সামাজিক মাধ্যমে যে ছবিটি আপনি দেখতে পাচ্ছেন তা কী আসল না নকল – এটি যাচাই করা যায় রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে। এই লেখায় ছবি দিয়ে ছবি খোঁজার সেই পদ্ধতি ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করা হবে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা অন্তরঙ্গভাবে নাচছেন সে দেশেরই গায়িকা বেইব্স ওডুমোর সাথে। ২০১৬ সালে হঠাৎকরেই এমন একটি ছবি ভেসে ওঠে সামাজিক মাধ্যমে। আর দক্ষিণ আফ্রিকানরাও শেয়ার করে করে ছবিটি ছড়িয়ে দিতে থাকেন ব্যাপকভাবে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এটি তৈরি করা হয়েছে, দুটি ছবিকে ফটোশপে জোড়া দিয়ে। সত্যের সাথে মিথ্যা মিশিয়ে কীভাবে তথ্যকে বিকৃত করা হয়, এটি তার অনন্য উদাহরণ।
এরে আগে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের মঞ্চে শিল্পীদের সাথে নাচতে দেখা গিয়েছিল সাবেক এই প্রেসিডেন্টকে। আর নারীপ্রেমী হিসেবে তাঁর খ্যাতির কারণে অনেকেই ওপরের ছবিটিকে সত্য বলে ধরে নিয়েছিলেন।
‘ভুয়া খবর’ নিয়ে সচেতনতা যত বাড়ছে, অনলাইনে পোস্ট দেখা মাত্রই তা শেয়ার করার ক্ষেত্রেও মানুষ ততটাই সতর্ক হয়ে উঠছে। কিন্তু আপনার দেখা ছবিটি সত্য কিনা, অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে নিশ্চিত হবেন, বিশেষ করে যখন ছবিটি দেখছেন মোবাইলে? আশার কথা হচ্ছে, এজন্য বেশ কিছু ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপ আছে, যা বিনা পয়সায় ব্যবহার করা যায়। এখানে তেমনই তিনটি কার্যকর পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে, যা আপনাকে ভুয়া ছবি শেয়ারের লজ্জা থেকে বাঁচাতে পারে।
টিনআই
টিনআই হলো, বিনাপয়সায় ছবি দিয়ে ছবি খোঁজার টুল। রিভার্স ইমেজ সার্চ অনেকটা ছবির সার্চ ইঞ্জিনের মত কাজ করে। কোনো ছবি দিয়ে সার্চ দিলে আপনি দেখতে পাবেন, অনলাইনে এর আগে কোথায় একই অথবা কাছাকাছি ধরণের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে।
টিনআই খুঁজে বের করে কোনো ছবির “সবচে বদলে দেয়া”, “সবচে পুরনো” এবং ”সবচে নতুন” সংস্করণ কোনটি। এটি ব্যবহার করে আপনি সহজেই জেনে নিতে পারবেন, জ্যাকব জুমা আর বেইবস ওডুমোর নাচের ছবিটি ফটোশপে তৈরি।
সম্পূর্ণ আলাদা দুটি ছবিকে জোড়া দিয়ে এটি বানানো হয়েছে। প্রথমটি ওডুমোর একটি কনসার্টের আর দ্বিতীয়টিতে দেখা যায় তানজানিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট জাকায়া কিকওয়েত ও জুমা নাচছেন। এই ছবি তোলা হয় ২০১২ সালে ইথিওপিয়ায় অনুষ্ঠিত এক নৈশভোজে।
টিনআই দিয়ে ছবি খুঁজবেন কীভাবে?
- যে ছবিটি যাচাই করতে চান, তা ডাউনলোড বা সেইভ করুন। সাধারণত, ছবির ওপর কিছুক্ষণ চেপে ধরে রাখলে, সেইভ করার অপশন আসে। অথবা ছবিটির ওয়েব অ্যাড্রেস কপি করে নিয়ে তার মাধ্যমেও যাচাই করতে পারেন। (লিংকটি অবশ্যই শুধু ছবির হতে হবে, গোটা পেইজের নয়।)
- ফোনের ব্রাউজারে www.tineye.com লিখে, সাইটে প্রবেশ করুন।
- “আপলোড ইমেজ” অপশন সিলেক্ট করুন এবং ফোনের ডকুমেন্ট বা ফটো গ্যালারি থেকে ছবিটি খুঁজে বের করুন। অথবা টিনআই সার্চ বারে গিয়ে ছবির লিংকটি পেস্ট করুন।
- ফলাফলে যেসব ছবি উঠে আসবে, সেখান থেকে একটি ছবি ক্লিক করুন এবং ”ইয়োর ইমেজ” ও “ইমেজ ম্যাচে” গিয়ে আপনি যে ছবিটি যাচাই করতে চান তার সাথে মিলিয়ে দেখুন। তখনই বুঝতে পারবেন, জুমা আর ওডুমোর নাচের ছবিটি আসলে বিকৃত করা হয়েছিল।
আপনি যাচাইয়ের গোটা প্রক্রিয়াটি দেখতে পাবেন এই ভিডিওতে।
গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ
রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে জানা যায়, ছবিটি প্রথম কখন ব্যবহার হয়েছে এবং ছবিতে যে ঘটনা দেখা যাচ্ছে তা কোথায় ও কোন সময়ে ঘটেছে। এর মাধ্যমে আপনি আরো জানতে পারবেন, ছবিটি যে উৎস থেকে এসেছে, তা বিশ্বাসযোগ্য কি না।
একদিন হঠাৎ করে একটি ছবি ফেসবুকে ভেসে উঠলো। তাতে দাবি করা হলো “কালো বানর” বলে ডাক দেয়ায় এক ব্যক্তি একজন নারীকে গুলি করে হত্যা করেছে। আর গোটা সোশ্যাল মিডিয়া এই ঘটনা বিশ্বাস করে বসলো। ছবির সাথে গল্পটি জুড়ে দিয়েছিল গুজব ছড়ানোর জন্য বিখ্যাত সাইট জানসি-লাইভ। দর্শকদের জন্য এটাই ছিল প্রথম সতর্ক চিহ্ন।
ছবিটি প্রথম যখন টুইটারে দেখি, তখন আমি আমার ডেস্ক থেকে দূরে ছিলাম। তখনই মোবাইলে একটি স্ক্রিনশট নিই। তারপর ছবিটিকে রিভার্স সার্চ করে খুঁজি। দেখতে পাই, ছবিটি আসল। কিন্তু সেটি তোলা হয় অনেক আগে, লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজ এলাকায়, যখন একটি মোটর বাইক একজন পথচারীকে চাপা দিয়ে চলে যায়।
গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ কীভাবে ব্যবহার করেবন?
- যে ছবিটি যাচাই করতে চান, তা ডাউনলোড বা সেইভ করুন। অথবা ছবিটির ওয়েব অ্যাড্রেস কপি করে নিন। (লিংকটি অবশ্যই শুধু ছবির হতে হবে, গোটা পেইজের নয়।)
- ফোনের ব্রাউজারে https://images.google.com লিখে, সাইটে প্রবেশ করুন।
- ব্রাউজারের মেন্যুতে যান। নিচের দিকে গিয়ে “রিকোয়েস্ট ডেস্কটপ সাইট” অপশন সিলেক্ট করুন। গুগল ক্রোম ব্রাউজারে স্ক্রিনের ওপরে ডান দিকে তিনটি ডটে চাপ দিলেই মেন্যু পাবেন। আইওএসের সাফারি ব্রাউজারে পাবেন স্ক্রিনের নিচের দিকে, মাঝ বরাবর।
- সার্চ বারে গিয়ে ক্যামেরার আইকনে চাপ দিন।
- এর পর আপনার জন্য দুটি উপায় খোলা থাকবে: হয় সার্চ বারে ছবির লিংকটি পেস্ট করা অথবা ফোনের যেই যায়গায় ছবিটি সেইভ করেছেন, সেখান থেকে আপলোড করা।
- এরপর ফলাফল দেখুন। খেয়াল করুন, আর কোথায় এবং কখন ছবিটি ব্যবহার হয়েছে। এভাবে পেছেনে যেতে যেতে এক সময় আপনি খুঁজে পাবেন, ছবিটি প্রথম কে ব্যবহার বা আপলোড করেছে এবং এর মালিকানা বা কপিরাইট কার।
পরামর্শ: আপনি যদি ডিফল্ট মোবাইল ব্রাউজার হিসেবে গুগল ক্রোম ব্যবহার করে থাকেন, তাহলে যে ছবিটি যাচাই করতে চান তার উপর চাপ দিয়ে ধরে রাখুন। দেখবেন একটি ড্রপ ডাউন মেন্যু আসবে। সেখানে “এই ছবিটি গুগলে অনুসন্ধান করুন” এরকম একটি অপশন পাবেন। তাতে চাপ দিলেই রিভার্স ইমেজ সার্চ শুরু হয়ে যাবে।
ফেইক ইমেজ ডিটেক্টর
এই টুলটি রিভার্স ইমেচ সার্চের জন্য টিনআই বা গুগলের মতোই ভালো। কিন্তু এতে বিশেষ একটি সুবিধা আছে। এই টুল দিয়ে ছবি থেকে তোলা ছবিরও সত্যতা যাচাই করা যায়।
ইমেজ ডিটেক্টর কীভাবে ব্যবহার করবেন?
- ক্রোম অথবা ফায়ারফক্স অ্যাপ স্টোর থেকে ফেইক ইমেজ ডিটেক্টর অ্যাপ নামান এবং ইন্সটল করুন।
- অ্যাপটি খুললেই দুটি অপশন দেখাবে, যে কোনো একটি বাছাই করুন। গ্যালারি থেকে বাছাই – এই অপশনে গেলে আপনার ফোন যেখানে ছবি সংরক্ষণ করে, সেই জায়গায় প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে অ্যাপটিকে, যাতে সেটি সে রিভার্স ইমেজ সার্চ করতে পারে। আরেকটি হলো, সাম্প্রতিক ছবি থেকে বাছাই – অর্থ্যাৎ কোনো পোস্টার, পত্রিকা বা সাময়িকীর পাতা থেকে ছবি তুলে সেটি সিলেক্ট করা।
ফেইক ইমেজ ডিটেক্টর দিয়ে আপনি ছবির এক্সিফ ডেটা – অর্থ্যাৎ ছবিটি কখন, কোথায়, কোন ডিভাইসে তোলা, এমনকি ফোনের মালিকের নাম – এ জাতীয় তথ্য চেক করতে পারবেন।
পরামর্শ: ফেইক ইমেজ ডিটেক্টর শুধু অ্যান্ড্রয়েডের জন্য বানানো হয়েছে। যারা আইওএস ডিভাইস ব্যবহার করেন, তারা বিনাপয়সায় ভেরাসিটি – রিভার্স ইমেজ সার্চ নামিয়ে দেখতে পারেন অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর থেকে।
ছবি যাচাইয়ের জন্য কয়েকটি পরামর্শ
সাংবাদিকদের জন্য ফটো ফ্যাক্টচেকিংয়ের এই গাইড তৈরি করেছে “ফার্স্ট ড্রাফট নিউজ”। তবে এর ব্যবহারিক টিপসগুলো যে কারোই কাজে আসবে। যাচাইয়ের জন্য নিজেকে যে প্রশ্নগুলো করতে হবে:
১. ছবিটি প্রথম কখন ব্যবহার হয়েছে? (আপনি যেটি যাচাই করতে যাচ্ছেন তার আগে?)
২. ছবিটি কেমন প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করা হয়েছিল? (যেমন: সিরিয়া বা আফগানিস্তানের পুরনো ছবি অনেক সময় ভেসে উঠতে দেখা যায় গাযার সাম্প্রতিক কোনো ঘটনায়।)
৩. ছবিটিতে মানুষ কেমন পোশাক পরিধান করেছে? যেখানকার কথা বলা হচ্ছে, সেই এলাকার পোশাকের ধরণের সাথে ছবির পরিচ্ছদ কি মিলে?
৪. ছবিতে যে আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে, তা কেমন? গ্রীস্মকালে পোস্ট করা ছবিতে যদি শীত বা তুষার দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে ছবিটি পুরনো বা অন্য এলাকার।
৫. ছবিতে কোনো রোড-সাইন, দোকানের নাম বা বিলবোর্ড আছে কিনা দেখুন। ছবিটি যে জায়গার বলা হচ্ছে, তার সাথে কী ছবিতে দেখা যাওয়া ভাষার মিল আছে?
৬. ছবিতে আলোয় কোনো অসামঞ্জস্যতা আছে কিনা দেখুন। কাছাকাছি দুটি বস্তুর মধ্যে কোনোটি কি বেশি বা কম আলোকিত? যদি হয়, তাহলে সম্ভবত ছবিটি জোড়া দেয়া বা কম্পিউটারে বিকৃত করা।
৭. ছবির মানুষ বা বস্তুর প্রান্তগুলোতে কোনো অসামঞ্জস্যতা চোখে পড়ছে? কাঁচা হাতে বদলে ফেলা ছবিতে এ ধরণের বিকৃতি সহজেই ধরা যায়।
৮. কোনো জায়গার আলো, রং এবং ছায়ায় স্বাভাবিকভাবেই সূক্ষ পার্থক্য থাকে। সফটওয়্যার দিয়ে বিকৃত করা ছবিতে অনেক সময় একটা বড় এলাকা জুড়ে একই রং দেখা যায়, বিশেষ করে ছবি থেকে কোনো কিছু সরিয়ে ফেলা হলে বা যুক্ত করা হলে।
৯. কোনো ছবি টুইট বা পোস্ট করার আগে তিন বার যাচাই করুন।
১০. অনেক সময় অবিশ্বাস্য বিষয়ও সত্য হতে পারে। যেমন: এই নারী দাবি করেছেন তিনি নিজ শরীরে তৃতীয় বক্ষ ইমপ্ল্যান্ট করেছেন।
১১. কেউ যদি কোনো পুরনো বা ভুয়া ছবি পোস্ট করেন, তাকে ভদ্রতার সাথে জানান।
১২. সিদ্ধান্ত নিন, আপনি ভুয়া খবরের অংশীদার হবেন নাকি সমাধানের।
আফ্রিকা মহাদেশের সেরা ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান, আফ্রিকা চেক –এর জন্য এই নির্দেশিকা তৈরি করেছেন রেমন্ড জোসেফ। এটি তাদের ওয়েবসাইটেও পাবেন। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে।
রেমন্ড জোসেফ একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার প্রশিক্ষক। তিনি সাবেক আইসিএফজে/নাইট ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিজম ফেলো। অনলাইন বা সামাজিক মাধ্যমের কন্টেন্ট যাচাই সম্পর্কে তিনি প্রশিক্ষণ দেন সাংবাদিকেদেরকে। পয়েন্টারের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট-চেকিং নেটওয়ার্কের অন্যতম পর্যালোচক রেমন্ড।