ করুন।
দলগতভাবে কাজ করুন। “দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি গোল্ড রাশ” নামের প্রতিবেদনের জন্য প্রায় দুই মাস ধরে চোরা-কারবারী, মাদক ব্যবসায়ী, আফ্রিকা আর ইউরোপের শিশু শ্রমিকদের কথা বলেছেন পোলিতজার। কারা শরনার্থী সংকট থেকে লাভবান হচ্ছে, সেটাই তিনি উদঘাটন করতে চেয়েছিলেন। এই কাজ করতে গিয়ে কোলাবরেটিভ কাজের ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারেন পোলিতজার। তিনি এবং একজন মাল্টিমিডিয়া সহকর্মী একে অন্যকে সাহায্য করার মাধ্যমে এমন অনেক কাজ করেছেন, যা তারা কেউই একা করতে পারতেন না।
“আমি শিশুদের সাথে ভালো কাজ করতাম, আর সে চোরা-কারবারীদের সাথে।”, বলেন পোলিতজার। একবার একটি শ্রম কারখানায় গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করতে হয়েছিল। তখন ভবনের এক পাশে তার মালিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পোলিতজার, আর আরেক অংশে ছবি তুলেছেন তার সহকর্মী।
প্যানেলের সবাইই একটা ব্যাপারে একমত। এধরনের অনুসন্ধানে আপনার এমন কাউকে লাগবে, যিনি বা যাঁরা ভূক্তভোগী মানুষদের ভাষা জানেন এবং তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
সবাই “বিশ্বাস করে” এমন ব্যক্তিও অপরাধী হতে পারেন। তাদের এড়িয়ে যাবেন না। লাইবেরিয়ান উদ্বাস্তুরা কীভাবে পাচার হয়, তা উন্মোচন করেছিলেন মায়াহ্। তিনি বলেন, “খুব অস্বাভাবিক একটি সোর্স থেকে অনুসন্ধানটি শুরু হয়েছিলো।” প্রচলিত গুজবগুলো যাচাই করতে গিয়ে তিনি দেখেন, ইউএনএইচসিআর-এর একজন কর্মকর্তা যেসব শিবির পরিচালনা করেন, সেখান থেকেই পাচারগুলো হচ্ছে। “ইউএনএইচসিআর-এর এই ব্যবস্থাপক একজন নারী এবং মা,” বলেন মায়াহ্।
ভূক্তভোগীদের ট্রমার প্রতি সংবেদনশীল হোন। ঘটনা ভুলে যাওয়া, মনোযোগের অভাব, স্পষ্ট আবেগের অভাব এবং একই ঘটনার একাধিক বর্ণনা ভূক্তভোগীদের ট্রমার লক্ষণ হতে পারে। এ ব্যাপারে সচেতন থাকারপরামর্শ দিয়েছেন স্যান্ডলার।
ভূক্তভোগীদের সাথে কথা বলার আগে, তারা সাক্ষাৎকার দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় আছে কিনা তা নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন প্যানেলিস্টরা। “আপনি নিশ্চয়ই ভুক্তভোগীকে আবার ট্রমাটাইজ করে ফেলতে চান না,” বলেন পোলিতজার। সম্ভব হলে একজন পেশাদার মনোবিজ্ঞানী বা পরামর্শদাতার মাধ্যমে ট্রমা দূর করে তাঁকে সাক্ষাৎকারের জন্য তৈরি করে নিন।
থালিয়া হোমস একজন দক্ষিণ আফ্রিকান ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি বাণিজ্য, স্বাস্থ্য এবং লংফর্ম ফিচার লেখায় দক্ষ। তিনি অনেক জাতীয় পুরষ্কার জিতেছেন এবং এর আগে মেইল অ্যান্ড গার্ডিয়ানে বিজনেস রিপোর্টার হিসাবে কাজ করেছেন। সাংবাদিকতার প্রতি নিজের এই প্রেম খুঁজে পাওয়ার আগে তিনি একজন ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা ছিলেন।
ম্যাডেলিন ক্রোনিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ ভিত্তিক একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার। তিনি মেইল অ্যান্ড গার্ডিয়ানের সাবেক স্টাফ ফটোগ্রাফার। ফটো-সাংবাদিকতা এবং সম্পাদকীয় পোর্ট্রেইট তোলায় তিনি দক্ষ।