এডউই প্লেনেল, সাংবাদিকতার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন রাজনীতিকে। এই ফরাসি সাংবাদিক একসময় লা মঁদ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন। এখন তিনি ওয়েবভিত্তিক স্বাধীন অনুসন্ধানী জার্নাল মিডিয়াপার্টের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট। ১ নভেম্বর, দ্বাদশ গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের (#জিআইজেসি২১) উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি উপস্থিত ছিলেন অন্যতম বক্তা হিসেবে।
প্লেনেল ফরাসি সংবাদমাধ্যমের জগতে একজন আইকন হিসেবে বিবেচিত (টুইটারে তাঁর প্রায় ১০ লাখ ফলোয়ার আছে)। উদ্বোধনী অধিবেশনের পর তিনি জিআইজেএন-এর ফরাসি সম্পাদক মার্থে হুবিও-র সঙ্গে কথা বলেছেন (তাঁর নিজের ভাষায়) বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য মৌলিক কিছু পরামর্শ দেওয়ার জন্য। এই প্রতিলিপি ফরাসি থেকে অনুবাদ এবং সামান্য সম্পাদনা করা হয়েছে।
১. তথ্যের মূল্য রক্ষায় সচেষ্ট থাকুন
২০০৮ সালে মিডিয়াপার্ট যখন যাত্রা শুরু করে, তখনো কেউ ভাবেনি যে সাধারণ তথ্য দিয়েও অনলাইন থেকে টাকা নেওয়া যায়। সবাই ভাবতেন, ডিজিটাল প্রযুক্তিতে তথ্য বুঝি বিনা মূল্যেরই হতে হয়। কিন্তু এটি মেনে নেওয়ার মাধ্যমে গণমাধ্যম আসলে তথ্যের দামের ধারণায় নেমে আসা ধসকেও মেনে নিয়েছে। সুবিধা করে দিয়েছে বিনোদনের, যা এখন রূপ নিয়েছে মতামতের রাজত্বে, সংঘাতের বাগাড়ম্বরে, বিতর্ক ও টক শোতে এবং দলকানা অবস্থানে।
মানসম্পন্ন তথ্যের জন্য যে অনেক কাজ করতে হয় এবং এই কাজের যে একটি মূল্য আছে, এমন ধারণাকে রক্ষা করার জন্য আমরা সচেষ্ট থাকি। আমরা ধারণাটিকে রক্ষা করি এই বলে যে আমাদের দেওয়া তথ্য উপকারী, বিশ্বাসযোগ্য, মৌলিক এবং অপ্রকাশিত; এবং যেসব পাঠকের এই তথ্যের ওপর ভরসা আছে এবং যাঁরা এর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, তাঁরা আমাদের সমর্থন দিতে পারেন এর গ্রাহক হয়ে। আমার মতে, জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট সাংবাদিকতার অর্থ একটি বিশ্বাসের বন্ধন গড়ে তোলা, যেখানে এই ধারণাকে সমর্থন করা হবে যে: তথ্যের মূল্য আছে।
তথ্যের মূল্য আছে। তাই এটিকে অবশ্যই সমর্থন করতে হবে, সাবস্ক্রাইব করে বা অনুদান দিয়ে। আমার মনে হয়, এই মডেল বিশ্বের অন্যান্য অংশেও কাজ করবে। যেমন, আফ্রিকাতে, এখন সেখানে সরাসরি টেলিফোন সাবস্ক্রিপশনের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করা যায়। কোথাও হয়তো সংহতিসূচক সাবস্ক্রিপশন পদ্ধতিও থাকতে পারে। স্থানীয় ভাষার অনেক ছোট রেডিও স্টেশন এগুলো ব্যবহার করে।
আমাদের হাল ছাড়লে চলবে না। ১০ বছরের বেশি সময় আগে, ফ্রান্সে আমরা যখন যাত্রা শুরু করেছিলাম, তখন কেউই ভাবেনি যে এ রকম পেইড মডেল কাজ করবে। সবাই বলেছিল: “প্লেনেল পাগল! এটা কখনোই কাজ করবে না। ইন্টারনেটে তথ্য বিনা মূল্যেই পাওয়া যাবে।” কিন্তু এখন, আমরা পুরোপুরি লাভজনক একটি সংবাদপত্র কোম্পানি। ফ্রান্সের অন্য যেকোনো সংবাদপত্রের চেয়ে এর মুনাফার হার বেশি এবং কোনো রকম বিজ্ঞাপন বা ভর্তুকি ছাড়াই। আমরা পুরোপুরি নির্ভরশীল সাবস্ক্রাইবারদের ওপর। এই রাস্তাই সবার গ্রহণ করা উচিত, স্থানীয় পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে।
২. পাঠকদের সঙ্গে শক্তিশালী ও অনুভূমিক সংযোগ গড়ে তুলুন
আমাদের লোগোর অনুপ্রেরণাটি এসেছে ১৯ শতকের এক সংবাদপত্র বিক্রেতার ছবি থেকে, যিনি রাস্তায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মানুষকে সংবাদপত্র কিনতে বলছেন। অনলাইন মিডিয়ার জন্য এই লোগো বেছে নেওয়ার মাধ্যমে আমরা দেখাতে চেয়েছিলাম যে, আমাদের এই ঐতিহ্যকেই রক্ষা করতে হবে। সংবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এবং ডিজিটাল হরাইজন্টাল সার্কুলেশনের সব ধরনের কৌশল ব্যবহার করতে হবে। আপনাকে বাইরে গিয়ে চেঁচিয়ে খবর বলে বলে নতুন গ্রাহক বা সদস্য খুঁজতে হবে, এবং পাঠকদের সঙ্গে অংশীদারত্বের সংযোগ গড়ে তুলতে হবে। ডিজিটাল বিপ্লবের অর্থ হলো, আমরা এখন আর পাঠকগোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে নই। ওপরে দাঁড়িয়ে, নিচের দিকে তাকিয়ে পাঠকদের দেখার দিন শেষ। সম্পর্কটা আর আগের মতো উল্লম্ব নয় এবং পাঠকেরা এখন আমাদের প্রশ্ন করতে পারেন।
এ কারণে মিডিয়াপার্টকে দুটি ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো হয়েছে: একটি পেইড সংবাদপত্র এবং একটি ফ্রি অংশগ্রহণমূলক ক্লাব। আপনি যদি মিডিয়াপার্টকে সমর্থন করেন, তাহলে আমরা আপনাকে একটি প্ল্যাটফর্ম দেব, যেখানে আপনি আপনার অঙ্গীকার, লড়াই বা সতর্কতার বিষয়গুলো শেয়ার করতে পারবেন। এখানে আপনি সংবাদপত্রে প্রকাশিত লেখা নিয়ে আলোচনা করতে পারবেন, সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন। আমার বিশ্বাস, এই মৌলিকত্ব একটি শক্তিও বটে, যে কারণে আমরা পাঠক ধরে রাখতে পেরেছি।
এই ধরনের সংযোগ গড়ে তোলার জন্য নির্দিষ্ট কিছু পেশার মানুষ প্রয়োজন। পাঠক ধরে রাখার জন্য শুধু সাংবাদিকতা করে যাওয়া যথেষ্ট নয়। আমাদের এমন মানুষ প্রয়োজন, যাঁরা পাঠক ধরে রাখবেন। তাঁদের কাছে যাবেন। বোঝার চেষ্টা করবেন যে, কেন কেউ আনসাবস্ক্রাইব করেছেন, কেন তাঁরা এটি ছেড়ে দিলেন। আমাদের এই ধরনের বিপণনের কাজও করতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে: আমরা টাই, ফ্রিজ বা জুতা বিক্রি করছি না। আমরা খুবই নির্দিষ্ট একটি পণ্য বিক্রি করছি, যেটি গণতন্ত্র ও জনপরিসরের বিতর্কের জন্য উপকারী। এই বিষয়টিই আমাদের ব্যাখ্যা, প্রচার ও সমর্থন করতে হবে।
এখন আমাদের সংবাদপত্রে কাজ করেন ১২০ জন পূর্ণকালীন কর্মী। কিন্তু তাঁদের মাত্র অর্ধেক সাংবাদিক। বাকিদের কেউ কম্পিউটার বিজ্ঞানী; আবার কেউ আছেন যোগাযোগ, বিপণন, ব্যবস্থাপনা বা সাবস্ক্রাইবারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজে। কিন্তু কন্টেন্টের জগতে সবাই একই সংস্কৃতির মধ্যে আছি। আমরা এমন ধরনের কন্টেন্ট তৈরি করি, যেটি পেশাদার এবং যার গণতান্ত্রিক মূল্য আছে। এ ধরনের কন্টেন্টই পারে একটি স্বাধীন ব্যবসা তৈরি করতে, যেটি চাকরির সুযোগ তৈরি করবে এবং হয়রানি ঠেকাবে।
৩. সব বিষয়কে জনস্বার্থের আয়নায় দেখুন
মিডিয়াপার্টের শুরুর দিকে আমরা শুধু আর্থরাজনৈতিক বিষয়গুলোই কাভার করতাম। কিন্তু পাঠক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের পরিসরও বাড়িয়েছি। প্রতিবেদনের বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাদের একমাত্র শর্ত হচ্ছে: জনস্বার্থ। যেমন, আমরা খেলা কাভার করি না, কিন্তু আমরা একটি ফুটবল জগতের ফাঁস হওয়া ডেটা নিয়ে অনুসন্ধান করে দেখিয়েছি যে এত জনপ্রিয় একটি খেলাও কীভাবে অর্থের প্রভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠতে পারে। আমরা ফরাসি #মিটু আন্দোলন উসকে দিয়েছি রাজনৈতিক ও চলচ্চিত্রের জগতে।
এখন গণতন্ত্রপন্থী হওয়া মানেই চরমপন্থী হওয়া, গণতন্ত্রের মৌলিকত্বকে মেনে নেওয়া। আমার কাছে এটি হলো এমন এক সংস্কৃতি, যেখানে সবার ওপরে স্থান দেওয়া হয় সমতাকে। আমরা যদি এই সমতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে পারি, তাহলে সামাজিক শ্রেণিকাঠামোয় বৈষম্য এবং জন্ম, লিঙ্গ, বিশ্বাস বা ধর্মের সঙ্গে জড়িত অসমতার মতো বৈচিত্র্যময় অনেক বিষয়ের সুরাহা করা যাবে। সংবাদপত্র নাম ধারণ করা যোগ্য—এমন যেকোনো কিছুর জন্য জনস্বার্থই একমাত্র বৈধ অ্যাজেন্ডা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
৪. হতাশা আসবে, মেনে নিন
আমাদের কাজ সিসিফাস এবং ক্যাসান্ড্রা—দুজনের মতোই। কীভাবে সমাজকে সামনের দিকে নিয়ে যাব? আমি বলছি না যে: আপনাদের জন্য সমাধান নিয়ে হাজির হচ্ছি। কারণ, এই সমাধান হাজির করার কাজটি সমাজের। আমাদের কাজ হলো: সমাজকে চিন্তা করতে দেওয়া। আমাদের দায়িত্ব শিক্ষকের মতো, যিনি শিক্ষার্থীকে অ্যাসাইনমেন্ট দেন, শিক্ষার্থীরা সেটি নিয়ে চিন্তা করেন এবং সমস্যাটির সমাধান বের করার পথে এগিয়ে যান।
আমরা, সাংবাদিকেরাও একই কাজ করি: সমস্যাটি সামনে তুলে ধরি। এই দিক দিয়ে চিন্তা করলে আমরা ক্যাসান্ড্রার মতো। কারণ, টেবিলে খারাপ খবরটিই পরিবেশন করি। কিন্তু বলা হয়, এই খারাপ খবর থেকেই একটি উন্নত গণতন্ত্র তৈরি হবে, যদি আমরা এর মুখোমুখি হই ।
এখানেই ক্যাসান্ড্রা নিজেকে সিসিফাস হিসেবে খুঁজে পায়, যে একটি পড়ন্ত পাথরকেও চড়াই ঠেলে ওপরে নিয়ে যেতে চায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা প্রায়ই বিষণ্ন ও হতাশ হয়ে থাকি। বুরকিনা ফাসোতে “সিটিজেন ব্রুম” নামে একটি আন্দোলন হয়েছিল। তাদের একটি অনুসন্ধানের কারণে দেশটির প্রেসিডেন্ট [ব্লেজ] কোম্পাওহে-র কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের অবসান ঘটেছিল। সেই আন্দোলনের এক কর্মীকে উদ্ধৃত করছি: “আপনারা, সাংবাদিকেরা খরগোশ পেলে বড় করে যান, কিন্তু তাদের ধরার কাজটা সমাজেরই।”
আমাদের কোনো প্রতিবেদন নিয়ে সমাজে প্রতিক্রিয়া দেখলে আমরা খুবই খুশি হই। কিন্তু আমাদের কর্মকাণ্ডের সীমা আছে: আমরা সেটুকুই করি, যেটুকু করতেই হবে। কিন্তু পরিবর্তনের জন্য সেই সমাজ তৈরি কি না, তা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। এ জন্যই কখনো কখনো হতাশার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। মেনে নিতে হবে যে আমরা কোনো আধ্যাত্মিক পরামর্শদাতা নই, এই গণতান্ত্রিক জীবনের চরিত্রমাত্র। আর গণতান্ত্রিক জীবনধারা কেমন হবে, সেটি ঠিক করার আমরা কেউ নই।
৫. নিজেকে প্রশ্ন করে যান, জ্ঞান ছড়িয়ে দিন
আমাদের বর্তমান এই সময়টা খুব উগ্র ও সহিংস। এটি গণতন্ত্রের এমন এক পিছিয়ে যাওয়ার সময়, যেখানে রাজনৈতিক ও আর্থিক স্বার্থগুলো কোনো ধরনের স্বাধীনতা সমর্থন করে না। তাহলে প্রতিরোধ গড়বেন কী করে? উত্তরটি আছে, সম্মিলিত শক্তিতে। একক শক্তির জায়গা নিয়ে সংশয়ী হতে হবে। সাংবাদিক কোনো একক নায়ক নন। আর যদি তিনি এমনটি হয়েও ওঠেন, তাহলে ঝুঁকি থেকে যায় যে, তিনি নিজেই নিজের গল্পের নায়ক হয়ে উঠবেন। তিনি নিজেই প্রশ্ন করবেন এবং জবাব দেবেন। শেষ পর্যন্ত তিনি পৌঁছাবেন একধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক গর্ব বা ঔদ্ধত্যের দিকে, এমনকি সেটি যদি সদুদ্দেশ্যেও হয়। প্রতিরোধের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় কেবল সম্মিলিত সংহতিতে: এটি একা থাকার মতো পরিস্থিতি নয়। মিডিয়াপার্টে এই বিষয়টিই আমাদের এত শক্তিশালী বানিয়েছে। চাপের মুখে, কুৎসা, মিথ্যা প্রচারণার মুখে আমরা অন্ধের মতো আচরণ করি না। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি এবং সম্মিলিতভাবে কিছু ঠিক করি। আমরা নিজেদেরই জিজ্ঞাসা করি যে, কাজটি ঠিক করেছি, না ভুল। সব সময়ই বিষয়গুলোর মুখোমুখি হই একটি সম্মিলিত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে।
আমি মনে করি, অনুসন্ধানী এই প্রক্রিয়ায় আপনি যখন ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো করেন, তখন আপনার লেখাটি যিনি পড়বেন, তাঁরই প্রথম এগিয়ে আসা উচিত আপনার সাহায্যে। তিনি আপনার সহকর্মী। এই ধরনের সম্মিলিত যাচাইকরণ ব্যবস্থাই আপনাকে সুরক্ষা দেবে।
আমাদের এখানে ওয়ার্কমেট এবং সাংবাদিকদের নিজেদের মধ্যে সম্পাদনার একটি প্রক্রিয়া থাকে। সেগুলো উচ্চ পর্যায় থেকে (যে সম্পাদকেরা টেক্সটের পাঠযোগ্যতা ও বোধগম্যতা নিয়ে কাজ করেন) অনুমোদন নিয়ে আসা হয়। ফরাসি #মিটু আন্দোলন উসকে দেওয়া প্রতিবেদনগুলো প্রকাশের পর আমরা দুই বছর পরপর সংবাদমাধ্যমের আইন, হয়রানি ও যৌন সহিংসতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ আয়োজন করি। কারণ, একটি জার্নাল নিজেকে যেমনটি দাবি করে, সেটির চর্চা তার নিজের ভেতরেও থাকতে হয়। এ জন্য প্রয়োজন চলমান শিক্ষা। এই পেশার একটি সৌন্দর্য হলো: আমরা পাকাপাকিভাবে স্বশিক্ষায় চলতে থাকি। সাংবাদিকতায়, আপনাকে সব সময় শিখতে হবে। আপনি কখনোই একবারের মতো বলে দিতে পারবেন না যে, “আমি জানি।” আমাদের সব সময়ই শিখতে হবে।