নামকরা এক জার্মান ডাক্তারের হাতে রোগীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনা অনুসন্ধান করতে রিপোর্টার জুলিয়ান লফলারের তিন বছর সময় লেগেছিল।
তাঁর প্রতিবেদনে বেশ কিছু ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ উঠে আসে, যেখানে সেই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে রোগীদের ওপর হামলার অভিযোগও আছে।
বাজফিড নিউজের লেখক ও ডের স্পিগেলের সম্পাদক লফলার, আরেক সাংবাদিকের সঙ্গে যৌথভাবে স্টোরিটি প্রকাশ করেন। তবে এর পরপরই সেটি সরিয়ে ফেলতে তার প্রকাশকের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য সেই ডাক্তার আইনী ব্যবস্থা নেন।
১৫ মার্চ, জিআইজেএনের টিপস অ্যান্ড টুলস ফ্রম উইমেন ইনভেস্টিগেটর্স ওয়েবিনারে লফলার বলেন, এই রিপোর্ট করতে গিয়ে তাঁকে যত বাধার মুখে পড়তে হয়েছে, ডাক্তারের দায়ের করা মামলায় আদালতের স্থগিতাদেশ ছিল তাদের মাত্র একটি।
#মিটু অনুসন্ধানের চ্যালেঞ্জ
লফলার বলেন, যেসব অনুসন্ধান ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের জবাবদিহি করতে চায় সেখানে আইনী প্রতিবন্ধকতা একটি সাধারণ বিষয়। তাঁর মতে #মিটু নিয়ে রিপোর্ট করা আরও কঠিন হতে পারে। কারণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য যাচাই করার জন্য কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়, তাই যাচাইযোগ্য প্রমাণ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, “কখনো কখনো ঘটনাগুলো অনেক আগের হয়ে থাকে, ফলে তা পুনর্গঠন করা সহজ নয়। এছাড়া অনেক ভুক্তভোগী মানসিক আঘাতের শিকার হন এবং মানসিকভাবে আহত ভুক্তভোগীর স্মৃতিতে ঘাটতি থাকে।”
রোগীদের নিপীড়নের ঘটনায় অভিযুক্ত এই চিকিৎসক পরবর্তীতে একটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন, যদিও তিনি এর বিরুদ্ধে আপিল করছেন।
লফলার বলেছেন, অভিযোগের সমর্থনে শক্তিশালী প্রমাণের অভাব থাকায় তিনি কিছু অনুসন্ধানে হাত না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে স্টোরিতে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ ও সমর্থনযোগ্য তথ্য আছে, অভিযুক্ত অপরাধী আমার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিলে স্টোরিটি আদালতে টিকবে এবং আইনগতভাবে বৈধ হবে।”
তবে তিনি বলেছেন, রিপোর্টারদের জন্য তথ্যের যথার্থতা যাচাই এবং এ ধরনের স্টোরি যেন প্রকাশিত হয় তা নিশ্চিত করার আরও অনেক উপায় আছে।
প্রথমত, সোর্সের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক স্থাপন করা জরুরি। “আমি মানুষকে বলি, আমি কে, কোথায় কাজ করি, [যেন] তারা আমার সম্পর্কে জানতে পারেন,” শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন লফলার। “এবং তারপর তাদের বলি, আমি বুঝতে চাই কী ঘটেছে। কেবল তারপরই, এটি প্রকাশ করা যাবে কি যাবে না সে বিষয়ে কথা বলি।”
তাঁর মতে, সোর্সের সঙ্গে কথোপকথন রেকর্ড করাও খুব গুরুত্বপূর্ণ, তবে একজন সাংবাদিক যখন আস্থার সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছেন, সে সময় রেকর্ডার সরিয়ে রাখলে প্রত্যক্ষদর্শীর জন্য বিষয়টি সহজ হয়। গোটা প্রক্রিয়া ও সময়ক্রম সম্পর্কে সৎ এবং স্বচ্ছ থাকাও আত্মবিশ্বাস তৈরিতে সাহায্য করে।
যৌন নিপীড়নের অভিযোগ নিয়ে #মিটু রিপোর্টিংয়ের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে লফলার বলেন, “আমাদের মধ্যকার কথা ও আলাপচারিতার জন্য আমি কিছু নিয়ম দাঁড় করানোর চেষ্টাও করি।” তিনি বলেন, “আমি বুঝিয়ে বলি, যা ঘটেছে সে সম্পর্কে আমাকে খুঁটিনাটি প্রশ্ন করতে হবে: কীভাবে কোথায় তাঁদের স্পর্শ করা হয়েছে, তাঁরা কী ভাবছিলেন, এবং ঠিক কোন সময়ে কেন তাঁরা সহায়তা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁদের লেখা দিনলিপি, ক্ষুদে বার্তা, বা এমন কিছু আছে কি না তা-ও জানতে চাই, যা তাঁরা আগে আমাকে পাঠানোর জন্য লিখেছিলেন।” তিনি তাঁর সোর্সকে যে কোনো প্রশ্নের উত্তরে “না” বলারও সুযোগ দেন।
মানসিক আঘাত সৃষ্টিকারী কোন ঘটনা নিয়ে সাক্ষাৎকার
নারীদের সরাসরি প্রভাবিত করে এবং ঐতিহাসিকভাবে কম রিপোর্ট করা হয় – এমন ইস্যু নিয়ে অনুসন্ধানের রিসোর্স ও টিপস তুলে ধরতে এই ওয়েবিনারে যে তিন জন রিপোর্টার যোগ দিয়েছেন, তাদের একজন লফলার।
প্যানেলের আরেক সদস্য ছিলেন কেনিয়ার সাংবাদিক রায়েল ওম্বুর। তিনি ওপেন ডেমোক্রেসির সেই দলটির সদস্য ছিলেন, যেটি আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে লিঙ্গ-রূপান্তর চিকিৎসা-পদ্ধতি নিয়ে অনুসন্ধান করেছে – যা কোনো ব্যক্তির যৌন অভিমুখীতা পরিবর্তন বা লিঙ্গ-পরিচয় অবদমনের একটি বহুল সমালোচিত এবং অবৈজ্ঞানিক চর্চা।
সম্ভাব্য সোর্সের সাক্ষাৎকারের সময়, পর্যাপ্ত সময় নেয়া কতটা জরুরি, তা তিনি বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন।
অম্বুর বলেছেন, “আমি যখন এলজিবিটিকিউআই বা নারীবাদী ইস্যুতে রিপোর্ট করি, তখন অনেক সময় নিয়ে শুনি, কারণ এটি তাঁদের গল্প, আর তাঁরাই তাঁদের গল্প ভালো বলতে পারেন।”
এই ধরনের স্টোরির ক্ষেত্রে সহকর্মী অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য তার একটি পরামর্শ হল, ব্যাখ্যামূলক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা। অন্যান্য পরামর্শ:
- সৎ থাকুন। আপনার মন যা ভাবতে চাইছে, তা-ই ভাবতে দিন।
- ভুক্তভোগীকে বলবেন না যে তাঁর অনুভূতি আপনি বুঝতে পারছেন, কারণ তাঁদের অনুভূতি শুধু তাঁরাই বোঝেন।
- ভালো-মন্দ বিচার করতে যাবেন না।
- ফলো-আপ প্রশ্ন করুন।
- ভালো শ্রোতা হোন।
- মনকে খোলা রাখুন।
নিরাপত্তা ও সুরক্ষার সেরা চর্চা
কেনিয়ার রূপান্তর থেরাপি সেন্টারগুলো নিয়ে রিপোর্ট করার সময় তিনি তাঁর ড্রাইভারকে সঙ্গে রেখেছিলেন, যা শারীরিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কাজে এসেছিল।
তিনি বলেন, আপনি কোন রেকর্ডিং ডিভাইস ব্যবহার করবেন সেই বিবেচনাও জরুরি। রিপোর্টিংয়ের জন্য তিনি গাড়ির চাবিতে লুকোনো অডিও রেকর্ডার ব্যবহার করেছেন এবং আরেকটি পকেট রেকর্ডার অন্তর্বাসে লুকিয়ে রেখেছেন। এ ধরনের কৌশলগুলো দৃশ্যধারণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি আন্ডারকভার রিপোর্টারদের জন্য পরিস্থিতিকে কিছুটা নিরাপদও করে তোলে।
অম্বুর বলেছেন, অনেক বছর ধরে যেখানে আন্ডারকাভার রিপোর্টিংয়ে পুরুষদের বেঁধে দেয়া অনুসন্ধানী কৌশল চলে আসছে, সেখানে এই কৌশলগুলো ব্যবহার করে নারী সাংবাদিকেরা কখনো কখনো আমাদের সামনে অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। তবে তিনি রিপোর্টারদের এই উত্তেজনায় গা ভাসিয়ে দিতে নিষেধ করেছেন।
তিনি সতর্ক করে বলেছেন, “কোনও কিছু খোঁজার জন্য আন্ডারকাভার রিপোর্টিংয়ে যাবেন না।”
অনুসন্ধানে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি
প্যানেলের তৃতীয় সদস্য বুর্জু কারাকাস জার্মানীর আর্ন্তজাতিক সম্প্রচার মাধ্যম ডয়েচে ভেলের তুরস্ক প্রতিনিধি। তিনি গর্ভপাত, মানবাধিকার ও জেন্ডার বিষয়ে রিপোর্ট করেছেন এবং সাংবাদিকদের তাঁদের চারপাশের জগত থেকে অনুসন্ধানী সূত্র নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে অনুসন্ধানের মাধ্যমে জেন্ডার ইস্যুগুলোতে আলোকপাত করা যায় এবং সরকারের জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা যায়।
তিনি বলেন, “নারীহত্যার সংখ্যাধিক্যের জন্য তুরস্ক বেশ পরিচিত। যখনই নারী বা এলজিবিটিআই ইস্যু নিয়ে কাজ করি, মনে হয়, সরকারের যে আচরণ নারীদের জীবন বিপন্ন করছে, সেটি উন্মোচন করছি।”
তিনি আরও বলেন,অনুসন্ধানী রিপোর্টারদের সোর্সের বিস্তৃত একটি জাল গড়ে তোলা উচিত, এবং এক্ষেত্রে এনজিও ও আইনজীবীরা বেশ কার্যকর হতে পারে। “দুর্ভাগ্যজনকভাবে কর্মকর্তাদের মধ্যে মিথ্যা বলার প্রবণতা থাকে অথবা তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে খোঁজখবর রাখেন না, যা এনজিওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।”
অম্বুর ও কারাকাস দুজনেই বলেছেন, সাংবাদিকদের স্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি যে তারা তাদের প্রতিবেদন থেকে কী ধরনের প্রভাব দেখতে চান। অবশ্য লফলার সতর্ক করে বলেছেন, প্রতিবেদন প্রকাশের পর যা ঘটে, তারওপর রিপোর্টারের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তিনি বলেছেন, “এই সিদ্ধান্ত অন্যদের ওপর বর্তায়,” এবং একজন সাংবাদিক হিসেবে তাঁর কাজ হল, “সঠিকভাবে তথ্য বের করে আনায় মনোযোগী হওয়া”।
হলিউড মোগল হার্ভে ওয়াইনস্টিন-সংশ্লিষ্ট যৌন নিপীড়নের অভিযোগ বিশদভাবে তুলে ধরা “শি সেইড” বইটির সহ-লেখক জোডি ক্যান্টরের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করেন লফলার। তাঁর প্রথম দিককার রিপোর্টিংয়ের পর থেকে ক্রমাগতভাবে যা বেরিয়ে আসছে, সে সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “এটি কখনোই শেষ হবার নয়।”
তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়ে লফলার বলেছেন, অসদাচরণ, হয়রানি ও যৌনতা নিয়ে অনুসন্ধান “একটি সীমাহীন ক্ষেত্র,” এবং #মিটু আন্দোলন দেখিয়ে দেয় “এখনো অনেক কিছু উন্মোচন করা বাকি আছে।”
আরও পড়ুন
ইনভেস্টিগেটিং সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ: রিপোর্টিং টিপস অ্যান্ড টুলস
এশিয়ায় ডিজিটাল যৌন অপরাধের ব্যাপকতা উন্মোচন করেছে যে জোটবদ্ধ অনুসন্ধান
রিসোর্সেস ফর ফিমেল-আইডেন্টিফাইয়িং জার্নালিস্টস – এ জিআইজেএন গাইড
ব্যাঞ্জো দামিলোলা,নাইজেরিয়ার অনুসন্ধানী সাংবাদিক। বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি নিয়ে তিনি অনুসন্ধান করেছেন এবং নাইজেরিয়ার পুলিশ বাহিনী, আদালত ও কারাগার ব্যবস্থায় সংঘটিত অপকর্ম নথিবদ্ধ করেছেন। ওল সোয়িঙ্কা সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম থেকে তিনি প্রশংসাপত্র পেয়েছেন এবং ২০১৯ সালের থম্পসন ফাউন্ডেশন ইয়ং জার্নাালিস্ট অ্যাওয়ার্ডে দ্বিতীয় হয়েছেন।