২০২১ সালে, গ্রীষ্মের শেষ দিকে, অলাভজনক স্বাধীন সংবাদমাধ্যম মিডওয়েস্ট সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিংয়ের সাংবাদিক ম্যাডিসন ম্যাকভান উড়ে যান ওকলাহোমার একটি শহরে। সেখানেই অবস্থান দেশটির অন্যতম বৃহৎ এক মিটপ্যাকিং (মাংস মোড়কজাতকরণ) কারখানার।
তাঁর এই যাত্রা শুরু হয় মাসখানেক আগে; কোভিড-১৯ মহামারির সময় সিবোর্ড ফুডসের কারখানায় কাজের পরিবেশ নিয়ে শ্রমিক ইউনিয়নের একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে। তিনি যতই শ্রমিকদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন ততই বেরিয়ে আসছিল উদ্বেগজনক এক চর্চা: কর্মীদের আঘাত পাওয়ার ঘটনাগুলোকে প্রতিষ্ঠানটি উপেক্ষা করে আসছে মহামারিরও আগে থেকে।
ম্যাকভান যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করেন, শ্রম নিরাপত্তা তাদের একটি। মাংস শিল্প নিয়ে কাজ করা এই রিপোর্টার খাদ্যপণ্যের গন্তব্য অনুসরণ করেন মাঠ থেকে মুদি দোকানের তাক পর্যন্ত, সবখানে। আরও ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “সেই সরবরাহ চেইনের সঙ্গে যুক্ত যে কোনো কিছুই আমার কাজের ক্ষেত্র।”
খাদ্যপণ্যকে প্রায়ই সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হলেও, দিন দিন এই খাত নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আগ্রহ বাড়ছে। কোনো খাবার উৎপাদন থেকে শুরু করে পাতে ওঠা পর্যন্ত কী কী ঘটে, তাঁরা সেদিকেও নজর দিচ্ছেন। এই সাংবাদিকসুলভ নিরীক্ষণ খাদ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবেশগত প্রভাব, শ্রম পরিস্থিতি, স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং রাজনৈতিক প্রভাবের মতো বিষয়গুলোকেও সামনে আনছে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক মার্ক শ্যাপিরো কৃষি ও পরিবেশ নিয়ে রিপোর্ট করেন। তিনি বলেন, “এখানে একটি সিস্টেম (ব্যবস্থা) কাজ করে, আর সাংবাদিক হিসেবে এধরনের ব্যবস্থার প্রতিটি উপাদান আপনাকে বুঝতে হবে।”
খাদ্যের ক্ষমতা
শ্যাপিরো, তাঁর কর্মজীবনের গোড়ার দিকে যখন কীটনাশক নিয়ে কাজ শুরু করেন, তখনও তিনি এ ধরনের সংবাদকে খাদ্য বিষয়ক প্রতিবেদন বলে ভাবতেন না। তিনি একে জনস্বাস্থ্যের বিষয় হিসেবে দেখতেন। শ্যাপিরো বলেন, খাদ্য নিয়ে লেখালেখিতে তাঁর আগ্রহ ছিল না; তিনি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে রিপোর্ট করতে চাইতেন।
কিন্তু এক পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন যে, “খাদ্য সমস্যা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার বিষয়ও বটে।”
“সিডস অব রেজিসটেন্স” (প্রতিরোধের বীজ) শীর্ষক বইয়ের লেখক এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট বার্কলির গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ জার্নালিজমের প্রভাষক শ্যাপিরো বলেন, গত এক দশকে খাদ্য-ব্যবস্থা কেন্দ্রিক সাংবাদিকতার “বিকাশ” হয়েছে।
ফুড অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিপোর্টিং নেটওয়ার্ক (ফার্ন) এবং সিভিল ইটসের মত কয়েকটি সংবাদমাধ্যম পুরোপুরি খাদ্য ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে – যার মধ্যে খাদ্য উৎপাদন, বিতরণ এবং প্রাপ্তিও রয়েছে। শ্যাপিরো জানান, ইনসাইড ক্লাইমেট নিউজ এবং গার্ডিয়ানের মতো, পরিবেশের বৃহত্তর পরিধি নিয়ে কাজ করা প্রকাশনাগুলোও এখন খাদ্য ব্যবস্থার ওপর মনোযোগ দিচ্ছে।
সরবরাহ চেইন জুড়ে শ্রম পরিস্থিতি আরেকটি বড় ইস্যু। খামারকর্মীদের অধিকার থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় কোভিড-সংশ্লিষ্ট সুরক্ষা ঘাটতি পর্যন্ত সবই এর বিষয়বস্তু। নিউইয়র্ক শহরে খাদ্য সরবরাহ কর্মীদের নিয়ে রিপোর্টের জন্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিভাগে ২০২২ জেমস বিয়ার্ড অ্যাওয়ার্ড জিতেছে দ্য সিটি। একই বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য নিউইয়র্ক ম্যাগাজিন/দ্য ভার্জ সম্ভাব্য পদকজয়ীদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান করে নিয়েছিল।
শ্যাপিরো বলেন, “মানুষ বুঝতে শুরু করেছে যে খাদ্য ব্যবস্থা নিয়ে রিপোর্ট করা মানে প্রতিটি বিট বা প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়েই কাজ করা।”
খাদ্য শিল্প নিয়ে সাম্প্রতিক অনেক অনুসন্ধান-ই মুদি দোকানের তাকের সঙ্গে বড় কর্পোরেশনের প্রভাবের মধ্যকার সংযোগকে তুলে ধরেছে। ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদন দেখিয়েছে যে ব্রাজিলে ব্যাপক বন নিধনের পেছনে খাদ্যপণ্যের বড় মার্কিন প্রতিষ্ঠান কার্গিলের সরবরাহ চেইনের সংযোগ ছিল। কার্গিলকে পণ্য সরবরাহকারী একটি খামারে শিশুশ্রম ব্যবহার হয়েছে (কারগিল সব ধরনের অপকর্মের অভিযোগ অস্বীকার করেছে) বলে একটি অভিযোগও তাতে উঠে এসেছে। তিন পর্বের এক ধারাবাহিকে অক্সপেকার্স সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ এনভায়রনমেন্টাল জার্নালিজম আফ্রিকা জুড়ে জেনেটিক্যালি মডিফায়েড (জিনগতভাবে পরিবর্তিত) শস্যের ব্যবহার, প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ওপর নজর দিয়েছে। আর ফরাসি লেখিকা ও লে মন্দ পত্রিকার অনুসন্ধানী সাংবাদিক স্টেফান হোরেল উন্মোচন করেছেন মনসান্টোর মতো কর্পোরেশনগুলোর প্রতিপত্তি এবং নথিবদ্ধ করেছেন কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাবগুলোকে।
একটি দেশে নির্দিষ্ট খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে, আশপাশের এলাকা ও পৃথিবীর অন্য প্রান্তে তার যে প্রভাব পড়ে সেটি তুলে ধরেছে সাম্প্রতিক কয়েকটি স্টোরি। ২০২১ সালে, চীনা টুনা কোম্পানি ডালিয়ান ওশান ফিশিং-এর জাহাজে শ্রম নিপীড়ন নিয়ে জোট বেঁধে অনুসন্ধান করেছে পরিবেশ বিষয়ক সংবাদ সাইট মোঙ্গাবে, জাপানের অলাভজনক অনুসন্ধানী সংস্থা তানসা এবং এনভায়রনমেন্টাল রিপোর্টিং কালেক্টিভ। একই বছর, ভারত মহাসাগরে ইয়েলোফিন টুনা আহরণে ইউরোপীয় চর্চার প্রভাব উন্মোচন করেছে আরেকটি মোঙ্গাবে প্রকল্প। মহামারির সময় ইউরোপে অভিবাসী খামারকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণের চিত্র তুলে ধরেছে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম, লাইটহাউস রিপোর্টস।
শ্যাপিরো ব্যাখ্যা করে বলেন, খাদ্যকে একটি বিশাল ব্যবস্থা হিসেবে দেখার মাধ্যমে সাংবাদিকেরা সেই সব যোগসূত্র ও স্বার্থগুলোকে চিহ্নিত করতে পারেন, যা খাদ্যের উৎপাদন ও বিতরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। কীটনাশক নিয়ে রিপোর্টের শুরুতে আপাতদৃষ্টিতে, জমিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা, কৃষকের দিকে মনোযোগ চলে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই খামারকে দেখা উচিৎ সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের আঙ্গিকে।
“আপনি একটি খামারে এক সেট বিষাক্ত পদার্থ প্রয়োগের পথ ধরে অনুসন্ধান শুরু করুন। সেই পথের শেষে আপনি পাবেন সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে প্রভাবশালী কয়েকটি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আর তারপরই সামনে আসবে সবচেয়ে ক্ষমতাধর বিনিয়োগকারীদের কার্যক্রম” – বলেন শ্যাপিরো।
খাদ্য বিষয়ক স্টোরিই জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্যের স্টোরি
১০ বছর আগে যখন ফার্ন যাত্রা শুরু করে, তখন এটি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামেনি বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী সম্পাদক ব্রেন্ট কানিংহাম। এই অলাভজনক সংস্থার লক্ষ্য ছিল খাদ্যখাত নিয়ে গভীর ও গুরুতর কভারেজের প্রয়োজন মেটানো, কারণ বিভিন্ন বার্তাকক্ষে বাজেট ছাঁটাইয়ের কারণে কৃষি রিপোর্টার কমে গেছে।
কিন্তু এক দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বৈশ্বিক জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য সংকটের সঙ্গে খাদ্য ব্যবস্থা নিবিড়ভাবে জড়িত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসে খাদ্য ও কৃষিখাত থেকে এবং জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির ২০২১ সালের রিপোর্ট অনুসারে, বিপন্নপ্রায় প্রজাতিগুলোর শতকরা ৮৬ ভাগের প্রধান হুমকি, কৃষি। কানিংহাম বলেছেন, ইদানিং ফার্নের প্রায় প্রতিটি স্টোরিতে এই প্রধান পরিবেশগত সমস্যাগুলোর কিছু না কিছু থাকে।
কানিংহাম আরও বলেন, “আমার মনে হয়, একটি উপলব্ধি জোরালো হচ্ছে যে কৃষি নিয়ে আমরা যদি এক ধরনের পদ্ধতিগত পদক্ষেপ না নিতে পারি, তাহলে কখনই আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি পুরোপুরি প্রশমন করতে পারব না।”
ফার্ন, অংশীদারিত্বের মডেলে কাজ করে, আর তাদের প্রায় সব স্টোরিই অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। খাবারের রেসিপি এবং রেস্তোরাঁর বৈশিষ্ট্য নিয়ে ফার্নের মাথাব্যাথ্যা নেই। তবে টেকসই মাছ চাষ থেকে শুরু করে কার্বন চাষের সম্ভাবনা, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জার্মান তৃণমূল আন্দোলন এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলায় মহামারি-পরবর্তী সুযোগের সদ্ব্যবহার পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি দৃষ্টিকোণ থেকে খাদ্য-ব্যবস্থাকে দেখে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রকাশনা ও সম্প্রচার প্ল্যাটফর্ম সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং সংস্থা, রিভিলে প্রকাশিত ২০২১ সালের একটি অনুসন্ধানে সাংবাদিক তেরেসা কটসিরিলোস ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কর্মসূচির আদ্যোপান্ত খতিয়ে দেখেছেন। দাবানলের সময় বাধ্যতামূলক স্থানত্যাগের আদেশ সত্ত্বেও খামারগুলোকে শ্রমিকদের কর্মস্থলে রাখার সুযোগ করে দিত সেই কর্মসূচি।
স্মৃতি হাতড়ে কানিংহাম বলেন, ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা কটসিরিলোস এই রাজ্যে কৃষি সম্পর্কিত সোর্সের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন এবং এই কর্মসূচি নিয়ে মানুষের অভিযোগের কথা জানতে পেরেছিলেন। এই প্রতিবেদনের ফলে সোনোমা কাউন্টি তাদের “কৃষি পাস” কর্মসূচি পর্যালোচনা করতে বাধ্য হয়।
কানিংহামের মতে, ফার্নের অন্যান্য স্টোরিগুলো ছিল বেশি ডেটা নির্ভর, অথবা তার ঘাটতি নিয়ে। মিডওয়েস্ট সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং এবং দ্য গার্ডিয়ানের একটি যৌথ অনুসন্ধানে ফার্ন দেখেছে যে, ১০ বছরে নর্থ ক্যারোলাইনায় পশুপালন কার্যক্রম নিয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে মাত্র ৩৩টি অভিযোগ এসেছে। ঠিক এর বিপরীত চিত্র উঠে আসে শুকর পালন করা অন্য রাজ্যগুলোতে। ঐ ১০ বছরে এসব রাজ্যে হাজার হাজার অভিযোগ আসে। কয়েক বছর ধরে নর্থ ক্যারোলাইনা কর্তৃপক্ষের কাছে শুকরের বর্জ্য অব্যবস্থাপনা নিয়ে আসা অভিযোগগুলো গায়েব হয়ে যাচ্ছিল।
ফার্নের অন্যতম লক্ষ্য হল সাংবাদিকদের, এবং কখনো কখনো ফ্রিল্যান্সারদেরও, ইন-ডেপথ রিপোর্টিংয়ের জন্য সময় ও সম্পদ যোগান দেওয়া, যেন রিপোর্টগুলো তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারে। কানিংহাম জোর দিয়ে বলেন, সংবাদমাধ্যমগুলোকে তাদের বেশিরভাগ প্রতিবেদনে, অনেকটা “প্রথাগত স্টোরিটেলিং,” অর্থ্যাৎ জুতোর তলা ক্ষয় করা রিপোর্টিং, সোর্স তৈরি এবং প্রচুর ফোনের ওপর নির্ভর করতে হবে।
কানিংহাম বলেছেন, “এটি এমন কোনো কৌশল বা গোপন বিষয় নয়, যা মানুষের অজানা। এটি হল নিছক সময় নিয়ে কাজ করা।”
বিকাশমান শিল্প নিয়ে সাংবাদিকতা
ব্রাজিলে কৃষি একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক খাত। সাংবাদিকেরা এ খাতে পরিবেশবিনাশী চর্চা ও শ্রমের অপব্যবহার নিয়ে সরব হয়েছেন।
রিপোর্টার ব্রাসিলের বিশেষ প্রকল্প সম্পাদক আনা আরানহা জানান, “বিশ্ববাসী ব্রাজিল থেকে আসা খাবারের ওপর নির্ভর করে।” দেশটি সয়াবিন, গরু মাংস, মুরগির মাংস, চিনি এবং আরও অনেক খাদ্যদ্রব্যের শীর্ষ রপ্তানিকারক। এক হিসাবে দেখা যায়, ২০২০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় দশ শতাংশ এই দেশের রপ্তানিকৃত খাবার খেয়েছে। তবে আরানহা বলেন, সেই খাদ্য উৎপাদনে যে কী হয় সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ততটা সচেতন নয়।
অলাভজনক অনুসন্ধানী সংস্থা রিপোর্টার ব্রাসিল ও এজেন্সিয়া পুবলিকা ২০১৮ সালে প্রো ত্রাস দো আলিমান্তো (“খাদ্যের অন্তরালে”) নামে একটি যৌথ প্রকল্প শুরু করে, যার মূল বিষয় ছিল মূলত দেশটির কৃষি শিল্প জুড়ে কীটনাশকের ব্যবহার।
এই প্রকল্পের রিপোর্টের বিষয়বস্তু ছিল: মৌমাছির ওপর ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে ইউরোপে নিষিদ্ধ হওয়া কীটনাশক কীভাবে ব্রাজিলে বিক্রি হয়, জরিমানার পরও একটি বড় চেইন স্টোর কীভাবে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করে দূষিত পণ্য উৎপাদন করে, এবং বিতর্কিত জায়গা থেকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে উৎখাতের চেষ্টায় জমির মালিকেরা কীভাবে অস্ত্র হিসেবে কীটনাশক ব্যবহার করেছিল।
আরানহা ব্যাখ্যা করে বলেন, কীটনাশক নিয়ে স্টোরি করা কঠিন। এ সম্পর্কিত ডেটা ব্যবহারের সুযোগ সহজে পাওয়া যায় না। তাঁর অনুসরণ করা একটি সহায়ক কৌশল হল বড় কৃষি ব্যবসায়ের মধ্যম পর্যায়ের সোর্সদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক স্থাপন করা। কারণ তাঁরা শিল্পের উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছু যেমন দেখেন, তেমনি দেখেন কীভাবে পণ্য ভোক্তাদের সামনে হাজির করা হয়। আরানহার মতে, এই পর্যায়ের যেসব কর্মী প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে অসন্তষ্ট, তাঁরা হতে পারেন সাংবাদিকদের সহায়ক রিসোর্স।
ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন সাংবাদিক ব্রাজিলের বিকাশমান কৃষি শিল্পের অন্যান্য দিকগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করছেন। রিপোর্টার ব্রাসিল আন্তর্জাতিক চকলেট কোম্পানিগুলোকে কোকো বিন সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানে “দাসসুলভ” শ্রম পরিস্থিতি উন্মোচন করেছে এবং গার্ডিয়ানের সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বের বৃহত্তম মাংস কোম্পানি ও আমাজনে বন নিধনের মধ্যে যোগসূত্র নিয়ে রিপোর্ট করেছে৷
আরানহা বলেন, ব্রাজিলের খাদ্য উৎপাদন নিয়ে রিপোর্ট করতে গেলে মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা “দুটি ভিন্ন ব্রহ্মান্ড” নিয়ে কাজ করছি। সাদা চোখে বাজারে খাবারের মনোরম পসরা আর ব্যবহৃত প্রযুক্তিকে আধুনিক মনে হলেও মাঠ পর্যায়ে তাঁর চোখে পড়ে শোচনীয় শ্রম পরিস্থিতি, নদী ও বনের সংকোচন এবং কৃষি ব্যবসার সম্প্রসারণের জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে উৎখাত।
আরানহা বলেন, “মনে হয় যেন একটি ভিন্ন সময় বা ভিন্ন জগৎ, বুঝলেন। মনে হয় না, সেগুলো একসুতোয় গাঁথা। কীভাবে এই দুই জগৎ একই চেইনের অংশ হতে পারে? প্রতিবার মাঠ থেকে ফিরে আমি অবাক হই, আর বলি, আমাদের খাবার যেখান থেকে আসছে, সেখানে ঠিক এমনটাই ঘটছে।”
একটি সুবিশাল শিল্প
মাংস শিল্প বিট নিয়ে মিডওয়েস্ট সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিংয়ে ম্যাকভানের ভাবনার পরিসরটি বেশ বিস্তৃত। গবাদি পশুপালন থেকে নিঃসরিত পানিতে অতিরিক্ত সারের উপস্থিতি কীভাবে নিম্ন আয়ের জনবসতিতে পানীয় জলের উৎসের ক্ষতি করে এবং শ্রমিকদের ঝুঁকি সত্ত্বেও কীভাবে সাবেক মার্কিন কৃষি মন্ত্রী সনি পারডু মহামারির প্রথম দিকে মিটপ্যাকিং কারখানা খোলা রাখার জন্য প্রভাব খাটিয়েছিলেন – এমন সব বিষয় নিয়ে তিনি রিপোর্ট করেছেন।
২০২১ সালের জুন মাসে তিনি তুলে ধরেন, মহামারির সময় মিটপ্যাকিং কারখানায় কীভাবে কারাবন্দীদের কাজ করানো হয়েছে। সেখানে বন্দীদের দুটি উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনায় যাওয়া-আসা করতে হত, এবং এর ফলে কারাগার ও কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে কোভিডের বড় ধরনের সংক্রমণের আশংকা তৈরি হয়েছিল। ম্যাকভান, সরকারি কর্মকর্তাদের চালাচালি করা ইমেইলের একটি লাইন থেকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারেন, যা সংবাদমাধ্যমটি তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের মাধ্যমে পেয়েছিল।
মাংস শিল্প কভারের ক্ষেত্রে ম্যাকভানের কর্মকৌশলের একটি বড় অংশ হল পাবলিক রেকর্ড। শহর এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাপালনকারী একটি কোম্পানির এলাকায় তিনি একটি পাবলিক এজেন্সি ও কোম্পানির ডোমেইন নাম থেকে যেকোনো ইমেলের মধ্যকার যোগাযোগ সম্পর্কে জানতে চেয়ে অনুরোধ পাঠিয়েছিলেন। সেই অনুরোধই তাঁকে সাফল্য এনে দেয়।
তিনি যোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের ওয়েবসাইটও একটি মূল্যবান তথ্যভাণ্ডার। এই ওয়েবসাইটে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ব্যবসায়িক অংশীদারদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বাণিজ্যিক ডেটা থাকে। ইউক্রেনসহ অন্যান্য দেশের কৃষি নিয়ে ইউএসডিএ কর্মীদের সংকলন করা রিপোর্টও তিনি ব্যবহার করেছেন।
অনেক অভিবাসী, উদ্বাস্তু এবং কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়োগ দেওয়া হয় বলে এই শিল্পের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে জানতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন ম্যাকভান ।
তিনি বলেন, “আপনি যদি খাদ্য শিল্পে কর্মরত মানুষের সংখ্যা নিয়ে ভাবেন – হোক খামারকর্মী, অথবা খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, মিটপ্যাকিং কারখানা, মুদি দোকান বা রেস্তোরাঁর শ্রমিক – আমি বলতে চাচ্ছি, এটি একটি বিশাল, বিশাল শিল্প।”
ম্যাকভান জোর দিয়ে বলেন, খাদ্য শিল্পের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় মানুষের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাই মূল কথা — যেমনটি তিনি করেছিলেন সিবোর্ড ফুডস অনুসন্ধানে। ম্যাকভান অনেক সাক্ষাৎকার স্প্যানিশ ভাষায় নিয়েছেন, কারণ এটি সেই এলাকার অনেক খাদ্য শিল্প শ্রমিকের মাতৃভাষা। তিনি বলেন, তিনি সবসময় সচেতন থাকেন যেন সোর্সদের সঙ্গে খুব সৎ থাকা যায়। নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় তিনি খুলে বলেন, কেন গল্পটিকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন এবং নিশ্চিত করেন তাঁদের যেন জানা থাকে যে তাঁরা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য নন। তিনি মনে করেন, এটি এমন একটি কৌশল যা একই সঙ্গে নৈতিক এবং সোর্সের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক।
ম্যাকভান বলেন, শেষ পর্যন্ত, অন্যান্য ব্যবসা বা সরকারি সংস্থাগুলোর মতোই খাদ্যখাতের বড় কর্পোরেশনগুলো নিয়েও একই ধরনের নিরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, “আমাদের দৃষ্টি সরালে চলবে না, কারণ এই খাদ্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোও আমাজন বা ফেসবুকের মত বড় কর্পোরেশন।”
আরানহা বলেন, একটি খাবার যখন টেবিলে আসে, তখন এই খাবার তৈরির পেছনে পরিবেশগত প্রভাব, শ্রম পরিস্থিতি ও কর্পোরেট স্বার্থ সবসময় ভোক্তাদের চোখে পড়ে না।
তিনি বলেন, “আপনার স্বাস্থ্য, আপনি মুখে কী দেন, খাবারের পেছনে কতটা খরচ করেন – এসব নিয়ে আমরা কথা বলছি। একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িয়ে আছে, বোঝেনই তো, শেকড়ের নাগাল পেতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়।”
আরও পড়ুন
দ্য ননপ্রফিট নিউজ সাইট টেকিং অন এগ্রিবিজনেস ইন দ্য ইউএস হার্টল্যান্ড
সরবরাহ চেইন অনুসন্ধানের যত রকম কৌশল
বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উত্থান
এলিজাবেথ হিউয়িট নেদারল্যান্ড-ভিত্তিক একজন স্বাধীন সাংবাদিক। তাঁর কাজ অনেক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, কলম্বিয়া জার্নালিজম রিভিউ এবং সিভিল ইটস অন্যতম। ইতিপূর্বে তিনি ইউএস প্রেস ফ্রিডম ট্র্যাকারে কাজ করেছেন এবং অলাভজনক সংবাদ সাইট ভিটিডিগারডটওআরজি-এর রিপোর্টার ও সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন।