গত ১০ বছরে ফরাসি ভাষায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জগৎ অনেকখানি সম্প্রসারিত হয়েছে, তরুণ সাংবাদিকদের জন্য অনুসন্ধান অনেক সহজ হয়েছে, এবং তা এখন আর কেবল নিঃসঙ্গ, অভিজ্ঞ রিপোর্টারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বেশ কিছু স্বাধীন সংবাদ সাইটের যাত্রা, সাংবাদিকদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি, ও নতুন প্রযুক্তিগত টুলের সহজলভ্যতা – নিশ্চিতভাবে এই ক্রমপ্রসারমাণ ধারায় অবদান রাখছে। এর ফলও এখন দৃশ্যমান: ২০২১ সাল ফরাসি ভাষী অনুসন্ধানের জন্য “সেরা” ছিল, যা এই বছর প্রকাশিত অনেক মানসম্পন্ন প্রতিবেদনের মধ্য থেকে ১২টিকে বাছাইয়ের কাজ কঠিন করে তুলেছে। এখানে (নিজের পছন্দ মতো) গল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে কৌশলের ব্যবহার, সমাজে গল্পের প্রভাব, ঝুঁকির মাত্রা ও ভৌগলিক বৈচিত্র্য বিবেচনা করা হয়েছে। একটি কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, আলজেরিয়া থেকে কানাডা, কমোরোস থেকে বেলজিয়াম: এই অনুসন্ধানগুলোতে যুক্ত সাংবাদিকেরা তাঁদের সাহস ও ধৈর্য প্রমাণ করেছেন।
পড়ুন এবং আবিষ্কার করুন, জিআইজেএনের ফরাসি সম্পাদক মার্থে হুবিও, ফরাসি ভাষী আফ্রিকা সম্পাদক ম্যাক্সিম ডোমেনি ও জিআইজেএনের ফরাসি সহকারী সম্পাদক আলসিয়ন উইমায়ের বাছাই করা বছরের সবচেয়ে শক্তিশালী অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো।
আট বছর পর প্যারিসের উপশহরের একটি পুলিশি ঘটনার পুনঃনিরীক্ষণ (ফ্রান্স)
সহিংস ঘটনায় কখনো কখনো নিরাপত্তা রক্ষীরা তাদের আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করেন। সম্প্রতি একটি ভিডিও অনুসন্ধানে এই দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ফরাসি দৈনিক ল্য মোঁদ। অনুসন্ধানটিতে তারা পুলিশের এক বিশৃঙ্খল অভিযানের ঘটনা যাচাই করেন, যার কারণে ২০১৩ সালের ২৫শে জুন উত্তর-পূর্ব প্যারিসের ভিলেমম্বলে উপশহরে একটি পরিবারের জীবন ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। সেদিন, ফ্লাশ-বল নামের এক ধরনের কম ক্ষতিকর বন্দুকের গুলিতে ৫৪ বছর বয়সী ফাতুমা কিবি একটি চোখ হারান এবং তাঁর ছেলে মোহাম্মদের কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘটনার সাত বছর পর ২০২০ সালের মার্চে গোলাগুলির ঘটনায় অভিযুক্ত দুই পুলিশ কর্মকর্তা আত্মরক্ষার অজুহাতে মুক্তি পান।
মামলার নথি, প্রতিবেশীদের ধারণ করা অদেখা কিছু ছবি, সাক্ষ্য ও থ্রিডি মডেলের ভিত্তিতে পুলিশি অভিযানের সেই চূড়ান্ত ১৪ মিনিট সময় খতিয়ে দেখে ল্য মোঁদের অনুসন্ধান। যেমন, পুলিশি বয়ানে বলা হয় প্রতিবেশীরা পুলিশকে ঘেরাও করেছিল, কিন্তু ভিডিও ও থ্রিডি মডেলিংয়ে উঠে আসে ঘটনা আসলে এমন নয়। অভিযানটির তথ্যগত পুনঃনির্মাণ থেকে দর্শকেরা সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সব ধরনের উপাদান খুঁজে পান। ইতালিতে অনুষ্ঠিত ২০২১ ডিআইজি অ্যাওয়ার্ডস্ ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যালে ভিডিওটি ”মাঝারি দৈর্ঘ্যের সেরা অনুসন্ধানী স্টোরি” ক্যাটাগরিতে “স্পেশাল মেনশন” লাভ করে।
রাশিয়ার কাছে স্বাস্থ্যবিষয়ক ডেটা ফাঁস (বেলজিয়াম)
বেলজিয়ামের দৈনিক ল্য সোয়া ও স্বাধীন পাক্ষিক সাময়িকী মিডোর সহযোগিতমূলক প্রতিবেদনে দেখা যায়, আমাদের ব্যক্তিগত ডেটার পাচার ও অপব্যবহার কতটা ব্যাপক হতে পারে। এতে উঠে আসে, বেলজিয়ামের সরকারি হাসপাতালের অধিকাংশ রোগীর ডেটা প্রক্রিয়াজাত করে যে সফটওয়্যার সেটি একটি আমেরিকান কোম্পানির তৈরি, এবং তারা ডেটা বিশ্লেষণের সাবকন্ট্রাক্ট দিয়েছে রাশিয়ার আরেক প্রতিষ্ঠানকে।
এই প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের মধ্যকার চুক্তি পুরোপুরি উন্মোচনের মাধ্যমে অনুসন্ধানকারীরা দেখিয়েছেন, রাশিয়ার আইটি বিশেষজ্ঞদের জন্য অতি-সংবেদনশীল স্বাস্থ্যবিষয়ক ডেটায় প্রবেশাধিকার কতটা সহজ হয়েছে। উল্লেখ্য, রাশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেটা ও গোপনীয়তা সংরক্ষণ মানদণ্ড মেনে চলে না। এই ফাঁসকাণ্ডে তথ্য নিরাপত্তা পদ্ধতির দুর্বলতা, সরকারি কাজের বেসরকারিকরণের ফলাফল, এবং ইউরোপে জিডিপিআর (জেনারেল ডেটা প্রটেকশন রেগুলেশন) নীতিমালা বাস্তবায়নের সমস্যাগুলো উন্মোচিত হয়। মার্চে এই প্রতিবেদন প্রকাশের জের ধরে বেলজিয়ামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক ফন্দেনব্রুকের কাছে চুক্তিটি পরিবর্তনের দাবি জানায় ন্যাশনাল কাউন্সিল অব দ্য অর্ডার অব ফিজিশিয়ান্স, যেন তাতে ইইউর ব্যক্তি-গোপনীয়তা আইন মেনে চলার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
জেনেভায় তেল ব্যবসার অন্ধকার দিক (সুইজারল্যান্ড)
২০১৮ সালে পণ্য বেচাকেনা প্রতিষ্ঠান গানভার-এর এক সাবেক ব্যবসায়ীকে ১৮ মাসের স্থগিত-কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। অভিযোগ: ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কঙ্গো ও আইভরি কোস্টে জ্বালানি তেলের চালানের বিনিময়ে ৪ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার ঘুষের কলকাঠি নেড়েছেন তিনি। এই রায় তথ্যচিত্র নির্মাতা রোলাঁ শোভিলকে কৌতুহলী করে তোলে। তিনি এই রায়কে চলচ্চিত্রের উপজীব্য করে, তে ব্লাইস-কুবোতার সঙ্গে যৌথভাবে “জেনেভা, পেট্রোলিয়াম অ্যাট এনি প্রাইস” নির্মাণ করেন, যা ২০২১ সালের জুনে রেডিও টেলিভিশন সুইসে প্রচারিত হয়।
সুইস আদালতের নথিপত্র এবং সুইস বেসরকারি সংস্থা পাবলিক আইয়ের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে শোভিলের অনুসন্ধানে এমন সব বিষয় উন্মোচিত হয়, যা খুব কম মানুষই জানতেন। যেমন: সুইজারল্যান্ড, বিশেষত জেনেভা হলো বিশ্বব্যাপী তেল ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু, এবং সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো সুইস কর্তৃপক্ষের তেমন তদারকি ছাড়াই আফ্রিকার তেল কেনে এবং পুনরায় বিক্রি করে। এই তথ্যচিত্রে কঙ্গো ও অন্যান্য দেশে সম্পদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
মন্ট্রিলে বৈশ্বিক কেলেঙ্কারি (কানাডা)
১০০০ ডলার জেতার ভুয়া প্রতিযোগিতা, মিথ্যা ভার্চুয়াল কনসার্ট, বা বিনা খরচায় চলচ্চিত্র জগতে যাওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি: গত দশকে এই ধরনের লোভনীয় প্রস্তাবে ক্লিক করে বিশ্বজুড়ে অনেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ব্যক্তিগত এবং ব্যাংকিং তথ্য পাচারের শিকার হয়েছেন। সিবিসির লে ডিক্রিপ্তারের পরিচালনায় রেডিও-কানাডার স্টোরি “আ মন্ট্রিল এম্পায়ার অব অনলাইন স্ক্যামস্” এসব অনলাইন ফাঁদের পেছনে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের একটি নেটওয়ার্ক উদঘাটন করেছে, যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় মাত্র একজন ব্যক্তির সঙ্গে।
এই স্টোরি প্রকাশের কিছু দিনের মধ্যে অ্যাডসেন্টার নামে একটি অনলাইন নেটওয়ার্কের মালিকানা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তিন মাস পর ঘোষণা আসে, প্রতিষ্ঠািনটি ব্যবসা-ই বন্ধ করে দিচ্ছে।
ইজিপ্ট পেপারসে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে ফ্রান্সের ভূমিকা ফাঁস (ফ্রান্স)
ফ্রান্সের ইতিহাসে গোপনীয় প্রতিরক্ষা নথি ফাঁসের সর্বোচ্চ নজির, এই ঘটনা। এজন্য ধন্যবাদের দাবিদার একটি বেনামী সূত্র এবং অলাভজনক অনুসন্ধানী গণমাধ্যম ও জিআইজেএন সদস্য ডিসক্লোজ। মিশরের স্বৈরশাসক আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসির সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে ফ্রান্সের সংশ্লিষ্টতার কয়েক শ’ নথি তারাই প্রথম হাতে পায়। এদের মধ্যে একাধিক ঘটনায় কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যু হয়। “জাতীয় প্রতিরক্ষার গোপনীয় তথ্য প্রকাশে” আইনী ঝুঁকি থাকার পরও জনস্বার্থ ও তথ্য অধিকারের স্বার্থে নথিগুলো প্রকাশে করার সিদ্ধান্ত নেয় ডিসক্লোজ।
পাঁচ পর্বের এই অনুসন্ধানে কয়েকটি চমক জাগানো উদঘাটন ছিল। ডিসক্লোজের প্রকাশ করা নথি অনুসারে, ২০১৬ সালে মিশরে আপাতদৃষ্টিতে সন্ত্রাস-বিরোধী উদ্দেশ্য নিয়ে একটি ফরাসি গোপন সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়, তবে সাধারণ মানুষের ওপর বোমাবর্ষণের ১৯টি ঘটনায় এই কার্যক্রমের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। বিচারবর্হিভূত হত্যা নিয়ে সেনাবাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দাবাহিনী দফায় দফায় সতর্ক করলেও সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলান্দ ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁখো মিশরে ‘অপারেশন সিরলি’ চালিয়ে যান। এমনকি ম্যাঁখো, আল-সিসিকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক দ্য লিজিওঁ অব অনার প্রদান করেন এবং দেশটির কাছে প্রায় সাড়ে চারশ কোটি মার্কিন ডলারে ৩০টি ফরাসি যুদ্ধ বিমান বিক্রি অনুমোদন করেন। ডিসক্লোজের তথ্যানুসারে, অপারেশন সিরলি এখানো চলমান। এই তথ্য ফাঁসের পর ফরাসি সরকার ঘোষণা করে, তারা একটি তদন্ত শুরু করছে এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা গোপনীয়তা লঙ্ঘনের দায়ে একজন বেনামী ফাঁসকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে যাচ্ছে।
যৌন হয়রানির দায়ে প্রাক্তন ফরাসি মন্ত্রী অভিযুক্ত (ফ্রান্স)
সপ্তাহখানেক আগেই ফ্রান্সের টিভি চ্যানেল “ওঁভয়ে স্পেসিয়ালের” অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান এক বিস্ময়কর ঘটনা উন্মোচন করে। খ্যাতিমান সাবেক ফরাসি পরিবেশ মন্ত্রী নিকোলা উলোর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের অভিযোগে চারজন নারীর সাক্ষ্য হাজির করে। তথ্যচিত্রটিতে অভিযুক্ত ব্যক্তির উত্তর জানার চেষ্টা করা হয়। উলো জোরালোভাবে অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং সম্প্রচারের কিছু দিন আগ পর্যন্ত অনুসন্ধান সম্পর্কে তাঁকে অবগত না করার জন্য উল্টো অনুসন্ধানী দলকে দায়ী করেন। তবে ওঁভয়ে স্পেসিয়াল দল সম্প্রচারের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই তাঁর মতামতের জন্য অনুরোধ জানিয়ে আসছিল, কিন্তু সাড়া না পেয়ে তাঁর মতামত ছাড়াই সম্প্রচার করা হয়।
এক সাবেক টিভি উপস্থাপকের বিরুদ্ধে আটজন নারীর যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে ধরা লিবারেশনের এই স্টোরির মতোই ফ্রান্স টিভির প্রতিবেদনটিতেও সূত্রের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যের জোরালো ভূমিকা উঠে আসে। এই চর্চা হয়রানির ধরন নির্ণয়ে সহায়ক হয় এবং হয়রানির শিকার অন্য অভিযোগকারীদের এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করে। এবং সত্যিই, সম্প্রচারের পর আরো দুই অভিযোগকারী উলোর বিরুদ্ধে কথা বলেন। অনুসন্ধানটি সম্প্রচারের দুই দিন আগে উলো সরাসরি এই অভিযোগ অস্বীকার করেন, কিন্তু একই সঙ্গে তিনি জন-পরিসর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন। এই ফাঁসকাণ্ডের পর ফরাসি প্রসিকিউটররা বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেন।
যেভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর সম্পদ লুট করে কাবিলা পরিবার ( গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো)
৩৫ লাখ নথি, ১৯ টি সহযোগী গণমাধ্যম, এবং পাঁচ বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে হওয়া এই সহযোগিতামূলক অনুসন্ধানের মাত্রা ছিল অনেক বিস্তৃত। কিন্তু কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলা ও তার আত্মীয়রা জনগণকে বিসর্জন দিয়ে যে আকাশছোঁয়া অর্থ আত্মসাৎ করছিলেন, তার বিচারে এই ব্যাপকতা প্রয়োজন ছিল। দেশটির অধিকাংশ মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারের কম। ফরাসি অনলাইনভিত্তিক স্বাধীন অনুসন্ধানী সাময়িকী মিডিয়াপার্ট ও ফরাসি বেসরকারি সংস্থা প্লাটফর্ম ফর দ্য প্রোটেকশন অব হুইসেলব্লোয়ারস ইন আফ্রিকার (পিপিএলএএএফ) দেওয়া তথ্যানুসারে, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে কাবিলা পরিবার সরকারি তহবিল থেকে ১৩ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার আত্মসাতের পরিকল্পনা করে। ইউরোপিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ কোলাবোরেশনস্ (ইআইসি) নেটওয়ার্ক ডেটাগুলো বিশ্লেষণ করে।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা খুব সহজ ছিল: মাত্র একটি ব্যাংক ও একটি শেল কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ। এক্ষেত্রে ব্যাংকটি ছিল বিজিএফআই ডিআরসি, যার ৪০ শতাংশ মূলধনের মালিক কাবিলার বোন এবং প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ছিলেন প্রেসিডেন্টের পালক ভাই। দুজন মিলে রাজধানী কিনশাসার একটি পুরনো গ্যারেজে প্রতিষ্ঠিত সুদ অয়েল নামের একটি শেল কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রণ করতেন। মিডিয়াপার্টের মতে, আফ্রিকার ইতিহাসের “সবচেয়ে বড় ফাঁসকাণ্ড” নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনটি এই পূর্ণাঙ্গ চুরিতন্ত্রের (ক্লেপটোক্রেসি) পেছনের কারসাজি ও পদ্ধতি সামনে এনেছে। এই ঘটনায় ফ্রান্স, চীন, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত অনেকগুলো গণতান্ত্রিক দেশের সংশ্লিষ্টতা উঠে আসে। এই উন্মোচনের পর একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়।
সাংবাদিক আলি আব্দুর মৃত্যুর কারণ কী? (কমোরোস)
২০২০ সালে, কমোরোসের তরুণ সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আলি আব্দুর মৃতদেহ নিজ বাড়িতে পাওয়া যায়। এই ঘটনাকে সরকার “স্বাভাবিক মৃত্যু” বলে দাবি করলেও অনুসন্ধানী সাংবাদিক হায়াৎ আব্দু তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। সংক্ষিপ্ত তদন্তের পর স্থানীয় সরকারি আইনজীবী ঘটনাটিকে “স্বাভাবিক” বলে রায় দেন। আলির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও হায়াৎ এই মৃত্যু নিয়ে সত্য ঘটনা উদঘাটনের সঙ্কল্প করেন।
ফেব্রুয়ারিতে ন্যাশনাল ম্যাগে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে কিছু “অস্বস্তিকর সাক্ষ্য” উন্মোচন করেন হায়াৎ, যা প্রমাণ করে, সেই সাংবাদিকের মৃত্যু মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। যেমন, তিনি দেখতে পান, আলির মৃতদেহ রক্তের উপর পড়ে ছিল এবং তাঁর একটি চোখে ছিল আঘাতের চিহ্ন। এছাড়াও আলির সঙ্গে যার জমি সংক্রান্ত বিরোধ ছিল, তার সঙ্গে তদন্ত পরিচালনাকারী আইনজীবীর সংশ্লিষ্টতা আবিষ্কার করেন তিনি। হায়াতের অনুসন্ধানের পর নিহতের পরিবার মামলা দায়ের করে এবং প্রায় দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়া একটি ঘটনায় নতুন আশার সঞ্চার হয়।
একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণের পেছনের গল্প (আলজেরিয়া)
আলজেরিয়ায় স্বাধীন গণমাধ্যম তোয়ালা ইনফোর অনুসন্ধানী সাংবাদিক লিয়া হায়া একটি বড় টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণের ঘটনায় যথাযথ যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা নিয়ে অনুসন্ধান করেন। তোয়ালার অনুসন্ধানী ধারাবাহিক কোম্পানি কেনাবেচার এক অজানা অধ্যায় উন্মোচন করে এবং রিপোর্টে বলা হয়, এই ঘটনায় আলজেরিয়ার জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে আরো উঠে আসে, মূল ডাচ প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের বিপুল মুনাফা এবং আলজেরিয়ার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ থেকে নেওয়া অর্থের আর্ন্তজাতিক বিনিময়ের ঘটনা আড়াল করেছে।
ফিরে আসা অভিবাসীরা আবারও দেশ ছাড়তে আগ্রহী (সেনেগাল)
সেনেগাল। স্পেনে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অন্যতম গন্তব্যস্থল। অনিয়মিত অভিবাসন ঠেকানোর কর্মসূচি ও কঠোর আইনের মাধ্যমে দেশটি সাগরে ভাসমান দেশত্যাগীদের ঢেউ থামানোর চেষ্টা করছে। এমনকি ২০২০ সালেও ইউরোপে উন্নত জীবনের আশায় আরো অনেক মানুষ এক নৌকা থেকে আরেক নৌকায় ভেসে বেড়িয়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিক অ্যাস মোমার লু দুর্গম সাগর পাড়ি দেয়া এমন কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দেখতে পান, আগের ভ্রমণের দুর্বিষহ স্মৃতির ক্ষত নিয়ে ফিরে আসা অভিবাসীরা আবারও নতুন যাত্রার অপেক্ষায়।
জনসাধারণের কাছ থেকে টাকা তুলে তরুণ সাংবাদিকদের সহায়তা দেওয়া স্বাধীন অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠান লা মেসুুঁ ডে হিপোকতেরের উদ্যোগে সংগঠিত স্টোরিটি আফ্রিকায় অসাধারণ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য রেডিও ক্যাটাগরিতে নভেম্বরে নবের জুঙ্গু প্রাইজ লাভ করে।
প্রধানমন্ত্রীত্ব নাড়িয়ে দেয়া প্যান্ডোরা পেপারস (আইভরি কোস্ট)
সুবিশাল প্যান্ডোরা পেপারস ডেটাবেসে আইভরি কোস্টের প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিক আচির নাম পাওয়ার পর দেশটির সাংবাদিক নোয়েল কোনানের মাথায় অনুসন্ধানের চিন্তা আসে। কিন্তু কয়েক মাস রিপোর্টিংয়ের পরও কোনানের স্টোরি প্রকাশ না হতে দেখে, তথ্য চাপা দেওয়ার সম্ভাব্য সমন্বিত প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে স্থানীয় ও আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যম তাঁর পাশে দাঁড়ায়।
তথাকথিক সেই সম্পাদকীয় চাপ ঠেলে সরিয়ে গত ৪ঠা অক্টোবর একটি ধারাবাহিক টুইট পোস্ট করেন কোনান। তার একটিতে বলা হয়, “কিছুদিন থেকে যে ভয়টা পাচ্ছিলাম, আজ তাই সত্য হলো। প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিক আচিকে নিয়ে প্রতিবেদনটি আমার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি।” উত্তরে পত্রিকার পরিচালক বলেন, কোনানের অভিযোগের প্রমাণ নেই, আর “লেখা প্রকাশ হবে কি হবে না, এটা তাঁর এখতিয়ার, কারণ তথ্যগুলো সঠিকভাবে যাচাই করা হয়নি।” দেখা যায়, তাঁর লেখায় একটি অফশোর পরামর্শক সংস্থার অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে। সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের আগে, দেশটির প্রধানমন্ত্রী বাহামা দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন। লেখাটি শেষমেষ দেশটির উঠতি অনুসন্ধানী অনলাইন, অঙ্কেট মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়।
পেগাসাস প্রকল্প, বিশ্বকে ঝাঁকুনি দেওয়া একটি সমন্বিত প্রতিবেদন
পেগাসাস প্রজেক্ট অনুসন্ধানের সূত্রপাত কোথায়? জিআইজেএনের সদস্য, ফ্রান্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফরবিডেন স্টোরিজের নেতৃত্বাধীন একটি অনুসন্ধানী জোটের হাতে ৫০ হাজার ফোন নাম্বারের একটি তালিকা আসে। সন্দেহ করা হচ্ছিল, নাম্বারগুলো স্পাইওয়্যার আক্রমণের শিকার; কারণ সেগুলোর ব্যবহারকারীরা সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী ও রাষ্ট্রপ্রধান। স্পাইওয়্যারটির নামে নামকরণ করা এই অনুসন্ধানে নজরদারি প্রযুক্তিটির উৎস, ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ এবং পেগাসাসের গ্রাহকদেরও খুঁটিয়ে দেখা হয়। অনুসন্ধানী এই জোটের মতে, পেগাসাস গ্রাহকদের মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক (বাহরাইন, মরক্কো, সৌদি আরব) ও গণতান্ত্রিক (ভারত, মেক্সিকো) দু’ধরনের সরকারই ছিল। অ্যামনেস্টি সিকিউরিটি ল্যাবের সহায়তায় ফরবিডেন স্টোরিজ মাসের পর মাস ধরে ১৬টি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদের আর্ন্তজাতিক দলকে সমন্বয় করে গেছে। সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ফোন বিশ্লেষণ করে অনুসন্ধানকারীরা দেখতে পায়, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁসহ ১৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে টার্গেট করা হয়েছিল। অনুসন্ধানী সাইট মিডিয়াপার্টের প্রতিষ্ঠাতা এডউই প্লেনেলের ফোন ঘেঁটে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী আরও ১৭৯ সাংবাদিকের সঙ্গে তাঁকেও তিনবার হ্যাক করেছে পেগাসাস।
পেগাসাস প্রজেক্টের ঝাঁকুনি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। জাতিসংঘ সাময়িকভাবে রাষ্ট্রগুলোর উপর নজরদারি প্রযুক্তি কেনা ও আদানপ্রদানে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই পেগাসাস প্রজেক্ট রিপোর্টারস্ উইথাউট বর্ডারসের প্রেস ফ্রিডম প্রাইজ লাভ করে, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী স্বীকৃতি আসে ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের কাছ থেকে, যা ফরবিডেন স্টোরিজকে মাল্টার এক সাহসী সাংবাদিকের নামানুসারে প্রবর্তিত প্রথম ড্যাফনি কারুয়ানা গালিৎসিয়া পুরস্কারে ভূষিত করে।
আরও পড়ুন
পেগাসাস প্রজেক্ট থেকে শিক্ষা: শিকারি স্পাইওয়্যার নিয়ে রিপোর্ট করবেন যেভাবে
লেসন ফ্রম দ্য প্যানডোরা পেপার্স: হাও টু ইনভেস্টিগেট ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম স্টোরিজ
টিপস ফর ইনভেস্টিগেটিং হোয়েন গভর্নমেন্টস শিল্ড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন