বছরখানেক আগেও ভারতকে প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি মনে করা হত, যেখানে গণমাধ্যম স্বাধীন ও শক্তিশালী এবং প্রবৃদ্ধি হার ক্রমাগত ঊর্ধ্বমূখী। কিন্তু আগ্রাসী হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং তার ধ্বজাধারী ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা নরেন্দ্র মোদির বদৌলতে ভারতে আধুনিক গণতন্ত্রের সবগুলো সূচক এখন নিম্নমুখী। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অযৌক্তিক অভিযোগে মামলা হয় এবং তাদের “দেশ বিরোধী” বলেও অভিহিত করা হয়। রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় কুশীলবদের হাতে মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যম কর্মীদের অনলাইন ও আইনী হেনস্তা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশিরভাগ সংবাদ চ্যানেল ক্ষমতাসীন দলের অপপ্রচারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলো যখন নীরবে সরকারি ভাষ্যের ধ্বজা ধরে ছিল, তখন গুটি কয়েক নতুন ডিজিটাল মাধ্যম সেখানে “স্বাধীন ও মুক্ত সাংবাদিকতায়” নেতৃত্ব দিয়ে গেছে। এই রিপোর্টাররা কেবল আদালতে আইনী হেনস্তার বিরুদ্ধে লড়েন নি, ক্ষমতাসীন অভিজাত গোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট ট্রল বাহিনীর নেটওয়ার্কও উন্মোচন করেছেন। গত বছর এই নির্ভীক অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা, বিশেষত ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্রের সাংবাদিকেরা, বেশ কিছু সাড়াজাগানো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন এবং অন্যান্য গণমাধ্যমকে তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করাতে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। – দীপক তিওয়ারি, জিআইজেএন হিন্দি সম্পাদক
নজরবন্দীত্বের দেশ: প্রত্যেক ভারতীয়কে নজরদারিতে আনতে মোদির পরিকল্পনার গভীরে
অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, রিপোর্টারস্ কালেক্টিভ পরিচালনা করেন একদল মহতী ও সমমনা অনুসন্ধানী রিপোর্টার। তাঁদেরই একজন কুমার সম্ভব। সমাজকল্যাণ কর্মসূচি দেখভালের অজুহাতে বিশাল এক ডেটাবেসের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের নজারদারি করতে ভারতীয় সরকারের এক অরওয়েলিয় (দমনমূলক) পরিকল্পনা উন্মোচন করেন তিনি। এই অনুসন্ধানে তিনি ব্যবহার করেন তথ্য অধিকার আইনে পাওয়া নথি। সম্ভবের এই উন্মোচন তুলে ধরে, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত ভারতীয়দের নজরে রাখতে প্রধানমন্ত্রী মোদির আগ্রাসী নজরদারি পরিকল্পনা কীভাবে সাজানো হয়েছে, যেন (তাঁর ভাষায়) “আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সংযুক্ত, রেকর্ড এবং পর্যবেক্ষণ করা যায়।”
সামাজিক মাধ্যম যাচাই করে অনুসন্ধান
চারটি ভাষায় প্রকাশিত ভারতের শীর্ষ অলাভজনক গণমাধ্যম দ্য অয়্যার, মুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সাংবাদিকতায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সিদ্ধার্থ ভারাদরাজনসহ প্রতিষ্ঠানটির রিপোর্টাররা প্রায়ই মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাসহ সরকারি হেনস্তার শিকার হন। পেগাসাস প্রজেক্টে দেখা গেছে, গণমাধ্যমটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক সাংবাদিককেও নজরদারির লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে।
অয়্যারের রিপোর্টার আলিশান জাফরি, শেহলাত মাকনুন ওয়ানি, ও ভারাদরাজন নিজে, সামাজিক মাধ্যম অ্যাকাউন্ট থেকে সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করে, মাসের পর মাস ধরে, দিল্লীর দাঙ্গা অনুসন্ধান করেন। এই দাঙ্গায় ৫৩ জন নিহত হন এবং শত শত বাড়ি ও দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দিল্লী পুলিশ যখন যথাযথ তদন্ত সম্পাদনে ব্যর্থ, তখন এই রিপোর্টাররা উদঘাটন করেন, এই দাঙ্গার ভুক্তভোগী মূলত সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়। ঘৃণার বিস্তার, উচ্ছৃঙ্খলতা এবং সহিংসতা উস্কে দিতে যারা মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে তাদের মুখোশও উন্মোচন করেছে এই অনুসন্ধান।
স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করে এনডিটিভির ভারতীয় এলাকায় চীনা অনুপ্রবেশের সত্যতা যাচাই
ভারত ও চীনের মধ্যে ২০০০ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, যা কয়েক দশক ধরে দুই দেশের মধ্যে বিবাদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সীমান্ত নিয়ে দেশ দুটি ১৯৬২ সালে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং গত বছরও সংঘর্ষে অনেক সৈন্য প্রাণ হারান।
মোদির গোঁড়া-জাতীয়তাবাদী সরকার, ভারতীয় ভূখণ্ডে চীনা অনুপ্রবেশের ঘটনা বারবার অস্বীকার করে আসছিল। তবে দেশটির শীর্ষ সংবাদ চ্যানেল এনডিটিভি স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করে এই দাবীকে মিথ্যা প্রমাণ করে। একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদনে ভারতের অরুণাচল প্রদেশের অভ্যন্তরে চীন নির্মিত ছিটমহলের অস্তিত্ব তুলে ধরে সংবাদ চ্যানেলটি। তাদের এই রিপোর্ট পরবর্তীতে আরও নিশ্চিত হয় মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের রিপোর্টে।
ভারতে পেগাসাস প্রজেক্টের প্রভাব
পেগাসাস প্রজেক্ট অনুসন্ধানে দ্য অয়্যারের ভূমিকা ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে বিরোধী দলীয় নেতা ও অন্যদের গোপনীয়তা লঙ্ঘন ও নজরদারির বিষয়টি মোদি সরকার অস্বীকার করলেও এই অনুসন্ধানের জের ধরে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বিষয়টি নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে।
দ্য অয়্যারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইজরায়েলি প্রযুক্তি কোম্পানি এনএসও গ্রুপের কাছে মন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, বিজ্ঞানী, মানবাধিকার কর্মী ও অন্যান্যদের ব্যবহার করা ৩০০টি ভেরিফায়েড ভারতীয় মোবাইল নাম্বারের তালিকা দেওয়া হয়। তাদেরকে নজরদারির লক্ষ্যবস্তু বলে মনে করা হয়। রিপোর্ট অনুসারে, ফোন নাম্বারগুলোর ছোট একটি নমুনার ফরেনসিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, “পেগাসাস স্পাইওয়্যারের নিশ্চিত লক্ষ্যবস্তু হওয়া ৩৭টি ফোনের ১০টিই ছিল ভারতীয় নাগরিকদের।”
হিন্দু আইটি সেলের গভীরে
নিউজলন্ড্রিতে প্রকাশিত রিপোর্টারস্ কালেক্টিভের সৃষ্টি জাসওয়াল ও শ্রীগিরিশ জালিহালের করা এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী ট্রলের একটি চক্রকে উন্মোচন করেছে। যারাই “হিন্দু-বিরোধী” মন্তব্য করেছে বলে চক্রটি মনে করত, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে তাদের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাত। নেটওয়ার্কটির কাজের ধরন হলো, “হিন্দু বিদ্বেষী” বলে মনে হওয়া সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের “উচিত শিক্ষা” দিতে, তাদের বিরুদ্ধে আইনী অভিযোগ দায়ের এবং পুলিশি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সদস্যদের প্ররোচিত করা। অনলাইন হেনস্তা চালিয়ে যেতে, একদল আইনজীবী ও “সাইবার স্বেচ্ছাসেবী” তাদের সঙ্গে কাজ করত।
বেসরকারি খাতের স্বার্থে ভারতের কৃষি-অর্থনীতির পুনর্গঠন
ভারতের সংসদে পাস হওয়া (সদ্য বাতিল) কৃষি আইন এবং মোদির ঘনিষ্ঠ দুই শিল্প প্রতিষ্ঠান – এই তিনের মধ্যে যোগসূত্র উন্মোচন করেছে ক্যারাভান সাময়িকীর প্রখ্যাত অনুসন্ধানী রিপোর্টার হারতোশ সিং বালের অনুসন্ধানটি। এই সাহসী রিপোর্ট প্রকাশিত হয় গত ফেব্রুয়ারির এমন এক সময়ে যখন নতুন বাজারবান্ধব সরকারি আইনটির বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রতিবাদের কারণে দেশজুড়ে বড় ধরনের বিক্ষোভ চলছে।
ভারতের এক কারাগারে তৃতীয় লিঙ্গের বন্দীদের জীবন যেমন
পুলিৎজার সেন্টার অন ক্রাইসিস রিপোর্টিংয়ের সহযোগিতায় এবং “বার্ড – দ্য প্রিজন প্রজেক্ট” ধারাবাহিকের অংশ হিসেবে ভারতের কারাগারে তৃতীয় লিঙ্গের বন্দীদের জীবন নিয়ে দুর্দান্ত এই প্রতিবেদন লিখেছেন রিপোর্টার সুকন্যা শান্তা। ভারতীয় আইনী ব্যবস্থায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিজেদের পছন্দমত লিঙ্গ-পরিচয় ধারণ, এবং সেই অনুযায়ী স্বীকৃতি ও আচরণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু এই উদঘাটনে কারাগারে পদ্ধতিগতভাবে লিঙ্গ নির্ধারণে ভুল করা, হেনস্তা, এবং যৌন সহিংসতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন রিপোর্টার।
ভারতের সরকারি কোভিড-১৯ পরিসংখ্যানের তথ্য যাচাই
নিউজলন্ড্রির দুই সাংবাদিক – চিন্তন প্যাটেল ও ভিভেক কল – ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার প্রকাশিত করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত ডেটা বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান করেন। সরকারি ডেটায় তাঁরা অনেক অস্পষ্টতা ও অসঙ্গতি খুঁজে পান এবং উপসংহারে তুলে ধরেন, মোদী সরকার মৃতের সংখ্যা গোপন করতে সরকারি পরিসংখ্যানে হেরফের করে এবং কমিয়ে দেখায়।
কোভিড-১৯ ব্রেকথ্রু ইনফেকশনের সত্য উন্মোচন
টিকা নেয়ার পর প্রতি ১০ হাজার জনে মাত্র দুই থেকে চারজন পরবর্তীতে আক্রান্ত (যা ব্রেকথ্রু ইনফেকশন নামে পরিচিত) হয়েছে বলে ভারত সরকারের মিথ্যা দাবি উন্মোচিত হয় জিআইজেএন সদস্য ইন্ডিয়াস্পেন্ডের এই ডেটা অনুসন্ধানে। এখানে রিপোর্টার রুকমিনি এস দেখিয়েছেন, স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা কীভাবে ভারতে তৈরি দুই টিকা কোভিশিল্ড ও কোভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা নিরূপণে ব্যর্থ হয়েছেন এবং জনসাধারণের সামনে টিকা দুটির কার্যকারিতা সম্পর্কে ত্রুটিপূর্ণ চিত্র উপস্থাপন করেছেন।
মোদি সরকারের ব্যর্থতা যেভাবে ভারতে কোভিড-১৯ দুর্যোগের কারণ হল
ক্যারাভানের এই প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে, মহামারি মোকাবিলায় ভারত সরকারের সাড়া নিয়ে গভীর অনুসন্ধান করেছেন রিপোর্টার চাহাত রানা। তাঁর দীর্ঘ অনুসন্ধানে উঠে আসে, কীভাবে মোদি দেশে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে পরিস্থিতিকে বড় ধরনের দুযোর্গের দিকে ঠেলে দেন, এবং যার ফলে হাসপাতালের বাইরে অক্সিজেনের অভাবে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুন
ভারতে মহামারিতে মৃত্যুর সত্যিকারের চিত্র যেভাবে উন্মোচন করেছেন স্থানীয় সাংবাদিকেরা
নারী সাংবাদিকদের ভাষ্যে ভারতের কোভিড-১৯ মহামারির গল্প
বিজ্ঞাপন যেভাবে মিডিয়া দখলের অস্ত্র হলো ভারতে
দীপক তিওয়ারি জিআইজেএনের হিন্দি সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ ভারতীয় সাংবাদিক, এবং ভুপালের মাখনলাল চতুর্বেদী ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশনের উপাচার্য। ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি রিপোর্টার, সহ-সম্পাদক, টেলিভিশন ধারাভাষ্যকার, গণমাধ্যম পরামর্শক, ও একটি উঠতি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন এবং দুটি বই লিখেছেন।