শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়ে রাশিয়ার শীর্ষ স্বাধীন সংবাদপত্র নোভায়া গেজেটার প্রধান সম্পাদক দিমিত্রি মুরাতভ তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, “আজকের এই পুরস্কার সব অনুসন্ধানী সাংবাদিকের জন্য।”
যাঁদের তিনি এই সম্মানের অংশীদার করেছেন, সেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সত্যিকারের দায়িত্ব মুরাতভ বর্ণনা করেন চার দিন পরে, জিআইজেএনের সঙ্গে এক ওয়েবিনার সাক্ষাৎকারে: “মানবজাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মিশন হলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা; কারণ, অনুসন্ধানী রিপোর্টাররা কাউকে আমাদের ভবিষ্যৎ চুরি করতে দেয় না।”
নোবেল কমিটি মুরাতভ ও ফিলিপাইনের স্বাধীন অনলাইন সংবাদ ওয়েবসাইট র্যাপলারের প্রতিষ্ঠাতা মারিয়া রেসাকে যুুগ্মভাবে এই পুরস্কারে ভূষিত করে, “বাকস্বাধীনতা রক্ষায় তাঁদের প্রচেষ্টার জন্য, যা কিনা গণতন্ত্র ও শান্তি বজায় রাখার পূর্বশর্ত।”
জিআইজেএনের নির্বাহী পরিচালক ডেভিড ই কাপলান ও উপপরিচালক গ্যাব্রিয়েলা মানুলির সঞ্চালনায় ঘণ্টাব্যাপী এই লম্বা সাক্ষাৎকারে ৭৪টি দেশের ২২৬ জন দর্শকশ্রোতা ছিলেন। তাঁদের উদ্দেশে মুরাতভ বলেন, “অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আমি ভালোবাসি ও সম্মান করি। কারণ, পেশাটি অসাধারণ—সূত্র ও ডেটাবেস নিয়ে কাজ; মনিটরের সামনে বসে নয়তো মাঠে গিয়ে কাজ। অনুসন্ধানী রিপোর্টারদের ভাগ্যে কখনো এমন বড় সম্মান জোটে না, অথচ [মানুষের অধিকার] টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁরাই অপরিহার্য।”
তরুণেরা কেন অনুসন্ধানী রিপোর্টার হতে চায়, এই প্রশ্নের উত্তরে মুরাতভের সোজাসাপ্টা উত্তর: “বিশ্বকে বদলাতে, আরও উন্নত করতে।”
প্রশ্ন করা হয়, এই স্লোগান কি টি-শার্টে দেওয়া যায়? তাঁর উত্তর: “আমার পরামর্শ, ট্যাটু!”
নরওয়ের অসলোতে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে, এই অর্জন নোভায়া গেজেটার গত ১৫ বছরে নিহত ছয় সাংবাদিককে উৎসর্গ করেন মুরাতভ। এঁদের একজন আন্না পলিতকোভস্কায়া। তিনি ২০০৬ সালে নিহত হন।
এই জটিল প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে কাপলান সাক্ষাৎকার শুরু করেন।
কাপলান বলেন, “আজ বিশ্বজুড়ে আমরা সাংবাদিকেরা অস্তিত্বের সংকটে আছি, শুধু মুক্ত গণমাধ্যম নয়, বরং গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্যও বটে।”
তিনি আরও বলেন, “সাংবাদিকেরা এই সংগ্রামের সামনের সারিতে থাকেন—আমাদের নামে মামলা হয়, আমরা জেলে যাই, আমরা গুলি খাই, আমরা অপ্রত্যাশিত নজরদারি ও আইনি হয়রানির শিকার হই এবং অজস্র অপতথ্যের কারণে আমাদের কাজও জনসাধারণের আস্থা হারায়।”
কাপলান বলেন, এই যুদ্ধের সামনের সারিতে নোভায়া গেজেটার অবস্থান। রাশিয়ায় প্রায় অসম্ভব পরিস্থিতিতে ওয়াচডগ সাংবাদিকতা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পত্রিকাটিকে ধন্যবাদ।
নোভায়া গেজেটা সম্পর্কে কাপলান বলেন, “২০ বছর ধরে আমরা এই পত্রিকা অনুসরণ করছি এবং পত্রিকাটির ওয়াচডগ রিপোর্টিং মান দেখে আমরা সব সময় অভিভূত হই।” তিনি আরও বলেন, “যেখানে অনেক স্বাধীন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ, সেখানে পত্রিকাটি দেশটির দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বাচন জালিয়াতি, পুলিশি সহিংসতা এবং ক্ষমতার অন্যান্য অপব্যবহার নিয়ে অনুসন্ধান করেছে।”
শ্রোতাদের উদ্দেশে মুরাতভ বলেন, স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য লুকিয়ে ঘটনার রেকর্ডিং, এক্সক্লুসিভ খবরের সন্ধান ও স্টোরি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রতিযোগিতার দিন শেষ হয়ে গেছে; বরং তিনি মনে করেন, শোষণের জন্য সক্রিয়ভাবে ন্যায়বিচার চাইতে এবং সরকারের অবহেলিত সমস্যার সমাধান খুঁজতে বার্তাকক্ষগুলোর পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের হাল ধরে রাখতে হবে।
মুরাতভ বলেন, “সমন্বিত কাজে আমার আগ্রহ—পেশাজীবী সাংবাদিকদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
খুব প্রয়োজনীয় উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মুরাতভ তাঁর সঙ্গে অপর নোবেলজয়ী মারিয়া রেসার দুর্ভোগ নিয়ে বলতে গিয়ে বার্তাকক্ষের ভূমিকা উল্লেখ করেন। মারিয়া ফিলিপাইনে মিথ্যা অভিযোগে কারাদণ্ডের অবিরাম হুমকির মুখে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, “সাংবাদিকদের সংহতি এখানে একমাত্র সমাধান। ঈশ্বর না করুক, আজ যদি মারিয়া রেসা ফিলিপাইনে গ্রেপ্তার হন, দেরি না করে আমি সেখানে যাব, নোবেল কমিটির সদস্য ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নিয়ে একসঙ্গে আমি সেখানে যেতে চাই। তাৎক্ষণিকভাবে দেশ-বিদেশের সহকর্মীদের প্রতি আমাদের সংহতি জানানো উচিত—আমাদের সেখানে যেতে হবে, তাঁদের অফিসে যেতে হবে, তাঁরা যে জেলে আছেন, সেখানে যেতে হবে।”
অন্যভাবে বলা যায়, দূর থেকে হাত মচলাবেন না, সতর্ক ভাষায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেবেন না। “তাৎক্ষণিকভাবে”—এই শব্দ বারবার বলে, মুরাতভ স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন: স্বৈরশাসক যখন অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, সহকর্মীদের উচিত দ্রুত সশরীরে সেখানে যাওয়া এবং তীব্র প্রতিবাদ জানানো।
জিআইজেএনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময়ে মুরাতভ ভলগা নদীর তীরে তাঁর জন্মস্থান সামারায় রেডিও সাংবাদিকতার সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা করছিলেন।
রাশিয়ায় স্বাধীন গণমাধ্যমে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে কিছুটা হলেও নিরাপত্তা দেবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে মুরাতভ বলেন, তিনি জানেন না। তবে এই স্বীকৃতি নোভায়া গেজেটাকে জনসাধারণের সমস্যা তুলে ধরার সম্ভাব্য আশ্রয়স্থলে রূপান্তর করেছে।
তিনি বলেন, “এখনো আমার অনেক কাজ বাকি; কারণ, আমি ব্যক্তিগতভাবে শত শত ইমেইল পাই। সাধারণ মানুষ চিকিৎসা, আদালতের শুনানি, বাসস্থান এবং শিশুরোগ নিয়ে সাহায্যের আবেদন জানায়।” তিনি যোগ করেন, “এই পুরস্কার আমার জন্য একটি নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি করেছে এবং সত্যি বলতে এই স্বীকৃতিতে আমি খুশি।”
মুরাতভ বলেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার প্রভাব—কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতি থেকে নীতিমালার পরিবর্তন এবং ভোটারদের প্রভাবিত করা পর্যন্ত যা-ই হোক না কেন, শুধু জীবনমান উন্নয়নের জন্য নয়, বরং সাংবাদিকদের পেশা ও উৎসাহ ধরে রাখার জন্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি উল্লেখ করেন, “আমাদের লেখা প্রবন্ধগুলোর কোনো ফলাফল না এলে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলি।” তিনি আরও বলেন, “প্রকাশ্যে বা জনসাধারণের সামনে এলে একটি প্রবন্ধের জীবনচক্র শুরু হয়। তাই ফলাফল পেতে হবে, ফল পেলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে হবে না।”
স্বৈরতন্ত্রে যখন ফলাফল অসম্ভব—তিনি বলেন, হয়রানির নিছক অভিযোগেরও একটি সহজাত ইতিবাচক দিক আছে, যা অবদমিত সমাজকে আশার আলো দেখায়।
এ ছাড়া দুর্নীতি ও মাফিয়া অপরাধ প্রতিরোধে মুরাতভ দুটি ভয়ের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন: কারা নির্যাতন এবং মেরুদণ্ডের পেশি ক্ষয়সহ (স্পাইনাল মাসকুলার আট্রফি—এসএমএ) বিরল শৈশবকালীন স্নায়বিক রোগ।
ইতিমধ্যে তিনি নোবেল পুরস্কারের সমস্ত অর্থ (প্রায় ৫ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার) রাশিয়ায় শিশুরোগ প্রতিষ্ঠান ও আন্না পোলিতকোভস্কায়া অ্যাওয়ার্ডের মতো সাংবাদিকতা ফাউন্ডেশন ধরনের দাতব্য সংস্থায় দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
মুরাতভ ব্যাখ্যা করেন, “আমরা একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যা নিপীড়নের বিচার করবে। বিশ্বব্যাপী ও রাশিয়ায় সব সময় কারাগারে যা হয়, তা ভয়াবহ, জঘন্য।” তিনি আরও বলেন, “আমি একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ নিতে চাই, যা বিভিন্ন দেশে নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করবে, যেন আমরা নির্যাতনের ওপর একটি আন্তর্জাতিক বই রচনা করতে পারি এবং নিপীড়কদের কাছে পাঠাতে পারি। সাংবাদিকতার একটি উদ্যোগ হিসেবে এটা শুরু করা যায় এবং আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নেটওয়ার্ক এই উদ্যোগে অংশ নিতে পারে।”
তাঁর কর্মমুখী দর্শনের অংশ হিসেবে মুরাতভ এই সাংবাদিককেন্দ্রিক রবিন হুড স্টাইলের ভাবনাচিন্তা নিয়ে এগিয়ে যান: যদি অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা চুরি হওয়া অর্থ খুঁজে বের করেন, যা নইলে সমাজ থেকে হারিয়ে যেত, তাহলে সেই উদ্ধারকৃত অর্থ একই সাংবাদিকদের দেখানো কোনো যৌক্তিক খাতে পুনর্বণ্টন করা উচিত।
তিনি বলেন, “আমরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা অনেক মাফিয়াকাণ্ড উদঘাটন করেছি, দুর্নীতি ও মাফিয়া জগতের বিপুল অর্থ উদ্ধার করতে একসঙ্গে কাজ করেছি—উদ্ধারকৃত সেই অর্থ কোথায় যাওয়া উচিত?” “আমার মতে, অভাবগ্রস্ত মানুষ বা অসুস্থ শিশু কিংবা তরুণদের জন্য প্রতিষ্ঠিত দাতব্য সংস্থায় সেই অর্থ প্রেরণের ব্যাপারে আমরা একমত হতে পারি। কিছু মানুষ কিছু চুরি করেছে এবং তারা অফশোর অ্যাকাউন্টে সেই অর্থ রেখেছে—এতটুকু বললেই আমাদের দায়িত্ব চুকে যায় না। সেই অর্থ আমরা সাধারণ মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারি।”
মুরাতভ বলেন, এই চিন্তার ব্যাপারে অনুসন্ধানী সাংবাদিক গোষ্ঠীর কোনো পরামর্শ তিনি সানন্দে গ্রহণ করবেন।
রাশিয়ায় সংবাদপত্রের ওপর ক্র্যাকডাউনের চড়া মূল্য দিতে হয়েছে নোভায়া গেজেটার কর্মীদের, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি রিপোর্ট এবং অনুসন্ধান চালিয়ে গেছে। জানতে চাওয়া হয়, তাঁর সহকর্মীদের টিকে থাকার ঘটনা থেকে দমনমূলক অন্যান্য দেশের রিপোর্টাররা কী শিখতে পারেন? মুরাতভ বলেন, বার্তাকক্ষ নয়, বরং সেই শাসন ব্যবস্থায় জোর দিন, এবং সেখানে পরিবর্তনের কথা বলুন।
তিনি বলেন, “নিজের যুক্তিতে অটল থাকুন—কখনো নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবেন না বা সমঝোতা করবেন না। আমাদের সরকার দমনমূলক হলেও আমাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন আসবে না, এবং আদর্শে আমরা অটল থাকব।” বরং পরিবর্তন যদি হয়, তবে তা হবে সরকারের আচরণে। রাশিয়ায় আইস্টোরিজ, বা অসাধারণ প্রকল্প দ্য অ্যান্টি-করাপশন ফাউন্ডেশনের এফবিকের মতো চমৎকার অনুসন্ধানী রিপোর্টারদের একটি প্রজন্ম আমরা পেয়েছি।”
মুরাতভের মতে, কার্যকর ওয়াচডগ রিপোর্টিংয়ের জন্য মেধা ও উৎসাহ সম্ভবত অনেক স্বৈরতান্ত্রিক সমাজে বিদ্যমান। আরও বলেন, স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোর তরুণ জনগোষ্ঠীর ভাবা উচিত, যেন তাদের মেধা সরকারি চাকরিতে অপচয় না হয়। তাঁর মতে, একে অন্যকে সমর্থন করা সাংবাদিকদের মৌলিক কাজ।
তিনি বলেন, “একেই বলে সংহতি।” “আমার আশা কোথায়? আমি জিআইজেএনের মতো অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ককে সহযোগিতা করার আশা রাখি।”
অনুসন্ধানী রিপোর্টারদের ক্ষুদ্র অথচ ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের উদাহরণ টেনে কাপলান সাক্ষাৎকারের পরিসমাপ্তি টানেন নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে মুরাতভের শেষোক্তি দিয়ে: “আমরা অত্যাচারের প্রতিষেধক।”
আরও পড়ুন
হোয়াই জার্নালিস্টস ইন অটোক্রেসিস শুড রিপোর্ট অ্যাজ ইফ দে আর ইন এ ডেমোক্রেসি
রিপোর্টিং ফ্যাক্টস টু পাওয়ার: হোয়াট দ্য ২০২১ নোবেল পিস প্রাইজ মিনস ফর জার্নালিজম
রাশিয়ার রোমান আনিন তার অনুসন্ধানে যেসব টুল ব্যবহার করেন
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএনের একজন প্রতিবেদক। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমস্ পত্রিকার সাবেক প্রধান রিপোর্টার। বিদেশি প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বিশ্বের ২৪টির বেশি দেশে সংবাদ, রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন।