পেগাসাস প্রজেক্টে কাজ করা ৮০ জন রিপোর্টারকে তাঁদের নিজ নিজ মোবাইল ফোনগুলো লম্বা সময়ের জন্য কোয়ারেন্টিনে পাঠাতে হয়েছিল, যেন তাঁদের ছয় মাস ধরে চলা অনুসন্ধানটি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সেই অনুসন্ধানে তাঁরা উন্মোচন করেছেন, কীভাবে গণহারে ডিজিটাল গুপ্তচরগিরি চালিয়ে গেছে ১১টি দেশের সরকারেরা।
অনুসন্ধানটির বিষয়ে অনেক তথ্য জানা গেছে অলাভজনক অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম, ফরবিডেন স্টোরিজের প্রতিষ্ঠাতা লরেন্ত রিচার্ড ও প্রধান সম্পাদক সাঁদ্রিন রিগোর সাক্ষাৎকার থেকে। জিআইজেএন-এর সদস্য সংগঠন ফরবিডেন স্টোরিজ এই সহযোগিতামূলক প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছে। এবং তাঁদের এই ধরনের সতর্কতা দেখিয়েছে, ইসরায়েলি এনএসও গ্রুপের পেগাসাস স্পাইওয়্যার কী চরম মাত্রার নজরদারির ঝুঁকি তৈরি করছে।
১৬টি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের জোটবদ্ধ কাজের মাধ্যমে পেগাসাস প্রজেক্ট উন্মোচন করেছে: ভারত থেকে হাঙ্গেরি পর্যন্ত, বিভিন্ন দেশের হাজারো অ্যাকটিভিস্ট, ভিন্ন মতাবলম্বী এবং অন্যান্য নাগরিকের (যাঁদের মধ্যে ১৮০ জন সাংবাদিকও আছেন) স্মার্টফোনগুলোকে কীভাবে সরকারি নজরদারির লক্ষ্য বানানো হয়েছে। এই স্পাইওয়্যার দিয়ে টার্গেট করা স্মার্টফোনগুলোর দখল নিয়ে নেওয়া যায়। এমনকি ফোনটির ক্যামেরাও চালু করে দেওয়া যায়। ব্যবহারকারী কিছুই জানবেন না এবং তাঁকে কোনো কিছু ক্লিকও করতে হবে না। পরবর্তী সময়ে টার্গেট করা এসব ব্যক্তির আইফোনগুলোর ফরেনসিক বিশ্লেষণ করেছে এই প্রজেক্টের কারিগরি সহযোগী, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সিকিউরিটি ল্যাব। তারা দেখেছে যে, আক্রান্ত বা হামলার শিকার হওয়া এসব ডিভাইসের ৮৫ শতাংশই পেগাসাস স্পাইওয়্যার আক্রমণের শিকার।
এসব ঘটনা উন্মোচনের প্রভাব এরই মধ্যে অনেক জায়গায় দেখা গেছে। বেশ কয়েকটি দেশের সংসদে সরকারি তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে, সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ করেছে, পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে। এবং গত সেপ্টেম্বরে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে পেগাসাস সিস্টেমকে বৈশ্বিকভাবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে।
সহযোগিতামূলক এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেখা গেছে, গণতন্ত্রের ওপর হামলা এবং সাংবাদিকদের চুপ করিয়ে দিতে পেগাসাস ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ডিজিটাল অস্ত্র হিসেবে। এনএসও গ্রুপ অবশ্য এসব স্বীকার করেনি। তারা বলেছে, “এই তালিকা পেগাসাসের সম্ভাব্য লক্ষ্যের তালিকা নয়। তালিকায় উল্লেখ করা নম্বরগুলোর সঙ্গে এনএসও গ্রুপের কোনো সংযোগ নেই।” এবং তারা দাবি করে যাচ্ছে যে, এই টুল শুধুই অপরাধ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সরকারগুলোকে সাহায্য করার জন্যই ব্যবহার করা হয়।
যে কাজে যোগাযোগের কোনো মাধ্যমই বিশ্বাস করা যায়নি
সদা বিদ্যমান নজরদারির ঝুঁকি, এই অনুসন্ধানের জন্য বিশেষ চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে বলে জানান রিচার্ড। রিপোর্টারদের জন্য তো বটেই, সেই সঙ্গে তাঁদের জন্যও, যাঁদেরকে এই ঝুঁকির ব্যাপারে জানাতে হতো। এই মানুষদের মধ্যে ছিলেন রাজনীতিবিদ, নাগরিক অধিকার কর্মী ও সাংবাদিক।
হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন—এমন মানুষদের বিষয়টি জানানোর লক্ষ্যে যোগাযোগ করার জন্য বেশ কিছু “সৃজনশীল পন্থা” বেছে নিয়েছিল এই অনুসন্ধানী দল। ফোন বা অন্যান্য ডিজিটাল যোগাযোগ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তারা যোগাযোগ করেছিল কোনো বন্ধুর মাধ্যমে। কোভিড-১৯ প্রটোকল মেনে দেখা করেছেন সামনাসামনি।
সামনাসামনি এসব বৈঠকের সময় অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের তাঁদের সেলফোনগুলো লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল একটি “বড়, কালো, বন্ধ স্যুটকেসের” ভেতর। তারপর সেগুলো অনেক দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল।
রিচার্ড বলেছেন, “অনুসন্ধানটিতে শুরু থেকেই খুব বেশি মাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। আমাদের কারিগরি সহযোগী, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি ল্যাবের সাহায্য নিয়ে, আমরা বেশ কিছু ডিভাইসে পেগাসাস স্পাইওয়্যার হামলার চিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলাম। সাইবার নজরদারির ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো সাংবাদিকেরা ভিকটিমের সত্যিকারের চেহারা এবং স্পাইওয়্যারের অপব্যবহারের বিষয়টি দেখাতে পেরেছেন।”
হ্যাকিংয়ের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য অয়্যারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সিদ্ধার্থ ভরদরাজন-এর মতো সাংবাদিক, হত্যার শিকার হওয়া সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির পরিবারের সদস্য এবং ১৪ জন রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁদের মধ্যে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁও আছেন।
সম্ভাব্য হ্যাকিংয়ের জন্য টার্গেট করা ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বরের ডেটা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর এই অনুসন্ধান শুরু হয়। এটি এগিয়েছে চারটি ধাপে: ডেটাবেসের তথ্য যাচাই এবং টার্গেটদের শনাক্ত করা; সহযোগী নিউজরুমগুলোর মাধ্যমে তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের বিষয়টি জানানো এবং সাক্ষাৎকার নেওয়া; ভিকটিমদের ফোনের ফরেনসিক বিশ্লেষণ, যা পরে সিটিজেন ল্যাবও পর্যালোচনা করেছে; এবং এনএসও গ্রুপ এবং এর ১১টি সরকারি গ্রাহক নিয়ে অনুসন্ধান। তাদের জবাবের জন্য অনেক ফলোআপ কলও করা হয়েছিল।
রিগো ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “প্রথম ধাপের কাজে, আমরা আমাদের কাছে থাকা নম্বরগুলোর সঙ্গে জড়িত মানুষদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। সমান্তরালে চালিয়ে গেছি ডেটার তথ্য যাচাইয়ের কাজ। নিজস্ব কন্ট্যাক্ট বুক, অন্য সাংবাদিকদের কাছ থেকে পাওয়া কন্ট্যাক্ট তালিকা এবং ওপেন সোর্স ডেটা ব্যবহার করে আমরা যত বেশি সম্ভব নম্বর যাচাই করার চেষ্টা করেছি।”
বিশেষভাবে সাংবাদিকদের নিয়ে করা প্রতিবেদনগুলোর ক্ষেত্রে রিপোর্টাররা এই আক্রমণের প্রেক্ষাপটও দেখার চেষ্টা করেছেন: যেমন, কাদের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেছেন, এবং কোন সময়ে তাঁরা হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন।
ফাঁস হওয়া তথ্যের ফ্যাক্টচেকিং
অনুসন্ধানটি শুধুই একটি ফোন নম্বরের লম্বা তালিকা নিয়ে শুরু হয়েছিল। এখানে কোনো নাম বা প্রেক্ষাপট ছিল না।
অনুসন্ধানী দলটি ফাঁস হয়ে যাওয়া এই ডেটার সোর্সের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি নিরাপত্তাজনিত ও আইনি কারণে। পাল্টা নজরদারির ঝুঁকি এতই বেশি যে, ঠিক কোন সময়ে এই অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল, সেটিও বলতে রাজি হননি রিগো। কারণ, তাঁর আশঙ্কা যে, এই টাইমলাইন প্রকাশিত হয়ে গেলে সেটি ধরেই সোর্সের সন্ধানে নামতে পারে সরকারি গোয়েন্দারা।
তবে ফরবিডেন স্টোরিজের এই অনুসন্ধানী দল ১৬টি সহযোগী সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ এবং জোটবদ্ধ হয়ে কাজ শুরুর আগে মাসের পর মাস ধরে এই ফাঁস হয়ে যাওয়া ডেটার সত্যতা যাচাই করেছে।
“একটি বড় ব্যাপার ছিল: বিশ্বস্ত ও মেধাবী সহযোগী বেছে নেওয়া। এটি হতে হতো এমন এক স্বপ্নের দল, যারা নির্দিষ্ট অঞ্চলে নির্দিষ্ট কিছু দক্ষতায় পারদর্শী,” বলেছেন রিচার্ড। “সহযোগিতামূলক সাংবাদিকতার চেতনা সত্যিই একটি নতুন বিষয়। একা একা সব কাজ করার বদলে এখানে আপনাকে প্রতিদিন কী জানছেন, তা শেয়ার করতে হয়। কারণ, এমনটি না করলে এটি কাজ করবে না।”
ফাঁস হয়ে যাওয়া ফোন নম্বরের মালিকদের খুঁজে বের করার জন্য রিপোর্টাররা সেই নম্বরগুলোতে ফোন দিতে পারেননি। তার বেশ কিছু কারণ ছিল। একটি হলো: আগে থেকেই জানা ছিল যে, এই ফোনগুলো নজরদারির আওতায় আছে। আরেকটি কারণ হলো: কিছু ফোন নম্বর হয়তো সত্যিই কোনো সন্ত্রাসী বা অপরাধী গোষ্ঠীর সদস্যের।
এর বদলে অনুসন্ধানী দলটি আগে পেগাসাস টার্গেটের শিকার—এমন ফোন নম্বরগুলোর সঙ্গে এই ফাঁস হয়ে যাওয়া তালিকাটি মেলাতে শুরু করেন। আগে এ ধরনের ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল সিটিজেন ল্যাব এবং অন্য কিছু সিভিল সোসাইটি ওয়াচডগ প্রতিষ্ঠান।
“আমরা তালিকাটি মিলিয়ে দেখেছি অন্য ঘটনাগুলোর সঙ্গে; হোয়্যাটসঅ্যাপ দুর্বলতার শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে উন্মুক্ত প্রতিবেদন থেকে। সেখান থেকে আমরা আরও নতুন তথ্য পেয়েছি,” বলেছেন রিচার্ড। “এসব হামলার ব্যাপারে ভিকটিমদের সতর্ক করার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক সৃজনশীল পন্থার আশ্রয় নিতে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে, আমরা এমনকি যোগাযোগ না করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ, সেটি করার কোনো সুরক্ষিত উপায় ছিল না।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা এরপর কিছু ভিকটিমকে রাজি করাই তাদের ফোনের কন্টেন্ট নিরাপদ উপায়ে শেয়ার করার জন্য। এবং প্রায় সব ক্ষেত্রেই, পেগাসাস হামলার পর থেকে আইফোনে কোনো পরিবর্তন আনা না হলে সেখানে স্পাইওয়্যার আক্রমণ বা আক্রমণের চেষ্টার পদচিহ্ন পাওয়া গেছে।”
হ্যাকিং নিয়ে রিপোর্টিংয়ের কয়েকটি টিপস
- এটি মাথায় রাখুন যে, কোনো এনক্রিপশন টুলই পেগাসাস আক্রমণ থেকে শতভাগ সুরক্ষা দিতে পারে না। তবে তাই বলে প্রয়োজনীয় নজরদারি-সংক্রান্ত অনুসন্ধান চালানো বন্ধ করে দেবেন না বা ভয় পাবেন না।
- পেগাসাস সবকিছু ক্রমাগত আর্কাইভ করে রাখার মতো কোনো টুল নয়। এটি বরং কাজ করে তাৎক্ষণিক আড়ি পাতার ব্যবস্থা হিসেবে। আমাদের অনুসন্ধানী দল দেখেছে: ডিজঅ্যাপিয়ারিং ম্যাসেজ অপশন চালু করা এই ঝুঁকি কমানোর (রুখে দেওয়ার নয়) একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। এনক্রিপ্টেড সিগন্যাল অ্যাপে ডিজঅ্যাপিয়ারিং ম্যাসেজের জন্য ডিফল্ট টাইমার ব্যবহার করুন। এখানে ৩০ সেকেন্ড পর বার্তাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে যায়। এবং এমন অপশনও সেট করা যায়, যেখানে বার্তাগুলো মুছে যাবে মাত্র এক সেকেন্ড পর। যেখানে সম্ভব, সেখানে সামনাসামনি বৈঠকের ব্যবস্থা করুন, এবং আপনার ফোনটি বাড়িতে রেখে আসুন।
- এই বিষয়ে কাজ করতে গেলে আপনাকে কী ধরনের পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে, সে সংক্রান্ত ধারণা পাওয়ার জন্য পড়ুন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের “হাউ টু ক্যাচ পেগাসাস” ফরেনসিক রিপোর্ট এবং ফরেনসিক আর্কিটেকচারের ম্যাপভিত্তিক ডিজিটাল ভায়োলেন্স প্ল্যাটফর্ম। কারিগরি দিকনির্দেশনার জন্য অ্যামনেস্টির সিকিউরিটি ল্যাব বা ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর সিটিজেন ল্যাবের মতো বিশেষজ্ঞ সিভিল সোসাইটি সংগঠনের সহায়তা নিতে পারেন। অ্যামনেস্টির উন্মুক্ত মোবাইল ভেরিফিকেশন টুলকিটের দিকে ইঙ্গিত করে রিচার্ড বলেছেন, “অ্যামনেস্টির সিকিউরিটি ল্যাব দুর্দান্ত কাজ করছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তারা এমন একটি টুল বানিয়েছে, যা দিয়ে আপনার ডিভাইসে স্পাইওয়্যারের সংক্রমণ শনাক্ত করা যাবে। এবং এটি তারা সবার সঙ্গে শেয়ার করেছে।”
- অনুসন্ধানের সময় যোগাযোগের জন্য কোনো অ্যান্ড্রয়েড চালিত ফোনের বদলে আইফোনের মতো কোনো আইওএস ডিভাইস ব্যবহার করুন। এটি বেশি সুরক্ষিত (এ নিয়ে কোনো দিকেই কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই), সে কারণে নয়; বরং এ কারণে যে, পেগাসাস আক্রমণের শিকার হলে আপনার সে ব্যাপারে জানার সুযোগ বেশি থাকবে। অ্যামনেস্টি যেমনটি বলেছে, “আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়: অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসের তুলনায় অ্যাপল আইওএস ডিভাইসে অনেক বেশি মাত্রায় ফরেনসিক পদচিহ্ন থেকে যায়।”
- তিন বা চার ধরনের ডেটা শনাক্ত করুন, যেগুলো আপনি সত্যিই সুরক্ষিত রাখতে চান। যেমন: সংবেদনশীল সোর্সের পরিচয়, কোনো প্রতিবেদনের কন্টেন্ট, প্রকাশনার তারিখ, এবং আপনার এই রিপোর্টিংয়ের কারণে কারা সত্যিই ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন। এই তথ্যগুলো আপনার অন্যান্য ফাইল ও তথ্যের চেয়ে আলাদা রাখুন। এগুলোর সুরক্ষার ব্যাপারে সৃজনশীলভাবে চিন্তা করুন। ভেরাক্রিপ্টের মতো ভালো এনক্রিপশন টুল দিয়ে এগুলো সুরক্ষিত রাখার কথা ভাবুন। তবে মাথায় রাখুন যে, দারুণ এসব টুলও অনেক সময় সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হতে পারে।
- ফোন আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে নজরদারির জন্য টার্গেট করাকে গুলিয়ে ফেলবেন না। সাইবার হামলা নিয়ে লেখার সময় ভাষার ব্যবহার নিয়ে সতর্ক হোন। “আক্রান্ত না হওয়ার পেছনে অনেক কারিগরি কারণ থাকতে পারে। ফলে ভাষা ব্যবহার নিয়ে সতর্ক থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ,” সতর্ক করে বলেছেন রিগো।
- অনুসন্ধানী প্রকল্প ও ব্যক্তিগত জীবনের জন্য ব্যবহৃত ডিভাইস ও অ্যাকাউন্টগুলো আলাদা করে ফেলুন। প্রকল্পের প্রথম সামনাসামনি মিটিংয়ে প্রতিবেদনের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলোর জন্য একটি করে সাংকেতিক শব্দ (কোড ওয়ার্ড) নির্ধারণ করে দিন। এবং নিশ্চিত করুন যেন, গবেষণার পর্যায়ে যোগাযোগের সময় এই সাংকেতিক শব্দগুলোই সবাই ব্যবহার করে।
- যদি ভিডিওর মাধ্যমে যোগাযোগ করার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে জিটসি ব্যবহার করুন। সাধারণভাবে, সম্ভব হলে বাণিজ্যিক টুলগুলোর ব্যবহার এড়িয়ে যান। রিচার্ড বলেছেন, “যোগাযোগের জন্য জিটসি খুবই ভালো টুল। ওপেন সোর্স প্রযুক্তির টুল বেছে নেওয়ার পেছনে দর্শনটি হলো: আপনি অন্তত দেখতে পারবেন যে এখানে কোন কোড ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। আরও যে একটি জিনিস আপনি দেখতে পারবেন, তা হলো: এই প্রযুক্তির মালিক কোন অঞ্চলে বাস করেন।”
আরও দেখুন, জিআইজেএন-এর এই প্রতিবেদন: হাউ টু আনকভার সার্ভেইলেন্স টেক ইওর গভর্নমেন্ট বাই।
নজরদারি নিয়ে সহযোগিতামূলক প্রকল্প কিভাবে আরও উন্নত করা যায়: পার্টনারদের দৃষ্টিভঙ্গি
এই প্রকল্পের ১৬টি মিডিয়া পার্টনারের মধ্যে ছিল গার্ডিয়ান, অয়্যার এবং অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি)।
সার্কেলস ও সেলেব্রোর মতো অন্যান্য সরকারি নজরদারি ব্যবস্থা ব্যক্তিমানুষের জন্য কিছু ক্ষতিকর ঝুঁকি তৈরি করছে। সেই সঙ্গে পেগাসাস স্পাইওয়্যারের ক্রমশ সর্বব্যাপী হয়ে ওঠা আলাদা ধরনের ঝুঁকি তৈরি করেছে। ওসিসিআরপি তার পাঠকদের এ ব্যাপারে সতর্ক করেছে এই সারমর্মে: “পেগাসাসের মাধ্যমে, বিশ্বের দুর্নীতিপরায়ণ ও অস্থির শাসকেরা তাদের ইচ্ছেমতো যে কারও ব্যাপারে অনেক ব্যক্তিগত তথ্য জেনে যেতে পারে।”
ওসিসিআরপি-র সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড্রিউ সুলিভান বলেছেন, “পেগাসাস প্রজেক্টের কাজ বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং ছিল; কারণ, আমরা যে ধরনের সফটওয়্যার নিয়ে রিপোর্টিং করছি, তার বৈশিষ্ট্যের কারণে। এটি প্রতিটি ফোনকেই আমাদের শত্রু বানিয়েছিল।
সুলিভান বলেছেন, “কঠিন পরিবেশের মধ্যে একটি সহজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভালো কাজ করেছে” ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। কিন্তু তিনি এ বলেও সতর্ক করেছেন যে, ভবিষ্যতে পেগাসাসের মতো হুমকি মোকাবিলার জন্য আরও ভালো ভালো টুল এবং সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন পড়বে।
“অন্য মানুষের প্রজেক্টে কাজ করার জন্য যোগ দেওয়ার অর্থ: আপনাকে তাদের টুল ব্যবহার করতে হবে। এটি বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে। যদি মনে করেন, আপনার টুল আরও ভালো কাজ করে। কাজগুলো ঠিকঠাক করার জন্য আমাদের যে টুলগুলো দরকার, তার সবকিছু হাতে পেয়ে যাওয়ার জন্য কিছু সময় লাগবে,” বলেছেন সুলিভান।
এ বিষয়ে ভবিষ্যতের সহযোগিতামূলক প্রকল্পগুলোকে এসব মূলনীতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন সুলিভান:
- শুরুতেই সবাইকে কাজে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলুন। “এখানে একটা শিক্ষণ-প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং গ্রুপগুলো প্রায়ই অনেক দেরিতে মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার মতো ভুল করে,” বলেন সুলিভান।
- ব্যবস্থাটি খুব সহজ-সাধারণ রাখুন।
- একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে জোট বাঁধুন। এবং আপনার নিরাপত্তাগত ব্যবস্থা কেমন হবে, তা আগে থেকেই ঠিক করে রাখুন।
- বিশ্বাস করেন, এমন মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলুন এবং সম্পর্কটি গভীর করুন বেশ কিছু প্রকল্পে কাজের মাধ্যমে। সুলিভানের পরামর্শ: “রিপোর্টিংয়ের জন্য কোনো দেশ থেকে কাউকে প্রয়োজন বলে যেনতেনভাবে কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে কাজ শুরু করবেন না, যার সঙ্গে হয়তো আপনি আগে কখনো কাজ করেননি।”
- মিডিয়া পার্টনারদের সঙ্গে ক্রেডিট শেয়ার করা নিশ্চিত করুন। সুলিভান ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “এটি একটি সহযোগিতামূলক কর্মযজ্ঞ গড়ে তোলার মতো ব্যাপার। মানুষকে ক্রেডিট দিতে এবং তাদের খুশি রাখতে কোনো পয়সা খরচ হয় না।”
রিগো অবশ্য বলেছেন, ১১টি দেশে পেগাসাস হামলা নিয়ে অনুসন্ধান সরাসরি প্রমাণ করে না যে বিশ্বজুড়ে এটি পেগাসাস হামলার ক্ষেত্রে “হিমশৈলের চূড়া মাত্র”। তবে তিনি চিন্তা করার মতো একটি গুরুতর ভাবনা দিয়েছেন, “আমরা মাত্র ১১টি দেশ নিয়ে রিপোর্টিং করেছি। কিন্তু পেগাসাস জনসমক্ষেই জানিয়েছে যে ৪০টি দেশে তাদের ৬০ জন গ্রাহক আছে।”
আরও পড়ুন
হাউ টু আনকভার সার্ভেইলেন্স টেক ইওর গভর্নমেন্ট বাই
দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা সাংবাদিকদের জন্য বাড়তি ঝুঁকির জানান দিল পেগাসাস প্রজেক্ট
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএন-এর রিপোর্টার। দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসে কাজ করেছেন প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে। বিদেশী প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশ থেকে।