নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশ করেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য রয়টার্স ইনস্টিটিউট। অনুমতি নিয়ে লেখাটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো। মূল লেখাটি এখানে পাবেন।
বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র যত পেছন দিকে হাঁটছে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকেরা ততই বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন। এ বছর রয়টার্স মেমোরিয়াল লেকচারে, নিকারাগুয়া ও ভেনেজুয়েলার বক্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, তাদের দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্রমপতনের বিষয়টি বাকি বিশ্বের জন্য একটি সতর্ক বার্তা হতে পারে।
ভেনেজুয়েলার সম্পাদক লুজ মেলি রেয়েস বলেন, “মানুষ বিশ্বাস করে গণতন্ত্র চিরস্থায়ী, আর আমরা দেখাচ্ছি, বিষয়টি তেমন নয়।”
কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোতে সাংবাদিকদের ভূমিকা সাহসিকতাপূর্ণ, কেননা কাজের জন্য তাদের দীর্ঘ কারাদণ্ড ও নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাহলে ভারত ও হাঙ্গেরির মতো দেশগুলোতে গণমাধ্যম টিকে থাকবে কী করে, যেখানে গণতন্ত্রের বহিরাবরণের আড়ালে দেশগুলো ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী ও দমনমূলক হয়ে উঠছে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিসরকে সংকুচিত করছে?
গণতন্ত্র যখন পেছন দিকে হাঁটতে থাকে তখন সাংবাদিকেরা কীভাবে রিপোর্টিং চালিয়ে যাবেন, তা জানতে আমি পিটার এরডেলি ও রিতু কাপুরের সঙ্গে কথা বলেছি। এরডেলি, রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ জার্নালিজমের একজন প্রাক্তন সাংবাদিক ফেলো। বর্তমানে তিনি হাঙ্গেরির অনলাইন সংবাদপত্র ফোরফোরফোর.এইচইউ এবং ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট ল্যাকমুজ-এর পরিচালকের পদে অধিষ্ঠিত। রিতু কাপুর রয়টার্স ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য এবং ভারতের প্রথম মোবাইলভিত্তিক ডিজিটাল নিউজ প্ল্যাটফর্ম, দ্য কুইন্টের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)-এর ২০২৩ প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে হাঙ্গেরির পরিস্থিতিকে সমস্যাজনক হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। দেশটির ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট ভিক্টর অরবানকে চিহ্নিত করা হয়েছে “সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হননকারী” হিসেবে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ টেনে প্রায়ই ভারতের নাম উল্লেখ করা হলেও আরএসএফ দেশটির সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পরিস্থিতিকে “ভীষণ গুরুতর” বলে মনে করে, কারণ চলতি বছরের শুরু থেকে দেশটিতে এ পর্যন্ত ১০ জন সাংবাদিক আটক ও একজনকে হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে।
সাংবাদিকেরা তাহলে কী করবেন?
হাঙ্গেরি ও ভারত, উভয় দেশই গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যদিও পতনের মাত্রা ভিন্ন। দুই দেশের সাংবাদিকেরা কীভাবে কাজ করবেন, তা-ও প্রভাবিত করছে এই পতন। “একটি দেশের সাংবাদিকদের কীভাবে কাজ করা উচিত, তা নির্ভর করে ওই দেশের গণতান্ত্রিক অবক্ষয় কোন পর্যায়ে রয়েছে এবং এর বিপরীতে কতটা রুখে দাঁড়ানো সম্ভব তার ওপর,” বলেন কাপুর।
প্রতিকূল পরিবেশে বয়স, লিঙ্গ, সম্প্রদায় ও জাতিসত্ত্বা, যৌন অবস্থান এবং অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীগত বিষয়ের ওপর নির্ভর করে সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতাও আলাদা হতে পারে। নারীদের যেমন অনলাইন লাঞ্ছনার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাদের যে ধরনের নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয় তা সত্যিই জঘন্য; যেমনটা দেখা গেছে, ব্রাজিলের সাংবাদিক ড্যানিয়েলা পিনেইরো ও আমেরিকার ডিসইনফরমেশন গবেষক নিনা জানকোভিচের ক্ষেত্রে।
অশ্বেতাঙ্গ কিংবা অন্যান্য প্রান্তিক পরিচয় বহনকারী নারীদের জন্য সমস্যাটি আরও গুরুতর। ভারতীয় মুসলিম নারীদের অনলাইনে ‘নিলামে’ তোলা এবং হয়রানির জন্য সামাজিক মাধ্যমে তাদের নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো- এর অন্যতম উদাহরণ। এটি লক্ষ্যনির্দিষ্ট অনলাইন হয়রানির একটি ধরন, যেখানে ওয়েবসাইট বা অ্যাপে বিশিষ্ট মুসলিম নারীদের ছবিসহ পরিচয় বৃত্তান্ত সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়ে প্রহসনমূলক নিলামের লক্ষ্যে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়।
ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে বার্তাকক্ষে কাজ করে যাওয়া সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা পাঁচটি শিক্ষা তুলে ধরছি, যা অন্য সাংবাদিকদেরও কাজে লাগতে পারে।
১. নির্ভুল সাংবাদিকতায় মনোনিবেশ করুন
সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি নির্ভুলতা। যারা প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করছেন তাদের জন্য বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা তাদের সামান্য একটি ভুল প্রতিষ্ঠানের ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে যে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে টিকে আছে। “তাড়াহুড়ো করে বা উস্কানিমূলক কাজের চেষ্টা করবেন না, শুধু নিশ্চিত করুন যে [আপনি যা প্রকাশ করেন] তা সন্দেহাতীতভাবে সম্পূর্ণ নির্ভুল,’’ কাপুর বলেন। “আপনি যদি সামান্যতম সুযোগও দেন, সেক্ষেত্রে আপনি নিজেকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।”
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের শিকার হওয়া দেশগুলোতে সাংবাদিকদের জন্য ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে তারা নিজ থেকে যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন তা হচ্ছে, উল্লিখিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরির সময় কোনোভাবেই একটুও প্রভাবিত না হওয়া, অথবা স্বচ্ছতা বা ন্যায্যতার বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় না দেওয়া। কাপুর সতর্ক করে বলেন, “আপনি পক্ষপাতগ্রস্ত হবেন না বা নিজের মতামতকে তুলে ধরবেন না, কেননা এটা করতে গিয়ে আপনি আপনার পাঠকদের বিশ্বাস হারাবেন,” বলেন কাপুর।
কাপুর কুইন্ট থেকে শেখা আরেকটি শিক্ষা তুলে ধরেন: রিসোর্স ব্যবহারের আগে সর্বোচ্চ প্রভাব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। ২০১৪ সালে যখন দ্য কুইন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন আরএসএফের প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারতের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪০তম (চলতি বছর, ভারতের অবস্থান হয়েছে ১৬১তম)। ২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি ডিজিটাল আউটলেটগুলোর যে প্রবণতা ছিল, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কুইন্টও প্রতিদিন প্রচুর সংখ্যক নিবন্ধ ও ভিডিও প্রকাশ করত। কাপুর জানান, খুব সম্প্রতি আউটলেটটি ব্যাপকভাবে এর আউটপুট কমিয়েছে; আগে যেখানে দিনে প্রায় ৩০০টি কনটেন্ট প্রকাশ করা হতো, এখন সেখানে মাত্র ৩০টি প্রকাশ করছে , যা আগের তুলনায় প্রায় ৯০% কম।
‘‘প্রচলিত কনটেন্ট দিয়ে পাঠকদের ভাসিয়ে দেয়ার পরিবর্তে, দ্য কুইন্ট এখন সার্বিক প্রভাব তৈরি এবং যে গল্পটা বলা প্রয়োজন সে দিকে মনোনিবেশ করেছে,’’ তিনি বলেন। নিজেদের সাফল্য পরিমাপের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলেছে এটি। পেজের কত ভিউ হচ্ছে কিংবা কত মানুষ ওয়েবসাইটে ভিড় করছে, এসব পরিমাপের বদলে এটি বরং পাঠকদের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোচনায় অংশ নিতে উৎসাহিত করছে।
এ পরিবর্তনের অংশ হিসেবে, আউটলেটটি কনটেন্ট বন্টন এবং পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্য বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম প্লাটফর্ম ব্যবহার করছে। কাপুর বলেন, “ইনস্টাগ্রামের ক্ষেত্রে আমরা সচেতনভাবে প্ল্যাটফর্মটির ধরন ও বিন্যাস অনুসারে আমাদের কনটেন্ট তৈরি করি। তা সত্ত্বেও, শ্রোতাদের আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে আমরা আমাদের সাইটে ফরম্যাটগুলোকে টিজার হিসেবে ব্যবহার করছি কিনা- সে বিষয়ে সচেতন। অন্যদিকে, আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে ইউটিউব, কারণ এটি ভিডিও কনটেন্ট ব্যবহারের প্রাথমিক জায়গা।”
২. আর্থিকভাবে শক্তিশালী ও টেকসই হন
আর্থিক দিকটি গুরুত্বপূর্ণ: পাঠকের ওপর প্রভাব বজায় রাখা, শোভন গণ-আলোচনাকে উৎসাহিত করা এবং সাংবাদিকতার মৌলিক লক্ষ্য অর্জনে আউটলেটটি টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট অর্থ থাকতে হবে।
যে কোনো পরিবেশে কাজ করা, যে কারও জন্য প্রযোজ্য। তবে সাংবাদিকতা যখন প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, বিষয়টি তখন আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
কাপুর ভারতের উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানে গণমাধ্যমকে অর্থপাচার বা কর ফাঁকির মতো অর্থনৈতিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মানহানির অভিযোগের মতো প্রচলিত আইনি কৌশল থেকে আলাদা। এ ধরনের অভিযোগের বিপরীতে ধীর আইনি প্রক্রিয়াগুলো অনেক বেশি ক্ষতিকর এবং এর মাধ্যমে সাংবাদিকদের ওপর ভ্রমণ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপ সম্ভব হয় (২০২২ সালে রানা আইয়ুবের ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছিল)। এসব মামলায়, মর্যাদাহানির কারণে প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিকতার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুন্ন হয় এবং আর্থিক খরচও বেড়ে যায়।
কাপুর বলেন, এতসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও, ভারতে এখনও পেওয়াল চালুর সঠিক সময় আসেনি। অনেক মানুষের কাছে সংবাদ পৌঁছে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে তথ্যের নির্ভরযোগ্য উৎসগুলোতে এখনো সবার অবাধ প্রবেশাধিকার রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক যে এ ধরনের কঠিন পরিবেশে সংবাদ সংস্থা হিসেবে আর্থিকভাবে টেকসই থাকার অর্থ হচ্ছে সাংবাদিকদের কর্মসংস্থান হ্রাস করা। দ্য কুইন্ট কীভাবে টিকে আছে জানতে চাইলে, কাপুর উল্লেখ করেন যে কয়েক বছর আগের তুলনায় আমাদের আউটলেটটি এখন আকারে খানিকটা ছোট, যার কারণে প্রকাশিত খবরের সংখ্যাও কমে গেছে। ‘‘কম সংখ্যক মানবসম্পদ ব্যবহার করে বিভিন্ন টুলের মাধ্যমে কিভাবে কাজ সম্পাদন করা যায়, আমরা এখন সে সম্পর্কিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি,’’ তিনি বলেন।
বর্তমানে ১৪৩ জন কর্মী কুইন্টে কর্মরত আছেন, যাদের মধ্যে ৭০ জন সাংবাদিক। গত বছর আমাদের আয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আয়ের প্রধান উৎস অনলাইন বিজ্ঞাপন। গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের সম্মুখীন একটি দেশের জন্য এটি বেশ কঠিন হতে পারে। কাপুর বলেন, যে সব সংবাদমাধ্যম বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয়ের উৎস খুঁজছে “তারা নৈতিকভাবে খুব বেশি শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে পারে না।” তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, কারা স্পন্সরশিপ দিচ্ছে বা বিজ্ঞাপনগুলোর সূত্র কী তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। দ্য কুইন্ট যেমন সরকারি বিজ্ঞাপন নেয় না। প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে মেটা আমাদের অর্থায়ন করে।
৩. পাঠকের সমর্থনকে কাজে লাগান
গণতান্ত্রিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে সংবাদ সংস্থার জন্য বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরতার বিষয়টি এখন আর মোটেও ইতিবাচক নয়। এ অবস্থায় কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান সদস্যপদের (মেম্বারশিপ) মাধ্যমে পাঠকনির্ভর রাজস্ব বৃদ্ধির মতো বিকল্প মডেলের দিকে ঝুঁকছে। বিজ্ঞাপন বাজার ঘিরে সরকারি হস্তক্ষেপের বিপরীতে সমাধান হয়ে এসেছে ফোরফোরফোর.এইচইউ (444.hu)। এরডেলি বলেন: “প্রথম দিকে পাঠকের মাধ্যমে আয়ের পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। তিন বছর যাবৎ পাঠকের কাছ থেকে কোনো ধরনের অর্থ নেয়া ছাড়াই কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা করেছি। এরপর বিজ্ঞাপনের বাজারে সরকার এতো বেশি হস্তক্ষেপ করতে থাকে যে আমরা উপলব্ধি করতে শুরু করি, এভাবে টিকে থাকা সম্ভব হবে না।”
এরডেলি বলেন, ফোরফোরফোর.এইচইউর মেম্বারশিপ স্কিমটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে। ২০২০ সালের আগস্টে পুরোপুরিভাবে মেম্বারশিপ পদ্ধতি চালু হলেও, এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল চার বছর আগে। প্রথমবারের মতো অনুদান সংগ্রহ শুরু হয় ২০১৭ সালে, এরপর তারা ক্রাউডফান্ডিং নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেন।
তিনি বলেন, “ধাপে ধাপে এগোনোর কারণে আমাদের একদল সমর্থক জুটে গিয়েছিল। বেশ কয়েক বছর সময় পাওয়ায় আমাদের জন্য শেখার, ব্যর্থ হওয়ার এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ ছিল।”
ফোরাফোরফোর.এইচইউর প্রকাশনা সংস্থা মাগিয়ার ইয়েতি জিয়ের্তির প্রধান নির্বাহী গ্যাবর কার্ডোস বলেন, বর্তমানে আমাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ২২ হাজারের মতো, যারা নিয়মিত অর্থপ্রদান করেন। আমাদের বার্ষিক আয়ের অর্ধেকেরও বেশি আসে পাঠকের কাছ থেকে, বাকি একটা বড় অংশ আসে বিজ্ঞাপন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ থেকে এবং একটি ছোট অংশ আমরা পাই অন্যান্য উৎস, যেমন, অনুদান নির্ভর প্রকল্প থেকে।
২০২২ সালে এই প্রকাশনা সংস্থাটির মোট আয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ দশমিক ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও ইউরো ও হাঙ্গেরিয়ান মুদ্রা ফরিন্তের মধ্যকার অস্থির বিনিময় হারের ওপর এ সংখ্যাটি নির্ভর করে বলে জানান কার্ডোস। বর্তমানে ফোরফোরফোর.এইচইউতে পূর্ণ-কালীন সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন ৩০ জন। আরো ১০ জনের বেশি কর্মরত রয়েছেন অন্য দুটি আউটলেটে; এদের একটি হচ্ছে বিজ্ঞান ম্যাগাজিন কিউবিট এবং অন্যটি ফ্যাক্ট-চেকিং আউটলেট লাকমুস।
অন্যান্য দেশের মতো, গণতন্ত্রের পিছু-হাঁটা দেশেও পাঠকেরা একগুচ্ছ জটিল কারণে সংবাদের জন্য অর্থ প্রদান করতে উৎসাহী থাকেন।
রয়টার্স ডিজিটাল নিউজ রিপোর্ট ২০২৩-এ বলা হয়, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে স্বতন্ত্র ও ভালো মানের খবর পড়ার জন্য অনলাইন সংবাদ পোর্টালগুলো সাবস্ক্রাইব করতে হয়। তাই, মার্কিনিদের মধ্যে ৬৫% উত্তরদাতা বলেছেন, তারা সংবাদ পাঠের বিপরীতে অর্থ প্রদান করেন। এ সংখ্যাটি যুক্তরাজ্যে ৪৮% এবং জার্মানিতে ৪৪%। আরেকটি কারণ হলো, অর্থায়নের মাধ্যমে মানসম্পন্ন সাংবাদিকতাকে সহায়তার করা, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত বাজারে। তাই, সেখানকার ৩৮% সংবাদ-গ্রাহক ভালো সাংবাদিকতাকে সহায়তা করাকে অর্থায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করেন।
হাঙ্গেরিতে গবেষকরা অবশ্য এ প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করেননি, তবে সেখানেও একই ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে: সরকারের কাজ ঘিরে অসন্তুষ্ট লোকেরা ফোরফোরফোর.এইচইউর মতো সদস্যপদভিত্তিক পোর্টালে সাবস্ক্রাইব করার জন্য নিজ থেকে আগ্রহ অনুভব করতে পারে।
"আমি বলব যে আমাদের দেশের বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতিতে স্বাধীন গণমাধ্যমকে সমর্থন রাজনৈতিকভাবে একটি অবস্থান নেয়ার মতো বিষয় হতে পারে," এরডেলি বলেন। নিয়মিত অর্থ প্রদানের জন্য যদিও একজন ব্যক্তির এ উপলব্ধিটুকুই যথেষ্ট নয়। "এই অনুভূতিটি হয়তো তাদের অনুদানে আগ্রহী করে তুলতে পারে বা পরিবর্তনের শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে, কিন্তু আপনি যদি পাঠকদের ধরে রাখতে চান তবে আপনাকে এমন সেবা দিতে হবে যা তাদের কাজে লাগে ও তারা উপকৃত হয়," তিনি বলেন। "সুতরাং শুরুর দিকে নতুন গ্রাহক আর্কষণের বিষয়টি প্রাথমিক অগ্রগতির জন্য ভাল হলেও আপনি যদি দীর্ঘমেয়াদে তাদের ধরে রাখতে চান তবে আপনাকে এমন সব সেবা ও সুবিধা প্রদান করতে হবে, যা তারা মূল্যবান বলে মনে করেন।"
৪. কথা বলুন এবং যুথবদ্ধ হন
কাপুরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ হচ্ছে অন্যান্য গণমাধ্যমের সঙ্গে যুথবদ্ধ হওয়া: যদি কোনো জোট থাকে তো সেখানে যোগ দেওয়া, নয় তো নিজেরাই তৈরি করে নেওয়া। তিনি বলেন, এখন পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সময় নয়, বরং সম্মিলিতভাবে দাঁড়ানোর সময়। এইভাবে, যদি কোনো সংবাদমাধ্যম বা কোনো সাংবাদিক কোনো ধরনের হুমকির মধ্যে থাকে, তাহলে অন্যেরা তাদের সাহায্যের জন্য একত্রিত হতে পারবেন।
বিভিন্ন প্রচারণা কার্যক্রমের জন্যও সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ; যেমন, সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেয় এমন আইন প্রণয়নের জন্য প্রচারণা। দ্য কুইন্ট যেমন ডিজিটাল-প্রকাশকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ডিজিপাব ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ছিল।
একই ধরনের উদ্যোগের খোঁজ অন্যান্য দেশেও পাওয়া যেতে পারে। ভেনেজুয়েলাতে যেমন গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের কারণে বাধাগ্রস্ত একদল সাংবাদিক পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ ও স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাঁচানোর লক্ষ্যে সম্প্রতি আলিয়ানজা প্রোপিরিওডিসমো নামে একটি সংগঠন চালু করেছে।
গুয়াতেমালাতেও আমরা একই ধরনের ঘটনা দেখি, যেখানে সাংবাদিকেরা জোট বেধে গুয়াতেমালা লিকস এর মতো প্রকল্প শুরু করেছে। এটি জনস্বার্থে গোপনীয় তথ্য শেয়ারের স্বাধীন ও নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম। দেশটির আসন্ন সাধারণ নির্বাচন ঘিরে বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের জোয়ার মোকাবিলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যৌথ ফ্যাক্ট-চেকিং প্রকল্প লা লিনতের্না, কিংবা গণমাধ্যমের ওপর নিপীড়ন নিয়ে সোচ্চার সংগঠন নো নোস ক্যালারান (দে উইল নট শাট আস আপ)।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়াতে হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মতো দেশগুলো আন্তর্জাতিক চাপের প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল। তহবিল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিতের জন্য আইনের শাসন এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের মতো নীতিগুলি মেনে চলা জরুরী। এর মানে এ দেশগুলোতে সাংবাদিকেরা তাদের সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার প্রসঙ্গগুলো তুলে ধরে বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ নীতির ওপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
এরডেলি বলেন, "সরকারি বিজ্ঞাপন বন্টন থেকে শুরু করে কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ বা অপপ্রচার করা কিংবা জনগণের তথ্যে প্রবেশাধিকার হ্রাস বা বিধিনিষেধ আরোপ যাই হোক না কেন, বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেয়া ও তা ঘিরে প্রচার প্রচারণা চালানো জারি রাখতে হবে, যেন সরকারও বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়। এটি হয়তো বিদ্যমান নীতিগুলোকে পরিবর্তন করতে পারবে না এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতিকে খারাপ করবে, তবে এটি আরো আপত্তিকর কিছু ঘটার ক্ষেত্রে বাধা দিতে পারে।"
৫. আপনাকে যদি দেশ ছাড়তে হয়
পরিস্থিতি যদি অনেক বেশি অসহনীয় হয়ে ওঠে, সাংবাদিকরা যদি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বা বাধ্য হতে পারেন। বিষয়টি কঠিন হলেও, দূর্ভাগ্যবশত, খুবই সাধারণ ঘটনা; বিশেষ করে আপনি যদি গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণে এগিয়ে থাকা দেশে সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এ সম্পর্কে কাপুর বলেন, ‘‘বাইরের দেশে অবস্থান করে সাংবাদিকেরা কোনো ধরনের হুমকি ছাড়াই অর্থপূর্ণ কাজ করতে পারেন।’’
রিপোর্ট করার জন্য সাংবাদিকদের নিজ দেশ ছেড়ে যাওয়ার উদাহরণ ল্যাটিন আমেরিকায় ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে। কিউবা ও নিকারাগুয়া থেকে অনেক সাংবাদিককে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনের সর্বাত্মক আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়ার অনেক সাংবাদিকও দেশ ছেড়েছেন।
এক্ষেত্রে অবশ্য বড় ধরনের অসুবিধা রয়েছে: আপনি যে দেশে থেকে রিপোর্ট করছেন সেখানে না থাকার কারণে অনুসন্ধান পরিচালনা করা, তথ্য যাচাই করা এবং সোর্সের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
নির্বাসনে থেকে সাংবাদিকতার বর্তমান প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করা লুইসা এসথার মুগাবো সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেছেন, বিদেশে থেকে কাজ করতে বাধ্য হওয়া সাংবাদিকদের উচিত "দেশের ভেতরে নেটওয়ার্ক ধরে রাখায় অগ্রাধিকার দেওয়া, যাদের তারা বছরের পর বছর ধরে পরখ করেছেন, যাদের [তারা] বিশ্বাস করেন এবং যারা স্বাধীনভাবে কাজ করেন, কারণ শেষ পর্যন্ত এটাই [তাদের নিজেদের] এবং [তাদের] সোর্সের সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।"
ভারতে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে অর্থ সংক্রান্ত অভিযোগ আনার বিষয়টি অনেকটাই সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ ধরনের আইনি বাধা এড়াতে বিদেশে প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করে, নিজ দেশে কার্যক্রম পরিচালনা একটি বিকল্প উপায় হতে পারে। সম্প্রতি রাশিয়া ও অন্যান্য দেশে 'বিদেশী এজেন্ট' হিসেবে আউটলেট খুলে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে অনেক সাংবাদিক রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে বাধা, বাক-স্বাধীনতার বিপরীতে হুমকি এবং হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছেন। এ অবস্থায় চলমান পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে সংবাদ উপস্থাপন ও আয়ের কৌশলগুলো এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যেন মিডিয়া আউটলেটগুলো টিকে থাকার পাশাপাশি কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিবেশে সফলভাবে উতরে যেতে সমর্থ হতে পারে। স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এমন সংবাদ মাধ্যম এই বিষয়গুলো নিয়ে গুরুত্বসহকারে প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে অন্যান্য গণমাধ্যমের সহকর্মী এবং তাদের কাজকে সমর্থন করতে পারে।
আরও পড়ুন
হোয়াই জার্নালিস্টস ইন অটোক্রেসিস শুড রিপোর্ট অ্যাজ ইফ দে আর ইন এ ডেমোক্রেসি
রিসোর্সেস ফর ট্যাকলিং অথরটেরিয়ান থ্রেটস অন ইন্টারন্যাশনাল ডে অব ডেমোক্রেসি
হাঙ্গেরিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ নিউজরুম আটলাটজো টার্গেটেড ইন প্রো-গভর্নমেন্ট স্মিয়ার ক্যাম্পেইন
মেরিনা আদমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ জার্নালিজম-এ ডিজিটাল সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। ইতালির এ সাংবাদিক ব্রাসেলসে পলিটিকো ইউরোপের হয়ে ব্রেকিং নিউজ করার পাশাপাশি যুক্ত আছেন লন্ডনের স্থানীয় সংবাদের সঙ্গে।