সাড়া জাগানো প্যান্ডোরা পেপার্স অনুসন্ধান প্রকাশের পরপরই অনুসন্ধানী সাংবাদিক জন-অ্যালান নামু তাড়াহুড়ো করে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছিলেন।
অফশোর সম্পদ, গোপন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও কেনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবার নিয়ে করা স্টোরিতে জড়িত ছিলেন বলে, তিনি সম্ভাব্য পাল্টা আঘাতের অপেক্ষায় না থেকে বাড়ি থেকে তাঁর পরিবারকে সরিয়ে ফেলেন, স্কুল থেকে সন্তানদের ছাড়িয়ে নেন, আর নিজে এক মাস আত্মগোপনে চলে যান। তখনই ভাবনাটা তাঁর মনে আসে: সাংবাদিকতার এই চাকরি কি আসলেই এতটা মূল্যবান!
তিনি বলেছেন, “প্যান্ডোরা পেপার্সে আমরা সে সময় দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবারের ওপর নজর দিয়েছি, আর এমন সব বিষয় উন্মোচন করেছি যা হয়তো তারা প্রকাশ্যে আনতে চায়নি। এই ঘটনার পর অনেকে ভেবেছিল, আমার ও আমার পরিবারের সেখানে বসবাস করা এবং প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় থাকা ঠিক হবে না।”
নাইরোবির অনুসন্ধানী ও ইন-ডেপথ সাংবাদিকতা প্রযোজনা সংস্থা আফ্রিকা আনসেন্সর্ডের প্রধান, নামুর জন্য তখন ছিল পেছনে ফিরে তাকানোর সময়। এই সময় তাঁকে ওয়াচডগ রিপোর্টার হওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে: তাঁর পরিবারকে ঝুঁকি ও চাপের মুখে ফেলা কি ঠিক হচ্ছে, আর অন্য কোনো কাজে যোগ দেওয়ার সঠিক সময়ই বা কখন?
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়টার্স ইনস্টিটিউট আয়োজিত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় মানসিক বিপর্যয় নিয়ে ওয়েবিনারে তিনি বলেছেন, “এই ভাবনাগুলো জেঁকে বসে। মনে প্রশ্ন আসে, নিজের আগ্রহ ও উচ্চাকাঙ্খায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমি কি আমার সন্তান ও স্ত্রীকে স্বাভাবিক জীবন দিতে পারছি? নিজেকে এই প্রশ্নগুলো করা মোটেও সহজ নয়। এটি কোনো স্বাভাবিক জীবন নয়, এমন জীবন আমার পরিবারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কি ঠিক?”
I'm going to be sharing some experiences on the emotional toll of investigative journalism on the 12th of this month with @risj_oxford . So, in preparation let me share one (short-ish) story from October-November last year, about #PandoraPapers and the days after. Ready? OK
— John-Allan Namu (@johnallannamu) October 4, 2022
যে বোঝা বইতে হয়
নামু বলেন, “এমন ঝামেলা যে আমাকে একা পোহাতে হয় ব্যাপারটি মোটেও তেমন নয়, বরং বিশ্বের অনেক অনুসন্ধানী সাংবাদিকের এই অভিজ্ঞতা আছে। বিষয়টি সত্যিই আমাকে ভাবায়: কেন আমি আমার পরিবারকে এমন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছি? আমার সন্তানেরা এখন যে বয়সে আছে, তারা আমার কাজ আর আমি কি করি– তা নিয়ে সত্যিই প্রশ্ন তুলতে পারে। এগুলো মোটেও সহজ আলাপ নয়।”
তিনি আরও বলেছেন, “সাংবাদিকদের বিষয়গুলো মানুষ বুঝে না। একটি বাইলাইন স্টোরির পেছনে কেবল একজন মানুষ থাকে না। পরিবার, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, এমনকি সেই সাংবাদিকের সঙ্গে ঘটে যাওয়া যে কোনো কিছুর প্রভাব থাকে।”
ওয়েবিনারের মডারেটর ভারতীয় সাংবাদিক ও সংবাদ উপস্থাপক মিতালি মুখার্জির বক্তব্যেও একই সুরের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। তিনি বলেছেন, ব্যক্তিগত আলাপে অনেক রিপোর্টার – “বিশেষ করে যাঁদের বাচ্চা আছে” – তাঁরা জানতে চান, এই কাজই কি তাঁদেরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে? আর তাদের ছাপিয়ে যদি তাদের সন্তানদের জীবনের দিকে তাকাই এবং প্রশ্ন করি যে আমরা যে কাজ বেছে নিয়েছি তার জন্য সেই সন্তানদের ভবিষ্যৎটা কী দাঁড়াচ্ছে।”
মুখার্জি বলেছেন, নামুর অভিজ্ঞতা তাঁকে বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলেছে। সেই সঙ্গে এই ঘটনা বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছে। যেমন: “অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে প্রত্যাশার পারদ কতটুকু থাকা উচিত, কাজের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, আর সাংবাদিকদের কী ধরনের মানসিক চাপ সামলাতে হয়।”
নামু বলেছেন, ব্যক্তিগত আক্রমণ যেখানে একটি বড় সমস্যা, সেটি হোক শারীরিক বা ভাবমূর্তির ক্ষতি অথবা অনলাইন ট্রলিং, আর জীবনধারার ইস্যু তো আছেই; অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কাজটিই একটি বোঝা হয়ে ধরা দেয়।
“কঠিন অবস্থায় থাকা মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা আরও গভীরে গিয়ে দাগ কাটে… এবং একজন মানুষ হিসেবে এসব কথা শুনতে শুনতে, আর নিজে এই মানসিক চাপের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আপনার ওপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই বিষয়গুলো ধীরে ধীরে আপনার মজ্জায় গেঁথে যায়।”
আফ্রিকা আনসেন্সর্ডের প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য ছিল, “অনুসন্ধান, উন্মোচন ও ক্ষমতায়ন”। গণমাধ্যমটি গড়ার আগে, নামু বহু বছর কেনিয়া টেলিভিশন নেটওয়ার্কের বিশেষ প্রকল্প সম্পাদক হিসেবে একটি অনুসন্ধানী দলের নেতৃত্ব দিতেন। যুদ্ধের মধ্যেও দক্ষিণ সুদানের অভিজাতদের মুনাফা অর্জনের বিষয়ে তিনি একটি তিন-পর্বের অনুসন্ধান করেছিলেন, যা তাঁকে ২০১৯ সালে জিআইজেএনের শাইনিং লাইট পুরস্কার এনে দেয়।
কোনো একটি জটিল গল্প, হামলা বা আইনি বাধাসহ যে কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা বা বিষয় একজন সাংবাদিকের মানসিক ও আবেগগত সুস্থতায় প্রভাব ফেলতে পারে। তাঁর মতে, ব্যক্তিগত মানসিক বিপর্যয়ের ধাক্কা “লম্বা সময় ধরে চলতে থাকে।”
তিনি বলেন, “যে কোনো ধরনের ইন-ডেপথ সাংবাদিকতায় এই চাপ আসে। লম্বা সময় পরিবার থেকে দূরে থাকা, আর যখন কাজটি সম্মানজনক থাকে না তখন হারানো সময় নিয়ে অপরাধবোধে ভোগা। শারীরিকভাবে হোক বা মানসিকভাবে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কর্মজীবনের একটি বড় অংশ নিজেকে নিয়েই পেরিয়ে যায়; সেখানে প্রতিনিয়ত এমন সব তথ্য নিয়ে বোঝাপড়া করতে হয় যা অনেকেরই অজানা। এজন্য কিছু মহলের বিরাগভাজন হয়ে আপনাকে অনুসন্ধানে যেতে হবে, অপ্রিয় কাজগুলো করতে হবে, বারবার কঠিন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে হবে।”
তিনি আরও বলেছেন, “এখানে ভারসাম্যের বিষয়টি আপনাকে বুঝতে হবে… আপনার বেছে নেয়া নিঃসঙ্গ জীবন ও কর্মজীবনের বেশ কিছু প্রভাব থাকে।”
টিকে থাকা ও উন্নতির জন্য স্বগোত্রীয় ও সহমর্মী কর্মীদের খোঁজ করার পরামর্শ দেন তিনি: এমন সম্পাদক যিনি তাঁর সাংবাদিকদের সমর্থন করেন, এমন সহকর্মী যিনি বুঝতে পারেন যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কী সইতে হয়, আর যারা হয়তো একই পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন।
প্যান্ডোরা পেপার্স অনুসন্ধান, ১১৭টি দেশের প্রায় ৬০০ সাংবাদিকের একটি বৈশ্বিক দলকে এক সুতোয় গেঁথেছে। এই অনুসন্ধান নামুর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, “আমরা বিচ্ছিন্ন নই, বরং আরও ভালো কিছুর জন্য একাট্টা হতে প্রস্তুত একটি কমিউনিটি।”
তিনি মনে করেন, “সাংবাদিকদের জন্য নিয়োজিত একটি সাংবাদিক কমিউনিটির সদস্য হওয়া ছিল আমার পেশাজীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এই বিষয়গুলোই আমাকে সচল রেখেছে। আমার স্ত্রী প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন যে, আমরা আগে আরও খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছি। তিনি অনেকটা খুঁটির মত আমাকে টিকিয়ে রেখেছেন। আমার পরামর্শ হলো: নিঃস্ব অবস্থায় আপনাকে শক্তি জোগাতে পারে, এমন খুঁটি খুঁজে নেয়া।”
তিনি বলেছেন, কিছু স্টোরির প্রভাব আশানুরূপ ছিল না। তবে তিনি জানতেন, “যা প্রকাশিত হয়ে গেছে, তা তো আর ফেরানো সম্ভব নয়। মানুষ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করতে পারে… তবে বোতল থেকে জ্বিন তো বেরিয়েই গেছে” – এটাই তাঁর সান্ত্বনা।
আধুনিক সংবাদকক্ষের কাঠামো
মুখার্জি জানান, গত দশক কীভাবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কাজের প্রেক্ষাপট বদলে দিয়েছে, যেখানে রাষ্ট্র-পৃষ্ঠপোষকতায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসা অনেকটা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর সেই সঙ্গে আছে হামলা, যা “একজন একক সাংবাদিক বা একটি সংবাদকক্ষের পক্ষে মোকাবিলা করা বেশ কঠিন হয়ে উঠতে পারে।”
একমত পোষণ করে নামু বলেছেন, বৈশ্বিকভাবে ও স্থানীয় পর্যায়ে কিছু নির্দিষ্ট প্রবণতা এই পরিবর্তনকে তুলে ধরে: অনলাইন গোষ্ঠীর আবির্ভাব, যাদের কাজ হলো জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে “এ ধরনের অগ্রগতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া”। তিনি বলেন, “একদল মানুষ আছে, যাদের কাজ হলো বিশ্বকে বেশ ভিন্ন [ভাবে] তুলে ধরা: মূলত আমরা সাংবাদিকেরা যা করছি, ঠিক তার বিপরীত।”
তিনি আরও বলেন, সাংবাদিক ও সম্পাদকদের কর্মপরিধির সীমাবদ্ধতা থাকলেও আফ্রিকা আনসেন্সর্ডে তিনি সংবাদকক্ষে মানসিক সহায়তা প্রদানের একটি কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। ছোট একটি দলে প্রয়োজন সাপেক্ষে উন্মুক্ত পরিবেশে কোনো কর্মীর সঙ্গে কথা বলা এক ধরনের কর্মপন্থা; আরেকটি হলো প্রয়োজন অনুসারে ভুক্তভোগী কর্মীর জন্য পেশাদার সহায়তা খোঁজ করা।
তিনি বলেছেন, “অনুসন্ধানের কাজে সাংবাদিকদের ওপর মানসিক চাপের বিষয়টি আমরা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি… যাতে মানুষকে জানানো যায় যে একটি খারাপ দিন, এমনকি খারাপ সপ্তাহ বা মাস কাটানো তেমন কিছু নয়; আর এমন পরিস্থিতির শিকার সাংবাদিকদের জন্য যেন সহায়ক রিসোর্স পৌঁছে দেওয়া যায়।”
নামু আরও বলেন, সম্মুখ সারির অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সমর্থনের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো সম্পাদকীয় পৃষ্ঠপোষকতা।
তিনি জানান, “এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলোর জন্য একজন সাংবাদিককে আপনি প্রস্তুত করতে পারবেন না। তবে আপনি তাঁদের জানাতে পারেন যে, আপনি তাঁদের কাজ সমর্থন করেন, আপনি তাঁদের পাশে আছেন। একজন সম্পাদকের কাজ হলো দিক নির্দেশনা ও সুরক্ষা দেওয়া। আর আক্ষরিক অর্থে: হামলার শিকার হলে আপনাকে অবশ্যই তাঁদের সুরক্ষা দিতে হবে।”
আর প্যান্ডোরা পেপার্স অনুসন্ধানের পর কী হলো? কয়েক সপ্তাহ পর তিনি বাড়িতে ফিরে যান এবং কাজটি চালিয়ে যান।
তিনি বলেছেন, “অনেক দিন থেকেই আমি এই কাজ ছেড়ে দিয়ে সহজ ও কম ঝুঁকিপূর্ণ কিছু একটা করার কথা ভেবেছি, যেখানে আমাকে অদ্ভুত নজর বা অনর্থক প্রশ্নের শিকার হতে হবে না, এমনকি যাদের সঙ্গে কখনো কথা হয়নি বা যাদের নিয়ে কোনো স্টোরিও করিনি, এমন অনেক রাজনীতিবিদ বা অভিজাত শ্রেণীর চক্ষুশূলও হতে হবে না।”
এমন অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত প্রশ্ন এখনও তাঁর মাথায় ঘুরপাক খায়। তবে আপাতত একদল আশাবাদী কর্মী নিয়ে তিনি ঘুরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ তাঁর এই কর্মী বাহিনী বিশ্বাস করে, তাঁদের স্টোরিগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে।
তিনি বলেন, “অবশেষে, আমাদের মধ্যে এমন কাউকে থাকতে হবে, যাঁরা সরল বিশ্বাসে মনে করবে যে সাংবাদিকতাই পরিবর্তন আনে। আর আমরা যে কাজ করি – একটি বা দুটি কাজ হিসেবে তা হয়তো সামান্য – তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এইসব কাজ মিলে বিপুল একটি সংকলন তৈরি হয় যা… অপকর্ম উন্মোচন করতে পারে।”
আপনি চাইলে, নামুর অংশ নেওয়া রয়টার্স ইনস্টিটিউটের পুরো ওয়েবিনারটি ইউটিউবে দেখতে পারেন:
আরও পড়ুন
রেজিলিয়েন্ট রিপোর্টিং: টিপস অন হাও টু কোপ উইথ বার্নআউট অ্যান্ড ট্রমা
ট্র্যাজেডির শিকার, সাক্ষী ও বেঁচে ফেরাদের সাক্ষাৎকার নেবেন যেভাবে
এক্সপার্ট অ্যাডভাইস ফর ব্রেকিং ইনটু ডকুমেন্টারিস
লরা ডিক্সন সহযোগী সম্পাদক হিসেবে জিআইজেএনে যোগ দেওয়ার আগে চার বছর কলম্বিয়ায় রিপোর্টিং করেছেন এবং প্যারিস ও টেক্সাসের অস্টিনে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা করেছেন। ফার্ক গেরিলা গোষ্ঠীর সঙ্গে কলম্বিয়ার সংঘাত নিয়ে তাঁর কাজ টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, আটলান্টিক ও অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।