চীন আরোপিত সেন্সরশিপ কাজে লাগিয়ে উইঘুরদের গোপন বন্দিশিবির নেটওয়ার্ক উন্মোচনের ঘটনাই সম্ভবত বছরের সবচেয়ে দুর্দান্ত অনুসন্ধানী কৌশল ছিল।
এই কাজের জন্য বাজফিড নিউজের দুই সহকর্মীর সঙ্গে পুলিৎজার পুরস্কার জিতেছেন ব্রিটিশ স্থপতি অ্যালিসন কিলিং। তাঁরা উন্মোচন করেন: চীনের বিভিন্ন বন্দিশিবিরে দশ লাখ মুসলিমকে তাদের ধর্মবিশ্বাসের জন্য কীভাবে আটকে রাখা হয়েছে। পুলিৎজার পুরস্কার গ্রহণের কয়েক মাস পর দ্বাদশ গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে (#জিআইজেসি২১) তিনি বলেছেন: চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত স্যাটেলাইট ছবির প্ল্যাটফর্মে মুছে ফেলা ডিজিটাল টাইলস ব্যবহার করে তাঁরা কীভাবে এসব গোপন স্থাপনার অস্তিত্ব উন্মোচন করেছেন।
এই অনুসন্ধানের জন্য জিওস্পেশাল বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করার অনেকগুলো কারণ বলেছেন কিলিং। সেগুলোর একটি ছিল: “আপনার সঙ্গে কথা বলবে—এমন সম্ভাব্য যেকোনো সোর্সকেই পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে এসব বন্দিশিবিরে।”
জিআইজেসি২১-এর “ম্যাপ ও স্যাটেলাইট ছবি দিয়ে অনুসন্ধান” শীর্ষক সেশনে এটি ছাড়াও স্যাটেলাইট ও ড্রোন ছবি নিয়ে কাজ করার আরও বেশ কিছু উদ্ভাবনী পথপদ্ধতির কথা বলেছেন তিন বক্তা। তাঁরা ব্যাখ্যা করেছেন: কীভাবে ওপেন সোর্স টুল ব্যবহার করে আকাশ থেকে মিথ্যা উন্মোচন করা যায়। (দেখুন স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার নিয়ে জিআইজেএন-এর গাইড)
চীনের বন্দিশিবিরগুলো লুকানো ছিল। কিন্তু নাইজেরিয়ার মাকোকো বস্তির মানুষেরা নীতি-নির্ধারকদের কাছে ছিল অদৃশ্য। লাগোসের কাছে একটি অগভীর হ্রদের ওপর বসবাস করা এই পুরো কমিউনিটি কোনো আনুষ্ঠানিক ম্যাপে জায়গা পায়নি।
অলাভজনক ওপেন ডেটা সংগঠন কোড ফর আফ্রিকার প্রজেক্ট ম্যানেজার জন ইরোমোসেলে বলেছেন, ড্রোন, ওপেন সোর্স টুল এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতা ছিল লাগোসের এই কমিউনিটিকে সবার সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে প্রধান উপাদান। অদৃশ্য হয়ে থাকার ফলে যারা বিদ্যুৎ, পানি বা এমনকি রাস্তার নামকরণের মতো আনুষ্ঠানিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল।
ম্যাপিং মোকোকো প্রকল্পে আমরা শুধু কারিগরি জ্ঞান নিয়েই যাইনি। আমরা সেখানকার কিছু ব্যক্তিকে এটি হাতেকলমে করতেও শিখিয়েছি। সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারাই ড্রোন উড়িয়েছে, এবং জায়গাটির ম্যাপিং করেছে,” বলেছেন ইমোরোসেলে। “আমরা একটি স্থানীয় শিক্ষামূলক এনজিওর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম; কারণ, কমিউনিটিভিত্তিক যেকোনো ডেটা প্রকল্প অবশ্যই মানুষকেন্দ্রিক হতে হয়। আমরা ড্রোন ব্যবহার করেছি এবং মাটিতে থাকা একটি দল কাজ করেছে কাস্টমাইজড ডেটা টুলকিট ব্যবহার করে।”
অবশ্যই, কিছু দেশের সরকার তারপরও সেসব বিষয় নিয়ে মিথ্যা বলে বা লুকানোর চেষ্টা করে, যেগুলো এতই বড় যে লুকিয়ে রাখা যায় না। যেমন, বিশাল আকারের ধোঁয়ার কুণ্ডলী, যেটি ব্রাজিলের আমাজন জঙ্গলে বড় ধরনের ক্ষতি করেছে। ২০২০ সালে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট, জাইর বোলসোনারো প্রথমে এই আগুনের ব্যাপকতা অস্বীকার করেছিলেন। তারপর আগুন ছড়িয়ে পড়ার জন্য দোষ চাপিয়েছিলেন এনজিও এবং আদিবাসী কমিউনিটিগুলোর ওপর।
জিআইজেসি২১-এর এই সেশনে, বিজ্ঞানভিত্তিক সাংবাদিকতার সংগঠন, অ্যাম্বিয়েন্টাল মিডিয়ার ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন দলের প্রধান, লরা কুর্টজবার্গ ব্যাখ্যা করেছেন: কীভাবে সহযোগিতামূলক স্মোক স্ক্রিন প্রজেক্টের মাধ্যমে, স্যাটেলাইট ডেটার সতর্ক বিশ্লেষণ করে তাঁরা প্রমাণ করেছেন: আমাজনে বন ধ্বংস হচ্ছে বড় আকারের ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গাগুলোতে এবং আগুন বিপর্যয়ের জন্য তারাই দায়ী।
“আমরা দেখেছিলাম যে, ২০১৯ সালে সবচেয়ে বেশি আগুন লাগার ঘটনা দেখা গেছে চারটি মিউনিসিপ্যালিটিতে। এবং এসব জায়গার ৭২ শতাংশই মাঝারি থেকে বড় ব্যক্তিমালিকানার অধীনে আছে। ২০২০ সালেও একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে,” বলেছেন কুর্টজবার্গ।
কিলিং ও তাঁর সহকর্মীরা চীনের বাইদু টোটাল ভিউ প্ল্যাটফর্মে কিছু সেন্সর করা টাইলস খুঁজে পেয়েছিলেন। এরপর আরও খোঁজাখুঁজি করে তাঁরা এমন আরও কয়েক শ সেন্সর করা টাইলসের সন্ধান পান। সেগুলোকে তাঁরা পরবর্তীকালে শনাক্ত করেন মুসলিমদের জন্য নির্মিত গোপন বন্দিশিবির হিসেবে।
“গোপন এই জায়গাগুলো ম্যাপিং করা, এবং গুগল আর্থের মতো অন্যান্য স্যাটেলাইট ছবির প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার মাধ্যমে বুঝতে পারি, আমরা চীনজুড়ে এমন বন্দিশিবিরের নেটওয়ার্ক উন্মোচনের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি,” বলেছেন কিলিং।
স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে রিপোর্টারদের সৃজনশীল সমাধান খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন কিলিং। ফাঁকা জায়গা পূরণের জন্য চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে বন্দিশিবিরের সাম্প্রতিক কোনো ছবি গুগল আর্থে পাওয়া যায়নি। তখন কিলিংয়ের দল ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির প্ল্যাটফর্ম, সেন্টিনেলহাব প্লেগ্রাউন্ডে খোঁজ করেছে সাম্প্রতিক হালনাগাদ ছবি পেতে। সেখানে তাঁরা কম রেজল্যুশনের তেমন ছবি পেয়েও যান।
সেন্টিনেলহাবের ছবিগুলোতে গাড়ি আকারের কোনো বস্তু দেখানো হয়েছে একটিমাত্র পিক্সেল দিয়ে। তাঁরা সেই ছবিগুলোতে থাকা ভবনের আকৃতির মতো প্যাটার্নগুলো গুগল আর্থের ভালো রেজল্যুশনের ছবির সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং বন্দিশিবিরের অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছেন।
আর, যেখানে ওপেন সোর্স ডেটা পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না, সেসব ক্ষেত্রে কিলিংয়ের দল যোগাযোগ করেছে বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট ডেটা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মিডিয়া দলের সঙ্গে।
আমরা প্ল্যানেট ল্যাবসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। সংবাদমাধ্যমের জন্য তাদের একটি প্রকল্প আছে। তারা সদয়ভাবে আমাদেরকে তাদের খুব ভালো রেজল্যুশনের হালনাগাদ ছবিগুলো দেখতে দিয়েছে,” বলেছেন কিলিং।
এরিয়াল ছবি ব্যবহার করে অনুসন্ধানের জন্য পরামর্শ
- জটিল কোনো স্যাটেলাইটভিত্তিক অনুসন্ধান, যেখানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোনো জায়গার দৃশ্য পরিবর্তন লক্ষ করতে হবে—এমন ক্ষেত্রে ব্রাউজার ভার্সনের বদলে গুগল আর্থের ডেস্কটপ ভার্সন ব্যবহার করুন।
- স্যাটেলাইট ছবিতে ভবনের অস্তিত্ব যাচাই করার জন্য, আশপাশের এমন বস্তুগুলো খেয়াল করুন যেগুলো মানুষের প্রয়োজন হবে ভবনগুলো ব্যবহারের জন্য। যেমন, কিলিং জানিয়েছেন: স্থানীয় কোনো রাস্তার পাশে বা ঝোপঝাড়পূর্ণ জায়গায় একটি অস্থায়ী পার্কিংয়ের জায়গা, চীনা বন্দিশিবিরের একটি ভালো নির্দেশক হয়ে উঠেছিল। স্থানীয়ভাবে নিরাপত্তাজনিত কারণে এবং বন্দিশিবির নির্মাণের দ্রুতগতির ফলে প্রায়ই এসব নির্মাণ প্রকল্পে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো পার্কিংয়ের জায়গা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বাস, গার্ড টাওয়ার, শরীরচর্চার জায়গা এবং কড়া লাল জাম্পসুট পরে কিছু মানুষের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা—এগুলো সবই ছিল বন্দিশিবির খুঁজে পাওয়ার উপকারী নির্দেশক।
- কোনো বস্তুর আকার হিসাব করার জন্য ওবিলিক স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করুন। বাজফিড দল এসব অ্যাঙ্গেল ব্যবহার করে বন্দিশিবিরের মেঝের ব্লক গণনা করেছিলেন। যা থেকে তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, পুরো ক্যাম্প নেটওয়ার্কে ১০ লাখ ১৪ হাজার বন্দি ধারণ সম্ভব।
- স্যাটেলাইট ডেটা রেন্ডার করার জন্য ম্যাপিং প্ল্যাটফর্ম, ম্যাপবক্স স্টুডিও ব্যবহার করুন। “ম্যাপবক্স একটি পর্যায় পর্যন্ত বিনা মূল্যেই ব্যবহার করা যায়। সাংবাদিকদের শুরু করার জন্য এটি খুবই ভালো ব্যাপার। এখানে অনেক ইন্টারঅ্যাকটিভ ফিচার পাবেন। আরস্টুডিও-ও খুব কার্যকর একটি টুল এবং এটি পুরোপুরি বিনা মূল্যে পাওয়া যায়,” বলেছেন কুর্টজবার্গ।
- জিওস্পেশাল ডেটা বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহার করুন কিউজিআইএস। কুর্টজবার্গ বলেছেন: “আমি যেসব টুলের কথা বলতে চাই, কিউজিআইএস সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি পুরোপুরি ওপেন সোর্স। আর্কজিআইএস-এর মতো এটিও একটি ডেস্কটপ সফটওয়্যার। আমি সাংবাদিকদের এটি দিয়ে শুরু করার পরামর্শ দেব। টুলটি দিয়ে শুধু ডেটা বিশ্লেষণই নয়, আপনি এটি দিয়ে প্রতিবেদনের জন্য ম্যাপ বা ছবিও বানাতে পারবেন। এবং কাজ করতে পারবেন ভেক্টর ডেটা ও স্যাটেলাইট ছবি নিয়ে।”
- ফ্লোরিশ ভিজ্যুয়ালাইজেশন টুলের অ্যাডভান্সড ফিচারগুলো বিনা মূল্যে পাওয়ার জন্য আবেদন করুন। যেমন ফ্লোরিশ ফটো স্লাইডার দিয়ে আপনি আকাশ থেকে তোলা আগে-পরের ছবি দেখাতে পারবেন। “ফ্লোরিশ ও ডেটার্যাপারের মতো টুলগুলো দিয়ে আপনি স্যাটেলাইট ডেটা থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি করতে পারবেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে,” বলেছেন ইরোমোসেলে। “খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এবং নিউজরুমগুলো সহজেই এসব প্রিমিয়াম ফিচার বিনা মূল্যে পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারে।”
- হাই-রেজল্যুশন ছবির জন্য ড্রোন ব্যবহারের কথা বিবেচনা করুন। আফ্রিকানড্রোন-এর মতো অলাভজনক সংগঠনের কাছ থেকে দক্ষতা, নির্দেশনা বা ব্যয় কমানোর মতো বিষয়ে সহায়তা নিন। “ছাড়কৃত মূল্যে আপনি আফ্রিকানড্রোনের সঙ্গে পার্টনারশিপ করার চেষ্টা করতে পারেন। আমরা একটি প্রাইমারি স্কুলের মাঠে আমাদের ড্রোনগুলো পরীক্ষা করি এবং স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া আছে,” বলেছেন ইরোমোসেলে।
- স্যাটেলাইট ছবিতে থাকা পরিবেশগত বিষয়গুলো বোঝার জন্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে জোট বাঁধুন। যেমন, স্মোক স্ক্রিন প্রজেক্টের জন্য অ্যাম্বিয়েন্টাল মিডিয়া জোট বেঁধেছিল ব্রাজিলের ন্যাশনাল সেন্টার ফর মনিটরিং, আর্লি ওয়ার্নিং অব ন্যাচারাল ডিজাস্টার, এবং চিকো মেন্ডেস ইনস্টিটিউট ফর বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশনের সঙ্গে।
- স্যাটেলাইট ও ড্রোন ছবি প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যবহার করুন ওপেন সোর্স ওপেনএরিয়ালম্যাপ টুল। “আপনি যখন সব কটি ড্রোন ছবি একসঙ্গে জোড়া দিতে চাইবেন (বা জাভা ওপেনস্ট্রিটম্যাপে এক্সপোর্ট করতে চাইবেন), আপনাকে এটি প্রথমে ওপেনএরিয়ালম্যাপে পাঠাতে হবে। যেখান থেকে আপনি সহজে এটি সম্পাদনা ও এক্সপোর্ট করতে পারবেন,” বলেছেন ইরোমোসেলে।
এই সেশনের মডারেটর ছিলেন পুলিৎজার সেন্টার অন ক্রাইসিস রিপোর্টিংয়ের নির্বাহী সম্পাদক মেরিনা ওয়াকার গেভারা। তিনি বলেছেন, “সেশনের তিন বক্তার মতো অগ্রণী সাংবাদিকেরা ক্রমবর্ধমান এই অনুসন্ধানী ক্ষেত্রটি নিয়ে কাজ করছেন। তাঁরা স্যাটেলাইট ছবি, ম্যাপিং এবং অন্যান্য ডিজিটাল টুল ব্যবহার করে সেন্সরশিপকে অগ্রাহ্য করছেন। দুর্নীতি-অনিয়ম তুলে ধরছেন, এবং সেসব বিষয় সবার সামনে নিয়ে আসছেন, যেগুলো ক্ষমতাবান মানুষ ও প্রতিষ্ঠানগুলো লুকিয়ে রাখতে চায়।”