বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর হিসেবে অলিম্পিকের নাম সুপরিচিত; আর সংগঠকদের দাবি, এর বিভিন্ন আয়োজন যেমন আয়োজক নগরীর জন্য ব্যাপক আর্থিক লাভের সুযোগ এনে দেয়, তেমনি বৈশ্বিক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার একটি উৎস হিসেবে হাজির হয়।
গোটা বিশ্বে আয়োজক দেশের মর্যাদা ও প্রতীকী সক্ষমতার পাশাপাশি, গ্রীষ্ম ও শীতকালীন আসরের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ ব্যয় এবং খেলোয়াড়দের ওপর প্রচণ্ড চাপের বিষয়টিও জড়িত – যার কারণে অলিম্পিক হয়ে ওঠে অনেক ধরনের দুর্নীতি, প্রতারণা এবং নিপীড়নের উপযুক্ত ক্ষেত্র। অতীতের অলিম্পিয়াডগুলো মানবাধিকার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব বিতর্ক জন্ম দিয়েছে, কর্তৃত্ববাদীদের প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে এবং বিভিন্ন বৈরী দেশের মধ্যে বোঝাপড়া গভীর করেছে। আসরগুলোতে অবৈধ মাদকসেবন, ঘুষ, সন্ত্রাসের হুমকি, অব্যবস্থাপনা এবং শারীরিক নির্যাতনের অনেক ঘটনাও ঘটেছে — যাদের বেশ কিছু প্রকাশ-ও পেয়েছে, ওয়াচডগ সাংবাদিকদের কল্যাণে।
তাই, বেইজিংয়ে ২০২২ শীতকালীন অলিম্পিক গেমসকে ঘিরে স্বাধীন গণমাধ্যম ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য আড়ম্বর ও পদকের পেছনের নানান ঘটনা তলিয়ে দেখার যথেষ্ট উপকরণ রয়েছে।
ইতিমধ্যে বেশ কিছু স্বাধীন সাংবাদিক তুলে ধরেছেন, উইঘুর বন্দীশিবিরের নির্মমতা, চলমান কোভিড-১৯ মহামারি, গণমাধ্যমের ওপর ক্রমবর্ধমান দমন পীড়ন, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য প্রমাণ সত্ত্বেও আর্ন্তজাতিক অলিম্পিক কমিটি কর্তৃক গত আসরের আয়োজক হিসেবে চীনকে বেছে নেওয়ার ঘটনা- কেন অলিম্পিক ইতিহাসের অন্যতম কেলেঙ্কারি।
গত শীতকালীন আসরের আগে কলম্বিয়া জার্নালিজম রিভিউয়ে উঠে আসে: “যে বার অ্যাডল্ফ হিটলারের চোখের সামনে আর্য শ্রেষ্ঠত্বের মিথ ভেঙ্গে দিয়েছিলেন জেসি ওয়েনস, অন্তত সেই ১৯৩৬ সালের গ্রীষ্মকালের পর থেকে, ‘শুধু খেলা নিয়েই থাকার’ যে ধারণা অন্য ক্রীড়া অনুষ্ঠানের কাভারেজের ক্ষেত্রে প্রচলিত ছিল, অলিম্পিক তার ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক সময়েও প্রতিবেদকদের অনেকেই এই প্রতিযোগিতা সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করেছেন।”
নিচের বাছাই করা তালিকায় অলিম্পিকের জীর্ণদশা নিয়ে প্রভাবশালী আটটি অনুসন্ধান তুলে ধরেছি। প্রত্যেকটি অনুসন্ধানে সাম্প্রতিক বড় ক্রীড়া আসর নিয়ে অনুসন্ধানে নিয়োজিত সাংবাদিকদের জন্য মূল্যবান দিকনির্দেশনা আছে।
১. “রিংয়ের রাজা” ও “রিংয়ের নতুন রাজা” (১৯৯২, ১৯৯৬)
কিংবদন্তি অনুসন্ধানী সাংবাদিক এন্ড্রু জেনিংসের লেখা-ই সম্ভবত অলিম্পিকের অভ্যন্তরে দুর্নীতি এবং ঘুষ লেনদেনের চূড়ান্ত উন্মোচন। ১৯৯২ সালে তাঁর রচিত বই “দ্য লর্ডস অব দ্য রিংস,” স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেডের সর্বকালের সেরা ১০০ ক্রীড়া বিষয়ক বইয়ের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। জেনিংস, তৎকালীন আর্ন্তজাতিক অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট হুয়ান অ্যান্তোনিও সামারাঞ্চের ফ্যাসিবাদ সমর্থনের অতীত, খেলোয়াড়দের মাদক সেবনের ঘটনা আড়াল করতে গভীর ষড়যন্ত্র এবং বিপণনকারীদের কাছ থেকে ঘুষ ও অনৈতিক অর্থ আদায়কারী কর্মকর্তাদের বিশাল নেটওয়ার্ক তুলে ধরেছেন।
চার বছর পর, রিংয়ের নতুন রাজা শিরোনামে আরেকটি ধারাবাহিক প্রকাশ করেন জেনিংস। এই ধারাবাহিকে আরও বেশ কিছু অবৈধ কাণ্ড উঠে এসেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দক্ষিণ কোরীয় বক্সারদের স্বর্ণপদক দিতে অলিম্পিক কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়ার গোপন প্রয়াস, বার্লিনের কেন্দ্রস্থলে ২০০০ সালের গ্রীষ্মকালীন আসরের আয়োজক নির্ধারণের নিলামকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ দুর্নীতি, এবং গোপন দালাল ও সন্দেহজনক খুনী হিসেবে একজন শীর্ষ আইওসি সহকারীর চমক জাগানিয়া অতীত ছিল।
সম্প্রতি জেনিংস মারা গেছেন। বিশ্বব্যাপী ক্রীড়া অনুসন্ধানী লেখকদের মাঝে তাঁর জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। অপরাধ উন্মোচনে দুর্নীতিগ্রস্ত সংগঠনের ফাঁকফোকর নিখুঁতভাবে তদন্ত করার উপায় জানতে অনুসন্ধানী রিপোর্টারদের জন্য অলিম্পিক নিয়ে তাঁর যুগান্তকারী কাজ পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করে।
২. “রাশিয়ান ইনসাইডার বলেছে, রাষ্ট্র-পরিচালিত ডোপিংয়ের জোরে অলিম্পিকে স্বর্ণপ্রাপ্তির জোয়ার” (২০১৪ – সোচি)
২০১৬ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসের রেবেকা রুইজ ও মাইকেল শোয়ার্টজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, রাশিয়ার রাষ্ট্র-পরিচালিত মাদক কর্মসূচিতে ডজন খানেক খেলোয়াড় জড়িত ছিলেন। রাশিয়ার সোচিতে ২০১৪ সালে আয়োজিত শীতকালীন অলিম্পিকে দেশটির পদক জয়ীর সংখ্যা বাড়াতেই এই কর্মসূচি। এই প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে, সচেতনভাবে আয়োজন করা এই প্রতারণামূলক প্রকল্পের সুবিধাভোগী অন্তত ১৫ জন রুশ পদকজয়ী এবং তাদের কারণে সহপ্রতিযোগীরা ভুক্তভোগী হয়।
ব্যাপক তথ্য যাচাই এবং নথিনির্ভর গবেষণার পরও, একজন প্রতিষ্ঠিত হুইসেলব্লোয়ারের অনুসন্ধানী মূল্যকে জোরের সঙ্গে তুলে ধরেছে এই স্কুপ: এই তথ্য-ফাঁসকারী হলেন রাশিয়ার মাদকবিরোধী ল্যাবের সাবেক পরিচালক। এই কর্মকর্তা স্পাই-মুভির মত খুঁটিনাটি বিবরণসহ কর্মক্ষমতা-বর্ধক নিষিদ্ধ মাদকের নকশা ও বিতরণ ব্যবস্থা ফাঁস করেছেন। এই স্টোরিতে উঠে আসে, দূষিত মূত্র সরিয়ে দিতে রুশ গোয়েন্দা সদস্যরা পরীক্ষাগারের দেয়ালে একটি গোপন ছিদ্র রাখতেন এবং “তাপ-নিরোধী” টেস্টিং বোতলে মূত্রের পরিবর্তে পরিষ্কার নমুনা দিয়ে দিতেন।
২০১৯ সালে, বিশ্ব মাদকবিরোধী এজেন্সির তৈরি করা ফাঁস হওয়া তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছিল টাইমস-ও। এই প্রতিবেদন, মাদক কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিতে রাশিয়ার অভিনব চেষ্টাকে সামনে নিয়ে আসে। এই ঘটনায় দেখা যায়, সেই তথ্য-ফাঁসকারী ব্যক্তি এজেন্সির কাছে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাতে রুশ কর্মকর্তারা সাজানো তথ্য ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এই কেলেঙ্কারিতে আর্ন্তজাতিক ক্রীড়া আসরে রাশিয়ার পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, এবং দেশের নাম চার বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে বিশ্ব মাদক বিরোধী এজেন্সি। তবে যেসব রুশ খেলোয়াড় এই প্রতারণার জড়িত ছিলেন না, তারা গত বছরের গ্রীষ্মকালীন আসরে অংশ নিতে পেরেছেন।
৩. “অলিম্পিক ভেন্যুতে সম্ভাব্য দুর্নীতি নিয়ে ব্রাজিলের অনুসন্ধান” (২০১৬ – রিও)
রিওতে ২০১৬ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক শুরু হওয়ার মাসখানেক আগে থেকে রয়টার্সের অনুসন্ধানী প্রতিবেদক ব্র্যাড ব্রুকস এই আসর নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের চলমান প্রতিটি তদন্ত খতিয়ে দেখেন। তিনি দেখতে পান, প্রতিটি তদন্তে কিছু বিষয় ঘুরে ফিরে আসছে, যা মূলত পদ্ধতিগত দুর্নীতি নির্দেশ করে। ব্রুকস দেখতে পান, এক হাজার আশি কোটি ডলার মূল্যের ভেন্যু প্রস্তুতের জন্য যে পাঁচটি বড় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল, তাদের সবার-ই নাম এসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি থেকে ঘুষ গ্রহণের আরেকটি আলাদা তদন্তে।
সাংবাদিকদের জন্য সম্ভবত সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল- এই গেমস সংক্রান্ত প্রতিটি চুক্তিতে ফেডারেল তদন্তকারীরা সরকারি তহবিল নয়-ছয়ের প্রমাণ পেয়েছেন। যদিও আশা ছিল, সাগরের পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশগত অপরাধ থেকে শুরু করে বন্দর এলাকার সাজসজ্জা ও “ঐতিহ্য রক্ষা” পর্যন্ত – বিভিন্ন রকম প্রকল্প, অলিম্পিক শেষ হওয়ার পরও, বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে লাভবান করবে। এই স্টোরিতে একজন আইনজীবীর উদ্ধৃতি যে কোনো অলিম্পিক আসরে সাংবাদিকদের জন্য দরকারি গাইড হিসেবে বিবেচিত হতে পারে: “কেবল ভৌত কাজের ক্ষেত্রে নয় – সেবা, নিরাপত্তা, সরকারি তহবিল ব্যবহার করা সমস্ত চুক্তির ক্ষেত্রে আমরা এমনটা দেখছি।”
৪. “নিপীড়নের অভিযোগে অভিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জিমন্যাস্টিকস চিকিৎসক” (১৯৯৬, ২০০০, ২০০৮, ২০১২)
২০১৮ সালে অলিম্পিক দলের একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের যৌন নিপীড়নের ঘটনার বিচার প্রসঙ্গে একজন মার্কিন প্রসিকিউটর বলেন: “অবশেষে এই বিচারকার্যের সূচনা ও নিপীড়নের দশক-দীর্ঘ চক্রের ইতি টানে অনুসন্ধানী রিপোর্টিং।” ১০টি যৌন নিপীড়নের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে আত্মসমর্পনের পর সেই বিচারক ডাক্তার ল্যারি নাসারকে ৪০ থেকে ১৭৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। নাসার প্রায় দুই দশক ধরে চারটি অলিম্পিক আসরে মার্কিন নারী-জিমন্যাস্ট দলের চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
অনুসন্ধানটি করেছে, মাঝারি গোছের আঞ্চলিক প্রকাশনা ইন্ডিয়ানাপোলিস স্টারের ছোট্ট একটি দল। তাদের প্রধান অনুসন্ধানী রিপোর্টগুলোকে আদালতে রেফারেন্স হিসেবে পেশ করা হয় – যা পরে সংসদীয় শুনানিতে গড়ায়, ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট নীতিতে পরিবর্তন আনে, সাংবাদিকতার একাধিক পুরস্কার অর্জন করে, এবং এটিকে ঘিরে নেটফ্লিক্সের একটি তথ্যচিত্রও তৈরি হয়।
এই উন্মোচন নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র অনুযায়ী, দলটির সাফল্যের একটি বড় কারণ ছিল, রিপোর্টাররা অভিযুক্তদের কথা “মন দিয়ে শুনেছিলেন,” এবং বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ভয়াবহ নির্যাতনের দাবিকে যথাযথ বিশ্বাসযোগ্যতা ও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছিলেন। দুঃখজনকভাবে, নিগ্রহ সম্পর্কে অবগত করার পরও জিমন্যাস্টিকস দলের কর্মকর্তা, পুলিশ, ও এফবিআই এজেন্টরা বিষয়টিতে ততটা আগ্রহ দেখাননি। এই ভয়াবহ অবজ্ঞার বিষয়টি পরবর্তীতে মার্কিন কংগ্রেসের শুনানিতে তদন্ত করা হয়েছিল। এই অনুসন্ধানের পিছনে ছুটতে গিয়ে অতিরিক্ত সময় ও তহবিলের প্রয়োজন হয়। এই সময় ও অর্থের যোগান দেয়ায় রিপোর্টাররা সম্পাদকদেরও কৃতিত্ব দেন। এর কল্যাণেই, নিছক স্থানীয় স্টোরি থেকে এটি একটি আর্ন্তজাতিক কেলেঙ্কারিতে পরিণত হয়, যার প্রভাব পড়ে অলিম্পিকসহ বড় বড় ক্রীড়া আসরের নিরাপত্তা সংক্রান্ত নীতিমালায়।
৫. “ফ্রান্সে দুর্নীতি তদন্তের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন এক জাপানী ব্যবসায়ী যাঁকে ৮২ লাখ ডলার দেয়া হয়েছিল টোকিওতে অলিম্পিক আয়োজনের পক্ষে লবিং করার জন্য)” (২০২০ – টোকিও)
অলিম্পিক নিলামের অংশ হিসেবে প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের হাত করার কোন কৌশলকে আমরা বৈধ বা নৈতিক বলতে পারি? আর কোন সংযোগের বলে ঐ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তদন্ত আড়াল করতে হয়? রয়টার্সের এই উন্মোচনে, যেসক আর্থিক লেনদেনের নথিপত্র বেরিয়ে আসে, তা একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার নির্বাহীকে কঠিন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ার পক্ষে বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে সাংবাদিকদের জন্য। এই নির্বাহী, টোকিও অলিম্পিক বিড কমিটি থেকে টাকা পেয়েছিলেন। তিনি আর্ন্তজাতিক অলিম্পিক কমিটির একজন সদস্যকে অবৈধ উপায়ে হাত করার কৌশল হিসেবে উপহার দেয়ার কথা স্বীকার করেন। আরেকজন সোর্স জানান, বিডিং পার্টিগুলোতে হরহামেশা “ভালো মানের” ঘড়ি হাতবদল হয় এবং রিপোর্টারদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, উপহার সামগ্রী সংক্রান্ত আইওসির নিয়মে মূল্যমানের ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখা নেই।
অনুসন্ধানী দলটি তখন আইওসি সদস্যদের অতীত ইতিহাস ঘাঁটাঘাটি শুরু করে, এবং পৃথক একটি ফরাসি অনুসন্ধান ও আগের নিলাম দুর্নীতির সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজে পায়।
৬. বিএএলসিও মাদক কেলেঙ্কারি (২০০০ – সিডনি)
জানতে চান, একটি ফুটো হওয়া সিরিঞ্জ এবং ছোট একটি ঔষধ ল্যাব নিয়ে মার্কিন ফেডারেল তদন্ত দলের চোখ এড়িয়ে যাওয়া অভিযান কীভাবে এ যাবৎকালের অন্যতম বড় স্টেরয়েড কেলেঙ্কারিতে রূপ নিল? এই অনুসন্ধানের কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার দুই অনুসন্ধানী রিপোর্টার: সান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকল পত্রিকার মার্ক ফাইনারু-ওয়াদা এবং ল্যান্স উইলিয়ামস। স্টোরিটি ছিল স্থানীয়। এর শুরু, বে এরিয়া ল্যাবরেটরি কো-অপারেটিভে (বিএএলসিও) জব্দ করা ডিজাইনার স্টেরয়েড থেকে। কিন্তু তাঁদের নাছোড়বান্দা রিপোর্টিং, সেখান থেকে একটি বড় মাদক চক্র উন্মোচন করে, যেখানে ক্রীড়াজগতের বেশ কিছু বড় নামের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।
বিশ্বখ্যাত দৌড়বিদ ম্যারিয়ন জোন্সের নামও এই তালিকায় ছিল। এর জন্য দায়ী কর্মক্ষমতা-বর্ধক বিএএলসিও স্টেরয়েড। এই স্টেরয়েড তখনকার প্রচলিত মাদক পরীক্ষায় ধরা পড়ত না। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ২০০০ সালের গ্রীষ্মকালীন আসরে জোন্স তিনটি স্বর্ণপদকসহ পাঁচটি পদক জয় করেন। তিনি শপথ করে বলেছিলেন, অলিম্পিক চলাকালে স্টেরয়েড নেন নি। কিন্তু ফাইনারু-ওয়াদা এবং উইলিয়ামস, বিচারকদের চূড়ান্ত বিবৃতি ও তাঁর প্রাক্তন স্বামীর সাক্ষ্য সংগ্রহ করেন। প্রাক্তন স্বামী সাক্ষ্য দেন, তিনি জোন্সকে – সিডনি অলিম্পিকের আগে, চলাকালীন সময় ও পরবর্তীতে – নিজ পাকস্থলিতে ইনজেকশন নিতে দেখেছেন। সাক্ষ্যপ্রমাণের মুখে জোন্স অবশেষে জনসম্মুখে অপরাধ স্বীকার করেন। পরিণতিতে তাঁর সব অলিম্পিক পদক কেড়ে নেয়া হয় (এছাড়া অন্য কয়েকটি আসরের শিরোপা), খেলাধুলা থেকে দু বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন, এবং ফেডারেল তদন্তকারীদের মিথ্যা বলার অপরাধে পরবর্তীতে তাকে ছয় মাসের জন্য কারাভোগ করতে হয়।
ক্রমেই বাড়তে থাকা বিএএলসিও’র খদ্দেরদের নেটওয়ার্ক ট্র্যাক করে নির্ভুল রিপোর্টিংয়ের কল্যাণে এই প্রতিবেদক যুগল বেশ কিছু আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রতিবেদন করেছেন। পরিশেষে তাঁদের সবগুলো স্টোরি “গেম অব শ্যাডোস” নামের একটি ঢাউস সাইজের অনুসন্ধানী বইয়ে একত্র করেছেন। কীভাবে কয়েকজন নামকরা বাস্কেটবল খেলোয়াড় নিয়মের তোয়াক্কা না করে এবং অবৈধভাবে শারীরিক কারসাজির মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন – তা উন্মোচনের মাধ্যমে তারা সাড়া ফেলে দেন। এই অনুসন্ধান, অপেশাদার ও পেশাদার ক্রীড়াজগতের স্টেরয়েড পরীক্ষা পদ্ধতিতে স্থায়ী পরিবর্তন আনে।
৭. “সল্ট লেক সিটি অলিম্পিক ঘুষ কেলেঙ্কারি” (২০০২ – সল্ট লেক সিটি)
১৯৯৮ সালের নভেম্বরে ইউটাহর কেটিভিএক্স-টিভির রিপোর্টার ক্রিস ভ্যানকার অলিম্পিক ইতিহাসের অন্যতম বড় ঘুষ কেলেঙ্কারি উন্মোচন করেন। তাঁর অনুসন্ধানে উঠে আসে, জয় নিশ্চিত করতে আর্ন্তজাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) ১২ জনের বেশি সদস্যকে দশ লাখ ডলার ঘুষ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সল্ট লেক অলিম্পিক বিড কমিটি। ভ্যানকারের প্রাথমিক স্টোরির কেন্দ্র ছিল ফাঁস হওয়া চিঠি, ও বেশ কিছু সোর্সের সহযোগিতা। পরবর্তীতে তিনি এই সোর্সদের সাহসিকতার প্রশংসা করেন। তাঁর পাওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে বেরিয়ে আসে, অন্যান্য ঘুষকাণ্ডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, একজন আইওসি সদস্যের মেয়ের কলেজ টিউশন ফি সল্ট লেক অলিম্পিক কমিটি পরিশোধ করেছে। পুরস্কারের উদ্ধৃতিপত্রে মর্যাদাপূর্ণ পিবডি অ্যাওয়ার্ডের বিচারকেরা উল্লেখ করেন, “এই অনুসন্ধানের প্রভাব এতই গভীর ছিল যে, আইওসি-কে তাদের নৈতিকতার নীতিমালায় বড় ধরনের সংস্কার করতে হয়েছে।” উদ্ধৃতিতে আরও বলা হয়, ভ্যানকারের অনুসন্ধানটি নেহাত ভাগ্যের জোরে হয়নি, বরং কঠোর পরিশ্রমের ফসল। কারণ, “১৯৯৬ সালে শহরটিতে অলিম্পিক আয়োজনের বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই তিনি বাজেট ইস্যু, জমি কেনাবেচা ও সল্ট লেকের অলিম্পিক বিডে সম্ভাব্য স্বার্থের সংঘাত নিয়ে অনুসন্ধান করে আসছিলেন,” যা তাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ পেতে সাহায্য করেছে।
৮. শতবর্ষী অলিম্পিক পার্কে সন্ত্রাসী বোমা হামলা অনুসন্ধানের ভালো-মন্দ (১৯৯৬ – আটলান্টা)
১৯৯৬ সালে জর্জিয়ার আটলান্টায় অলিম্পিক পার্কে সন্ত্রাসী বোমা হামলার কারণে এই অলিম্পিকের আধুনিক আয়োজনের শতবর্ষ উদযাপন ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই সহিংসতায় একজন নিহত ও শতাধিক আহত হন। রিচার্ড জুয়েল নামের নিরাপত্তা কর্মীর সতর্ক দৃষ্টি না থাকলে এই হামলার পরিণতি আরও ভয়াবহ হতে পারত। এই নিরাপত্তা কর্মী পরিত্যক্ত ব্যাকপ্যাক ও সন্দেহজনক বস্তু পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছিলেন এবং বিস্ফোরণের আগে ঐ এলাকা আংশিকভাবে খালি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কিন্তু দেশজুড়ে নায়কোচিত পরিচয়ের দিন কয়েক পর জুয়েলের জগৎ উল্টে যায়। আটলান্টা জার্নালে তাঁকে এফবিআই এর চলমান তদন্তে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে সনাক্ত করা হয়। পত্রিকায় জুয়েলের নাম উল্লেখ করার সিদ্ধান্ত সেই থেকে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু এবং গণমাধ্যমের নৈতিকতা প্রশ্নে বিষয়টি আলোচিত হয়, কারণ শেষ পর্যন্ত ফেডারেল তদন্তকারীদের উপসংহারে এই হামলার সঙ্গে জুয়েলের কোন সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
তবে এই জার্নাল একই সঙ্গে পুরনো ধাঁচের সাংবাদিকতা কৌশল ব্যবহার করে জুয়েল ও নিজেদের ইমেজ উদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জার্নালের অনুসন্ধানী রিপোর্টার বিল র্যাংকিন প্রত্যক্ষদর্শী ও ফেডারেল সোর্সের বয়ানের ভিত্তিতে ঘটনার দিনের প্রতি মিনিটের সময়রেখা তৈরি করেন। তিনি গ্রাউন্ড জিরো থেকে ফোন বুথ পর্যন্ত পাঁচটি ব্লক হেঁটে যেতে যে সময় লাগে, সেটি হিসাব করে দেখিয়ে দেন, বোমবর্ষণকারী যে ফোন বুথে কল করে সতর্ক করেছিল, সেখানে জুয়েলের পক্ষে শারীরিকভাবে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না।
আরও পড়ুন
রিপোর্টারের গাইড: সংঘবদ্ধ অপরাধীদের অর্থ লেনদেন অনুসন্ধান করবেন যেভাবে
ফিল্মস ফর ট্রান্সপারেন্সির ৫টি দুর্নীতি বিরোধী তথ্যচিত্র
হুইসেলব্লোয়িং: যারা গোপনে জানিয়ে দেন অনিয়মের খবর
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএনের প্রতিবেদক। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমস পত্রিকার সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। বিদেশি প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের ২৪টির বেশি দেশে সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন।