অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা আর বার্বিদের জগত, সচরাচর এক সুতোয় মেলে না। কিন্তু আমেরিকার সুবিশাল খেলনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাটেল সর্বশেষ যে পুতুলটি বাজারে ছেড়েছে, সেটি খোদ আইডা বি. ওয়েলসের, যাকে কিনা নিউইয়র্ক টাইমস “দেশটির অন্যতম প্রভাবশালী সাংবাদিক” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ওয়েলসের জন্ম ১৮৬২ সালে, একটি দাস পরিবারে। দাসপ্রথা বিলোপের পরবর্তী বছরগুলোতে, আমেরিকার দক্ষিণে আফ্রিকান-আমেরিকান লিঞ্চিংয়ের (বিচার ছাড়া ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা) ঘটনাগুলোকে লিপিবদ্ধ করার প্রাণান্ত চেষ্টা, তাঁকে বৈশ্বিক সম্মান এনে দেয়।
রিপোর্টার হওয়ার আগে, ওয়েলস তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষক হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি মেমফিস ফ্রি স্পিচ পত্রিকার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পুতুলটির হাতেও এই পত্রিকার প্রতিকৃতি দেখা যায়।
বার্বি পুতুল এক সময় পরিচিত ছিল সোনালী চুল, নীল চোখ, আর উরু-গোড়ালি-কোমরের অসামঞ্জস্যপূর্ণ অনুপাতের জন্য। তবে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাটেল, ওয়েলসের এই পুতুল এনেছে “অনুপ্রেরণাদায়ী নারী” সিরিজের সর্বশেষ সংযোজন হিসেবে। এই সিরিজে আরও আছেন মায়া অ্যাঞ্জেলু, শিল্পী ফ্রিদা কাহলো, নাগরিক অধিকার কর্মী রোজা পার্কস, জাজ সঙ্গীতশিল্পী এলা ফিটজেরাল্ড এবং সেবিকা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।
নির্মাতারা সিরিজটি সেই “সাহসী নারীদের নিবেদন করেছেন, যাঁরা ঝুঁকি নিয়েছেন এবং কয়েক প্রজন্মের মেয়েদের, বড় থেকে আরও বড়, স্বপ্ন দেখার পথ করে দিয়েছেন।”
ম্যাটেলই একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়, যারা মৃত্যুর পর ওয়েলসকে এভাবে সম্মান জানিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস্ পত্রিকার ওভারলুকড সিরিজে জায়গা পাওয়া প্রথম শোকবার্তাগুলোর একটি ছিল তাঁকে নিয়ে। মৃত্যু-সংবাদের সংগ্রহশালায় শেতাঙ্গদের আধিপত্যে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করা হয়েছিল এই সিরিজে। (পত্রিকাটি বলেছে, ওয়েলস “আধুনিক সাংবাদিকতার কেন্দ্রীয় নীতি হিসেবে বিবেচিত রিপোর্টিং কৌশল প্রণয়নে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছেন।”)
২০২০ সালে পুলিৎজার প্রাইজও তাঁকে বিশেষ মরণোত্তর সম্মানে ভূষিত করে, “লিঞ্চিংয়ের যুগে আফ্রিকান-আমেরিকানদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর ও বিদ্বেষপূর্ণ সহিংসতা নিয়ে তাঁর অসাধারণ ও সাহসী রিপোর্টিংয়ের” জন্য।
সহকর্মী সাংবাদিকেরা ওয়েলসকে আফ্রিকান আমেরিকান অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সন্ততুল্য অভিভাবক হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি লিখেছিলেন, “ভুলকে ঠিক করার পথ হলো তাদের ওপর সত্যের আলো ফেলা।”
১৮৯২ সালে টেনেসির মেমফিসে খুব কাছের এক বন্ধু হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর লিঞ্চিং নিয়ে অনুসন্ধানে নামেন তিনি। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার, পরিবারের সাক্ষ্য, পরিসংখ্যান ও ছবি সংগ্রহের জন্য কয়েক মাস ধরে ঘুরে বেঁড়ান দক্ষিণাঞ্চলে।
রিপোর্টে তাঁকে দেখা যাবে, খবরের সন্ধানে মেমফিসের বাইরে ছুটে বেড়াতে। কিন্তু একই সঙ্গে আমেরিকার দক্ষিণে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের উপর সহিংস আক্রমণ নিয়ে চার দশকব্যাপী অনুসন্ধানের সূত্রপাতও ছিল এটি। তাঁর অনুসন্ধান বেরোয় সম্পাদকীয় ধারাবহিকে, যা পরবর্তীতে “সাউদার্ন হররস” ও “আ রেড হরর” নামের দুটি বইয়ে প্রকাশিত হয়।
২০২০ সালে প্রকাশিত এই প্রোফাইলে পয়েন্টার ইনস্টিটিউটের বারবারা অ্যালেন লিখেছেন, “একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীর জন্যে মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করা কাজ ছিল এটি, যিনি মাসের পর মাস দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোতে চষে বেড়িয়েছেন, আর নথিপত্র, গবেষণা ও ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের লিঞ্চিং অনুসন্ধান করেছেন — যে প্রক্রিয়া আধুনিক অনুসন্ধানী কৌশলের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল।”
ওয়েলসকে নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের শোকগাঁথায় লেখা হয়: “তাঁর লক্ষ্য ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের স্বার্থেই কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে লেখা, এবং এমনভাবে, যা তাঁর মতো শেতাঙ্গদের অধীনে জন্ম নেওয়া এবং রুখে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় দিন গোনা মানুষের কাছে সহজবোধ্য।”
তিনি নারীদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব কালারড উইমেন্স ক্লাব ও ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব কালারড পিপলের (এনএএসিপি) সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯৩১ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
চেহারার সাদৃশ্য নিশ্চিত করতে ওয়েলসের প্রপৌত্রী, লেখিকা ও ইতিহাসবিদ মিশেল ডাস্টার, বার্বি দলটির সঙ্গে কাজ করেন। তিনি বলেন, ওয়েলস “একজন অগ্রপথিক, যিনি সাহসের সঙ্গে নিজের বিশ্বাসে অটল ছিলেন এবং নাগরিক অধিকার ও নারীর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রথাগত অচলাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।”
লরা ডিক্সন জিআইজেএনের সহযোগী সম্পাদক ও যুক্তরাজ্যের ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি কলম্বিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো থেকে রিপোর্ট করেছেন এবং তাঁর কাজ এ পর্যন্ত দ্য টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও আটলান্টিকসহ অনেক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স মিডিয়া ফাউন্ডেশন এবং পুলিৎজার সেন্টার অন ক্রাইসিস রিপোর্টিং থেকে রিপোর্টিং ফেলোশিপ পেয়েছেন।