পাভলা হলকোভা হলেন চেক প্রজাতন্ত্র (চেকিয়া) ও স্লোভাকিয়ায় সংগঠিত অপরাধ ও তার প্রভাব নিয়ে আন্তঃসীমান্ত অনুসন্ধানে নিয়োজিত স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান চেক সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও প্রতিষ্ঠাতা।
এছাড়াও হলকোভা, অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশান রিপোর্টিং প্রজেক্টের সেন্ট্রাল ইউরোপ সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেন। তাঁর গড়া চেক সেন্টার ওসিসিআরপির (এবং জিআইজেএনেরও) সদস্য প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি প্যান্ডোরা পেপার্স সহ একাধিক যুগান্তকারী আর্থিক অনুসন্ধানে কাজ করেছেন। তাঁর দল উন্মোচন করেছে, তৎকালীন চেক প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ বাবিস কীভাবে ফ্রান্সে বিলাসবহুল রিয়েল এস্টেট কেনার জন্য অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে মিলিয়ন ইউরো স্থানান্তর করেছিলেন। নির্বাচনের কয়েক দিন আগে তাদের অনুসন্ধান প্রকাশিত হয়, আর এই নির্বাচনে বাবিস হেরে যান।
আজারবাইজানি লন্ড্রোম্যাট নামে আরেকটি প্রকল্পে তারা তুলে আনেন, আজারবাইজানের অভিজাত শাসকগোষ্ঠী কীভাবে শেল কোম্পানির মাধ্যমে ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের টাকা দিয়েছেন এবং মুদ্রাপাচার ও বিলাসপণ্য ক্রয় করেছেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে একাধিক ইউরোপীয় ব্যাঙ্ক ও সংস্থার মাধ্যমে প্রায় ২.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাঠানো হয়েছে৷ পানামা পেপার, পেগাসাস প্রজেক্ট ও রুশ লন্ড্রোম্যাট প্রকল্পেও তিনি যুক্ত ছিলেন। এসব অনুসন্ধানে, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে মলদোভা ও লাটভিয়াভিত্তিক বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কের মাধ্যমে রাশিয়ার বাইরে ২০ থেকে ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচারের পরিকল্পনা প্রকাশ্যে এসেছিল৷
একটি মোড় বদলে দেওয়া ফোনকল
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে হলকোভা একটি ফোনকল পান। তিনি জানতে পারেন, তাঁর বন্ধু ও সহকর্মী স্লোভাক সাংবাদিক ইয়ান কুচিয়াক ও তাঁর বাগদত্তা মার্টিনা কুশনিরোভাকে হত্যা করা হয়েছে। সে সময় ইতালির শক্তিশালী মাফিয়া চক্র ‘এনদ্রাংঘেতা’র সঙ্গে স্লোভাক সরকারের যোগসাজশ নিয়ে একটি অনুসন্ধানে তিনি ইয়ানের সঙ্গে কাজ করছিলেন।
এরপর হলকোভা অনুসন্ধানটি শেষ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হন এবং কুচিয়াক ও তাঁর বাগদত্তা হত্যার অনুসন্ধানে অন্যান্য সাংবাদিকদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক উদ্যোগ নেন। এর ধারাবাহিকতায় ওসিসিআরপি, চেক সেন্টার, ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং প্রজেক্ট ইতালি (আইআরপিআই) ও কুচিয়াকের প্রতিষ্ঠান আকচুয়ালিটিডটএসকে মিলে এ মার্ডার্ড জার্নালিস্টস লাস্ট ইনভেস্টিগেশন শীর্ষক ধারাবাহিক প্রকাশ করে, যেখানে প্রকৃত সত্য উঠে আসে। তিনি ও তাঁর দলটি ব্যবসায়ী মারিয়ান কোচনারকে নিয়ে, পুলিশি তদন্তের ফাঁস হওয়া ৫০ টেরাবাইটের বেশি ডেটা সংগ্রহ করেন। কুচিয়াক এই ব্যবসায়ীর আর্থিক অপরাধ অনুসন্ধান করছিলেন। কোচনার লাইব্রেরি নামে তাঁদের অনুসন্ধানের কারণে স্লোভাকিয়ায় দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা উন্মোচিত হয় এবং প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী সহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা পদত্যাগে বাধ্য হন। জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তারাও পদত্যাগ করেন এবং প্রায় ২১ জন বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও বিচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়।
ওসিসিআরপি ও ফাইনাল কাট ফর রিয়েলের সহ-প্রযোজনায় দ্য কিলিং অব এ জার্নালিস্ট নামক চলচ্চিত্রে হলকোভাকে দেখানো হয়। চলচ্চিত্রটি মূলত কুচিয়াক ও মার্টিনা হত্যাকাণ্ড তদন্তের ফাঁস হওয়া পুলিশি নথি নিয়ে হলকোভা ও তাঁর সহকর্মীদের অনুসন্ধানকে তুলে ধরেছে।
হলকোভা তাঁর কাজের জন্য অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। তবে তিনি যাদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন, তাদের পক্ষ থেকে হুমকি ও হয়রানির শিকারও হয়েছেন। তাঁকে এই বলেও হুমকি দেওয়া হয়েছে যে হুমকিদাতারা তাঁর বাড়ির ঠিকানা জানেন। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা প্রধানমন্ত্রী বাবিসের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর, তাঁদেরকে চেকিয়ার সুষ্ঠু নির্বাচন বানচালে বিদেশীদের অর্থপুষ্ট দালাল বলে অভিহিত করা হয়। সম্প্রতি আমি হলকোভার সঙ্গে কথা বলেছি; জানতে চেয়েছি তাঁর অনুপ্রেরণা, তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা কীভাবে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন, এবং তাঁরা সাধারণত কোন ধরনের স্টোরি এড়িয়ে চলেন।
প্রশ্ন: আপনি কেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন?
পাভলা হলকোভা: আমি সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করেছি আর অনলাইন সংবাদে কাজ করা ছিল আমার প্রথম চাকরি। কাজটি ছিল অনেকটা সংস্থাগুলোর বানানো রিপোর্ট থেকে সংবাদ পুনর্লিখনের মতো। তাই মনে মনে বলেছিলাম, আমি যে ধরনের সাংবাদিকতা করতে চাই, এটি তা নয়। তারপর ২০১৩ সালে আমি ওসিসিআরপি-এর পল রাদুর সঙ্গে দেখা করি, এবং তিনি আন্তঃসীমান্ত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সম্পর্কে কথা বলেন। তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে আমি ঠিক এ ধরনের সাংবাদিকতাই করতে চেয়েছি, তাই আমি এই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছি।
প্রশ্ন: এ ধরনের স্টোরি নিয়ে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা কী?
পা.হ.: কয়েকটি মৌলিক নিয়ম আছে যা আমরা মেনে চলি। যেমন, আমাদের কেউ স্টোরি দিলেই যে আমরা সেটি করব, এমন নয়। সিক্রেট সার্ভিস বা কোনো রাজনীতিবিদ এসে আপনাকে কোনো স্টোরি দিলে তা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, কারণ আপনি তাদের ব্যক্তিগত বা সাংগঠনিক স্বার্থের বড় পরিকল্পনার অংশ হয়ে যেতে পারেন। তাই এমন স্টোরি আমরা করি না। বরং আমরা অস্ত্র চোরাচালান ও অর্থ পাচার থেকে কোকেন বাণিজ্য পর্যন্ত নানা ধরনের বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করি।
প্রশ্ন: মধ্য ইউরোপে অনুসন্ধানী সাংবাদিক হওয়ার কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথা বলুন।
পা.হ.: চেক প্রজাতন্ত্রে আমাদের বেলায় মূলত কাজজনিত চাপ, রাজনীতিবিদদের হুমকি ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা। যেমন, সবচেয়ে বড় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাবিস। তাই আমাদের মতো সাংবাদিকদের নিয়ে প্রচারণা চালানো তার জন্য খুবই সহজ। এছাড়া, আর যা আছে সেগুলো নিরবেই ঘটে; ব্যতিক্রম হলো আমাদের সহকর্মী ইয়ান কুচিয়াকের হত্যাকাণ্ড।
প্রশ্ন: উক্ত চ্যালেঞ্জগুলো আপনি কীভাবে মোকাবেলা করেন?
পা.হ.: চেক ও আন্তর্জাতিক উভয় দলের চমৎকার মানুষগুলোর সঙ্গে আমি কাজ করছি। এটাই আমাকে চাঙ্গা রাখে আর আমি যখন হতাশা, ক্ষোভ ও ক্লান্তিতে ডুবে থাকি, তাঁরা সবসময় আমার নিজেকে ফিরে পেতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন: আপনি ও আপনার সহকর্মীরা একে অন্যকে কীভাবে সহায়তা করেন?
পা. হ.: আমরা একে অন্যকে অনেক সমর্থন জোগাই, আর আমার মতে, এর কারণ কাজের ধরন; আমরা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করি। বাণিজ্যিক গণমাধ্যমের চেয়ে আমাদের নীতিতে কিছুটা ভিন্নতা থাকে। আমরা অন্য সহকর্মীদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখি না, বরং তারা আমাদের স্টোরি তৈরিতে সহায়তা করতে পারে। অনেক সাংবাদিকের কাছে এটি একটি নতুন ধারণা, তবে আমাদের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায়, সম্ভবত আমরা খুব দ্রুতই কাজের চাপে মুষড়ে পড়তাম।
প্রশ্ন: কাজজনিত চাপ সামলাতে আপনার পরামর্শ কী?
পা. হ.: কাজের চাপে মুষড়ে পড়া যে কারো জন্য আমার আন্তরিক পরামর্শ, ঘুমোতে যাওয়ার আগে বই বা উপন্যাস পড়ুন। চলমান স্টোরিগুলো নিয়ে স্বপ্ন দেখা থেকে এটি আপনাকে দূরে রাখে৷ যেমন, আমি প্রায়ই এক সঙ্গে ছয় বা সাতটি উপন্যাস পড়ি।
প্রশ্ন: আপনার বেশ কিছু অনুসন্ধানে প্রভাবশালী ব্যক্তি বা সংস্থার মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে যা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারত। আপনি কীভাবে একটি স্টোরি বা কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে নিজেকে নিরাপদ রাখেন?
পা.হ.: এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার জন্য কঠিন, কারণ আমি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশগুলোর একটিতে বাস করি। একই সময়ে আমি বলকান ও অন্যান্য দেশের রাজনীতিবিদদের নিয়েও অনুসন্ধান করি, তাই অন্য দেশগুলোতে অনুসন্ধানী কাজের অভিজ্ঞতা হয়ত আমার কাজে আসে। তবে অবশ্যই আমরা সবসময় সতর্ক থাকি আর যথাযথভাবে রিপোর্টিং করার চেষ্টা করি। আমরা স্টোরির চরিত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলি আর স্টোরিতে তাদের বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ দিই।
প্রশ্ন: আপনার জানা এমন কোনো শিক্ষার কথা কী বলবেন, যা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় যুক্ত সবারই শেখা উচিত?
পা.হ.: আমি শিখেছি যে একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করা কতটা জরুরি। আর আমি কেবল অভিজ্ঞতা, হতাশা বা আনন্দ ভাগাভাগির কথা বলছি না; আমি ডেটা, প্রকৃত নথি ও স্টোরির খসড়া ভাগাভাগির কথাও বলছি, ইয়ান কুচিয়াক ও তাঁর বাগদত্তা হত্যার ঘটনায় যেমনটি হয়েছে। আমার সঙ্গে তাঁর গুগল ড্রাইভ শেয়ার করা এবং তাঁর সব নথি ও অনুসন্ধানে আমার অ্যাক্সেস ছিল বলেই হয়ত তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো আমরা শেষ করতে পেরেছি। তাঁর শুরু করা স্টোরিগুলো শেষ করতে এটাই কাজে এসেছিল। তাই শেয়ারিং খুব সহজ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি উপকরণ।
প্রশ্ন: বিশ্বব্যাপী স্বাধীন সাংবাদিকতার ঝুঁকি বাড়ছে। সাংবাদিকেরা কীভাবে এই ঝুঁকি মোকাবেলা করতে পারেন?
পা.হ.: সাংবাদিক হিসেবে পাঠকদের সঙ্গে আমাদের আরও বেশি কথা বলতে হবে এবং বোঝাতে হবে যে আমাদের জন্য নিজেদের রক্ষার উপায় খুব সীমিত। আমরা যদি পাঠকদের বোঝাতে পারি যে আমরা তাদের জন্য কাজ করি, তারা প্রয়োজনে আমাদের পক্ষে দাঁড়াবে।
প্রশ্ন: আপনার কোন কাজটিকে সেরা বলে মনে হয়?
পা. হ.: আমার করা একটি প্রকল্প, যা নিয়ে আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত আর এটিই এখন পর্যন্ত করা আমার সবচেয়ে কঠিন কাজ: ইয়ান কুচিয়াক হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধান আর তারপর যে সিস্টেমের কারণে এমন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তা উন্মোচনে নিয়োজিত সাংবাদিকদের একটি দলকে সমন্বয় করা। কাজটি সবচেয়ে কঠিন ছিল, কারণ আমরা সত্যিই ইয়ানের ভাল বন্ধু ছিলাম আর আপনার ভাল বন্ধু হত্যার অনুসন্ধান করা সত্যিই বেশ চ্যালেঞ্জিং।
এই সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশ করে রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজম। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
আরও পড়ুন
টাকার গন্ধ শুঁকে সংঘবদ্ধ অপরাধ খুঁজে বের করে যে চেক অনুসন্ধানী দল
হোয়াই আই থিংক স্লোভাক জার্নালিস্ট ইয়ান কুচিয়াক’স মার্ডার উইল নেভার বি ইনভেস্টিগেটেড
গানস, পলিটিক্স অ্যান্ড মিডিয়া: এ লুক অ্যাট চেক ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম
মরিস ওনিয়াঙ্গো কেনিয়ার নাইরোবি ভিত্তিক একজন ফ্রিল্যান্স মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাতা। তিনি জিআইজেএন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, হান্ড্রেড রিপোর্টার্স, আফ্রিকাডটকম, এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য লিখেছেন।