একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কিন্তু জালিয়াত; আপনার অনুসন্ধানকে থামিয়ে দিতে তাদের হাতে আছে আইনজীবী, বেসরকারি গোয়েন্দা, হ্যাকার, এমনকি বিদেশি গুপ্তচর বাহিনী লেলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা; ভেবেছেন, এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে সামাল দেবেন?
লন্ডনের ফাইনান্সিয়াল টাইমসের (এফটি) অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যান ম্যাকক্রাম ছয় বছর ধরে জার্মান ইলেকট্রনিক লেনদেন প্রতিষ্ঠান অয়্যারকার্ড নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন। আর এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি শিখেছেন, কোন কোন কৌশলে এমন প্রতিষ্ঠানকে মোকাবিলা করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে: একটি সুরক্ষিত বাঙ্কারে রক্ষিত এয়ার-গ্যাপড ল্যাপটপ ব্যবহার (যার সঙ্গে কোনো নেটওয়ার্ক সংযুক্ত নেই), এবং রেলস্টেশনে ফেউয়ের নজরদারি ফাঁকি দেওয়া থেকে শুরু করে, সম্ভাব্য হুইসেলব্লোয়ারের (তথ্যফাঁসকারী) মায়ের আস্থা অর্জন পর্যন্ত অনেক কিছুই।
ধারণা করা হয়, হাউস অফ অয়্যারকার্ড ধারাবাহিকে ম্যাকক্রাম ইতিহাসের অন্যতম বড় কর্পোরেট জালিয়াতি উদঘাটন করেছেন, যার ফলে ২০২০ সালে ৩০ বিলিয়ন ডলারের সেই বৈশ্বিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পতন ঘটেছে, তাদের বেশ ক’জন নির্বাহী গ্রেফতার হয়েছেন এবং দুই জার্মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান পদত্যাগ করেছেন। তাঁর অনুসন্ধানটি ছোট-বড় জালিয়াতির একটি জটিল জালকে উন্মোচিত করেছে, যেখানে রয়েছে ছোট-বড় শেল কোম্পানির (যে কোম্পানির অস্তিত্ব শুধু কাগজে) একটি অংশীদারী নেটওয়ার্ক, সাজানো অধিগ্রহণ, ভুয়া গ্রাহক, জালিয়াতি এবং বিক্রি ও মুনাফার অতিরঞ্জিত হিসাব।
এই স্কুপের পেছনে ছুটতে গিয়ে ম্যাকক্রাম যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং যেসব ভুল করেছেন, তা অকপটে তুলে ধরেছেন জিআইজেএনের সাম্প্রতিক মাস্টারক্লাস ওয়েবিনারে, যা উপস্থাপনা করেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও লেখক ক্যাথেরিন ইবান৷ এই গল্পের পুরোটা পাবেন মানি মেন: আ হট স্টার্টআপ; আ বিলিয়ন ডলার ফ্রড, আ ফাইট ফর দ্য ট্রুথ শীর্ষক তাঁর নতুন বইয়ে।
ম্যাকক্রাম জানান, এই স্টোরি ঘিরে এত “শোরগোল” হয়েছিল এবং অয়্যারকার্ডের বহুমুখী আক্রমণ এতটাই কৌশলী ছিল যে এক পর্যায়ে তাঁর রিপোর্টিং নিয়েই তদন্ত শুরু করে জার্মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা, প্রাইভেট ডিটেকটিভ দল, এবং এমনকি নিজ প্রতিষ্ঠান ফাইনান্সিয়াল টাইমসও৷ (এফটির স্বাধীন, অভ্যন্তরীণ তদন্তে তাঁর সাংবাদিকতায় কোনো ব্যত্যয় ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে গোপন আঁতাতের প্রমাণ মেলেনি)।
ম্যাকক্রাম বলেছেন, যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অপরাধমূলক আচরণ তুলে ধরে, সেগুলোতে নজর দেয়ার সময় সাংবাদিকদের বুঝতে হবে, কর্পোরেট জালিয়াতি সাধারণত শুরু হয় কীভাবে।
“‘চলো, হিসাবে বড় গরমিল করি,’ – প্রতারকেরা সাধারণত এভাবে শুরু করে না,” তিনি বলছিলেন। “যা প্রায়ই ঘটে থাকে, তা আসলে অনেকটা এমন, ‘ওহ, আমরা একটি সমস্যায় পড়েছি — আমাদের এই প্রান্তিকের হিসাব মেলাতে হবে, কিন্তু পারছি না, তাই একটু জালিয়াতি করব, আর পরে সব ঠিক করে নেব।’ অবশ্য, তারা সেটি আর ঠিক করতে পারে না, আর জালিয়াতি বড় থেকে আরও বড় হতে থাকে।”
ম্যাকক্রাম বলেছেন, বিশ্বজুড়ে দ্রুত-বর্ধনশীল প্রতিষ্ঠানগুলোতে – বিশেষ করে ক্রিপ্টোকারেন্সি জগতে – সম্ভবত অয়্যারকার্ডের মতো আরও অনেক জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে, যা সনাক্ত করা যায়নি। আর এই ঘটনাগুলো উদঘাটনে সাংবাদিকেরা বেশ কিছু কৌশল অবলম্বন করতে পারেন৷
তিনি বলেন, “অনেক প্রতিষ্ঠানকেই জবাবদিহি করা হচ্ছে না। তারা বলে, তাদের বিলিয়ন ডলারের সম্পদ আছে – তাহলে, সেগুলো কোথায়?”
ম্যাকক্রাম জানান, বিনিয়োগ ব্যর্থ হলে যেসব বিনিয়োগকারী মুনাফা করেন, সেই শর্ট সেলারেরা অনেক সময় জালিয়াতি অনুসন্ধানের প্রাথমিক সূত্র হিসেবে কাজ করেন। আর ২০১৫ সালে, অস্ট্রেলিয়া থেকে এমনই একজন শর্ট সেলার তাঁকে অয়্যারকার্ডের সমস্যা নিয়ে প্রথমবারের মতো সতর্ক করেছিলেন।
তিনি বলেন, “কোম্পানিটি নিজেদের ইউরোপীয় পেপ্যাল হিসেবে উপস্থাপন করেছিল, সেসময়ে যার মূল্য ছিল প্রায় চার বিলিয়ন ডলার; তবে এই ব্যবসার ধরন বোঝা জটিল ছিল। তারপর দ্বিতীয় শর্ট সেলারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়, যিনি একটি মজার তত্ত্ব নিয়ে আসেন: সেটি ছিল, হিসাবে জালিয়াতি। অন্য তত্ত্বটি মূলত অর্থ পাচার সম্পর্কিত।”
ম্যাকক্রাম সতর্ক করে দিয়ে বলেন, আর্থিক বাজারের অন্য সব খেলোয়াড়দের মতো শর্ট সেলারদেরও ব্যক্তিগত স্বার্থ আছে, তাই সাংবাদিকদের উচিত তাদের উদ্দেশ্য ও দাবি সম্পর্কে সতর্ক থাকা। তাদের মন্তব্য ব্যবহার করবেন কি করবেন না, সে সিদ্ধান্তও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নিতে হবে।
“আমি শর্ট সেলারদের গোপন সোর্স হিসেবে বিবেচনা করেছি,” বলেন তিনি। তাদের বক্তব্য সরাসরি ব্যবহার না করে, বরং তাদের দাবিগুলোকে যাচাইয়ের জন্য তিনি স্থানীয় রেজিস্ট্রির তথ্য ব্যবহার করেছেন।
স্টোরিকে আটকে দিয়েছিল যে দুটি ভুল
যাই হোক, ম্যাকক্রাম একটি ঘটনার কথা বিস্তারিত তুলে ধরেন। সে বার, শর্ট সেলারদের দেয়া তথ্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করার কারণে তাঁর অনুসন্ধান এক বছরেরও বেশি সময় আটকে ছিল। এই বিনিয়োগকারীদের একটি দলের কাছ থেকে তিনি একটি ফাইল পেয়েছিলেন, যাতে অয়্যারকার্ড নিয়ে বেশ কিছু দাবি করা হয়েছিল। একটি ছোট ব্লগ পোস্টে তিনি সেই প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন। ম্যাকক্রামের ভাষ্যমতে, এরপরই কোম্পানিটির আইনজীবীরা দাবি করতে থাকেন যে, সেই রিপোর্টে থাকা সম্ভাব্য মানহানিকর অভিযোগের দায় এখন এফটির ওপর বর্তাবে। এই আইনী হুমকির কারণে তাঁর কভারেজ কার্যত অচল হয়ে গিয়েছিল।
ম্যাকক্রাম বলেছেন, তাঁর কভারেজকে বিতর্কিত করতে আইনি হুমকি ছাড়াও আরেকটি অস্ত্র ব্যবহার করেছে অয়্যারকার্ডের জনসংযোগ দল: তাদের দাবি ছিল যে, তিনি হয় শেয়ারের দর প্রভাবিত করার জন্য শর্ট সেলারদের সঙ্গে আঁতাত করেছেন, নয়তো তাদের হাতে বোকা বনেছেন।
ম্যাকক্রাম এখন স্বীকার করেন যে, লিঙ্কটি পোস্ট করার আগে এফটির আইনজীবীদের পরামর্শ নিতে অবহেলা করাটা ভুল ছিল।
“আপনার প্রশ্ন যদি হয় ‘এ ব্যাপারে কি আমাদের একজন আইনজীবীর কথা মতো চলা উচিত?’ তাহলে উত্তরটি আপনার জানা,” তিনি বলেছেন।
স্টোরি থেকে স্টোরি আসতে পারে — এবং সোর্সও
কিন্তু তাঁর অবিরাম কভারেজ শেষ পর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখেছে। এই সাফল্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, ম্যাকক্রাম শুরুর দিকে অপকর্মের অকাট্য প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করেননি, বরং অয়্যারকার্ডের ব্যবসা নিয়ে প্রশ্ন তুলে – একের পর এক খবর প্রকাশ করে গিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের অনিশ্চিত আইনি ব্যবস্থায় মানহানি মামলার হুমকি এড়াতে গোড়ার দিককার স্টোরিগুলোতে “জালিয়াতি” শব্দটি পরিহারে তিনি বিশেষভাবে সতর্ক ছিলেন। তিনি অয়্যারকার্ডের সমস্যাকে বরং “একটি ধাঁধা” হিসেবে দেখিয়েছেন।
এটিই শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই ধারাবাহিকে তাঁর বাইলাইনের কারণে হুইসেলব্লোয়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তারা শর্ট সেলারদের মতো কেবল কতগুলো প্রাথমিক প্রশ্নের উত্তর দেয়নি, বরং ভেতরকার সাক্ষ্যপ্রমাণও যোগান দেয়। তিনি যেমনটা বলেছেন, “স্টোরি থেকে স্টোরি আসে।”
তিনি মনে করেন, “মূল বিষয় হলো: শুধু ভালো প্রতিবেদন লিখতে থাকা। আপনি একই বিষয়ে লেগে আছেন দেখে মানুষই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।”
যেমন: সিঙ্গাপুরে অয়্যারকার্ডের যে আইনজীবী ছিলেন, তার মা ম্যাকক্রামের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি তাঁর আগের স্টোরিগুলো পড়েছিলেন, অনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, নিজ ছেলেকেও ম্যাকক্রামের সঙ্গে দেখা করতে তাগিদ দিয়েছিলেন।
ম্যাকক্রাম হেসে বলেন, “বিষয়টি জানার পর সেই হুইসেলব্লোয়ারের মনে হয়েছিল, ‘হা ঈশ্বর! মা, তুমি এ কী করলে?’ তবে তারপর তিনি ঠিক কাজটিই করেছিলেন। তিনি আমাকে প্রথমে একটি নথি পাঠিয়েছিলেন। এই নথিটি ছিল সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট নিয়ে একটি বিদেশী আইনী প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন। আর আমি জানতাম, এটি ভালো জিনিস, কারণ এখানে লেখা ছিল ‘আইন দ্বারা সুরক্ষিত, অনুলিপি করবেন না।’”
তিনি বলেন, এই বিষয়ে পরবর্তী স্টোরিগুলো আরও হুইসেলব্লোয়ার টেনে এনেছে।
সিঙ্গাপুরে অয়্যারকার্ডের প্রথম হুইসেলব্লোয়ারের সঙ্গে বৈঠকে ম্যাকক্রাম যে নিরাপত্তা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেগুলোর মধ্যে আছে:
- তিনি একটি প্রিপেইড বার্নার ফোন (একবারই ব্যবহার হয়) কিনেছিলেন, যা সনাক্ত করা কঠিন।
- এফটির সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে তিনি একটি এয়ার-গ্যাপড ল্যাপটপ ব্যবহার করেছেন। এই ল্যাপটপে ইন্টারনেট সংযোগ ছিল না, তবে ফাইল এনক্রিপ্ট করার জন্য সফটঅয়্যার ইনস্টল করা ছিল।
- তিনি একটি নতুন, সাধারণ ক্রোমবুক ল্যাপটপ কেনেন যেন সেখানে কোনো ফাইল না থাকে, এবং ভ্রমণের সময় প্রয়োজনে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়৷ “আসলে আমাকে বলা হয়েছিল ‘হোটেলের ওয়াইফাই ব্যবহার করবেন না,’” তিনি বলেন। “আমরা অয়্যারকার্ডের হ্যাকিং সক্ষমতা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম।”
- একজন সোর্সের সঙ্গে সশরীরে দেখা করে তিনি এনক্রিপ্ট করা ইমেইলের কপি সংগ্রহ করেন এবং তারপর কেবল সিগন্যাল অ্যাপের মাধ্যমে হুইসেলব্লোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন।
- লন্ডনে ফিরে তিনি ফাইনান্সিয়াল টাইমস ভবনের ভেতরে একটি জানালাবিহীন “বাঙ্কারে” এয়ার-গ্যাপড ল্যাপটপে কাজ করেছেন।
- প্রয়োজনীয় কাগজপত্র মুদ্রণের জন্য তিনি একটি পুরানো, সাদা-কালো লেজার প্রিন্টার ব্যবহার করেছেন, যেন সামান্যতম ডিজিটাল প্রমাণও না থাকে। কারণ এ ধরনের প্রমাণ নথির মেটাডেটা প্রকাশ করে দিতে পারে। বিষয়টি তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “অনেকে বুঝতে পারেন না যে একটি আধুনিক রঙিন প্রিন্টার ব্যবহার করলে মুদ্রিত কাগজে মাইক্রোডট প্যাটার্ন তৈরি করতে পারে, যা নথিটি মুদ্রণের স্থান ও সময় প্রকাশ করে দিতে পারে। তাই খুব সংবেদনশীল নথিগুলোর ক্ষেত্রে আপনি সতর্ক থাকতে চাইবেন।”
- ফাঁস হওয়া নথিতে “আইন দ্বারা সুরক্ষিত” বাক্যাংশটি তার স্টোরিকে আটকে দিতে পারে – এটি বুঝতে পেরে ম্যাকক্রাম এমন অন্য নথি খুঁজতে থাকেন যেখানে একই তথ্য আছে, কিন্তু সেই “জাদুকরী দুই শব্দ” নেই। আর তিনি সেটি খুঁজে পান আরেক অয়্যারকার্ড-আইনজীবীর পাওয়ারপয়েন্ট সারাংশে।
মাস্টারক্লাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, বিলিয়ন-ডলারের অপরাধী প্রতিষ্ঠান নিয়ে অনুসন্ধানে আইনি মারপ্যাঁচ সামলানো। এক্ষেত্রে আপনাকে সুশৃঙ্খল হতে হবে; সঠিক কিন্তু আইনগতভাবে সমস্যাজনক সাক্ষ্যপ্রমাণ বাদ দিতে হবে, অথবা সেটিকে দিশারী হিসেবে ধরে নিয়ে অন্য প্রমাণ খুঁজে পেতে হবে।
ম্যাকক্রাম বলেছেন, “আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে অয়্যারকার্ডের ব্যবসার কেন্দ্রে ছিল ব্যবসায়িক অংশীদারত্ব-নির্ভর এই বিন্যাস — মূলত, কোম্পানির বিপুল মুনাফার দায়দায়িত্ব ব্যবসায়ের অংশীদার বন্ধুদের, কিন্তু অদ্ভুত বিষয় ছিল, তারা (কোম্পানিটি) কখনই তাদের কোনো টাকা দিয়েছে বলে মনে হয়নি। আমার সহকর্মী স্টেফানিয়া পালমা এই অংশীদারদের কয়েকজনের সঙ্গে সাক্ষাত শুরু করেন, আর সেখানেই তিনি অকাট্য প্রমাণের একটি সংগ্রহ খুঁজে পান।”
ফিলিপাইনের ম্যানিলায় অয়্যারকার্ডের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারের অফিসে গিয়ে পালমা দেখতে পান, সেখানে একটি ট্যুর বাস কোম্পানিরও অফিস আছে, আর সেখানকার কেউই ডিজিটাল লেনদেন প্রক্রিয়াকরণ করছে বলে মনে হয়নি।
কর্পোরেট জালিয়াতি মোকাবিলায় পরামর্শ
দীর্ঘমেয়াদী জালিয়াতি অনুসন্ধানে নিয়োজিত সাংবাদিকদের জন্য ম্যাকক্রাম আরও পাঁচটি পরামর্শ দিয়েছেন:
- বিলিয়ন-ডলার কোম্পানিতে ছোটখাটো জালিয়াতির প্রমাণ বাদ দেবেন না। ম্যাকক্রাম বলেছেন, আর্থিক অনিয়মের আকার ছোট মনে হচ্ছে বলে অনেক সাংবাদিক সোর্সের দাবিতে গুরুত্ব দেন না – যেমন ব্যাকডেটে করা চুক্তি; অথবা, ধরুন, মাত্র ২০,০০০ ডলারের জাল চালান। মনে হতে পারে বিলিয়ন-ডলারের ব্যালেন্স শিটে পরিমাণটি নেহাতই সামান্য, অথবা এত বড় প্রতিষ্ঠান এমন ঝুঁকি নেবে, তা অবিশ্বাস্য। তিনি বলেন, অথচ এগুলোই পদ্ধতিগত অপরাধের দিকে ইঙ্গিত করতে পারে। তিনি বলেন, “আমরা যখন হুইসেলব্লোয়ারদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করি, তখন তার প্রতিক্রিয়ায় অয়্যারকার্ড বলেছিল, ‘আচ্ছা, সব সংখ্যাই তো ছোট – এগুলো চোখে পড়ার মতো না।’ আর অনেকেই যে ভুলটি করেছিলেন তা হলো: প্রাতিষ্ঠানিক চর্চাকে আমলে না এনে, তারা টাকার পরিমাণের দিকে তাকিয়েছিলেন যা আসলেই সামান্য ছিল। আমরা জানতে চেয়েছি: অয়্যারকার্ডের আর্থিক শাখার কর্মীরা কেন এই অদ্ভুত ছোটখাট জালিয়াতি করছিলেন? আর কেনই বা তাদের বরখাস্ত করা হয়নি?”
- ওয়েব্যাক মেশিন ব্যবহার করে দেখুন যে সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে অধিগ্রহণ করা কোম্পানির ওয়েবসাইটে আমূল পরিবর্তন হয়েছে কিনা ৷ “এই ওয়েব্যাক মেশিন আমি অনেক ব্যবহার করেছি – সন্দেহজনক বলে মনে হয় এমন কোম্পানি অনুসন্ধানে এটি খুবই কার্যকর,” বলেন তিনি। “অয়্যারকার্ড একটি কোম্পানি কেনার ঘোষণা দেবে, আর কেনার ঠিক আগেই আপনি সেই প্রতিষ্ঠানের একটি চকচকে নতুন ওয়েবসাইট দেখতে পাবেন, যেখানে এর ব্যবসায়ের ধরন পাল্টে যাবে৷ আপনার মনে হতে পারে: ‘ওহ, এটি একটি পর্যটন ওয়েবসাইট ছিল, এখন হঠাৎ পাল্টে এটি একটি আর্থিক লেনদেন প্রতিষ্ঠান হয়ে গেল।’”
- আপনার নোটবুকে স্পষ্ট করে সাক্ষাৎকারের তারিখ লিখুন। তিনি বলেন, “এই বিষয়ে ছয় বছর ধরে কাজ করার পর সত্যিই মনে হয়, যদি আমার নোটবুকের সামনে বড় অক্ষরে তারিখগুলো লিখে রাখতাম।”
- নির্ভরযোগ্য কোম্পানি রেজিস্ট্রি ডেটাবেস ব্যবহার করুন। এর মধ্যে রয়েছে এসিআরএ (সিঙ্গাপুর), কোম্পানি হাউস (যুক্তরাজ্য), এবং ওপেনকর্পোরেটস (আন্তর্জাতিক)।
- কোনো কোম্পানি কীভাবে ব্যবসা করে, তা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারলে আরও গভীরে অনুসন্ধান করুন। ম্যাকক্রাম বলেছেন, “সদুত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আপনাকে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে। অয়্যারকার্ডের ক্ষেত্রে, নতুন করে প্রশ্ন করার পরে তাদের ব্যাখ্যায় পরিবর্তন আসে, এবং তখন মনে হয়, ‘আহা!’ আমরা সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি বলে তারা আর বলতে পারেনি যে আমরা এই জটিলতা বুঝতে পারিনি।”
নোংরা কৌশল সামলানো
ম্যাকক্রাম বলেছেন, নানা ধরনের “নোংরা চাল” চেলে এই অনুসন্ধানকে আটকানোর চেষ্টা করা হয়েছিল – শারীরিক নজরদারি ও অনলাইন হয়রানি থেকে শুরু করে এফটিকে ১০ মিলিয়ন ডলার ঘুষের প্রস্তাব, এবং এমনকি নথিতে রাশিয়ান নার্ভ এজেন্ট দিয়ে রাসায়নিক হামলার বিশ্বাসযোগ্য হুমকিও ছিল।
“আমরা বুঝতে পারি যে [অয়্যারকার্ডের একজন নির্বাহীর সঙ্গে] রাশিয়ান গুপ্তচরদের সম্পৃক্ততা আছে, আর এ কারণে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ছিল, তাই সতর্কতা হিসেবে আমি টিউব (ট্রেন) প্ল্যাটফর্মের ধারে দাঁড়াবো না বলে ঠিক করেছিলাম” তিনি বলেন। “আমরা এক পর্যায়ে বুঝতে পারি যে লন্ডনজুড়ে ৩০ জন প্রাইভেট গোয়েন্দার একটি দল আমাদের সঙ্গে সোর্সদের কথোপকথনের প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করছে এবং শর্ট সেলারদের সঙ্গে আমাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ খুঁজছে। এমনকি আমরা ঘরে থাকলেও ফোনে স্টোরি সম্পর্কে কথা বলতাম না। সোর্সের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমি টিউব স্টেশনের একদিক দিয়ে লুকিয়ে প্রবেশ করে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে পড়তাম।”
প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন নির্বাহীর ফৌজদারি বিচার শুরু হবে এই বছরের শেষ দিকে, আর তাদের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা জার্মানি থেকে পালিয়ে গেছেন এবং পলাতক রয়েছেন।
ম্যাকক্রাম বলেছেন, এই অনুসন্ধানের অনেক সুনির্দিষ্ট প্রভাব আছে। তবে এটি বড় কর্পোরেশনগুলোর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে অনেক সাংবাদিকের মনোযোগ ফিরিয়েছে: “আমার জন্য বড় প্রভাব হলো: এটি আর্থিক বাজারের বড় জালিয়াতির দিকে আবার মানুষের নজর টেনে এনেছে।”
আরও পড়ুন
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও তার মালিকদের কোথায় খুঁজবেন?
রিপোর্টারের গাইড: সংঘবদ্ধ অপরাধীদের অর্থ লেনদেন অনুসন্ধান করবেন যেভাবে
জিআইজেএন টুলবক্স: গোপন অর্থ লেনদেন ও আর্থিক স্বার্থের সংঘাত অনুসন্ধান
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএনের প্রতিবেদক। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমস পত্রিকার সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। বিদেশি প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের ২৪টির বেশি দেশে সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন।