২০২২ সালের অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সেরা তথ্যচিত্রের (পূর্ণদৈর্ঘ্য) মনোনয়নে যেসব বিষয় উঠে এসেছে তাদের মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি বিস্মৃত মাইলফলক, মানবপাচারের কারণে উদ্বাস্তুদের দীর্ঘমেয়াদী মানসিক যন্ত্রণা ও যুগান্তকারী একটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রকল্পের গভীরে দৃষ্টিপাতসহ বিস্তৃত, বৈশ্বিক বিষয়াবলী।
ক্ষমতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সেক্সিজম ও কলঙ্কের ভয়কে জয়
অস্কার মনোনীত তথ্যচিত্র “রাইটিং উইথ ফায়ার”- এ দেখা যায়, একদল নারী সাংবাদিক তাদেরকে দেয়া বাক্সবন্দী স্মার্টফোনের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাই দেখে রিপোর্টারদের একজন বলছেন, “মানিয়ে নিতে না পারলে আমরা টিকবো না।”
একজনের স্বগতোক্তি, “আমি কখনো মোবাইল ফোন ব্যবহার করিনি, ভয় হয়, পাছে নষ্ট করে ফেলি।”
ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে, রিন্টু থমাস ও সুস্মিত ঘোষের এই নির্মাণ “সাংবাদিকতার সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী চলচ্চিত্র – হয়তো সর্বকালের,” যেখানে ভারতের উত্তর প্রদেশের নারী কর্মী পরিচালিত রিপোর্টিং সাইট খবর লহরিয়ার রিপোর্টিং দলকে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত অনেক নারীই দলিত সম্প্রদায়ের, ভারতীয় বর্ণ প্রথায় যাদের একসময় “অচ্ছুত” বলা হত। তারা এখনো বড় ধরনের বৈষম্যের শিকার হন, যা এই সম্প্রদায়ের নারীদের বেলায় দ্বিগুণ।
দলটির একজন সদস্য তথ্যচিত্র নির্মাতাদের বলছিলেন, “এই অঞ্চলে একজন দলিত নারী সাংবাদিক হবেন, এটি কল্পনার বাইরে।” চলচ্চিত্র জুড়ে দেখা যাবে ধর্ষণ, খনিতে মৃত্যু ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে অনুসন্ধানের সময় নির্ভয়া এই সাংবাদিকেরা কতটা বিরূপ আচরণের শিকার হন। এটি এমন এক জায়গা এবং সেখানে সাংবাদিকতা করার চ্যালেঞ্জগুলোকে আমাদের সামনে নিয়ে আসে, যেখানে কণ্ঠরোধের জন্য আপনার জাত ও লিঙ্গ-পরিচয়, দুটোই ব্যবহৃত হতে পারে।
একটি বিক্ষােভ চলাকালে খবর লহরিয়ার রিপোর্টারকে এক ব্যক্তি বলেন, “মুখ সামলে কথা বলো, বাড়াবাড়ি করো না।” সাংবাদিকের জায়গায় থাকলে আপনি কী করতেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে অবজ্ঞার সুরে আরেকজন বলেন, “ঘরের কাজে মন দিতাম।” এর জবাবে সেই নারী সাংবাদিককে বলতে শোনা যায়, “আমি মানি না।”
সমালোচকদের কাছে তথ্যচ্চিত্রটি বেশ সমাদৃত হয়েছে, তবে এতে যেসব সাংবাদিকদের দেখানো হয়েছে, তারা বেশ শীতল প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। দলটি লিখেছে, “চলচ্চিত্র একটি চলমান ও শক্তিশালী দলিল, তবে এখানে খবর লহরিয়াকে এমন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখানো হয়েছে যেন একটি পক্ষ এবং সেটিকে ঘিরে রিপোর্টিং-ই এর সুনির্দিষ্ট ও সর্বাত্মক ফোকাস; এটি সঠিক নয়।” তারা আরও বলেন, “এটি এমন একটি স্টোরি, যা আমাদের মাত্র একটি অংশকে তুলে ধরে, এবং আংশিক স্টোরিতে সামগ্রিক চিত্রকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের সুযোগ থাকে।”
কৃষ্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের উন্মোচন
এ বছর সেরা তথ্যচিত্রের অস্কার পেয়েছে আহমীর “কুয়েস্টলাভ” থম্পসনের তথ্যচিত্র “সামার অব সোল (…অর হোয়েন দ্য রেভ্যুলুশন কুড নট বি টেলিভাইজড)।” এটি নির্মিত হয়েছে ১৯৬৯ সালের হারলেম সাংস্কৃতিক উৎসব নিয়ে। কৃষ্ণাঙ্গ ইতিহাস, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, ও ফ্যাশনকে উদযাপনের এই উৎসবে স্টিভি ওয়ান্ডার, নিনা সিমোন ও গ্ল্যাডিস নাইটের মতো শিল্পীরা অংশ নিয়েছিলেন। এতদিন এর ফুটেজ অগোচর ও বিস্মৃত রয়ে গিয়েছিল।
নির্মাতাদের বিচারে তথ্যচিত্রটি, “আংশিক সংগীত নির্ভর, আংশিক ঐতিহাসিক দলিল।” তবে গ্ল্যাডিস নাইটের ভাষায় তথ্যচিত্রটি দেখিয়েছে, “এটি নিছক গানের বিষয় নয়, তখন আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটছিল।” নিউ ইয়র্ক টাইমস বলেছে, তথ্যচিত্রটি উল্লেখযোগ্য পরিবেশনার একটি ভান্ডার এবং সেটি “গায়ে কাঁটা দেয়া উত্তেজক দুই ঘন্টা সময়” উপহার দেয়।
চীনের ক্রমবর্ধমান দুঃখ
জেসিকা কিংডনের তথ্যচিত্র “অ্যাসেনশন” চীনের ৫১টি জায়গা থেকে নেয়া দৃশ্যের মাধ্যমে “চৈনিক স্বপ্নের স্পন্দনকে ধারণ করেছে।” বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এই দেশ যখন অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হচ্ছে, তখন সেখানকার কর্মক্ষেত্রে বিদ্যমান শ্রেণী বিভাজনকে দুর্দান্ত ভিজ্যুয়াল ও একটি বিরল অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে খতিয়ে দেখেছে এই তথ্যচিত্র। অস্কারে মনোনীত হওয়ার আগে তথ্যচিত্রটি বেশ কয়েকটি উৎসবে প্রশংসিত হয়েছে।
কারা নির্যাতনের দেয়ালে আঘাত
স্ট্যানলি নেলসন ও ট্রেসি এ. কারির তথ্যচিত্র “অ্যাটিকা” নির্মিত হয়েছে নিউইয়র্কের ম্যাক্সিমাম-সিকিউরিটি কারাগারে ১৯৭১ সালে সংঘটিত কুখ্যাত দাঙ্গাকে ঘিরে। কারা-বিদ্রোহের সময়, অ্যাটিকা ছিল পদ্ধতিগত বর্ণবাদের একটি প্রধান উদাহরণ, যেখানে সম্পূর্ণ শ্বেতাঙ্গ কারারক্ষী বাহিনীর হাতে নিয়মিতভাবে অবহেলা ও সহিংস নির্যাতনের শিকার হতেন সংখ্যাগরিষ্ঠ অশ্বেতাঙ্গ বন্দীরা।
কারা-কম্পাউন্ডে কারারক্ষী ও রাজ্য পুলিশের হামলার মধ্য দিয়ে চার দিনের এই অচলাবস্থার অবসান ঘটে, যার জের ধরে ৩৩ জন বন্দী এবং ১০ জন সংশোধন কর্মকর্তা বা কারা-কর্মচারীর নিহত হন। এটি বিবেচিত হয় মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ কারা-বিদ্রোহ হিসেবে।
আধুনিক যুগে, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্ণ বৈষম্য উন্মোচনে পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা ও ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের মতো উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে, প্রায় ৫০ বছর আগের এই কারা-বিদ্রোহ ও তার সহিংস পরিণতি নিয়ে নির্মিত এই তথ্যচিত্র অদ্ভুতভাবে প্রাসঙ্গিক।
মানবপাচারের দীর্ঘস্থায়ী মানসিক প্রভাব
সানড্যান্স গ্র্যান্ড জুরি প্রাইজ বিজয়ী “ফ্লি” পরিচালনা করেছেন জোনাস পোহের রাসমুসেন। ছবিটির কাঠামো যেভাবে “তথ্যচিত্রের অর্থকে আরও সম্প্রসারিত করেছে” – তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন সমালোচকরাও। এই অ্যানিমেটেড ফিচার এমন একটি শিশুর ওপর মনোনিবেশ করেছে যে পরিবারকে ছেড়ে কাবুল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। ২০ বছর পরে এসে, সে এখনো কীভাবে সেইসব ঘটনা এবং যাত্রাপথে নিপীড়ন করা মানবপাচারকারীদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে, সেই গল্পই উঠে এসেছে তথ্যচিত্রটিতে।
আরও পড়ুন
তাঁরা যে আগুন ছড়িয়ে দিলেন সবখানে
হোয়াট ডাইভার্সিটি লুকস লাইক ইন ইনভেস্টিগেটিভ নিউজরুমস অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড
হোয়াট টু ওয়াচ: শর্টলিস্টেড অস্কার-নমিনেটেড ডকুমেন্টারিজ ইন ২০২১
লরা ডিক্সন জিআইজেএনের সহযোগী সম্পাদক ও যুক্তরাজ্যের ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি কলম্বিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো থেকে রিপোর্ট করেছেন এবং তাঁর কাজ এ পর্যন্ত দ্য টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও আটলান্টিকসহ অনেক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স মিডিয়া ফাউন্ডেশন এবং পুলিৎজার সেন্টার অন ক্রাইসিস রিপোর্টিং থেকে রিপোর্টিং ফেলোশিপ পেয়েছেন।