২০২০ সালের নভেম্বরে, চিকুরুবি ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজন থেকে মুক্তির একদিন পর এজেন্সি ফ্রান্স-প্রেসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জিম্বাবুয়ের সাংবাদিক হোপওয়েল চিনোনো ব্যাখ্যা করেন, কেন তাঁকে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছিল। দেশটির প্রেসিডেন্টের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “বিশেষ করে প্রেসিডেন্টের পরিবার জড়িত বলে, মানানগাগোয়ার অনুগত শাসকগোষ্ঠী ও সরকার চায়নি দুর্নীতি উন্মোচিত হোক।” তিনি বলেন, “দুর্নীতি প্রকাশে আমি পিছপা হব না। একবার দুর্নীতির উন্মোচন বন্ধ করা মানে সাংবাদিকতা থামিয়ে দেয়া।”
গোটা বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা একই অনুভূতি ধারণ করেন। তবে আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণতম অঞ্চল, বিশেষ করে এসওয়াতিনি, লেসোথো, মালাউই, মোজাম্বিক ও জিম্বাবুয়ের অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা রাজনৈতিক ও কর্তৃত্ববাদী চ্যালেঞ্জের কারণে এখন তাঁদের পেশাজীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছেন। এসব বাধার মধ্যে রয়েছে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের নিয়ে রিপোর্ট করার পর প্রতিশোধের ভয়, হয়রানি, নির্যাতন ও মৃত্যুর হুমকি, সাংবাদিকদের গুপ্তচর ও সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করা, নজরদারি বৃদ্ধি, তথ্যের ঘাটতি এবং আর্থিক সহায়তার অভাব। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া এবং বতসোয়ানা সহ এই অঞ্চলের যেসব দেশ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার র্যাঙ্কিংয়ে ভালো অবস্থানে আছে, সেগুলোও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রতিকূলতার মুখে পড়েছে৷
ইউনেস্কোর সহায়তায় মিডিয়া ইনস্টিটিউট অব সাউদার্ন আফ্রিকা (মিসা) প্রণীত দ্য স্টেট অব প্রেস ফ্রিডম ইন সাউদার্ন আফ্রিকা ২০১৯-২০২০ প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, “নির্বিচারে গ্রেফতার ও আটক, জেল, শারীরিক হামলা, বড় অংকের জরিমানা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য বিপজ্জনক আইন প্রবর্তন, এমনকি হত্যার মতো আক্রমনের ক্রমবর্ধমান খবর থেকে বোঝা যায় সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীদের নিরাপত্তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।” এই অঞ্চলে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্বকারী বেশ কিছু নতুন দমনমূলক আইন ও চর্চারও সন্ধান পেয়েছে প্রতিবেদনটি: “দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকায় গণমাধ্যম পরিস্থিতি ও পরিচালনার পরিবেশকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে কোভিড-১৯ মহামারির আঘাতজনিত উত্থানপতন এবং ডিজিটাল যুগের আগমন, যা গণমাধ্যমের স্থায়িত্ব ও টিকে থাকার ক্ষমতাকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে।”
আর্থিক প্রতিকূলতা
আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল একটি বিশাল এলাকা নিয়ে গঠিত, যার আয়তন প্রায় ভারতের সমান এবং জনসংখ্যা ১৩ কোটির বেশি। এটি অনেক ভাষা ও জাতিসত্ত্বার আবাসস্থল, যা দক্ষিণ আফ্রিকার শিল্প কেন্দ্র থেকে দরিদ্র পর্তুগিজভাষী মোজাম্বিক এবং ক্ষুদ্র ভূ-বেষ্টিত দেশ এসওয়াতিনি (সাবেক সোয়াজিল্যান্ড) ও লেসোথো পর্যন্ত বিস্তৃত। সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও এই অঞ্চল দারিদ্র্য, দুর্নীতি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে গভীর সমস্যায় ভারাক্রান্ত।
দুর্বল ও অকার্যকর অর্থনীতির কারণে অঞ্চলটির অনেক বার্তাকক্ষের জন্য টাকা যোগানো কঠিন হয়ে পড়েছে, আর সম্পদের ঘাটতিকে আরও প্রকট করে তুলেছে মহামারি।
মিসা, ২০২১ সালের প্রতিবেদেনের সমাপ্তিতে বলেছে, “গণমাধ্যমগুলোর জন্য টেকসই ব্যবসা ও টিকে থাকার সক্ষমতার সমস্যা আগে থেকেই ছিল, যাকে কোভিড-১৯ আরও হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। বিজ্ঞাপনী আয়ে কমতি ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে মহামারিতে বাজেট কাটছাঁট করতে হয়েছে বড় আকারে, তাই অনেক সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীকে চাকরি হারাতে হয়েছে।”
জিম্বাবুয়ের পদকজয়ী অনুসন্ধানী সাংবাদিক ব্লেস্ড মালাঙ্গা এই প্রভাব কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, “এই মুহূর্তে জিম্বাবুয়ের সংবাদমাধ্যমগুলো খুবই শোচনীয় অবস্থায় আছে এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করার মতো কর্মীবাহিনী তাদের হাতে নেই।” তাঁর মতে, “এক বা দুই দিনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হয় না। এটির জন্য সময় ও সম্পদ দরকার হয়। আপনি যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দেখছেন, তার জন্য অর্থ যোগান দেয় অলাভজনক সংগঠনগুলো।”
লেসোথোর অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরাও অর্থ সংকট সামাল দিচ্ছেন। এমএনএন সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের প্রতিষ্ঠাতা-অংশীদার সেচাবা মোখেথি ব্যাখ্যা করে বলেন, “সামান্য সম্পদ নিয়েই আমাদের টানাটানির মধ্যে থাকতে হয়, যার সঙ্গে কাজের পরিমাণ বা অন্য জায়গার সহকর্মীদের পারিশ্রমিকের তুলনাই করা যায় না।” তিনি বলেন, “এই পরিস্থিতি, আমাদেরকে প্রতিবেদনের জন্য ক্ষুদ্র অনুদানের আবেদন এবং ছোট ব্যবসা শুরুর মাধ্যমে সম্পদের বিকল্প উৎসের পেছনে ছুটতে বাধ্য করে।” অনুদানের জন্য আবেদন ও ব্যবসায়িক উদ্যোগের মতো অসম্পাদকীয় কাজে বাধ্য হয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা তাঁদের মূল কাজ, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন অন্বেষণ, থেকে দূরে সরে যান। বতসোয়ানা, জিম্বাবুয়ে, মালাউই, এসওয়াতিনি ও নামিবিয়ার রিপোর্টারদের জন্যেও এটি বেশ সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই রিপোর্টারেরা বলে থাকেন, অনুসন্ধান এবং টিকে থাকার জন্য অনুদানের আবেদন – এখন এই দুই কাজে তাঁদের সময় ভাগ করতে হয়।
এসওয়াতিনিতে, দ্য নেশন সাময়িকীর মতো যেসব প্রকাশনা রাষ্ট্রের সমালোচনা করে, তারা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ, সমালোচনামূলক খবর প্রকাশ করা গণমাধ্যমগুলোকে শায়েস্তা করতে, সরকার বিজ্ঞাপন বণ্টনের ক্ষমতা ব্যবহার করে। দ্য নেশনের অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও ইনলেইস সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের প্রতিষ্ঠাতা ভুইসিলে লাতশোয়ায়ো ব্যাখ্যা করে বলেন, “সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো দ্য নেশনকে বিজ্ঞাপন দেয় না। সমালোচনামূলক অবস্থানের কারণে দ্য নেশন থেকে বিজ্ঞাপন তুলে নিতে কখনো কখনো সরকারি কোম্পানিগুলোকেও নির্দেশ দেয় স্ব স্ব মন্ত্রণালয়।” সরকারের “গণমাধ্যম জবরদখল” কৌশলের কল্যাণে দ্য নেশনের মতো স্বাধীন গণমাধ্যমগুলো তহবিল সংকটে ভোগে এবং অপকর্ম প্রকাশের প্রচেষ্টার জন্য সাজাভোগ করে।
ভয় ও হয়রানির সংস্কৃতি
এই অঞ্চলে স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিবেশ উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সাংবাদিকদের ওপর ক্রমবর্ধমান হামলা ও হয়রানির ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। আরএসএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, “২০২০ সালের ১৫ মার্চ থেকে ১৫ মে সময়ের মধ্যে সাব-সাহারান আফ্রিকায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হামলা ও গ্রেফতারের যত ঘটনা ঘটেছে, তা ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় তিনগুণ।”
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা থাকলেও এই অঞ্চলের অনেক দেশে এখনো বেশ কিছু সেকেলে আইন ও নীতিমালা আছে, যা সাংবাদিকদের কাজের জন্য বাধা বা হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। মিসার রিপোর্টে বলা হয়েছে, “সাংবাদিকদের শারীরিক ও মৌখিক আক্রমণ, হয়রানি ও নির্যাতন এবং কখনো কখনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে অভিযানের ফলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।”
আরএসএফের ২০২১ সালের বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে এসওয়াতিনি ১৪১তম, জিম্বাবুয়ে ১৩০তম, মোজাম্বিক ১০৮তম এবং লেসোথো ৮৮তম অবস্থানে রয়েছে। মালাউইর অবস্থা কিছুটা ভালো, র্যাংকিংয়ে ৬২তম। আর অন্য তিন দেশ বতসোয়ানা (৩৮তম), দক্ষিণ আফ্রিকা (৩২তম), ও নামিবিয়া (২৪তম) রয়েছে অনেক পশ্চিমা দেশের সমপর্যায়ে বা ওপরে। তবে ২০২০ সালের তুলনায় জিম্বাবুয়ে, মালাউই, বতসোয়ানা, নামিবিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার গণমাধ্যমের পরিবেশে অবনতি হয়েছে।
লেসোথোর মতো দেশে সাংবাদিকেরা এখনও রাজনীতিবিদ ও তাদের সমর্থকদের হুমকির শিকার হন। অপকর্ম প্রকাশের পর সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা রাজনীতিবিদ ও তাদের সমর্থকদের কাছ থেকে হত্যার হুমকিও পান। নির্মাণ প্রকল্পের জন্য চীন থেকে বড় অংকের ঋণ নিতে মোসিসিলির চেষ্টা উন্মোচন করেছে এমএনএনের যে প্রতিবেদন, তার প্রসঙ্গ টেনে মোখেথি বলেন, “সাবেক প্রধানমন্ত্রী পাকালিথা মোসিসিলির অনুসারীদের সঙ্গে আমাদের সমস্যা ছিল, যারা আমাদের রিপোর্টার বিলি এনটাওট ও তাঁর গোটা পরিবারকে হত্যার হুমকি দিয়ে আমাদের স্টোরিকে খাটো করতে চেয়েছিল।” তিনি বলেন, “আমরা অত্যন্ত অস্থির ও রাজনীতি-প্রভাবিত একটি সমাজের মুখোমুখি, যেখানে কেউ কেউ তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের রক্ষার জন্য সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালাতে সবসময় তৈরি থাকেন।”
এসওয়াতিনি হলো রাজা তৃতীয় মাসোয়াতির অধীন একটি নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র। রাজ পরিবারের সমালোচনা প্রচণ্ড অসম্মানজনক বলে জনমানুষের মনে যে বিস্তৃত ধারণা রয়েছে, তার সঙ্গে সেখানকার সাংবাদিকদের প্রতিনিয়ত লড়তে হয়। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও আইনী বাধার সংমিশ্রণে টাইম অব এসওয়াতিনি এবং এসওয়াতিনি অবজারভারের মতো মূলধারার পত্রিকাগুলোর অনুসন্ধানী প্রকল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এসওয়াতিনি মিডিয়া ব্যারোমিটারের মতে, দেশটিতে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিতকারী প্রায় ৩২টি আইন আছে। ১৯৬৮ সালের সেডিশন অ্যান্ড সাবভারসিভ অ্যাক্টিভিটিজ অ্যাক্টে “রাষ্ট্রদ্রোহী প্রকাশনা” এবং “রাজা ও তার প্রজাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও মানহানিকর বা অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে,” এমন তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক শব্দের ব্যবহারকেও অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২০১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মেইল অ্যান্ড গার্ডিয়ান পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে “জুয়েমার্ট” হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক জুয়েলি মার্টিন ডিলামিনি বর্ণনা করেন, গ্রেফতার ও পুলিশী নির্যাতন তাঁকে এসওয়াতিনি ছাড়তে বাধ্য করেছে কীভাবে। জুয়েমার্ট বলেন, “আমি সোয়াজিল্যান্ড শপিং নামে আমার নিজের পত্রিকা চালু করি। কিন্তু সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করায় শেষ পর্যন্ত তারা এটি বন্ধ করে দেয়।”
জিম্বাবুয়ের পদকজয়ী সাংবাদিক ইলিয়াস মাম্বো বলেন, যাদের নিয়ে অনুসন্ধান করা হয়, তাদের কাছ থেকে হুমকি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রধান বাধা। জিম্বাবুয়ের কিয়াদজোয়া খনি থেকে হীরা লুট নিয়ে অনুসন্ধানে তিনি একই ধরনের হুমকি পেয়েছিলেন বলে জানান। মাম্বো স্মরণ করেন, তিনি ও তাঁর সহলেখক ওবে মানায়িতি “নিরাপত্তা ইস্যু মোকাবেলা করেছেন, যেখানে এই স্টোরি করা থেকে আমাদের বিরত রাখতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক কর্তা ব্যক্তিরা হুমকির আশ্রয় নিয়েছিলেন।”
মালাউই পুলিশ, সম্প্রতি প্লাটফর্ম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নাালিজম (পিআইজে) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক গ্রেগরি গন্ডিকে গ্রেফতার করেছে এবং সোর্সের পরিচয় প্রকাশে বাধ্য করতে তাঁর কম্পিউটার ও ফোন জব্দ করেছে। জানা যায়, অ্যাটর্নি জেনারেল থাবো চাকাকা নিরেন্দা দেশটির দুর্নীতি বিরোধী ব্যুরোকে যে গোপন আইনী মতামত দিয়েছিলেন সেটি ফাঁসকারীর পরিচয় জানতে কর্তৃপক্ষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। মালাউইর পুলিশ, সামরিক বাহিনী ও ইমিগ্রেশন বিভাগের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ধারাবাহিক লেখা প্রকাশ করে যাচ্ছে পিআইজে। গন্ডিকে পরবর্তীতে মুক্তি দেয়া হয়।
এই অঞ্চলের কয়েকজন অনুসন্ধানী সাংবাদিককে সন্ত্রাসী বা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শত্রু হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। মালাউইর অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও আফ্রিকা-ব্রিফের প্রধান সম্পাদক উইনস্টন মোয়ালে বলেন, “আফ্রিকায় সাংবাদিকদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বা আচরণ একটি পুরনো সমস্যা। আমাদেরকে রাষ্ট্রবিরোধীদের গুপ্তচর হিসেবে দেখা হয়। সবসময় আমাকে এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, যেখানে সোর্সকে মনে করিয়ে দিতে হয়, একটি সম্পূর্ণ ও বস্তুনিষ্ঠ স্টোরির জন্য তাদের তথ্য দেয়া জরুরি।”
ডেটা শূন্যতা ও অসাড় কর্মকর্তা
আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে সরকারি সোর্সের নিষ্ক্রিয়তার কারণে সৃষ্ট ডেটা শূন্যতার দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। মোয়ালি বলেন, “মূল সমস্যা হলো তথ্যের কেন্দ্রীয় উৎসের অভাব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গর্ভবতী নারীদের শারীরিক পরীক্ষায় উপস্থিতির ওপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব নিয়ে স্টোরি করার সময় মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আমাকে বলেছিলেন, তাঁর কাছে দেশটির হাসপাতাল সংক্রান্ত কোনো ডেটা নেই, আর বিকল্প হিসেবে আমার উচিত, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রতিটি হাসপাতালে কথা বলা।”
ব্লেস্ড মালাঙ্গা বলেন, “জিম্বাবুয়েতে তথ্য পাওয়া বেশ কঠিন। আপনি এমন ওয়েবসাইট পেতে পারেন যেগুলোতে তথ্য হালনাগাদ করা নেই, অথবা সরকারি কর্মকর্তাদের নির্দিষ্ট তথ্যের জন্য অনুরোধ করলে বলা হতে পারে আপনি একজন অ্যাক্টিভিস্ট বা আপনি রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করতে চান।”
বাধাকে পাশ কাটিয়ে চলা
সোয়াজিল্যান্ড শপিং বন্ধের পর নির্বাসিত জুয়েমার্ট এখন সোয়াজিল্যান্ড নিউজ নামের একটি অনলাইন প্রকাশনা পরিচালনা করছেন। তিনি প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকেন এবং সেখানকার উদার ও স্বাধীন গণমাধ্যম পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাঁর কাজের জন্য সামাজিক মাধ্যম, তথ্যফাঁস ও আন্তর্জাতিক সমর্থনকে সদ্ব্যবহার করেন।
জুয়েমার্ট বলেন, “আমরা টুইটারে আছি, আর ফেসবুক ব্যবহার করি, কারণ যাদের আমরা টার্গেট করি তাদের অধিকাংশই ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে আছেন। খুব দ্রুত আমরা দুই লাখ ফলোয়ারে পৌঁছে যাচ্ছি।” ২০২১ সালের জুনে এসওয়াতিনিতে বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে, জুয়েমার্ট রাজতন্ত্র, বিক্ষোভকারীদের বে্আইনি হত্যা, দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন।
হোপওয়েল চিন’ওনো তথাকথিত ‘মিথ্যা’ টুইট, গণবিক্ষোভ উস্কে দেয়া, ও দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্য ২০২০ সাল থেকে তিনবার গ্রেফতার হলেও তিনি টুইটার ব্যবহার করে ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহি করে যাচ্ছেন। এদিকে জিম্বাবুয়ের সাংবাদিকেরা এখনো দ্য নিউজহকস এর মতো সাইটের মাধ্যমে সরকারের দুর্নীতি, ভূমি থেকে উচ্ছেদ, ও অন্যান্য জবাবদিহিমূলক প্রসঙ্গ নিয়ে রিপোর্ট করছেন।
মোয়ালি জোর দিয়ে বলেন, তিনি ভীত নন এবং অপকর্ম প্রকাশ ও আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে কাজ চালিয়ে যাবেন।
অলাভজনক সংস্থা ও সমন্বিত সহযোগিতার শক্তি
বতসোয়ানা, নামিবিয়া, মালাউই ও জিম্বাবুয়ের মতো দেশগুলোতে গণমাধ্যম জবরদখলের সরকারি প্রচেষ্টা এবং বিজ্ঞাপনদাতা-নির্ভর সংবাদ মাধ্যমের অস্থির প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বেশ কয়েকটি অলাভজনক নিউজরুম তৈরি হয়েছে। গ্যাবোরোন ভিত্তিক আইএনকে সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অনুসন্ধানী সাংবাদিক এনটিবিনিয়ান এনটিবিনিয়ান বলেন, “এই মডেলের মাধ্যমে আমরা অনুসন্ধান এবং অঞ্চলের অন্যদের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি।” বতসোয়ানা সরকার ও নির্মাণখাতের একটি চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার অস্বচ্ছ চুক্তির মতো স্টোরি ব্রেক করতে, এই মডেল আইএনকে-কে সহায়তা করেছে বলেও জানান তিনি।
আইএনকে, ইনলেইস সেন্টার, এমএনএন, দ্য নামিবিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট ও মালাউইর প্লাটফর্ম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম এর মতো সাইটগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার আমাবুনগানে সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের প্রকল্প ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম হাব (আইজেহাব) এর মাধ্যমে একে অন্যকে সহযোগিতা করছে। এই বহুজাতিক সহযোগিতা, অংশগ্রহণকারীদের ডিজিটাল কর্মশালা থেকে শেখা, স্টোরি ও দক্ষতা ভাগাভাগি এবং তাদের অনুসন্ধানের পরিধি বিস্তৃত করতে সক্ষম করে তুলছে।
সহযোগিতামূলক সম্পর্কের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণের মধ্যে অন্যতম হল: এমএনএনের উদঘাটন, যাতে উঠে এসেছে লেসোথো মিলিয়ন মিলিয়ন গ্যালন নিরাপদ পানি প্রতিবেশি দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে বিক্রি করলেও দেশটির জনগণ পানি সংকটে ভুগছে; আইএনকের উন্মোচন, যেখানে খনি খননের জন্য ভূমি দখলে ভাইস প্রেসিডেন্ট স্লামবার সগওয়ের সংশ্লিষ্টতা উঠে এসেছে; এবং ইনলেইস সেন্টারের অনুসন্ধান, যা এসওয়াতিনিতে সাবেক খনি শ্রমিকদের বিধবা স্ত্রীদের দুর্দশা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রকাশ করেছে।
এনটিবিনিয়ান উল্লেখ করেন, “বতসোয়ানাতেই আমাদের স্টোরি শেষ হয় না, বরং সমগ্র অঞ্চল এবং বিশ্বজুড়ে তা চলমান থাকে।” এনলেইসের ভুইসিলে লাতশোয়ায়োর মতে, আঞ্চলিক নেটওয়ার্কগুলো সংবেদনশীল স্টোরির নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া থেকেও ছোট সংবাদমাধ্যমকে সুরক্ষা দিতে পারে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “যদি মনে হয়, কোনো স্টোরির কারণে আমাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে, তবে আমরা সেটি হাবে পাঠিয়ে দেই, আর সেগুলো ডেইলি ম্যাভেরিক সহ অন্যান্য প্রকাশনায় প্রকাশিত হতে পারে।”
মালাউই, জিম্বাবুয়ে, এসওয়াতিনি, জাম্বিয়া, ও নামিবিয়ার সাংবাদিকেরাও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর কোলাবোরেটিভ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নাালিজম (সিসিআইজে) এর মতো অলাভজনক সংস্থার সঙ্গে জোট বেঁধে কাজ করছেন এবং অনুদান অর্থায়ন ও প্রশিক্ষণের সুযোগ থেকে উপকৃত হচ্ছেন। সিসিআইজের সদস্য, নামিবিয়ার সাংবাদিক সোঞ্জা স্মিথ তাঁর স্টোরি “ডায়িং ফর এ ড্রপ” এবং “গ্রেপ ক্রপ ব্রিংস ইন মিলিয়নস, বাট ফার্ম ওয়ার্কার্স লিভ এ হার্শ লাইফ”এর জন্য পুরস্কার জিতেছেন।
এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, সেচাবা মোখেথির মতো এই অঞ্চলের কিছু অনুসন্ধানী সাংবাদিক ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদী; ধন্যবাদ, সহযোগিতার ক্রমবর্ধমান সুযোগ, অলাভজনক তহবিলের উত্থান এবং গল্প বলার নতুন ডিজিটাল টুলগুলোকে৷ তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, প্রতিদিন এত শত বাধার মুখোমুখি হলেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা একটি উজ্জ্বল পথেই রয়েছে।”
আরও পড়ুন
জিআইজেএন রিসোর্স সেন্টার: সাস্টেনিবিলিটি
এডিটর্স পিক: ২০২১ বেস্ট ইনভেস্টিগেটিভ স্টোরিজ ফ্রম সাব-সাহারান আফ্রিকা
হোয়াই সাউথ আফ্রিকা’স পাওনিয়ারিং ইনভেস্টিগেটিভ ননপ্রফিট ইজ সাপোর্টিং আদার রিজিওনাল স্টার্ট-আপস
ক্যারোলাইন এম. লুঙ্গা সিটি ইউনিভাসিটি অব লন্ডনের (ইউকে) পিএইচডি গবেষক। সাংবাদিকতার প্রভাষক হিসেবে তাঁর ১০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি আর্ন্তজাতিক সাংবাদিকতার মাস্টার্স প্রোগ্রামের একজন গ্রাজুয়েট টিচিং অ্যাসিসট্যান্ট এবং বর্তমানে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে সহযোগিতামূলক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে গবেষণা করছেন।