“হলফ করে বলছি, গত শীতে একটু উষ্ণতার জন্য আমরা আমাদের পরনের কাপড় পুড়িয়েছি” – সাদ্দাম হোসেন আল-গাসি যখন একথা বলছিলেন সেটি যেন আলেপ্পোর বাইরে তাঁর যে আবাস সেই তাঁবু-ভরা গ্রামটির দৃশ্য ফুটিয়ে তুলছিল। ভিডিওটি ৩৬০ ডিগ্রীর বলে দর্শক সেখান থেকে তার ইচ্ছে মত স্মার্টফোন ঘুরিয়ে জপ কাসের অলিগলি দেখে নিতে পারেন, যেখানটায় ঠাঁই হয়েছে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ৬৭ লাখ মানুষের। সংঘাতপূর্ণ এই অঞ্চলের গল্পগুলোকে তুলে ধরতে স্বাধীন গণমাধ্যম সংস্থা ফ্রন্টলাইন ইন ফোকাস যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, এটি তার একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। পুরষ্কারজয়ী আলোকচিত্রী খলিল আশাভি সংস্থাটির সহপ্রতিষ্ঠাতা।
২০১৩ সালে সিরিয়া থেকে তাঁর রিপোর্টিং শুরু করেন আশাভি। সে সময় তিনি রয়টার্সসহ বিভিন্ন সংবাদ প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় ছবি জমা দিতেন। এর পাঁচ বছর পর তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ফ্রন্টলাইন ইন ফোকাস চালু করেন। তিনি শুরুতে একটি ফেসবুক পেজে তাঁর নিজের কাজ তুলে ধরতেন; তারপর দেশটির আরও বড় পরিসরের গল্প তুলে ধরতে শুরু করেন। বর্তমানে ফ্রন্টলাইন ইন ফোকাস সিরিয়া থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও ফটোসাংবাদিকতা করছে এবং ডাচ ব্রডকাস্টার এনওএস ও সুইস প্রতিষ্ঠান এসআরএফ-এর মতো গণমাধ্যম সেবাগ্রহীতাদের জন্য ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) ও অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) ভিত্তিক স্টোরিটেলিংয়ের দিকে সম্প্রসারিত হচ্ছে।
সংস্থাটি সিরিয়ার স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করে (এবং প্রশিক্ষণে সহায়তা দিয়ে থাকে), এবং তাদের বেশিরভাগ কর্মী সিরিয়াতেই থাকেন। সিরিয়া ও সুইজারল্যান্ড থেকে ফ্রন্টলাইনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা আশাভি ও প্রোডাক্ট থিঙ্কার হাইল খালাফের সঙ্গে আলোচনায় উঠে এসেছে, সংস্থাটি সংঘাত ও সংকটের মানবিক গল্পগুলো তুলে ধরতে কীভাবে ইমার্সিভ পদ্ধতি (বাস্তবতার আবহ তৈরিতে ছবির ব্যবহার) কাজে লাগাচ্ছে।
লরা অলিভার: আপনার রিপোর্টিং মূলত সিরিয়া ভিত্তিক, অথচ আপনি ইয়েমেনে অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করেন এবং লিবিয়া থেকেও স্টোরি করেছেন। ফ্রন্টলাইন ইন ফোকাস আসলে কোন স্টোরিগুলো তুলে ধরে?
খলিল আশাভি: সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ২০১৭ – ১৮ পর্যন্ত, সব সংবাদ সংস্থার আলোচনার বিষয় ছিল যুদ্ধ, আর মাঠ পর্যায়ে এই যুদ্ধের ঘটনা পরিক্রমা। কিন্তু বাড়িঘর ছেড়ে আসা মানুষগুলোর অবস্থা নিয়ে এদের বেশিরভাগই কিছু বলছিল না। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা কিছু স্টোরি করেছি বটে, তবে আমদের মূল মনোযোগ ছিল- জনস্বার্থ। গত দু’বছরে, আমরা কোনো কিছু তুলে ধরতে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির ওপর নজর দিয়েছি, কারণ গণমাধ্যমও এধরনের [চরিত্র প্রধান] স্টোরি আশা করে।
হাইল খালাফ: যুদ্ধের শুরুতে ক্ষণে ক্ষণে সংঘাতের রঙ পাল্টেছে আর এধরনের স্টোরিতে সংবাদ সংস্থাগুলোরও আগ্রহ ছিল। ইতিমধ্যে ১১ বছর পেরিয়ে গেছে আর এখন এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী সংকটে রূপ নিয়েছে। আপনি এমন লোকও পাবেন, যারা ১০ বছর ধরে তাঁবুতে বাস করছেন। আমরা সেই মানবিক দিকে নজর দিতে চাই, যেদিকে সচরাচর চোখ পড়ে না। এমন একজনকে নিয়েও আমাদের স্টোরি আছে, যিনি আশ্রয়হীন বিড়ালদের জন্য একটি অভয়ারণ্য তৈরি করেছেন। এছাড়া আরেকজনকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন আছে, যিনি নিজ বাড়িতে যেতে পারেন না, অথচ সেটি আশ্রয়শিবির থেকে খালি চোখে দেখা যায়। যুদ্ধ মানে কেবল লড়াই আর সংঘাত নয়।
যুদ্ধের শুরুতে সাধারণ মানুষ নাগরিক সাংবাদিকতার ধারণাটি পছন্দ করেছিল। বিভিন্ন সংস্থা ও দূতাবাস জনসাধারণকে ছবি তোলা ও পাঠানোর সরঞ্জাম দিয়েছিল। তবে কেউ তাদের প্রশিক্ষণ দেয়নি। অথচ সিরিয়ার ভেতরে কী ঘটছে, বাইরে থেকে তা জানার এটিই ছিল একমাত্র উপায়। কারো কারো ক্ষেত্রে এটি কাজ করেছিল বটে, তবে এমন অনেকেই আছে যাদের আরেকটু মনোযোগ ও পরামর্শ প্রয়োজন ছিল। যারা নিজেদের সাংবাদিক মনে করেন তাদের সক্ষমতা তৈরি করতে হবে, তবে অনেক সময় তাদেরও সেই পেশাদার প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়।
এলও: এই গল্পগুলো বলতে ভিআর ও এআর স্টোরিটেলিং কীভাবে কাজে আসে?
কেএ: ভিআর ও এআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে গণমাধ্যমের জন্য স্টোরি তৈরি করা মিডিয়া প্রোডাকশনের একটি নতুন ও বৈপ্লবিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতি দর্শকদেরকে সংবাদের প্রথাগত উপস্থাপন থেকে বেরিয়ে আসতে, এবং এই নতুন অভিজ্ঞতায় নিমগ্ন হতে সাহায্য করে। আপনি কখনো কি কল্পনা করেছেন, একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের ক্ষতবিক্ষত রাস্তায় আপনি হাঁটছেন? ঠিক এমন অভিজ্ঞতাই আমরা আপনার সামনে হাজির করি।
এইচকে: একটি সাধারণ ভিডিওর তুলনায় ভিআর বা এআর স্টোরিতে আপনি অনেক কিছু তুলে ধরতে পারেন। দর্শক অনেক বেশি জানতে পারে আর ভুক্তভোগীর দৃষ্টিতে সেই পরিস্থিতি দেখতে পারে। এআর একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তি: আপনি চাইলে আপনার রান্নাঘর বা বসার ঘরে কাউকে হাজির করতে পারেন, আর কীভাবে তার পরিবার রাসায়নিক হামলায় নিহত হয়েছে সেই গল্প শুনতে পারেন।
কেএ: সাংবাদিকদের মাধ্যমে আমরা সিরীয় শরণার্থী শিবিরের গল্প তুলে ধরতে একটি ভিআর লাইভ স্ট্রিম করেছি। সাংবাদিকেরা সরাসরি অনুবাদ সুবিধা কাজে লাগিয়ে শিবিরের যে কারো সঙ্গে কথা বলতে পারেন। এই লাইভ স্ট্রিম ব্যবহার করে আমরা ডাচ টিভির জন্যও একটি স্টোরি তৈরি করেছি। আমরা এখন সংঘাত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের শিশুদের গল্প মাথায় রেখে এআর প্রজেক্ট তৈরির কাজ করছি। প্রকল্পটি এআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৩০টিরও বেশি স্টোরি তৈরি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এলও: কী কী সরঞ্জাম প্রয়োজন?
এইচকে: সরঞ্জাম ও সম্পাদনা বেশ ব্যয়বহুল: কিছু ৩৬০ ডিগ্রী ক্যামেরার দামই ৮০০ মার্কিন ডলার, তা-ও মাইক্রোফোন ও কেবল ছাড়া। কিছু এইট-কে ক্যামেরার দাম পড়ে সাড়ে চার হাজার মার্কিন ডলার। তাই আমরা একটি (ক্যামেরা) নির্মাতা-কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছি৷ স্টোরিগুলো তৈরিতেও প্রচুর সময় ও সম্পদ লাগতে পারে। ভিআর লাইভ স্ট্রিমের জন্য সরাসরি অনুবাদ সুবিধা দিতে পাঁচজন সব সময় প্রস্তুত ছিলেন।
কেএ: ভিআর ও এআর-এ সম্পাদনা করা বেশ কঠিন। এআর-এ যা দেখাতে চান, তা স্ক্যান করতে একটি স্ক্যানার লাগে। দেখানো অবজেক্টগুলোতে প্রায়ই ত্রুটি পাওয়া যায়, বিশেষ করে মানুষ বা প্রাণীর মতো চলমান অবজেক্টে তা বেশি হয়ে থাকে। তারপর আমরা সেগুলোকে একটি প্রসেসিং সফটওয়্যারে এক্সপোর্ট করি, এবং যতক্ষণ না সম্ভাব্য যথাযথ আকৃতি পাই ততক্ষণ একটু একটু করে প্রক্রিয়াজাত করি। তারপর অবজেক্টগুলোর আকার ছোট করে আনি, কারণ অবজেক্টগুলো আকারে বড় থাকে এবং ইন্টারনেট সংযোগ দুর্বল হলে অনলাইনে বড় আকারের অবজেক্ট নাও দেখা যেতে পারে। শেষ ধাপে আছে, সফটওয়্যার ও এআর মডেলের জন্য বিশেষভাবে নকশা করা ডিসপ্লে ইন্টারফেসের সাহায্যে সংবাদমাধ্যমের জন্য তৈরি করা ম্যাটেরিয়ালের সঙ্গে এই অবজেক্টগুলোকে যুক্ত করা।
সিরিয়ার আরেকটি সমস্যা হল ইন্টারনেট: বাড়ি ও অফিসের বাইরে ইন্টারনেট সংযোগ নেই, তাই স্যাটেলাইট ইন্টারনেট রাখতে হয়, যা আমাদের সঙ্গেই থাকে।
এলও: রিপোর্টার, দর্শক এবং নিউজরুমের জন্য চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
কেএ: সিরিয়া থেকে রিপোর্ট করায় নিরাপত্তা নিয়েও আমাদের ভাবতে হয়। আমরা আমাদের কর্মীদের হেলমেট, সুরক্ষা পোষাক এবং নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। আমাদের সংবাদদাতাদের অবস্থান ট্র্যাক করতে আমরা ৩৬০ ডিগ্রী লাইভ স্ট্রিম ব্যবহার করি: সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে ধরে নিতে হয়, কোনো সমস্যা হয়েছে।
এইচকে: কাউকে কোথাও পাঠানোর আগে নিরাপত্তার দিক থেকে আমরা সবসময় একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করে থাকি। এছাড়াও নাগরিক সাংবাদিকদের প্রায়ই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ভালো যোগাযোগ থাকে। তারপরও ছবি তোলার সময় অবশ্যই তাদেরকে আপনার উদ্দেশ্য খোলাসা করে বলতে হবে।
কেএ: প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ গতিসম্পন্ন চমৎকার ইন্টারনেট অবকাঠামো এবং বিভিন্ন ধরনের ভিআর হেডসেট থাকায় এ ধরনের স্টোরি দেখতে তেমন একটা সমস্যা হয় না। দুর্বল প্রযুক্তি ও ধীরগতির ইন্টারনেট সংযোগ সম্পন্ন দেশের দর্শকেরা নিজেদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এই স্টোরিগুলো দেখতে পারেন। আমরা আমাদের স্টোরির আকারও কমাতে চাই, যেন ইন্টারনেট সংযোগ যতই খারাপ হোক না কেন সবাই সেগুলো দেখতে পারে।
এইচকে: আমার বিশ্বাস, এই প্রযুক্তিগুলোই আমাদের ভবিষ্যৎ। আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক, তাই ঘটতে চলেছে। তাই এই খেলায় এক ধাপ এগিয়ে থাকাই ভালো।
এই পোস্ট মূলত রয়টার্স ইনস্টিটিউটে প্রকাশিত হয় এবং অনুমতি নিয়ে এখানে পুনরায় প্রকাশ করা হল।
আরও পড়ুন
হাও দে ডিড ইট: ইনসাইড এ মেগা-কোলাবোরেশন অন দ্য ইউএস-মেক্সিকো ওয়াল
৯ ধরনের ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিং, যা মোবাইল ফোনের জন্য খুবই কার্যকর
নিউ টুলস ওপেন আপ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি টু জার্নালিস্টস
লরা অলিভার যুক্তরাজ্যভিত্তিক একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজমে লেখালেখি করেন এবং এর আগে গার্ডিয়ান ও বিবিসির জন্যেও লিখেছেন। স্ল্যাক মেসেজিং অ্যাপে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকদের বৈশ্বিক কমিউনিটি সোসাইটি অব ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্টস এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা তিনি।