
ছবি: শাটারস্টক
গেমিং ও সংবাদের যোগসূত্রের একটি পুরনো ইতিহাস আছে। পাঠক সম্পৃক্ততা বাড়াতে ও তরুণ পাঠককুলের নাগাল পেতে দৈনিক পত্রিকার প্রচলিত ধাঁধা ও শব্দজট থেকে শুরু করে ওয়ার্ডলির মতো আধুনিক গেম পর্যন্ত নানান সংবাদ-সংশ্লিষ্ট গেম ব্যবহার করা হয়েছে, দশকের পর দশক ধরে। একই কারণে এখন আমাদের অনেক শখ, কেনাকাটার অভ্যাস ও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে গেমিফাই করা হচ্ছে।
গেমগুলো সমানুভূতিও জাগায় বলে মনে করেন সুইডিশ সাংবাদিক আন্না থুলিন, যিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের নিউজরুম ফেলোশিপের অংশ হিসেবে গেমিফিকেশন ও সাংবাদিকতা নিয়ে একটি কেস স্টাডি লিখেছেন। বিষয়টি পাঠকশ্রোতার ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে।
থুলিন ব্যাখ্যা করে বলেন, “স্টোরি শেয়ার করার যথেষ্ট সময় আপনার হাতে আছে। আগ্রহ ধরে রাখুন। সবসময় আপনার চাওয়া যেন পাঠককে যতটা সম্ভব ধরে রাখার মধ্যে নিবিষ্ট থাকে।”
থুলিন তাঁর প্রতিবেদনে যে স্টোরিগুলো নিয়ে কাজ করেছেন সেগুলোর একটি ছিল জলদস্যুদের মাছ শিকার নিয়ে আল জাজিরার পুরস্কারজয়ী ইন্টারঅ্যাকটিভ অনুসন্ধান। একটি ইমেইল খোলার মাধ্যমে পাঠক এই প্রতিবেদন পড়া শুরু করেন এবং তাকে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলবর্তী সিয়েরা লিওনের জলাভূমিতে অবৈধ ট্রলার নিয়ে অনুসন্ধানরত একজন সাংবাদিকের সঙ্গে যোগ দিতে বলা হয়। এ ধরনের উদাহরণে, গেমগুলো ইমার্সিভ স্টোরিটেলিং কৌশল হিসেবে কাজ করতে পারে, যেখানে পাঠক স্টোরি উন্মোচনের পথ ধরে পরোক্ষ দর্শকের ভূমিকায় না থেকে বরং স্টোরিতে একাত্ম হতে পারেন।

পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে অবৈধ মাছ শিকার নিয়ে অনুসন্ধানের লক্ষ্যে আল জাজিরা একসঙ্গে কয়েকজন মিলে খেলার মতো একটি গেম বানিয়েছে। এখানে পাঠক একটি ইমেইল খুলে খেলা শুরু করেন, যেখানে সিয়েরা লিওনের জলাঞ্চলে অবৈধ ট্রলারের সন্ধানে তাকে যোগ দিতে বলা হয়৷ ছবি: স্ক্রিনশট, আল জাজিরা
“গেমিফিকেশনের মূল ভাবনা ছিল অনুসন্ধানগুলোকে আকর্ষণীয় ও ব্যবহারোপযোগী করার মাধ্যমে আরও অনেক পাঠকশ্রোতার নাগালে পৌঁছে দেওয়া,” থুলিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন অনুসন্ধানটির মূল পরিকল্পনাকারী ও তথ্যচিত্রকার, জুলিয়ানা রুফাস৷
আপনার সংবাদকক্ষে গেমিফিকেশন শুরু করতে চান? এখানে কয়েকটি পরামর্শ রইল।
রিপোর্টিংই গেমের মেরুদন্ড
কেবল একটি বিনোদনমূলক গেম তৈরি করাই যথেষ্ট নয়। এর পিছনের গল্প এবং ডেটাও শক্তিশালী হতে হবে।
ফাইনান্সিয়াল টাইমসের উবার গেম ও সংশ্লিষ্ট ডিজিটাল ফিচারটি ছিল, প্রকাশের বছরে পত্রিকাটির সর্বাধিক পঠিত ও ব্যবহৃত স্টোরিগুলোর একটি৷ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত দলটি পাঠককে এমন একজন উবার চালকের আসনে বসান, যিনি গিগ ইকোনোমিতে জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করছেন।

গিগ-অর্থনীতিতে টিকে থাকার সংগ্রামের বিষয়টিকে রিপোর্টিংয়ে প্রাণবন্ত করে তুলতে ফাইনান্সিয়াল টাইমস একজন উবার ড্রাইভারের দৈনন্দিন জীবনের অনুকরণে একটি গেম তৈরি করেছে। ছবি: স্ক্রিনশট, ফাইনান্সিয়াল টাইমস
ফাইনান্সিয়াল টাইমসের ডিজিটাল ডেলিভারির প্রাক্তন প্রধান রবিন কোং বলেছেন, “উবার গেমে এই ইন্টারঅ্যাকশনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আপনাকে সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে কল্পনা করতে বাধ্য করা এবং এমন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যে কত কঠিন তা বুঝতে সাহায্য করা।”
কোং বলেন, “এখানে দুটি বিপরীতমুখী অনূভূতি রয়েছে; প্রথমত টাকা আসতে দেখে আপনার ভালো লাগা, এবং এও বুঝতে পারা যে খরচ বাবদ কত টাকা চলে যাচ্ছে।” তাঁর মতে, খরচ মেটাতে গাড়ি নিয়ে ছুটে বেড়াবেন, নাকি ছেলেকে বাড়ির কাজে সহায়তা করতে বাড়ি ফিরে যাবেন – সেখানে জীবনের এমন বাস্তব সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় ছিল; প্রতিবেদকদের চোখে চালকদের এই সংগ্রাম ধরা পড়েছে এবং গেমের ডিজাইনেও তা উঠে এসেছে।
কোং বলেছেন, পত্রিকার অনুসন্ধানী দলটি সবার আগে রিপোর্টিংয়ের পর স্টোরির জন্য ঘন্টাপ্রতি গড় রাইড, জ্বালানি ও পরিচ্ছন্নতা বাবদ খরচ এবং পরবর্তীতে গেমটিতে কোডিংয়ের জন্য প্রতি ঘন্টার গড় ভাড়ার মতো প্রয়োজনীয় প্রাসঙ্গিক ডেটা সংগ্রহ করেছে।
অন্তত একজন ডেভেলপার প্রয়োজন
অনুসন্ধানী স্টোরিগুলোকে গেমিফাই করার কোনো একক পদ্ধতি নেই। তবে ভালভাবে প্রস্তুত করা না হলে গেমটি আপনার স্টোরিকে আরও আকর্ষণীয় না করে বরং মনোযোগ বিচ্যুতির কারণ হতে পারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি ওপেন সোর্স টুলের কল্যাণে সাংবাদিকেরা এখন আগের চেয়ে সহজে তাঁদের ডিজিটাল স্টোরিতে গেম যুক্ত করতে পারেন। স্ক্রিপ্টিং ও ডিজাইনের প্রাথমিক টুল হিসেবে টোয়াইন ও নিউজগেমারের মতো টুলগুলো দুর্দান্ত, তবে কাজের জন্য কিছু কাস্টমাইজেশন প্রয়োজন। তাই আপনার কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে কাজ করতে অভ্যস্ত অন্তত একজন ডেভেলপারের সঙ্গে অংশীদারিত্বের পরামর্শ দেন কোং।
তিনি সতর্ক করে বলেন, “আপনার হয়ত কিছুটা কোডিং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কাউকে লাগবে, বিশেষ করে কিছু টুলের জন্য; আপনি হয়ত সেগুলো সমন্বয় করতে চাইবেন। আপনি সেগুলো ইচ্ছে মতো ব্যবহার করতে পারবেন না।”
গেম প্লের জটিলতা, অলংকরণ ও কাঠামোর ভিত্তিতে আপনার ওয়েবসাইটে যেন নির্বিঘ্নে চলতে পারে, তা নিশ্চিত করতে আপনার আরও দক্ষ কোডার ও ডেভেলপার প্রয়োজন হতে পারে। কোং আরও বলেন, “আপনি হয়ত নিজস্ব শৈলী ব্যবহার করতে চাইবেন এবং বুঝতে চাইবেন যে সেটি আপনার কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত করবেন।”
গেমিফাই করার একটি উপাদান বেছে নিন এবং সে মোতাবেক এগিয়ে যান
আপনার প্রতিবেদনে গেমিং যুক্ত করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো স্টোরির বর্ণনার কেন্দ্রে থাকা একটি বার্তা বা থিম বেছে নেওয়া এবং গেমিফিকেশনের মাধ্যমে তা আরও বিশদাকারে তুলে ধরা।
আরো কেন্দ্রীভূত এই কৌশলটি গেমিফিকেশনকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দেয় না। জলদস্যুদের মাছ শিকার নিয়ে আল জাজিরার গেমটি মোটামুটি সহজ হলেও গেমটির একাধিক বা বিভিন্ন রকমের ফলাফল ছিল না – প্রাথমিক ভাবনা থেকে প্রকাশনা পর্যন্ত তা কার্যকর করতে প্রায় ১০ মাস সময় লেগেছিল।
আল জাজিরার অনুসন্ধানটির মূল বিষয় ছিল অবৈধ মাছ ধরার নৌকাগুলো খুঁজে বের করা। উবার নিয়ে করা স্টোরির ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল চালকদের ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন উপলব্ধি করা।
কোং বলেছেন, “মানুষের আগ্রহ তৈরিতে বা আপনার অনুসন্ধানের একটি নির্দিষ্ট দিক তুলে ধরতে বা প্রকাশ্যে আনতে গেমটি কাজে লাগানো যেতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “যতটা সম্ভব ছোট ও সহজ রাখুন, কারণ শুরুতে আপনি যতটা জটিল ভেবেছিলেন, সময়ের সঙ্গে তা আরও জটিল রূপ ধারণ করতে পারে।”
কেস স্টাডি
কঠোর সাংবাদিকতা ও পাঠকশ্রোতার সৃজনশীল সম্পৃক্ততার সমন্বয় ঘটাতে ইন্টারঅ্যাক্টিভ অনুসন্ধান আগের চেয়ে বেশি স্বীকৃতি পাচ্ছে। ২০১৮ সালে প্রোপাবলিকা, ডব্লিউএনওয়াইসি, ও প্লেমেটিক্স মিলে দ্য ওয়েটিং গেম নামের একটি স্টোরি প্রকাশ করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে নির্মম অভিবাসন যাত্রা এবং আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে দেশটিতে প্রবেশের পর অভিবাসীরা যে অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হন, এটি সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পাঠকদেরকে নিয়ে যায়।
জিআইজেএনের প্রদায়ক প্যাট্রিক স্ট্রোহেকারের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সিসি ওয়েই বলেন, “বিশেষ এই ক্ষেত্রে আমাদের ভাবনা ছিল: ‘প্রচলিত ব্যবস্থার অধীনে একজন মানুষকে যত দীর্ঘ অপেক্ষার মধ্যে থাকতে হয়, কেমন হয়, আমরা যদি মানুষকে সেই অভিজ্ঞতার স্বাদ দিতে পারি, ততক্ষণ অপেক্ষায় রাখতে পারি?’”
এমন আরেকটি ইন্টারেক্টিভ অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরি করেছে কলম্বিয়ার কুয়েশতিয়ন পুবলিকা । গেম অব ভোটস্ নামের এই অনুসন্ধান সম্প্রতি সিগমা পুরস্কার জিতেছে। এই গেম, ২০২২ সালের সংসদীয় নির্বাচনের আগে কলম্বিয়ার ভোটারদের এমন এক মধ্যযুগীয় বাস্তবতার ভেতর দিয়ে নিয়ে যায়, যেখানে তারা বুঝতে পারে যে হাল আমলের রাজনৈতিক পরিবারগুলো কীভাবে দেশটির ক্ষমতা দখল ও কুক্ষিগত করে রাখে।

কুয়েশতিয়ন পুবলিকো একটি গেম তৈরির জন্য ২০২৩ সিগমা অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছে। এই গেম কতগুলো ডেটাবেসের ভিত্তিতে পাঠককে কলম্বিয়ার আসন্ন নির্বাচনের বিভিন্ন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে নিয়ে যায়। ছবি: স্ক্রিনশট, কুয়েশতিয়ন পুবলিকো
মূল শিক্ষা
লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্সের এই প্রকল্পের গবেষক থুলিন রিপোর্টিংয়ে গেমের ব্যবহার নিয়ে সংবাদমাধ্যমের জন্য কিছু সুচিন্তিত সুপারিশ পেশ করেছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বচ্ছতা, সরলতা, সহযোগিতা আর “পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা।” গেমিফাইড স্টোরিগুলোতে নৈতিকতা ও ব্যবহারোপযোগীতার পাশাপাশি ব্র্যান্ডিং নিয়ে দুশ্চিন্তা সহ কিছুটা ঝুঁকিও থাকে বলে তিনি সতর্ক করেছেন।
থুলিন বলেছেন, “সাইটে নিউজ গেম বা গেমিফাইড উপাদান যা-ই থাকুক না কেন, কাঠামো ও কন্টেন্ট থেকে শুরু করে ব্যবহৃত রং ও বাটনের আকার পর্যন্ত প্রতিটি জিনিস আপনার কোম্পানির পরিচয়ের প্রতিফলন ঘটাবে।” তাই স্টোরিতে অন্য যে কোনো মিডিয়া উপাদান যুক্ত করার ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের একটি নির্দিষ্ট সূত্র মেনে চলা উচিত। তিনি বলেছেন, “কোনোভাবে এটি মানোয়ন্ননে ভূমিকা রাখে কিনা, নিজেকে সেই প্রশ্ন করুন। কেবল বলার জন্য বলা, ‘আমাদের তরুণ পাঠকদের কীভাবে আকৃষ্ট করা যায়? আসুন একটু গেমিফিকেশন করি।’ না, আমার মনে হয় না, এটি কাজ করে।”
আরও পড়ুন
অনারিং দ্য বেস্ট ইন ডেটা জার্নালিজম: উইনারস অব দ্য ২০২৩ সিগমা অ্যাওয়ার্ডস
হাও প্রোপাবলিকা ইউজড এ গেম টু টেল স্টোরিজ অব ফাইভ ইমিগ্রান্টস সিকিং অ্যাসাইলাম
ক্যাটারিনা সাবাদোস কানাডার ভ্যাঙ্কুভার-ভিত্তিক মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক। তিনি বর্তমানে গ্লোবাল রিপোর্টিং সেন্টারে সাপ্লাই চেইন নিয়ে সংবাদ করছেন। তাঁর রিপোর্টিং ও গবেষণা এনবিসি নিউজ, কানাডার ন্যাশনাল অবজারভার, দ্য টাই, দ্য টরন্টো স্টার এবং ওসিসিআরপি-তে প্রকাশিত হয়েছে।