গ্যাস ফ্লেয়ারিং হলো তেল উৎপাদনের সময় তৈরি হওয়া অতিরিক্ত প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানো। এর ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড ও মিথেন নির্গমনের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় এবং ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে আশপাশের জনবসতি ছেয়ে যায়।
২০৩০ সালের মধ্যে সব শীর্ষ তেল কোম্পানি ও অনেক দেশ নিয়মিত ফ্লেয়ারিং বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও ইরাকের মতো দেশগুলোতে এখনও ফ্লেয়ারিং হচ্ছে। দেশটি ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী গ্যাস ফ্লেয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস ছিল, এমনকি পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশটি বৈশ্বিক গড়ের দ্বিগুণ হারে উষ্ণ হচ্ছে৷
সম্প্রতি, বিবিসি আরবি সংস্করণের একটি দল দক্ষিণ ইরাকে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর গ্যাস ফ্লেয়ারিংয়ের প্রভাব অনুসন্ধান করেছে।
তাদের তৈরি করা তথ্যচিত্র “আন্ডার পয়জন্ড স্কাইস” (বিষাক্ত আকাশের আড়ালে), তেল খনি সংলগ্ন এলাকায় দূষণের মাত্রা নিরূপণে বসরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শুকরি আল-হাসেনের উদ্যোগকে তুলে ধরেছে। নির্মাতাদের দাবি, বিশ্বের বড় কয়েকটি তেল কোম্পানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ফ্লেয়ারিং নির্গমনের ঘটনা আড়াল করে এবং “বিনিয়োগকারী ও জনসাধারণের সামনে এমন একটি চিত্র তুলে ধরে যেন মনে হয়, তারা নিজেদের প্রতিশ্রুত ২০৩০ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথেই রয়েছে।”
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সহায়তায় বিবিসির দলটি ইরাকের সবচেয়ে বড় তেল খনি রুমাইলা সহ চারটি ভিন্ন তেল খনি সংলগ্ন অঞ্চলের বাতাসে বেনজিনের পরিমাণ নিরূপণ করেছে। এসব খনির প্রত্যেকটিতেই গ্যাস ফ্লেয়ারিং হয়। বেনজিন এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ নির্গত করে যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় এবং বিশেষ করে শৈশবকালীন লিউকেমিয়ার জন্য দায়ী। গ্যাস ফ্লেয়ারিং সংশ্লিষ্ট শনাক্তযোগ্য বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি নিরূপণের লক্ষ্যে অনুসন্ধানটি শিশুদের প্রস্রাবের নমুনা বিশ্লেষণ কয়েছে। এতে লিউকেমিয়ার রোগী আলী হুসেন জুলুদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। গত এপ্রিল মাসে মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত তিনি চলচ্চিত্রটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন।
অধ্যাপক শুকরি-আল-হাসান এসব অঞ্চলে দূষণের মাত্রা পরীক্ষা করতে, প্রথমবারের মতো উন্মুক্ত ডেটা সংগ্রহ করেন। পরীক্ষার ফলাফলে উদ্বেগজনক চিত্র দেখে তাঁর মাথায় একটি প্রশ্ন এসেছিল: “তেল কোম্পানিগুলো যে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে, তার দাম কেন আমরা শোধ করছি?”
গত মার্চে, তথ্যচিত্রটি রয়্যাল টেলিভিশন সোসাইটির কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স-ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয় এবং বিচারকদের ভাষায় তা “সাংবাদিকতার একটি উদ্ভাবনী ও মৌলিক কাজের নজির।” পরিচালক জেসিকা কেলি ও প্রযোজক ওয়েন পিনেলের সাক্ষাৎকারটি সামান্য সম্পাদনা সহকারে নিচে তুলে ধরা হলো।
জিআইজেএন: দলটি কেন দক্ষিণ ইরাকের তেল খনি সংলগ্ন জনগোষ্ঠীর ওপর গ্যাস ফ্লেয়ারিংয়ের প্রভাব অনুসন্ধানে হাত দিল?
জেসিকা কেলি: সে সময়ে মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে তেল ও গ্যাস শিল্পকে ঘিরে জলবায়ু বিষয়ক প্রতিবেদনের ঘাটতি ছিল বলে মনে হয়েছিল। দক্ষিণ ইরাকের অধিবাসীদের আবাসন সংলগ্ন তেল খনি থেকে বিশাল অগ্নিশিখা ও কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভয়ঙ্কর ছবিগুলো টুইটারে শেয়ার হতে দেখেছি। আমাদের কাছে মনে হয়েছিল, জলবায়ু বিষয়ক স্টোরি বলার মতো এটি দারুণ ভিজ্যুয়াল সূচনা বিন্দু , আর তাই আমরা অনুসন্ধানে হাত দিয়েছি।
ওয়েন পিনেল: এর সবই গ্যাস ফ্লেয়ারিংয়ের কারণে সৃষ্ট বলে আমরা জানতে পেরেছি। এই প্রক্রিয়ায় তেল খনন থেকে নির্গত বর্জ্য গ্যাস উন্মুক্ত পরিবেশে পোড়ানো হয়। উভয় প্রক্রিয়াই বৈশ্বিক জলবায়ুর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, কারণ এর ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়, তবে তা মানব স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর।
ইরাকের এই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তাঁরা বারবার আমাদের একই গল্প শুনিয়েছেন: এখানে অনেক মানুষ ক্যান্সারে, বিশেষত লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। তাই এই দুটি বিষয়ের যোগসূত্র আছে কিনা, আমরা তা অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
জিআইজেএন: আপনি কী এই অনুসন্ধানের গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া বর্ণনা করতে পারেন?
পিনেল: প্রাথমিক পর্যায়ে একাধিক ওপেন সোর্স পদ্ধতি ব্যবহার করে, আমরা আবাসিক এলাকার সঙ্গে অগ্নিশিখার দূরত্ব নির্ধারণে উপগ্রহ চিত্র দেখেছি এবং এই খনিগুলো থেকে কতটা নির্গমন হয়, তা নিরূপণে ইন্ডাস্ট্রি ডেটা বিশ্লেষণ করেছি৷
আমরা অল্পতেই বুঝে গেলাম যে ইরাকের বায়ু দূষণের মাত্রা নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই, এবং ক্যান্সারের হার নিয়েও ডেটা নেহাতই সামান্য। তাই এসবের পরিবর্তে ক্যান্সারের সঙ্গে উচ্চ মাত্রার গ্যাস ফ্লেয়ারিংয়ের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যত্র সংঘটিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা তুলে ধরেছি। এর ওপর ভিত্তি করে আমরা তেল খনি সংশ্লিষ্ট এলাকার বাতাসে এবং বসবাসকারী শিশুদের প্রস্রাবে বেনজিন ও ন্যাপথলিন সহ ক্যান্সার সৃষ্টিকারী দূষিত উপাদানের মাত্রা নিরূপণের জন্য একটি “পাইলট গবেষণা” পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিই।
জিআইজেএন: আপনি কি এই অনুসন্ধান পরিচালনা করতে গিয়ে কোন চ্যালেঞ্জ বা বাধার সম্মুখীন হয়েছেন? যদি তাই হয়, তবে তা কী ছিল আর কীভাবে আপনি তা মোকাবিলা করলেন?
কেলি: ইরাকে দলের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা খুব বেশি গভীরে যেতে পারিনি। আমাদের পুরো কাজ জুড়ে সামরিক বাহিনী ও ইরাকি গোয়েন্দাদের উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছিল। আমাদের দলের একজন গোয়েন্দা [কর্মকর্তাদের] হুমকির শিকার হন এবং এজন্য তাকে প্রকল্প ছেড়ে যেতে হয়। কেবল ফ্লেয়ারিং নিয়ে জানতে চাওয়ায় আমাদের একটি সাক্ষাৎকার থামিয়ে দিতে হয়েছিল। ইরাকের অর্থনীতির ৯০% এর বেশি তেল থেকে আসায় এই ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে সমালোচনা করা বেশ কঠিন।
গবেষণায় অংশ নেওয়ার মত যথেষ্ট সাহসী একজন বিজ্ঞানীর সন্ধানে আমরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ অতিবাহিত করেছি। আর জীবনের ঝুঁকি থাকায় বসরার পরিবেশবাদী কর্মীদের নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রায় অসম্ভব ছিল। অন্যতম বড় একটি বাধা ছিল আলী যেখানে থাকতেন তার কাছাকাছি বিপি পরিচালিত খনি রুমাইলায় চিত্র ধারণ করা। নিরাপত্তা চেকপয়েন্টের কারণে সেখানে পৌঁছানো যায় না এবং সেখানে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য আমাদের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। তখনই আমরা আলীর হাতে একটি ক্যামেরা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যেন নিজের জীবনকে তিনি ক্যামেরায় তুলে ধরতে পারেন।
বসরার চরম আবহাওয়া পরিস্থিতিও উল্লেখযোগ্য। আমরা আগস্ট মাসে সেখানে ছিলাম, যখন তাপমাত্রা কখনও কখনও ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১২২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) ছাড়িয়ে যেত। অন্যান্য মাসগুলোতে বালির ঝড়ের কবলে পড়ে অনেক সময় পুরো দিন আমাদের চিত্র ধারণে বিরত থাকতে হয়েছে। দূষণও অনিবার্য, বাতাসে তীব্র গন্ধ আর হলদে আকাশ। সৌভাগ্যক্রমে আমরা ইরাকের বাইরে বাড়ি ফিরে তুলনামূলক পরিষ্কার বাতাসে শ্বাস নিতে পেরেছি। কিন্তু বসরায় বসবাসরত ইরাকিদের কোনো রেহাই নেই।
জিআইজেএন: অনুসন্ধানের সময় আপনি কীভাবে নিজের ও সাক্ষাৎকারদাতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন?
পিনেল: চিত্র ধারণকালে আমরা বিবিসির উচ্চ ঝুঁকি বিষয়ক দলের সঙ্গে কাজ করেছি। তারা আমাদের ও আমাদের প্রদায়কদের নিরাপত্তা বিধানে সহায়তা করেছেন। এমনকি তথ্যচিত্রটি সম্প্রচারের পরও আমরা প্রদায়কদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি যেন চলচ্চিত্রটির রেশ ধরে উদ্ভূত যেকোনো নিরাপত্তা ইস্যুতে আমরা সাড়া দিতে পারি। রাতে বসরা নগরী বিপজ্জনক হতে পারে, এই আশঙ্কায় অন্ধকারের পেছনে আগুনের চিত্র ধারণে আমাদের সাঁজোয়া যান ব্যবহার করতে হয়েছিল।
চলচ্চিত্রটিতে আপনি যেমনটি দেখতে পাবেন, বিভিন্ন ভূমিকায় থাকা অনেকেই বেনামে কাজ করেছেন। ইরাকে সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এড়াতে আমাদের সঙ্গে কাজ করা কয়েকজন সাংবাদিক ও ফ্রিল্যান্সার বেনামী থেকে গেছেন। এই স্টোরিতে ভূমিকা পালনে ইরাকি প্রদায়ক ও সহকর্মীরা যে ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়েছিলেন, আমরা তাঁদের সবার কাছে সমানভাবে কৃতজ্ঞ।
জিআইজেএন: আপনারা কি এই অনুসন্ধানে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ভূমিকা সম্পর্কে বলতে পারেন আর তাঁরা কীভাবে অনুসন্ধানে ভূমিকা রেখেছেন?
কেলি: মূখ্য ভূমিকা পালনকারী ইরাকি পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক শুকরি আল-হাসেন ছাড়া এই অনুসন্ধান সম্ভব হতো না। দূষণ পর্যবেক্ষণের পরিকল্পনা তৈরিতে আমরা তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। গ্যাস-ফ্লেয়ারিং আক্রান্ত শহরগুলোর অধিবাসীদের সঙ্গে তাঁর সহজ আচরণ ও সখ্যতা এবং নমুনা সংগ্রহে পেশাদারিত্ব আমাদের চিত্র ধারণে মনোনিবেশ করার পথ উমুক্ত করেছে। তিনি এ বিষয়ে দারুণ উৎসাহী ছিলেন, বসরাতেই তিনি বেড়ে উঠেছেন, পরিবেশ বিপর্যয় ও মানব স্বাস্থ্যে দূষণের প্রভাব প্রত্যক্ষ করেছেন। জ্বালানি তেল শিল্পের সমালোচনা করে তিনি বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন আর তাই তাঁর সাহসিকতাকে অত্যুক্তি বলা যায় না।
পিনেল: আমরা কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন, ও গ্রিনপিস সায়েন্স ইউনিট সহ গোটা বিশ্বের বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কথা বলেছি। পরীক্ষামূলক কর্মসূচি পরিচালনার জন্য আমদের সম্ভাব্য পদ্ধতিগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে তারা আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন। ফলাফল পাওয়ার পর ডেটা বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর জন্য আমাদের এই বিশেষজ্ঞ প্যানেলের পরামর্শের প্রয়োজন ছিল। এক্সেটার ইউনিভার্সিটির গ্রিনপিস সায়েন্স ইউনিটে কর্মরত আইদান ফ্যারোর নামটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি আমাদের সঠিক দূষণ-মনিটর চিনতে সহায়তা করেছেন এবং সেগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
জিআইজেএন: অনুসন্ধানের সময় আপনি কি তেল কোম্পানি বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রতিরোধ বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করেছেন?
কেলি: আমাদের অন্তত একটি সাক্ষাৎকার আটকে দেওয়া হয়েছিল… দেশে দূষণ-মনিটর নিয়ে আসা এবং রুমাইলায় চিত্র ধারণের ক্ষেত্রে বড় ধরণের ঝুঁকি ছিল। অঞ্চলটিতে কঠোর পাহারা থাকায় চিত্র ধারণের অনুমতির জন্য একাধিকবার আবেদন সত্ত্বেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। এমনকি এলাকায় প্রবেশের জন্য ইরাকি মন্ত্রী ও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের অনুরোধও উপেক্ষিত হয়েছিল।
জিআইজেএন: অনুসন্ধানকালীন কোনো ভুল বা অনাকাঙ্ক্ষিত গাফেলতি কি হয়েছিল আর সেগুলোর সমাধান কীভাবে হয়েছিল?
কেলি: মূলত আমরা কেবল বায়ুতে বিষাক্ত রাসায়নিক বেনজিনের উপস্থিতি শনাক্তে বায়ু পরীক্ষা করতে যাচ্ছিলাম, তবে অনুসন্ধানের মাঝ পথে আমরা বুঝতে পারি যে আসলে মানুষের দেহে কতটা বেনজিন প্রবেশ করছে তা দেখাতে আমাদের অন্য ধরনের পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তাই আমরা অনুসন্ধানের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং শিশুদের প্রস্রাবে দূষণের মাত্রাও পরিমাপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। প্রিমিয়ার লিগনেসের মার্টিন বোডট এই কৌশলটি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন। তিনি সম্প্রতি ইরাক ও ফ্রান্সে গ্যাস ফ্লেয়ারিং সম্পর্কিত একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছেন: “লেস ড্যামনেস ডু পেট্রোল” [তেলের অভিশাপ]।
পিনেল: আমরা “ভেন্টিং” এর চর্চা নিয়ে আরও বিশদাকারে জানতে চেয়েছি। এটি হলো এমন এক ধরনের চর্চা যেখানে গ্যাস না জ্বালিয়ে, বরং অদগ্ধ অবস্থায় মিথেন আকারে বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেওয়া হয়। এটি ফ্লেয়ারিংয়ের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর, তবে ব্যাখ্যা করা ও পরিমাপ করা কঠিন, কারণ তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এটি অদৃশ্যও বটে। চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে চারপাশে ছড়িয়ে পড়া দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষায় মিথেন ভেন্টিং সম্পর্কিত কিছু তথ্য জুড়ে দিয়েছি এবং গ্যাস ফ্লেয়ারিংয়ের সময় কীভাবে মিথেন নির্গত হয়, এই অধ্যাপক চলচ্চিত্রটিতে তাও ব্যাখ্যা করেছেন।
জিআইজেএন: অনুসন্ধানের সবচেয়ে বিস্ময়কর বা চমকপ্রদ আবিষ্কার কী ছিল?
পিনেল: বিপি গোটা বিশ্বে যত ফ্লেয়ারিং নির্গমনের কথা স্বীকার করে, কেবল এক রুমাইলা খনি থেকে তার চেয়ে বেশি নির্গমন হয় – জলবায়ুর দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি জানা নিঃসন্দেহে হতবাক করার মতো বিষয় ছিল। গ্রিনপিস আনআর্থডের জো স্যান্ডলার ক্লার্কের তথ্যচিত্রের ব্যাখ্যানুসারে এই আবিষ্কারটি আমাদের সামনে অনুসন্ধানের একটি সম্পূর্ণ নতুন পথ খুলে দিয়েছে, কারণ আমরা বুঝতে পেরেছি যে এটি কার্যকরভাবে একটি “অ্যাকাউন্টিং কৌশল”। বেশিরভাগ বড় তেল কোম্পানি এটি এমনভাবে ব্যবহার করছে যেন দেখানো যায় যে তারা জলবায়ু বিষয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করছে। এটি তাদের দাবির অসারতা সামনে এনেছে এবং নৈতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে – যেমন, যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম পেনশন তহবিল, নেস্ট, বিপির বার্ষিক শেয়ারহোল্ডার সভায় আমাদের চলচ্চিত্রকে উদ্বৃত করে রীতিমত বিদ্রোহ সূত্রপাত করেছে৷
[বিপি রুমাইলার খনিটি যৌথ পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও তারা অপারেটর নয়। তারা বিবিসির তথ্যচিত্র-দলের কাছ থেকে আসা অসংখ্য সাক্ষাৎকারের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অনুসন্ধানের প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে যে তারা উত্থাপিত অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে। “এই জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিতে এবং যেকোনো উদ্বেগের বিষয় বুঝতে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির পর্যালোচনা করেছে – এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।” তারা বিবিসিকে আরও জানিয়েছে যে কেবল অপারেটর হিসেবে কর্মকাণ্ডের কারণে সৃষ্ট ফ্লেয়ারিং নির্গমন সম্পর্কে রিপোর্ট করা তাদের “নিয়মিত কার্যক্রম।” তাদের মতে, রুমাইলার ফ্লেয়ারিং ও অপারেশনাল ডেটা “তাই আমাদের প্রতিবেদনে যুুক্ত করা হয়নি।”]
কেলি: মানুষের ক্ষয়ক্ষতি হতে দেখাটাও বিস্ময়কর ছিল। অনুসন্ধানের সময় জুড়ে, আমরা ক্যান্সার আক্রান্ত চারটি শিশুর দৃশ্য ধারণ করেছি। এই ক্যান্সারের শিকার হওয়ার সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানি দূষণের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কারণ তারা তেল খনির কাছাকাছি থাকতেন আর তাদের সবাই এখন মারা গেছেন। ইরাকে আমরা হরহামেশা যে ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসা দেখি এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশে বেশিরভাগ মানুষ যে ধরনের চিকিৎসা পেয়ে থাকে, তার মধ্যে বিশাল বৈষম্য চোখে পড়েছে।
জিআইজেএন: এই অনুসন্ধানের ফলে নীতি পরিবর্তন ও জনসচেতনতায় কী প্রভাব পড়বে বলে আপনি মনে করেন?
পিনেল: ব্যক্তিগতভাবে আমি আশা করি, জলবায়ুর জন্য গ্যাস ফ্লেয়ারিংয়ের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর দিকে আরও মনোযোগ দেওয়া হবে। আর শেষ পর্যন্ত কোম্পানি ও সরকারগুলো রুমাইলার মতো এলাকাগুলোকে “স্যাক্রিফাইস জোন” হিসেবে ভাবা বন্ধ করবে – যেখানে মুনাফা ও সম্পদ আহরণকে জন্য মানুষের স্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকার মৌলিক মানবাধিকারের উপরে স্থান দেওয়া হয়।
কেলি: আমার আশা, চলচ্চিত্রটির কারণে সরকার ও তেল কোম্পানিগুলো গ্যাস ফ্লেয়ারিং সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পুরো ব্যাপ্তি সম্পর্কে স্বীকার করবে। দিন শেষে, এ ধরনের কাজ পুরোপুরি পরিহার করা যায়, গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করা উচিত আর কেবল পুড়িয়ে ফেলা নয়, বরং জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা উচিত।
জিআইজেএন: এ বছরের শুরুতে আলীর মৃত্যু পরবর্তী অনুসন্ধানটি বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সে সম্পর্কে আমাদের আরও জানান আর তাদের অনুসন্ধানটি প্রকাশের পর সাংবাদিকেরা কী শিখতে পেরেছেন?
পিনেল: আলীর মৃত্যুতে আমরা খুব বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি- তিনিই ছিলেন চলচ্চিত্রের নৈতিক কেন্দ্রবিন্দু, যিনি আরও পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর পরিবেশের দাবি তোলেন যেন তেল শিল্পের বিষাক্ত দূষণের কারণে তাঁর মতো কষ্ট যেন আশেপাশের শিশুদেরকে ভোগ করতে না হয়।
এমনকি শেষ দিনগুলোতেও তিনি কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভায় বিপির প্রধান নির্বাহীকে কোম্পানির দূষণ নিয়ে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তার অবর্তমানে তার শোকার্ত বাবা এগিয়ে এসেছেন। সাধারণত বৈশ্বিক প্রভাবশালীরা যেখানে জবাবদিহিতার বাইরে থাকেন, সেখানে তিনি বিপিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো বিরল কাণ্ড ঘটিয়েছেন আর কোম্পানিটি আমাদের অসংখ্য সাক্ষাৎকারের আবেদন এড়িয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি প্রচারেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে।
কেলি: চলচ্চিত্রটি শেষ হওয়ার পর এর প্রভাব নিশ্চিত করতে কাজে লাগানোর মতো আপনার হাতে সময় ও রিসোর্স থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সৌভাগ্যক্রমে বিবিসি নিউজ আরবি সংস্করণে তারা বিষয়টিকে সত্যিই গুরুত্ব সহকারে নেয়। চলচ্চিত্রটিকে আমরা মিশরে কপ টুয়েন্টিসেভেন সম্মেলনে নিয়ে যেতে পেরেছি, এমনকি আলীকে আমাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম, আর এর ফলে আমরা সত্যিই পরিবেশ বিষয়ক প্রভাবশালী ক্যাম্পেইনার ও ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িতদের সামনে ছবিটি দেখাতে পেরেছি।
জিআইজেএন: এই বিষয় সম্পর্কিত কোনো ভবিষ্যত অনুসন্ধান বা ফলো-আপ রিপোর্টের পরিকল্পনা কি আছে?
পিনেল: বিশ্বজুড়ে অন্যান্য “স্যাক্রিফাইস জোনে” নজর দিয়ে আমরা এমন একটি অনুসন্ধানের ফলোআপ করার পরিকল্পনা করছি, যেখানে তেল ও গ্যাস ইন্ডাস্ট্রির কারণে স্বাস্থ্য ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির একটি স্ক্রিনিং থেকে আরও জানতে পেরেছি যে সাংবাদিকতাসুলভ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দূষণ পর্যবেক্ষণের ধারণাটি নিউইয়র্কে কাজে লাগানো হচ্ছে৷ তারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যের ওপর যান-চলাচলের প্রভাব নিয়ে কাজ করছেন। আমরা ভবিষ্যতের সহযোগিতামূলক প্রকল্পের জন্য ইরাকের অধ্যাপক শুকরির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কলম্বিয়ার শিক্ষার্থীদের সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছি।
কেলি: আমাদের অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে তেল কোম্পানি ও ইরাকি সরকার পরিবেশগত ক্ষতি কাটিয়ে উঠার অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং আমরা তাদের ওপর নিবিড় নজর রাখছি। আমরা নিশ্চিত করতে চাই যেন আলীর মতো যেসব শিশু ও যুবকদের সঙ্গে আমরা দেখা করেছি তাদের গল্পগুলো স্মৃতির অতলে হারিয়ে না যায়; নিজ জনগোষ্ঠীর পরিস্থিতি বিশ্বকে জানাতে দুঃখজনক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা যেন বৃথা না যায়।
আরও পড়ুন
মিথেন গ্যাসের উৎস অনুসন্ধানের গাইড – যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার মূল চাবিকাঠি
ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম ইন ইরাক ওয়াজ নেভার ইজি। নাও ইটস অলমোস্ট ইমপসিবল
ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং ইন মিডল ইস্ট
শফিক ফয়েজ জিআইজেএনের সহযোগী আরবি সম্পাদক। ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিং ও সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ে তাঁর ১৩ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে।