অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্টে (ওসিসিআরপি) আমরা সম্পত্তি খোঁজার জন্য শেল কোম্পানির (যে কোম্পানির অস্তিত্ব শুধু কাগজে) তালিকা তৈরি এবং ব্যাংকিং রেকর্ড ঘাঁটাঘাঁটি করে অভ্যস্ত – তবে সাধারণত এসব সম্পত্তির ক্লোয়ি, কাইলি ও পিচ বেলিনির মতো নাম থাকে না।
কিন্তু আমরা রাশিয়ান অ্যাসেট ট্র্যাকার নামে একটি প্রকল্প চালু করার পর থেকে আগের সব ধারণাই বদলে যায়। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অনুগত ধনকুবের (অলিগার্ক) ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্পত্তির বিশদ তালিকা তৈরির উদ্দেশ্যে এই প্রকল্প শুরু হয়েছিল। আমরা পাঠকদের বলেছিলাম, তালিকায় যুক্ত করার মত কোনো জমি, বিমান, প্রতিষ্ঠান বা অন্যান্য দামী সম্পত্তির খোঁজ পেলেই আমাদের জানাতে।
“ঘোড়া” যে এই তালিকার একটি শ্রেণিবিভাগ হতে পারে, তা শুরুতে আমাদের মাথায়ই আসেনি। তবে “সোফিয়া আব্রামোভিচের (রুশ ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচের মেয়ে) বেশ কিছু শো-জাম্পার ঘোড়া আছে, যাদের একেকটির দাম পাঁচ লাখ মার্কিন ডলার” – এ খবর পাওয়া মাত্রই আমরা অনুসন্ধান শুরু করি।
আমরা ঘোড়া বিশেষজ্ঞ নই, আর হওয়ার প্রয়োজনও ছিল না। ঘোড়ার মালিকানার ডেটাবেস, সামাজিক মাধ্যম, প্রতিযোগিতার ফলাফল ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিসহ পুরোপুরি উন্মুক্ত সোর্সের ওপর নির্ভর করেই আমরা শেষ পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি ঘোড়া সনাক্ত করতে সক্ষম হই, যেগুলোর মালিকানা হয় সোফিয়া আব্রামোভিচের নয়তো তাঁর মা ইরিনার।
কীভাবে ঘোড়ার খোঁজ পেলাম?
খবরটি পাওয়ার পর আমরা খোঁজ শুরু করি, গুগলে! বিভিন্ন গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করে বিপুল সংখ্যক সার্চ-ফলাফলকে ছোট করে আনা বা “গুগল ডর্কিং” হলো একটি মূল্যবান ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স কৌশল, যা প্রায়ই আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। এটি দিয়ে অনলাইনে উন্মুক্ত বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা বোঝায়। যেমন, গুগলে কেবল “Sofia Abramovich” লিখে সার্চ করে আমরা খুব বেশিদূর যেতে পারিনি, তবে “Sofia Abramovich” AND “showjumpers” OR “horses” লিখে সার্চকে আরও সুনির্দিষ্ট করার পর এমন ফলাফল পাওয়া যায়, যা আমাদের সঠিক দিকে নিয়ে যেতে শুরু করে।
বার বার চেষ্টা এবং চিন্তায় যতটা কুলোয় তত ধরনের সার্চ কৌশল ও অপারেটর ব্যবহারের ক্লান্তিকর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা – এবং আমাদের সহযোগী ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল সেক্রেটারিয়েট – দুটি পথের সন্ধান পাই। প্রাথমিকভাবে, সার্চে পাওয়া বিভিন্ন সংবাদ প্রবন্ধ, পিডিএফ ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেখে মনে হচ্ছিল আমরা যে ইঙ্গিতটি পেয়েছিলাম সেটি সঠিক। অর্থ্যাৎ, প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া শো-জাম্পার ঘোড়ার মালিক ও আরোহী হিসেবে সোফিয়ার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু আমরা জানতাম, আমাদের অতি-সতর্ক ফ্যাক্ট চেকারেরা আরও জোরালো প্রমাণ চাইবেন।
আমরা দেখেছি, আমাদের হাতে আসা ফলাফলের অনেকগুলোই এসেছে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর ইকুয়েস্ট্রিয়ান স্পোর্টসের (এফইআই) ওয়েবসাইট থেকে। এটি অশ্বারোহী ক্রীড়ার আর্ন্তজাতিক অভিভাবক সংস্থা, যার সদর দপ্তর সুইজারল্যান্ডের লুজানে। আমরা সারা দুনিয়ার কোম্পানি ও ভূসম্পত্তির ডেটাবেস নিয়ে নিরন্তর কাজ করছি এবং সেগুলো ব্যবহার করছি; কিন্তু ঘোড়ার মালিকানা ছিল একটি অজানা ক্ষেত্র। তবে এফইআই ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করে আমরা দেখেছি, ডেটাবেসটি উন্মুক্ত এবং বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়; সেখানে সারা বিশ্বের যাবতীয় শো জাম্পারের তথ্য সংরক্ষিত আছে, মালিকানাসহ।
ঘোড়া বা মালিকের নাম দিয়ে এই ডেটাবেসে তথ্য খোঁজা যায়, এবং আব্রামোভিচ উপাধি দিয়ে খোঁজ করে সোফিয়া ও ইরিনার মালিকানাধীন অনেকগুলো ঘোড়ার তথ্য পাওয়া যায়, যা শুরু হিসেবে বেশ কার্যকর ছিল। কিছু ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, ঘোড়ার মালিকানা পরিবর্তন হয়ে ইরিনা থেকে সোফিয়ার কাছে গেছে। এমনটা দেখা গেছে, ২০২২ সালের মার্চে। একই মাসে যুক্তরাজ্য সরকার আব্রামোভিচের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এটি পরিস্কার বোঝা গিয়েছিল, কারণ ততদিনে আমরা খেয়াল করেছিলাম যে আব্রামোভিচ তার সম্পত্তি রক্ষা করতে ঠিক একই সময়ে আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। (যেমন, তিনি যুক্তরাজ্যে তাঁর হেলিকপ্টারের নিবন্ধন বাতিল করে সেটিকে রাশিয়ায় পুনঃনিবন্ধন করেছেন এবং তাঁর গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর হাতে ছেড়ে দিয়েছেন।)
নতুন ডেটাবেস পাওয়ার পর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল, কোন ধরনের সার্চে কী ধরনের ফলাফল আসে, তা পরীক্ষা করতে থাকা। যেমন, এই ঘটনায় আমাদের সন্দেহ হয়েছিল যে সোফিয়ার মালিকানাধীন কিছু ঘোড়ার তথ্য তার প্রোফাইলে নেই। কিন্তু ঘোড়ার নাম দিয়ে সার্চ করার পর, আমরা সেগুলোকে ডেটাবেসে পেয়েছি এবং তাঁর মালিকানা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি।
সেখান থেকে আমরা চলে যাই সামাজিক মাধ্যমে, যা কিনা গবেষক ও রিপোর্টারদের জন্য কোনো ব্যক্তির জীবনাচার সম্পর্কে জানার অন্যতম সেরা রিসোর্স। মানুষের অর্থবিত্ত হলে মাঝে মাঝে তাঁরা নিজেদের সম্পদ নিয়ে বড়াই করতে পছন্দ করেন। সামজিক মাধ্যম হলো নিজেকে জাহির করার সেই উপযুক্ত জায়গা এবং ধনীদের জন্য নিজেদের সম্পদ প্রদর্শনের প্রিয় প্লাটফর্ম। প্রোফাইলটি উন্মুক্ত হলে সেখানকার পোস্টগুলোতে চোখ বুলানো এবং দৃশ্যমান সম্পদ বা অন্য সহায়ক তথ্য বের করার জন্য ঘন্টাখানেক সময় কাটানো বরাবরই ফলদায়ক। দৃশ্যমান সম্পদের মধ্যে থাকতে পারে ঐ ব্যক্তির পরিহিত দামী গহনা, বা বিদেশে কোনো ইয়টে তাঁর ছবি – যে ইয়টটির মালিকানা আপনি তাঁর বলে সন্দেহ করছেন। আর সহায়ক তথ্যের মধ্যে রয়েছে দরকারি পরিচায়ক তথ্য; যেমন: জন্মদিনের পোস্ট থেকে আপনি তাঁর জন্মতারিখ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন, অথবা স্বামী/স্ত্রী বা সঙ্গীর সঙ্গে কোনো পোস্ট পেলে সেখান থেকে তাঁদের সম্পর্কের ধরন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন।
সোফিয়ার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টটি আমাদের খুঁজে পাওয়া বেশ কিছু ঘোড়ার ছবি ও ভিডিওতে পরিপূর্ণ ছিল। সেখানে কয়েকঘন্টা ধরে নিবিড় অনুসন্ধান চালানোর পর বিভিন্ন ধরনের সূত্র মিলেছে যেখান থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পেরেছি, কোন ঘোড়া আসলে কোনটি।
যেমন, এফইআই-এর প্রাথমিক তালিকায় পাওয়া ঘোড়াগুলোর একটির নাম ছিল “ভ্যালকিরি দে জান্স।” ২০২২ সালের ৩রা মার্চ পর্যন্ত ভ্যালকিরির মালিক ছিলেন আব্রামোভিচের সাবেক স্ত্রী ইরিনা। তারপর এটি পুনঃনিবন্ধিত হয় সোফিয়ার নামে। ইনস্টাগ্রামে সোফিয়ার কোনো পোস্টেই “ভ্যালকিরি দে জান্সের” কথা উল্লেখ করা হয়নি। তবে “পার্সিকে” নিয়ে বেশ কয়েকটি পোস্ট পাওয়া যায় এবং একটি পোস্টে ইঙ্গিত মেলে যে ভ্যালকিরিকে আদর করে তিনি পার্সি নামে ডাকতেন।
সোফিয়ার ইনস্টাগ্রাম পেজে পাওয়া আরও একটি ঘোড়া হলো সদ্যোজাত অশ্বশাবক, পিচ বেলিনি। আমরা যখন বুঝতে পারলাম এই ঘোড়াটি এফইআইতে নিবন্ধিত নয়, তখন দ্বিতীয় একটি ডেটাবেসে নজর দিলাম। অ্যাঙলো ইউরোপিয়ান স্টাডবুক নামের এই ডেটাবেসে ইউরোপ ও আমেরিকার “মানসম্মত জাতের” ঘোড়াগুলোকে নিবন্ধন করা হয়। আমরা এখানে সোফিয়ার নামে নিবন্ধিত আরও ২৭টি ঘোড়ার খোঁজ পেয়েছি।
এই ডেটাবেসে নিবন্ধিত অনেক ঘোড়াই সদ্য জন্ম নেওয়া। স্টাডবুকে পাওয়া জন্মতারিখের সঙ্গে, ইনস্টাগ্রামে সেগুলোর জন্ম নিয়ে সোফিয়ার করা পোস্টের তারিখ মিলিয়ে আমরা ঘোড়াগুলোকে সনাক্ত করতে পেরেছি।
ঘোড়াগুলোর দাম কত?
রাশিয়ান অ্যাসেট ট্র্যাকারের লক্ষ্য কেবল পুতিনের বন্ধু, সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষকদের বিদেশে সঞ্চিত সম্পদের তালিকা তৈরি করা নয়, বরং এই শাসনামলের সুবিধা নিয়ে আব্রামোভিচসহ অন্যেরা কতটা সম্পদ অর্জন করেছেন সেটিও তুলে ধরা।
আমরা যখন ঘোড়াগুলোর দাম নিরূপণের চেষ্টা শুরু করলাম তখনো ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না, কী মিলবে। হেলিকপ্টার বা স্থাবর সম্পত্তির দাম বের করা বেশ সহজ। প্রায় ক্ষেত্রেই, কেনাবেচার সময় সম্পত্তির মূল্য দলিলে উল্লেখ করা থাকে। উড়োজাহাজ বেচাকেনার প্রক্রিয়া উন্মুক্ত এবং প্রায়ই দামের তালিকাও পাওয়া যায়। তবে একটি ঘোড়ার মূল্য – প্রতিযোগিতায় সেটির ইতিহাস ও সাফল্য থেকে শুরু করে বংশ পরিচয় ও বয়সসহ – বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করে বলে আমাদের জানান বৃটেনভিত্তিক এক প্রজননবিদ। দামী যে কেবল ঘোড়াই হয়, তা নয়: কোনো কোনো সফল শো-জাম্পারের বীর্যের মূল্যই ২০ লাখ পাউন্ড (২৫ লাখ মার্কিন ডলার) পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং এই বীর্য হিমায়িত বা সদ্য সংগৃহীত (আরও ব্যয়বহুল) কিনা, তার ওপর দাম ওঠানামা করতে পারে।
আমরা আব্রামোভিচের প্রত্যেকটি ঘোড়ার যথাযথ মূল্য আলাদাভাবে নিশ্চিত করতে পারিনি। সেই ঘোড়াগুলোর বীর্য বিক্রি করা হয়েছে কিনা, সে সম্পর্কেও উন্মুক্ত উৎসে কোনো তথ্য নেই। আমরা শুধু জানি এই বিশ্বে সবচেয়ে প্রতিযোগিতাসক্ষম কিছু শো-জাম্পার লাখ লাখ পাউন্ডে বিকোয়, যার মধ্যে সোফিয়ার মালিকানাধীন কয়েকটি ঘোড়ার জনক-জননীও রয়েছে। যেমন: পুরস্কারজয়ী বিলি কঙ্গো থেকে জন্ম নিয়েছে সোফিয়ার বিলি ফ্রাউলিন।
এই স্টোরি প্রথম প্রকাশ করে অর্গানাইজ্ড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশিত হল। আপনি মিডিয়ামে প্রকাশিত ঘোড়া বিষয়ক অনুসন্ধানের মূল লেখাটি পাবেন এখানে, এবং অলিগার্কদের ঘোড়া ও অন্যান্য সম্পদ নিয়ে ওসিসিআরপির অনুসন্ধানটি পাবেন এখানে।
আরও পড়ুন
ইনভেস্টিগেটিং রাশিয়া অ্যান্ড দ্য ওয়ার ইন ইউক্রেন
১০ টিপস ফর ট্র্যাকিং রাশিয়ান-ওউনড অ্যাসেটস
অলিগার্ক লস্যুটস এইম টু সাইলেন্স জার্নালিস্টস ইন ইউকে
লরা ডাইমিস ওসিসিআরপিতে গবেষক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি মূলত মধ্যপ্রাচ্য/উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গতিবিধি অনুসরণে সাংবাদিকদের সহায়তা করেন। এছাড়াও তিনি ওসিসিআরপির নিয়মিত সংবাদ দলের জন্য রিপোর্ট করেন। আগে তিনি আরব রিপোর্টার্স ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (এআরআইজে) ও জর্ডান টাইমসের সম্পাদক ছিলেন।