হুমকির মুখে স্বল্প সময়ের মধ্যে সাংবাদিকদের ঘর ছাড়তে হতে পারে। সংঘাত কখনো কখনো আগে থেকে আঁচ করা যায়, আর তাই যারা ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে থাকেন, তাদের দেশ ত্যাগের পথ প্রস্তুত রাখতে হয়, সেই সঙ্গে প্রস্তুত রাখতে হয় জরুরি কাগজপত্র। এই কাগজগুলো শুধু যে তাদের পথেঘাটেই কাজে লাগবে – তা নয়, বরং প্রয়োজনে নিরাপদ অঞ্চল বা দেশ ভ্রমণেও সহায়ক হতে পারে। কোন কাগজপত্র সংগ্রহে রাখা জরুরি আর দেশ ত্যাগে কোন সংগঠনগুলো সাংবাদিকদের সহায়তা দেয়, তার একটি তালিকা নিচে দেওয়া হলো:
যে কাগজগুলো তৈরি রাখবেন
১. নিম্নোক্ত কাগজপত্রের মূল বা হার্ড কপি সঙ্গে রাখবেন।
২. সব কিছুর ছবি তুলুন এবং আপনার বিশ্বস্ত এনক্রিপ্টেড (অনধিকার ব্যবহার ঠেকাতে নিরাপত্তা কোডবিশিষ্ট) ক্লাউড সেবা (যেমন; ড্রপবক্স, সিঙ্ক ডট কম) অথবা দ্বিতীয় কোন ডিভাইসে সব কিছু সংরক্ষণ করবেন – পাছে আপনার স্মার্টফোন হারিয়ে যায়। এমনকি দেশের বাইরে অবস্থানরত আপনার পরিবার বা বন্ধুদের কাছেও সেগুলো পাঠাতে পারেন।
- পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স।
- মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ খেয়াল করুন। যদি এমন হয়, কিছুদিনের মধ্যে মেয়াদ শেষ হবে, সম্ভব হলে দেরি না করে নবায়ন করুন।
- আপনার যদি বেশ কয়েকটি সনাক্তকরণ কাগজ থাকে, সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় রাখুন – পাছে কোনো একটি হারিয়ে যায়।
- জন্ম নিবন্ধন (অথবা কোন অফিসিয়াল কাগজ, যা আপনার জন্মস্থান ও তারিখের প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে)।
- অন্যান্য: বিবাহ সনদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ (ডিপ্লোমা, স্নাতক পাশ ও ভর্তি, ফলাফলের প্রমাণপত্র), গণমাধ্যমে কাজ করার পরিচয়পত্র, পেশাগত সনদ, টিকা সনদ।
নিম্নোক্ত তথ্যগুলো একটি ডকুমেন্টে ইংরেজিতে লিপিবিদ্ধ করে একটি ক্লাউড সেবা, এবং যে কোন প্রয়োজনে কপি-পেস্ট করে অন্যকে পাঠানো যায়, এমনভাবে আপনার স্মার্টফোনে সংরক্ষণ করুন:
- সম্পূর্ণ বৈধ নাম, ঠিকানা, এবং জন্মতারিখ।
- পাসপোর্ট নাম্বার, সেই সঙ্গে ইস্যু নাম্বার ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ।
- বর্তমান ঠিকানা – যদিও অনলাইনে মেসেজ আদানপ্রদানে সতর্ক থাকুন।
- ইমেইল ঠিকানা।
- ফোন নাম্বার এবং অন্যথায় আপনার হোয়াটসঅ্যাপ ও সিগনাল নাম্বার।
- কর্মক্ষেত্রের ঠিকানা/ স্থানীয় ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরির প্রমাণপত্র।
যদি আপনার বিশ্বস্ত কোন বন্ধু বা পরিচিত কেউ দেশের বাইরে অবস্থান করেন, ডকুমেন্ট ও তথ্যগুলোর নিরাপত্তার স্বার্থে এগুলোর ডিজিটাল কপি তাঁদের পাঠানোর ব্যাপারে ভাবতে পারেন।
ব্যক্তিগত কাগজপত্র
- ছবি এবং যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন ও সংরক্ষণ করতে চান, এমন সব কিছুর ডিজিটাল কপি তৈরি করুন।
- বিশ্বস্ত ক্লাউড সেবায় সব কিছু সংরক্ষণ করুন।
প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ
- নিরাপদ কোনো দেশের ভ্রমণ ভিসার জন্য আবেদন করুন – যদি আপনার সহজ ও অস্থায়ী উপায়ের প্রয়োজন হয়।
- আপনি আগে কাজ করেছেন (বার্তাকক্ষ, যে অনলাইন সাময়িকীর জন্য আপনি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা করেছেন, যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আপনি কাজ করেছেন বা পরামর্শ দিয়েছেন), এমন আর্ন্তজাতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
- আপনার কাজের প্রমাণপত্র বা রেকর্ড ইংরেজি ভাষায় দিতে বলুন (যেমন; প্রধান সম্পাদকের স্বাক্ষরিত ডকুমেন্ট বা মানব সম্পদ বিভাগ প্রতিনিধি দ্বারা আপনার কর্মসম্পাদন এবং চাকরি বা ফ্রিল্যান্স কাজের সত্যায়ন)।
- জাতীয় সরকার পর্যায়ে তাদের কোনো যোগযোগ আছে কি না এবং আপনি ঐ দেশে আশ্রয়প্রার্থী মর্যাদার আবেদন করলে তারা সমর্থন করতে পারবে কি না, জানতে চান।
- সহায়ক ইলেক্ট্রনিক ডকুমেন্ট ইংরেজি ভাষায় দিতে বলুন এবং ঘটনা জানাজানি হলে সহায়তার প্রয়োজনে সংগঠন থেকে একজন কন্টাক্ট পার্সনের চাহিদা জানান।
- আপনার সদস্যপদ আছে, এমন আর্ন্তজাতিক পেশাদার সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করুন এবং আপনাকে সমর্থন করে তাদের চিঠি ও প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আপনার সংশ্লিষ্টতা বা সদস্যপদের প্রমাণপত্র ইংরেজিতে দিতে বলুন।
- অন্য দেশে নিরাপদ আশ্রয় ও আশ্রয়প্রার্থী মর্যাদা প্রাপ্তির উপায় খুঁজুন। এই প্রক্রিয়ার শুরুটা হোক যেখানে আপনার নিকটাত্মীয় (মা-বাবা, দাদা-দাদি, ভাইবোন, সহধর্মী, ছেলেমেয়ে) বাস করেন, সেখান থেকে।
- কোথায় থেকে শুরু করবেন– তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত থাকলে, যে দেশ নিয়ে আপনি আগ্রহী, এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে সে দেশের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন;
- এছাড়াও শরণার্থী সহায়ক সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। তারা আপনাকে অন্য দেশে আশ্রয়প্রার্থী হওয়ার আইনি কাঠামো বুঝতে সহায়তা করতে পারে।
ডিজিটাল ও শারীরিক নিরাপত্তায় করণীয়
- অপরিহার্য বিষয়গুলো জানতে এবং এ বিষয়ে সহায়তা করা সংগঠনের সন্ধান পেতে জিআইজেএনের ডিজিটাল নিরাপত্তা টিপশিট দেখুন ।
- জিআইজেএন জার্নালিজম সিকিউরিটি অ্যাসেসমেন্ট টুল ব্যবহার করুন।
- জিআইজেএনের এনক্রিপ্টেড অ্যাপস অ্যান্ড প্রোগ্রামস ফর জার্নালিস্টস।
- শারীরিক ও ডিজিটাল নিরাপত্তার পাশাপাশি আইনি সহায়তা প্রাপ্তির বিষয়ে বিশদ পরামর্শ দেয় কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)।
যে সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন
কাজের জন্য বিপদে পড়া সাংবাদিকদের জরুরি সহায়তা দেয়- এমন সংগঠনগুলোর তালিকা নিচে দেওয়া হলো:
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) “সম্মুখসারির সাংবাদিকদের সহায়তা দেয়, এবং আহত, কারারুদ্ধ, অথবা কাজের জন্য দেশ ত্যাগে বাধ্য সাংবাদিকদের সহায়তায় দ্রুত সাড়া দেয়।” তাদের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগের উপায় হলো ই-মেইল (emergencies@cpj.org)।
কানাডিয়ান জার্নালিস্টস ফর ফ্রি এক্সপ্রেশন (সিজেএফই) নিম্নোক্ত শর্তে আর্থিক সহায়তা দেয়:
- “আবেদনকারীকে অবশ্যই সাংবাদিক হতে হবে, যে কোন আইফেএক্স সদস্য বা জরুরি সহায়তা দেয় এমন কোন সংগঠন দ্বারা যাচাইকৃত হতে হবে।
- সাধারণত অনুদানকৃত অর্থের পরিমাণ ৫০০ থেকে ১৫০০ কানাডিয়ান ডলার (৪০০ থেকে ১২০০ মার্কিন ডলার) হয়ে থাকে।
- সাংবাদিকেরা সিজেএফই থেকে সর্বোচ্চ দুটি আলাদা অনুদান পেতে পারেন।
- সিজেএফই শুধুমাত্র ইংরেজি আবেদন গ্রহণ করে।”
সিজেএফই-এর আর্থিক সহায়তার মধ্যে অবরুদ্ধ সাংবাদিকদের জন্য আইনি ব্যয়, মেডিকেল ব্যয়, নিরাপদ স্থানে যাওয়ার পরিবহন খরচ, এবং নিরাপদ দেশে পুর্নবাসন খরচ অর্ন্তভুক্ত।
ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড (এফপিইউ) কর্মক্ষম নয়, এমন সাংবাদিকদের স্বল্পমেয়াদী সহায়তা, অথবা অনিরাপদ বা ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে সাময়িকভাবে উদ্ধারের খরচ দিতে পারে। আপনি এখানে আবেদন করতে পারেন। এফপিইউ’র সাইট অনুসারে আবশ্যক শর্তগুলো:
- “আপনি একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বা একটি গণমাধ্যমে কর্মরত পেশাজীবী;
- আপনার জরুরি পরিস্থিতি একজন গণমাধ্যম পেশাজীবী হিসেবে আপনার কাজের প্রত্যক্ষ ফলাফল;
- আপনি একমত হবেন যে, এই সহায়তা নিয়মিত নয়, বরং একটি ঘটনাসাপেক্ষে (এককালীন) দেয়া হয়;
- আপনি একমত হবেন যে, এই সহায়তার লক্ষ্য হলো যত দ্রুত সম্ভব আপনি যেন কাজে ফিরতে পারেন;
- আপনার উদ্ভুত পরিস্থিতি আপনি নিজে ছাড়া অন্তত দুটি বিশ্বস্ত সূত্র দ্বারা নিশ্চিত করা যেতে পারে।”
ফ্রিডম হাউস একটি জরুরি সহায়তা কর্মসূচি পরিচালনা করে। আবেদন জমা দেওয়ার ব্যাপারে খোঁজ নিতে তাদের সঙ্গে ইমেইলে (info@csolifeline.org) যোগযোগ করুন।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস (আইএফজে) এর একটি নিরাপত্তা তহবিল আছে। এই তহবিলের জন্য আপনি এখানে আবেদন করতে পারেন।
ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া সাপোর্ট (আইএমএস) এর একটি নিরাপত্তা প্যাকেজ আছে, যার মধ্যে “২৪/৭ হটলাইন, নিরাপদ বাসস্থান, নিরাপত্তা তহবিল, নিরাপত্তা সামগ্রী, আইনি সহায়তা, জরুরি সহায়তা,” এবং আরও অনেক কিছু অর্ন্তভুক্ত।
ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স মিডিয়া ফাউন্ডেশনের (আইডব্লিউএমএফ) একটি জরুরি তহবিল আছে, যা মানসিক ও স্বাস্থ্যগত সেবা, সাময়িক স্থানান্তর সহায়তা (তিন মাস), এবং আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে। তহবিলের জন্য আপনি এখানে আবেদন করতে পারেন। আপনাকে অবশ্যই এই শর্তগুলো পূরণ করতে হবে।
জর্নালিস্টেন হেইফেন জর্নালিস্টেন (সাংবাদিকদের সাহায্যে সাংবাদিকেরা)। স্থানান্তর প্রক্রিয়ার আবেদন করতে জার্মানভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তাদের ইমেইল করুন এই ঠিকানায় (jhjgermany@t-online.de)।
রিপোর্টারস্ উইদাউট বর্ডারস্ (আরএসএফ) বিপদগ্রস্ত সাংবাদিকদের সহায়তার জন্য জন্য আবেদন করতে বলে assistance2@rsf.org ঠিকানায় বা +33 1 4483 8466 নাম্বারে।
- নির্বাসিত সাংবাদিকদের জন্য আরএসএফের গাইডে ইউএনএইচসিআর, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ এবং আশ্রয়প্রার্থী হওয়ার প্রক্রিয়া দেয়া আছে।
- আপডেটের জন্য আরএসএফ রাশিয়ার টুইটার ফিড অনুসরণ করুন।
- আরএসএফের জার্মান শাখার রিপোর্টার ওনে গ্রেনজেন স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় আবেদনের জন্য সহায়তা করে থাকেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করুন kontakt@reporter-ohne-grenzen.de ঠিকানায়।
আর্ন্তজাতিক ফেলোশিপ
পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত যে সাংবাদিকদের দেশ ত্যাগ করতে হয়, তাঁরা সময় হলে এই আর্ন্তজাতিক ফেলোশিপগুলোর একটিতে আবেদন করতে পারেন, যা কখনো কখনো ভিসা প্রক্রিয়ায় সহায়তা দিয়ে থাকে এবং ভাতা ও আবাসনের ব্যবস্থা করে থাকে।