তুরস্ক ও সিরিয়ায় গত ৬ই ফেব্রুয়ারির ভয়াবহ ভূমিকম্প বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে ক্রমবর্ধমান “প্রাকৃতিক দুর্যোগ” পুরোটাই প্রাকৃতিক নয় বরং প্রায় ক্ষেত্রেই মানুষের ভুল পদক্ষেপ, অবহেলা বা দুর্নীতি পরিস্থিতিকে আরও শোচনীয় করে তোলে।
যেমন, তুরস্কে ভূমিকম্পে ভবন ধ্বসের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কয়েক ডজন ঠিকাদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু যেসব রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তা সাধারণ ক্ষমা আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার করে অনেক অবকাঠামোকে মজবুত করতে দেননি, তারা জবাবদিহির বাইরে থেকে গেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সজ্ঞান অবহেলার কারণে বিপর্যয় আরও ঘনীভূত হয়েছে, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত কমপক্ষে ৪০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
গত এক দশকে জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্নীতি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবক্ষয়ের কারণে ওয়াচডগ রিপোর্টারদের জন্য বন্যা, ভূমিকম্প, সুনামি, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ও টাইফুন পরবর্তী জোর তৎপরতার সঙ্গে অনুসন্ধান করা এবং মাঠ পর্যায়ে বা দূর থেকে, যে কোনোভাবে, মূল ক্রীড়ানকদের জবাবদিহি করা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
নেপাল ইনভেস্টিগেটিভ মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক রাজনীশ ভান্ডারি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের জন্য ২০১৫ সালের নেপালের ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করেছেন। সেই ঘটনায় প্রায় ৯,০০০ মানুষ নিহত হয়।
তিনি টাইমস পত্রিকার জন্য করা একটি ভিডিওর কথা মনে করে বলেন, “প্রথম স্টোরি পাঠাতে ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য আমি ট্রাফিক পুলিশ স্টেশনে বসে ছিলাম।”
ভান্ডারি বলেন, দুর্যোগ – বিশেষ করে পুনর্গঠনের দুর্নীতিপ্রবণ পর্যায় – নিয়ে অনুসন্ধানের দুর্দান্ত কিছু ওয়াচডগ পদ্ধতি রয়েছে, যেমন, ডেটাবেস ও রিমোট সেন্সিং টুল, সোশ্যাল মিডিয়া সার্চ এবং অর্থের গতিপথ অনুসরণ করা। তবে তিনি উল্লেখ করেন যে এই স্টোরিগুলোর জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বাড়তি চেষ্টার প্রয়োজন: মাঠ থেকে রিপোর্ট করা (বা ঘটনাস্থলে কোনো সহায়তাকারীর সঙ্গে অংশীদারিত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলা); বেঁচে ফেরা ও শোকাহত পরিবারের প্রতি সমানুভূতি প্রদর্শন; এবং ঘটনার পরের সপ্তাহ ও মাসগুলোতে নতুন ও সৃজনশীল প্রশ্ন করা চালিয়ে যাওয়া।
ওয়াচডগ রিপোর্টারদের জন্য শুরু করার প্রথম পদক্ষেপ হলো তুরস্কে ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কেবল “প্রাকৃতিক” কারণে হয়েছে, এমন ধারণা বাদ দেয়া। এর পরিবর্তে, বিপজ্জনক ঘটনা ও মনুষ্যসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের মিশেল হিসেবে ভাবুন। আর তারপর ফরেনসিক পরীক্ষা অনুসরণ করুন: অর্থ, মানুষ, অপ্রত্যাশিত চাহিদা, দায়ী কর্মকর্তা। আপনার অনুসন্ধানই হয়তো প্রথমবারের মতো প্রকৃত ঘটনায় ইঙ্গিত করতে পারে এবং ভবিষ্যতে জীবন বাঁচাতে পারে।
বিষয়টি বিবেচনা করে সোর্স ও নিজেদের ব্যাপারে অনুসন্ধানী সম্পাদক ও সাংবাদিকদের জানতে চাওয়া ১০টি প্রশ্ন এখানে তুলে ধরা হলো।
১. ত্রাণের টাকা কোথায় যায়, আর খরচের ক্ষেত্রে ফুটোগুলোই বা কোথায়? দুর্যোগে লাখ লাখ ডলারের সহায়তা, পুনর্গঠন অনুদান, এবং ত্রাণ সহায়তা আসে। দুর্নীতির মামলা ছাড়াও, সাংবাদিকেরা প্রায়ই বিতরণ ব্যবস্থায় উদ্বেগজনক অনিয়ম ও পদ্ধতিগত ব্যর্থতা সামনে এনেছেন যা সেই অর্থের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে বা আটকে দেয়। নেপালের সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম ২০১৫ সালে নেপালের বিধ্বংসী ভূমিকম্প পরবর্তী পুনর্গঠন তহবিলের ফাঁকফোঁকরগুলো নিয়ে একটি দুর্দান্ত ওয়াচডগ স্টোরি তৈরি করেছে, যেখানে দেখা যায় ২১ মাস পর বাস্তুচ্যুতদের মাঝে মাত্র ৩% আর্থিক সহায়তা পৌঁছেছে৷ অর্থের গতিপথ নিয়ে জানতে চাওয়া মূল প্রশ্নগুলো হলো: “বন্টন ব্যবস্থার নেপথ্যে কারা — আর তদারকির দায়িত্বে কে কে আছেন?” “জরুরি অবস্থা সংশ্লিষ্ট কোনো আইন কি আছে বা খাদ্যদ্রব্য কি চুরি হয়েছে বা কালো বাজারি অর্থনীতিতে কি পাচার হয়েছে?” এবং “বেসরকারি সেবা দানকারীদের কীভাবে নির্বাচন করা হয়েছে আর তারা কি সেই চুক্তি অনুযায়ী বিতরণ করেছে?”
২. ঘটনার আগে ও পরে মনুষ্যসৃষ্ট কর্মকাণ্ডে কি বিপর্যয় আরও শোচনীয় হয়েছে? এই একটি প্রশ্ন পরিকল্পনা ব্যর্থতা ও যোগাযোগের গরমিল নিয়ে চটজলদি স্টোরি থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পর্যন্ত অসংখ্য অনুসন্ধানী দিক সামনে আনতে পারে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণত পূর্বাভাস, পরিকল্পনা, সম্পদের বন্টন, এমনকি সময়মত জনসাধারণের মাঝে সতর্কবার্তা দিয়েও ঘূর্ণিঝড়, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ও সুনামির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলানো যায়। কার্যকর ও সমন্বিত সরকারি তৎপরতার মাধ্যমেও ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি সীমিত রাখা যায়, যেমনটি দেখা গেছে ২০১০ সালে, নিউজিল্যান্ডে। সেবার ৭.১ মাত্রার ক্যান্টারবেরি ভূমিকম্পের পর সফল সাড়াদান কার্যক্রমের কারণে মাত্র একজনের মৃত্যু হয়েছিল।
৩. বিপর্যয়ের কারণে কি ঘটনাস্থলের আশেপাশের সুরক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি বা বিষাক্ত দূষণ ছড়িয়ে পড়তে পারে? জাপানে ২০১১ সালের সুনামির পর ফুকুশিমা পারমাণবিক বিপর্যয় এবং প্রযুক্তিগত ও যোগাযোগ ত্রুটি সবচেয়ে সুপরিচিত দৃষ্টান্ত। তবে ভূমিকম্প, বন্যা ও সুনামির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত তেল শোধনাগার, সামরিক ঘাঁটি ও রাসায়নিক কারখানা থেকে দূষণের মতো জটিল প্রভাব পড়তে পারে, যা নিয়ে অনেক সময় সাংবাদিকসুলভ অনুসন্ধান হয় না।
৪. দুর্নীতি বা গোষ্ঠীপ্রীতির কারণে কি মৃতের সংখ্যা বেড়েছে? নেচার জার্নালের এক গবেষণা অনুসারে, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ভূমিকম্পের কারণে ধসে পড়া ভবনে ৮৩% মৃত্যু পদ্ধতিগতভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোতে হয়েছে। গবেষকদের মতে, “মাঝারি ভূমিকম্প থেকে বড় দুর্যোগ হওয়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী” দুর্বল নির্মাণ সংস্কৃতি। কিছু ক্ষেত্রে বেশি প্রাণহানির কারণ হলো: দায়িত্বজ্ঞানহীন নেতারা জরুরী দুর্যোগ মোকাবিলার কাজে নিয়োজিত সংস্থায় অযোগ্য বন্ধুদের বসান এবং এতে করে ত্রাণ তহবিলের অবৈধ হাতবদল হয়। ২০২২ সালে পাকিস্তানের ব্যাপক বন্যার পর এমনটা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল।
৫. জরুরী ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমস্যা, বা দুর্যোগ সহায়তায় বৈষম্য নিয়ে ডেটায় কী পাওয়া যায়? ২০২১ সালে ওয়াশিংটন পোস্টের ডেটা সাংবাদিক অ্যান্ড্রু বা ট্রান সরকারি ডেটাবেস ঘেঁটে দেখতে পান যে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি (ফেমা) থেকে সহায়তা অনুমোদনের হার ২০১০ সালের ৬৩% থেকে ২০২১ সালে কমে মাত্র ১৩% হয়েছে। আমেরিকার “ডিপ সাউথ”-এ দুর্যোগে বেঁচে ফেরা কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য সহায়তা বরাদ্দ পদ্ধতিগতভাবে প্রত্যাখ্যানের চিত্র তুলে ধরতে অনুসন্ধানী দলটি আদমশুমারি ডেটায় জাতিগত শ্রেণী ভেদে সহায়তা সংশ্লিষ্ট ডেটাও তুলনা করেছেন।
৬. দুর্যোগের শিকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে দৃশ্যত লুটপাট ও শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা নিয়ে কীভাবে নৈতিকতার সঙ্গে রিপোর্ট করতে পারি? সুনির্দিষ্টভাবে কোনো অনুসন্ধানী দিক না হলেও লক্ষণীয় বিষয় হলো: ছাঁচীকরণ এবং পক্ষপাতের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৫ সালের হারিকেন ক্যাটরিনা বিপর্যয় নিয়ে গবেষক নাদিয়া দাবিশার সংবাদ কভারেজের বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেঁচে ফেরা কৃষ্ণাঙ্গদের প্রায়ই বিশৃঙ্খলার প্রেক্ষিতে চিত্রিত করা হলেও জীবিত শ্বেতাঙ্গদের সাহায্যপ্রার্থী হিসেবে দেখানো হয়েছে। তিনি বলেছেন যে দোকান থেকে খাবার নেয়া একজন আফ্রো-আমেরিকান ব্যক্তিকে কীভাবে “লুটেরা” হিসেবে দেখানো হয়েছে, যেখানে একই কাজে জড়িত একজন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে “খাবারের খোঁজ করছেন।” বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন যে ছাঁচীকরণ এড়াতে এবং পরিস্থিতির শিকার ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর লুটপাটের মত বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করার সময় সাংবাদিকদের সতর্ক থাকা উচিত।
৭. জরুরী দুর্যোগ মোকাবিলা ব্যবস্থায় জড়িতদের কাছ থেকে আমরা কী শিখতে পারি? দ্য নিউ হিউম্যানিটারিয়ান-এর নির্বাহী সম্পাদক জোসেফাইন শ্মিট জিআইজেএনকে বলেছেন, দুর্যোগ মোকাবিলা ব্যবস্থা এবং “৩০ বিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তা খাত” – এখন আর সরকার, জাতিসংঘ ও “বড় সাহায্য প্রকল্পের” একচেটিয়া ব্যবসা নয়। এই দলে নিজ খরচে দুর্যোগস্থল ভ্রমণে নিয়োজিত বেসরকারি ব্যক্তি, অনলাইন কমিউনিটি, এমনকি স্বেচ্ছাসেবক অগ্নিনির্বাপকেরাও আছেন। এরা গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য স্বাধীন তথ্য, মূল্যবান অ্যাক্সেস, এমনকি হুইসেলব্লোয়ারের ভূমিকা পালন করতে পারেন।
৮. প্রাথমিক বিপর্যয়ের কারণে কী ধরনের জনস্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হতে পারে? প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর সৃষ্ট নতুন পরিস্থিতি, বিশেষ করে দূষিত পানীয় জল ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় ব্যর্থতার কারণে রোগ থেকে মৃত্যুর নতুন ঢেউ সৃষ্টি হয়ে থাকে। এছাড়াও যক্ষ্মা ট্যাবলেট থেকে প্রসবপূর্ব যত্ন ও ভেন্টিলেটর পর্যন্ত দৈনন্দিন জটিল স্বাস্থ্য সেবার বাধাগুলো নিবিড়ভাবে যাচাই করা প্রয়োজন।
৯. দুর্যোগে কে লাভবান হচ্ছে? অতীতের দুর্যোগগুলোতে মতাদর্শিক বিভ্রান্তি-সৃষ্টিকারী থেকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও অনলাইনে অনুদান হাতিয়ে নিতে ভুক্তভোগী ছদ্মবেশে প্রতারকচক্রসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধাবাদীদের আশঙ্কাজনক উত্থান চোখে পড়েছে৷ ২০১০ সালে হাইতি ভূমিকম্পের কয়েক সপ্তাহ পর পোর্ট-অ-প্রিন্সের ক্ষতিগ্রস্ত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একজন অফ-ডিউটি কর্মকর্তা এই প্রতিবেদক ও একজন বেসরকারি বিমানচালককে ঐ স্থান ত্যাগের অধিকার হরণ করে চাঁদাবাজির চেষ্টা করেছিল; এর ফলশ্রুতিতে বিমানটিকে সেই কর্মকর্তার ডাকা একটি সহিংস গোষ্ঠী থেকে দূরে সরিয়ে নিতে হয়েছিল বিমানচালককে।
১০. এখানে কী নেই? পুনর্গঠন প্রকল্পে প্রয়োজনীয় দক্ষ কারিগরের অভাব থেকে শুরু করে সম্ভাব্য বিপর্যয়ের মুখে অবহেলিত দরিদ্র জনগোষ্ঠী পর্যন্ত, দুর্যোগ পরবর্তী সমস্যা এত বেশি যে সেগুলোর ব্যাপারে নিয়মিত সম্পাদকীয় চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। যোগ করার মত কোনো নতুন ধারণা আপনার থাকলে আমাদের জানান। দুর্যোগ অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট যে বড় নির্দেশিকা নিয়ে আমরা কাজ করছি, সেখানে যুক্ত করব৷
আরও পড়ুন
স্যাটেলাইট ছবি কোথায় পাবেন এবং কীভাবে ব্যবহার করবেন?
জলবায়ু সংকট: অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য আইডিয়া
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমস পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। বিদেশ প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ২০০০ সালে মোজাম্বিকের বন্যা, ২০০৪ সালে শ্রীলংকার সুনামি, এবং ২০১০ সালে হাইতির ভূমিকম্প নিয়ে রিপোর্ট করেছেন।