দাসপ্রথা নিছক অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো বিষয় নয়। জাতিসঙ্ঘ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় চার কোটি নারী, পুরুষ ও শিশু আধুনিক দাসত্বের শিকার হন। দাসত্ব, জোরপূর্বক শ্রম ও মানব পাচার এখন শুধু চর্চাই হচ্ছে না, এটি খুব লাভজনক অপরাধও বটে। আর সাংবাদিকদের অনুসন্ধানের জন্যও এটি একটি গুরুতর বিষয়।
দ্বাদশ গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে (#জিআইজেসি) “মানব পাচার ও জোরপূর্বক শ্রম” শিরোনামে একটি সেশন পরিচালনা করেছেন দুইবারের পুলিৎজারজয়ী মার্থা মেনডোজা। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এই সাংবাদিকের রিপোর্টিংয়ের কারণে দাস হয়ে থাকা ২,০০০ জেলে মুক্ত হয়েছিলেন।
সেশনটিতে তিনি কথা বলেছেন আরও দুই পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক এবং একজন সম্পাদকের সঙ্গে, যারা জোরপূর্বক শ্রম নিয়ে সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞ। তারা পরামর্শ দিয়েছেন, এধরনের প্রতিবেদন পিচ ও রিপোর্ট করার উপায় নিয়ে। আর একজন, আগ্রহী সাংবাদিকদের জন্য একটি টুলকিট শেয়ার করেছেন।
২০১৬ সালে মেনডোজার সঙ্গে যৌথভাবে পুলিৎজার জেতেন এপির দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ভিত্তিক সাংবাদিক, রবিন ম্যাকডোয়েল। তিনি কথা বলেন মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার পাম তেল শিল্পে জোরপূর্বক শ্রম নিয়ে তাঁর অনুসন্ধান সম্পর্কে, যেখানে মার্গি ম্যাসনের সঙ্গে মিলে তিনি বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। সিরিজটি এবছর পুলিৎজার পুরস্কারের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিভাগে চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছিল। বৈশ্বিকভাবে, পাম তেল উৎপাদন একটি শতকোটি ডলারের শিল্প, যার সরবরাহ চেইন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ব্র্যান্ডের ডিওড্রেন্ট, টুথপেস্ট, কসমেটিকস থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাত খাবার পর্যন্ত বিস্তৃত।
ম্যাকডোয়েলের সঙ্গে কাজ করা রিপোর্টিং দলটি ২৪টি পাম অয়েল কোম্পানির ১৩০ জনেরও বেশি শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নেয়। এদের অনেকেই বলেছিলেন তারা দুর্ব্যবহার, প্রতারণা ও হুমকির শিকার হয়েছেন, বিপুল দেনা শোধের জন্য তাদের জোর করে কাজ করানো হয়েছে, এবং তাদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটকে রাখা হয়েছে। নারী শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন যে, তারা ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
ম্যাকডোয়েল শ্রোতাদের বলেন, পাম ফলের ভার এবং সেগুলো তোলার জন্য বারবার নিচের দিকে ঝোঁকার ফলে নারীদের শরীরে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে কাজের চাপ এত বেশি যে, শ্রমিকরা শিশুসহ পুরো পরিবারকেই পাম বাগানে কাজ করতে নিয়ে আসতেন।
খুব কম ভোক্তাই হয়তো সত্যি সত্যি উপলব্ধি করে যে তাদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষার পণ্যগুলো এ ধরনের জোরপূর্বক শ্রমের ফসল, বলেন ম্যাকডোয়েল। “মানুষ সত্যিই বিন্দুগুলো মিলিয়ে দেখে না যে কী ঘটে চলেছে, কেন এমনটি ঘটছে, পণ্যগুলো কোথায় যাচ্ছে।”
দুর্দশাগ্রস্ত এসব কমিউনিটি ও শ্রমিকদের ওপর করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবের নিয়েও কথা বলেন সেশনের অন্য বক্তারা। যেমন, থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের ভারত প্রতিনিধি রলি শ্রীবাস্তব, যিনি অভিবাসন ও মানব পাচার নিয়ে বিস্তর রিপোর্টিং করেছেন। কোভিড-১৯ লকডাউনের সময় ভারতে অভিবাসী শ্রমিকদের সংকট নিয়ে একটি ইন-ডেপথ প্রতিবেদন তুলে ধরেন তিনি।
এই প্রতিবেদনে শ্রমিকদের এক জনস্রোতের চিত্র উঠে আসে, যা তৈরি হয় মূলত লকডাউনে অচলপ্রায় ভারত, লাখ লাখ শহুরে শ্রমিকের কাজ হারানো এবং পরিবহন ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ার জের ধরে। মরিয়া হয়ে নিজ শহর, নগর ও গ্রামে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সেসময় এসব শ্রমিকেরা কোথাও যেতে না পেরে একরকম গৃহহীন হয়ে পড়েন।
শ্রীবাস্তব বলেছেন, এই অভিবাসনের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল মানুষের জীবনে। সড়ক দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে; রেল চালাচল বন্ধ ভেবে লাইনের ওপর শুয়ে থাকা অভিবাসীরা ট্রেনের চাপায় মারা গেছেন; অনেক শ্রমিক তাদের বেতনটাও পাননি, মালিকরা দেনা শোধের নামে কেটে রেখেছেন বলে। শ্রীবাস্তব বলেছেন, “আমরা কেউই এই বিশাল জনস্রোত এবং এর সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলোর কথা অনুমান করতে পারিনি। সরকার লকডাউনের ঘোষণা দেওয়ার পর কেউই কল্পনা করেনি যে এমনটি ঘটবে।
অ্যানি কেলি, গার্ডিয়ানের বৈশ্বিক মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত প্রকল্পের সম্পাদক, যিনি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার নারী পাচার, কাতার বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণে দাসত্ব, এবং পোশাক শিল্পে জোরপূর্বক শ্রমের মত বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, “আড়াল করা বা উপেক্ষিত মানুষের কণ্ঠ অন্যদের শোনানোর জন্য এই অনুসন্ধানগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কী সেসব মানুষদের কণ্ঠ শোনানোর প্ল্যাটফর্ম হতে পারেন, যাদেরকে আমাদের বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন ও সরকারগুলো জেনেশুনে আড়াল করে রেখেছে?”
জোরপূর্বক শ্রমের স্টোরি পিচ করবেন কী করে?
- সম্পাদকদের কাছে জোরপূর্বক শ্রম বিষয়ে প্রতিবেদনের ধারণা উপস্থাপনের উপায় নিয়ে কয়েকটি উপকারী পরামর্শ দিয়েছেন কেলি।
- এমন কোনো স্পষ্ট সংযোগ বা ভাষ্য উপস্থাপন করুন, যেটি পাঠকদের মনে নাড়া দেবে বা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যবহারের সঙ্গে মেলানো যাবে।
- যে শোষণগুলোর কথা আপনি উন্মোচন করতে যাচ্ছেন, সেসবের কারণে মানুষের জীবনে কী মূল্য দিতে হচ্ছে- তা যোগ করুন।
- অজানা যেসব সত্য উন্মোচন করছেন- তা ব্যাখ্যা করুন।
- আড়াল করা বা উপেক্ষিত মানুষদের কণ্ঠ তুলে আনুন।
- প্রতিবেদনটি কিভাবে ক্ষমতাধরদের জবাবদিহি করবে, বা কোনো ধরনের পরিবর্তন বা প্রভাব ফেলবে কিনা- তা বিবেচনা করুন।
জোরপূর্বক শ্রম নিয়ে রিপোর্টিং টিপস
জোরপূর্বক শ্রম নিয়ে রিপোর্টিংয়ের জন্য এই পরামর্শগুলো দিয়েছেন ম্যাকডোয়েল ও শ্রীবাস্তব:
- ডেটা অন্তর্ভূক্ত করুন: সংসদীয় কমিটি বা পোর্টালসহ সব ধরনের সূত্র ঘেঁটে দেখুন এবং প্রেক্ষাপটসহ একেকটি ঘটনাকে তুলে আনুন।
- হেল্পলাইন এবং অলাভজনক সংগঠনে কর্মরত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
- প্রতিবেদনটির প্রেক্ষিত ফুটিয়ে তোলার জন্য বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার নিন।
- অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে জোট বেঁধে কাজ করুন। জোরপূর্বক শ্রম সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলোতে প্রায়ই বিস্তৃত পরিসরের কাভারেজ প্রয়োজন হয়। এখানে অনেক বেশি সংখ্যায় সোর্স থাকে এবং বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে একযোগে রিপোর্টিং করতে হয়।
- সম্পাদকদের সঙ্গে শুরুতেই পরামর্শ করুন। এবং কোনো সমস্যার মুখে পড়লে, যত দ্রুত সম্ভব তাদেরকে বলুন। এমন কোনো সমস্যার কথা কখনো গোপন করবেন না, যেটি প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়ার পর বড় হয়ে দেখা দিতে পারে।
- সোর্সদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখুন, প্রতিবেদন প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পরও।
ফরাসী পরামর্শক চার্লস অথম্যান, সাংবাদিক ও শ্রম ইউনিয়নগুলোর জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করেন। জোরপূর্বক শ্রম নিয়ে কাজ করা সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি নতুন একটি টুলকিটও শেয়ার করেছেন। অথম্যান ও তাঁর দল টুলকিটটি তৈরি করেছিলেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার জন্য। এখানে জোরপূর্বক শ্রম সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলি বোঝা, খুঁজে বের করা, এবং রিপোর্ট ও ফলোআপেরও নির্দেশনা আছে। অথম্যান বলেছেন: কিটটি তৈরি করা হয়েছে এক জায়গাতেই সব কিছু পাওয়ার জন্য, এবং বৈশ্বিকভাবে।
ম্যাকডোয়েলের কাছ থেকে আরেকটি পরামর্শ এসেছে: এই বিষয় নিয়ে রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে মাঠে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
ম্যাকডোয়েল ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “প্রতিটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরই কাজের নিজস্ব পদ্ধতি থাকে। কেউ তথ্য অধিকার আইন পছন্দ করেন, কেউ সোর্সদের কাছ থেকে পাওয়া টিপসের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করেন, আবার কারো কাছে হয়তো দুর্দান্ত ডেটাবেজ আছে। কিন্তু আমার মনে হয়, আপনি যখন শ্রম হয়রানি, পাচার, বা ঋণ-দাসত্ব নিয়ে কথা বলছেন, তখন আপনাকে সত্যিই মাঠপর্যায়ে যেতে হবে এবং শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।”
এই বিষয়ে বিস্তারিত পাবেন জিআইজেএন-এর ইনভেস্টিগেটিং অর্গানাইজড ক্রাইম গাইডে, যেখানে মানব পাচার নিয়ে একটি অধ্যায় লিখেছেন মার্থা মেনডোজা। মানব পাচার ও জোরপূর্বক শ্রম নিয়ে অন্যান্য আরও অনেক গবেষণা উপকরণ আছে জিআেইজেএন রিসোর্স সেন্টারে। এশিয়া ও ইউরোপের যেসব সাংবাদিক মানব পাচার ও আধুনিক দাসত্ব অনুসন্ধানে আগ্রহী তারা জার্নালিজম ফান্ড ডট ইইউর এই রিপোর্টিং অনুদানও দেখতে পারেন।