সম্পাদকের নোট: আমরা এখন দ্বাদশ গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে মিলিত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ১ থেকে ৫ নভেম্বর প্রথমবারের মতো শুধুই অনলাইনে আয়োজিত হচ্ছে সম্মেলনটি। গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক এবং এই সম্মেলনের ধারণা কোথা থেকে এসেছে, তা আমাদের সহকর্মীদের কাছে আবার তুলে ধরার এটিই ভালো সময় বলে মনে হয়েছে। বিশ শতকের শেষ নাগাদ বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের এক জায়গায় এনে নিজেদের মধ্যে জ্ঞান বিনিময়ের একটি সাদামাটা ধারণা থেকে জন্ম হয়েছিল জিআইজেএন-এর, যেটি এখন ছড়িয়ে পড়েছে ৮২টি দেশে, ২১১টি সদস্য সংগঠনে।
২০০০ সালের বসন্তে, ডেনমার্কের আরহুসে নিজ বাড়িতে অতিথি ব্র্যান্ট হিউস্টনের সঙ্গে ওয়াইন উপভোগ করছিলেন নিলস মুলভাদ। সেই বসন্তে তাঁরা আয়োজন করেছিলেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের এক সম্মেলন, যেখানে একশ-র বেশি সাংবাদিক এসেছিলেন আধুনিক অনুসন্ধানী কৌশল নিয়ে আলোচনার জন্য। সেখানে বিশেষভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল দ্রুত-বিকাশমান কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড রিপোর্টিংয়ের (সিএআর) দিকে। ওয়াইন খেতে খেতে এই আয়োজনের সফলতা উদযাপন করছিলেন মুলভাদ ও হিউস্টন।
হিউস্টন, নিজ এলাকা মিসৌরিতে সিএআর চর্চায় অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের অ্যাসোসিয়েশন, ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্স অ্যান্ড এডিটর্স পরিচালনা করতেন। আইআরই-র ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড রিপোর্টিং (নিকার) আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। ১৯৯৬ সালে মুলভাদ আইআরই-র একটি বুট ক্যাম্পে যোগ দেন, এবং তিনিও সিএআর-এর ঘোরে পড়ে যান। দেশে ফিরে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ডিকার [দ্য ড্যানিশ ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যানালিটিক্যাল রিপোর্টিং] এবং ব্যস্ত হয়ে পড়েন ইউরোপজুড়ে ডেটা সাংবাদিকতার প্রচার-প্রসারের কাজে। তাঁর বার্ষিক ইভেন্টগুলোতে তখনই আধা ডজন দেশের সাংবাদিকেরা অংশ নিতেন। তিনি এবং হিউস্টন তখন চিন্তা শুরু করেন ভবিষ্যৎ নিয়ে।
“পরেরবার আমরা পুরো বিশ্বকেই কেন আমন্ত্রণ জানাই না?” প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন হিউস্টন।
এ ধরনের একটি উদ্যোগের জন্য ভূমি তৈরিই ছিল। বিশ্বায়নের ফলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ছড়িয়ে পড়ছিল বিশ্বজুড়ে। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান এবং ইন্টারনেট-মোবাইল ফোনের ব্যাপক প্রসারের কারণে এটি আরও বেগবান হয়েছিল। তবে তখন পর্যন্ত, অনুসন্ধানকারীদের এই বাড়তে থাকা বৈশ্বিক কমিউনিটির জন্য কোনো সত্যিকারের, কেন্দ্রীয় মেলবন্ধনের জায়গা ছিল না। হিউস্টন ও মুলভাদও সংশয়ী ছিলেন যে, একা একা এবং প্রতিযোগিতার মধ্যে কাজ করার জন্য কুখ্যাত হিসেবে বিবেচিত অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা এমন একটি সম্মেলনের ডাকে আদৌ সাড়া দেবেন কি না।
ডিকার, আইআরই এবং ড্যানিশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস-এর সহায়তায় ২০০১ সালে মুলভাদ কোপেনহেগেনের সবচেয়ে বিখ্যাত হোটেলটি বুক করেন এপ্রিলের এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এবং আশা করতে থাকেন ভালো কিছুর। সেই সময়ের কথা স্মরণ করে হিউস্টন বলেন, “আমরা ধারণা করেছিলাম যে, কিছু মানুষ আসবে। কিন্তু আমাদের জানায় গলদ ছিল। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, এটি ছিল সঠিক সময়ের জন্য সঠিক একটি ইভেন্ট।”
সব মিলিয়ে ৪০টি দেশ থেকে ৩০০-র বেশি সাংবাদিক কোপেনহেগেনে এসেছিলেন টিপস-টুলস ও সহৃদয় মানুষের খোঁজে। সে সময় সম্মেলনটির মেজাজ ছিল একটি ধর্মীয় পুনর্জাগরণের মতো। পোড় খাওয়া সব অনুসন্ধানী সাংবাদিক এখানে এসে আবিষ্কার করেন যে, তাঁরা দুনিয়াতে একা নন। “অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের মধ্যে অনেক মিল আছে। তাঁরা কোথা থেকে এসেছেন, কী নিয়ে কাজ করেন, তা কোনো বিষয় না,” বলেন হিউস্টন, “সম্মেলনে তাৎক্ষণিকভাবেই সবার মধ্যে একটি বোঝাপড়া ও বন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। প্রথম দিনে অনেকেই এটি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে, কীভাবে মানুষজন উন্মুক্তভাবে জ্ঞান বিনিময় করছে। দ্বিতীয় দিনে এটিই হয়ে গিয়েছিল সর্বজনীন চর্চা।”
এমন সাদামাটাভাবেই শুরু হয়েছিল গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের যাত্রা। আজ ১ নভেম্বর থেকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দ্বাদশ আসর। প্রথমবারের মতো এটি আয়োজিত হবে অনলাইনে। বিগত বছরগুলোতে এসব সম্মেলনে অংশ ও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১৪০টি দেশের ৮ হাজারের বেশি সাংবাদিক। এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী ও ডেটা সাংবাদিকতার ব্যাপক প্রসারের ক্ষেত্রে। এখানে অংশ নিয়ে তাঁরা নিজেদের দক্ষতা বাড়িয়েছেন, দুর্দান্ত সব সহযোগিতামূলক প্রকল্প শুরু করেছেন এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বেশ কিছু সংগঠন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছেন।
মুলভাদ বলেন, “আমি কখনো কল্পনাই করিনি যে, এটি আজকের এই অবস্থায় রূপ নেবে। এখন এটিকেই আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচনা করি। এমনটি যে ঘটবে, তা আমরা সে সময় জানতামও না। এটি কীভাবে যেন হয়ে গেছে।”
প্রথম সম্মেলনের দুই বছর পর, দলটি দ্বিতীয় সম্মেলনেরও আয়োজন করে কোপেনহেগেনে। সে সময় ৯/১১ হামলা এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত দমনপীড়নের কারণে যাতায়াত করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তারপরও ৩০০ সাংবাদিক অংশ নিয়েছিলেন সম্মেলনটিতে এবং উত্তাপ-উত্তেজনাও ছিল আগের মতো। হিউস্টন ও মুলভাদ ভালোমতোই বুঝে যান যে, এসব দক্ষতা আদান-প্রদান, প্রশিক্ষণের ক্ষুধা, সহযোগিতার চেতনা—এসব কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। “দুই সম্মেলনের মাঝের সময়টিতেও সবাই একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে চেয়েছিলেন। এবং আমরা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম যে, এই নেটওয়ার্ক যেন সচল থাকে,” বলেছেন হিউস্টন। সেই লক্ষ্যে তাঁরা আনুষ্ঠানিক অ্যাসোসিয়েশন গঠনের জন্য সম্মেলনে একটি বৈঠক আয়োজন করেন এবং মূলনীতির খসড়া তৈরি করেন।
সংগঠিত হওয়ার এই বিবৃতিটি ছিল সাধারণ ও সোজাসাপ্টা: তাঁরা “স্বাধীন সাংবাদিকতার সংগঠনগুলোর এমন এক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবেন, যেটি সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী ও কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড রিপোর্টিংয়ের প্রশিক্ষণ দেবে এবং তথ্য শেয়ার করবে।” এই নতুন গ্রুপের লক্ষ্য হবে: সম্মেলন ও কর্মশালা আয়োজন করা; অনুসন্ধানী ও ডেটা সাংবাদিকতার সংগঠন গড়ে তোলা ও টিকিয়ে রাখা; সেরা চর্চাগুলোকে সমর্থন ও প্রচার করা; উন্মুক্ত নথিপত্র ও ডেটা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সহায়তা করা; এবং বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য রিসোর্স ও নেটওয়ার্কিং সেবার ব্যবস্থা করা।
এই নেটওয়ার্কের সদস্যপদ সীমিত শুধু অলাভজনক বা তাদের সমগোত্রীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য। কারণ, বাণিজ্যিক মিডিয়া অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও প্রশিক্ষণ, মেন্টরিং, দক্ষতা আদান-প্রদান ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অলাভজনক সংগঠনগুলোই এসব দক্ষতা-কৌশল বিশ্বজুড়ে প্রচারের ক্ষেত্রে বেশি কাজ করেছে।
সব মিলিয়ে, ২২টি দেশের ৩৫টি সংগঠন এই প্রতিষ্ঠাকালীন নথিতে স্বাক্ষর করে। এদের তিন ভাগের দুই ভাগই ছিল ইউরোপ থেকে। তবে এই গ্রুপে এমন অনেক সংগঠন ছিল, যারা বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। যেমন ব্রাজিল, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশন; ঘানা, ফিলিপাইন, নেপাল ও রোমানিয়ার রিপোর্টিং সেন্টার। এ ছাড়া ছিল হাতে গোনা কয়েকটি স্কুল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, গণমাধ্যম উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা এনজিও এবং সে সময়ের খুবই অল্প পরিচিত আন্তসীমান্ত সংগঠন, যার নাম আইসিআইজে। আইআরই এই প্রক্রিয়ায় অনেক অবদান রেখেছিল। কিন্তু তখনো এটির কোনো তহবিল, অনুদান বা কেন্দ্রীয় সংগঠন ছিল না।
তারা নিজেদের ডাকত গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক বা জিআইজেএন বলে।
সে সময় জিআইজেএন কাজ করত গ্লোবাল কনফারেন্স আয়োজনের সহায়ক ব্যবস্থা হিসেবে, যার শুরুটা হয়েছিল ২০০৫ সালের আমস্টারডাম কনফারেন্স থেকে। পরবর্তী সময়ে প্রতি ১৮ থেকে ২৪ মাস পর আয়োজিত হয়েছে এই সম্মেলন। ২০০৫ সালে আমস্টারডাম সম্মেলনটি আয়োজিত হয়েছিল ডাচ-ফ্লেমিশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (ভিভিওজে)-এর সৌজন্যে। এই সম্মেলনেও বিশ্বের কয়েক শ সাংবাদিক অংশ নিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে টরন্টোতে আয়োজিত সম্মেলনটির আয়োজক ছিল কানাডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব জার্নালিস্টস। ২০০৮-এ লিলেহ্যামারের সম্মেলনটি আয়োজন করেছিল নরওয়ের ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম অ্যাসোসিয়েশন (স্কুপ)। এবং ২০১০ সালে জেনেভায় সম্মেলনটি আয়োজন করে সুইস ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক।
জেনেভায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সম্মেলনের সময়, স্পষ্টই বোঝা যায় যে ইভেন্টটি আকার, আয়তন ও গুণগত মানের দিক থেকে অনেক বড় হয়েছে। এখানে ৮০টি দেশ থেকে অংশ নিয়েছিলেন ৫০০-র বেশি সাংবাদিক। অনেকেই এসেছিলেন তৃতীয় বা চতুর্থবারের মতো। হিউস্টন ও মুলভাদ যে বৈশ্বিক কমিউনিটির কথা কল্পনা করেছিলেন, তা এখন আক্ষরিক অর্থেই পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে। বাণিজ্যিক মিডিয়াগুলো যেখানে অর্থনৈতিক মন্দা ও বিজ্ঞাপন হারানোর দ্বিমুখী চাপের মুখে পড়েছিল, সে সময় জিআইজেএন-এর মেরুদণ্ড গঠনকারী অলাভজনক সংগঠনগুলোকে অনুসরণ করা হচ্ছিল বিশ্বজুড়ে। ২০০৭ সালে সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া অ্যাসিস্ট্যান্স-এর এক জরিপ থেকে ২৬টি দেশে এমন ৩৯টি অলাভজনক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কেন্দ্র শনাক্ত করা হয়। পরবর্তী পাঁচ বছরে সংখ্যাটি দ্বিগুণের বেশি হয়েছে।
২০১০ সালে, হিউস্টন ও মুলভাদ জিআইজেএন-এর একটি অনানুষ্ঠানিক পরিচালনা পর্যদ তৈরি করেন। এটি ছিল একটি স্বেচ্ছাসেবামূলক গ্রুপ, যারা এই নেটওয়ার্কের ক্রমবর্ধমান নানা চাহিদা মেটাতে সহায়তা করবে। সম্মেলনের আয়োজকদের অর্থ সংগ্রহ এবং ভালো সাংবাদিক খুঁজে বের করার জন্য সাহায্য প্রয়োজন ছিল। বিভিন্ন প্রতিবেদন ক্রমেই সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে যেতে শুরু করায় রিপোর্টাররা জানতে চাইছিলেন যে কীভাবে অন্যান্য মহাদেশের সাংবাদিক সহকর্মীদের কাছে পৌঁছানো যায়। হতাশ হয়ে পড়া সম্পাদকেরা জানতে চেয়েছেন: কীভাবে তাঁদের নিজস্ব অলাভজনক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা যায়। অন্য অনেকে বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নিতে চাইতেন সাম্প্রতিক সব কৌশল-পরামর্শ জানার জন্য। এবং একসময়ের উদ্ভাবনী পার্শ্ব-প্রদর্শনী, ডেটা সাংবাদিকতা হয়ে উঠেছে অন্যতম আকর্ষণ। বৈশ্বিক সম্মেলনের প্রশিক্ষকেরা কম্পিউটারে পারদর্শী একটি নতুন প্রজন্ম তৈরি করেছেন, যেটির চাহিদা এখন আকাশচুম্বী।
বৈশ্বিক সম্মেলনে অংশ নেওয়া অভিজ্ঞদের কাছে এটি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে যে, আরও বেশি কাঠামোবদ্ধ একটি সংগঠন থেকে বৈশ্বিক সম্মেলন এবং বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক—দুই-ই লাভবান হবে। ফলে ২০১১ সালে হিউস্টন, মুলভাদ এবং অন্যদের সমর্থন নিয়ে আমি একটি সেক্রেটারিয়েট গঠনের প্রস্তাব দিই, যেটি জিআইজেএন-এর কাছে আসা বিভিন্ন অনুরোধ নিয়ে কাজ করবে, বৈশ্বিক সম্মেলনে সহায়তা দেবে এবং বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে আরও শক্তিশালী করার মূল মিশনটি সামনে নিয়ে যাবে। ২০১১ সালের অক্টোবরে ইউক্রেনের কিয়েভে অনুষ্ঠিত সপ্তম বৈশ্বিক সম্মেলনে জিআইজেএন সদস্য সংগঠনের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শেষে একটি অস্থায়ী সেক্রেটারিয়েট গঠনের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর যাত্রা শুরু হয় ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
আমাকে এই নতুন উদ্যোগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সম্মান দেওয়া হয়। অ্যাডেসিয়াম ও ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন থেকে পাওয়া ৩৫ হাজার ডলারের প্রাথমিক তহবিল নিয়ে, আমরা এক বছর ধরে নানাবিধ মাঠপর্যায়ের কাজ করি: তৈরি করা হয় একটি ওয়েবসাইট, যেখানে ছিল ব্যাপক রিসোর্স, একটি বৈশ্বিক ক্যালেন্ডার এবং বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নানান খবরাখবর। এ ছাড়া বেশ কিছু নেটওয়ার্ক এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়। এবং জিআইজেএনকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার নেটওয়ার্কের বাইরে সত্যিকারের বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে পরিণত করার একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। আমাদের এসব উদ্যোগ বড় প্রণোদনা পায় ২০১৩ সালে, রিও ডি জেনিরোতে আয়োজিত বৈশ্বিক সম্মেলনে। যেখানে নবগঠিত এই সেক্রেটারিয়েট জোট বাঁধে ব্রাজিলের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অ্যাসোসিয়েশন, আবরাজির সঙ্গে। তাদের হাত ধরে প্রথম সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় উন্নয়নশীল বিশ্বে। আমাদের সম্মেলনটি সংযুক্ত করেছিলাম আবরাজির বার্ষিক কংগ্রেস এবং ল্যাটিন আমেরিকান ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্স (কোলপিন)-এর সঙ্গে। এবং এর প্রভাব আমাদের সবাইকেই অবাক করে। এই সম্মেলনে এক হাজার অংশগ্রহণকারীর আশা করেছিলাম। কিন্তু রিও সম্মেলনে নতুন রেকর্ড গড়ে ৯৩টি দেশ থেকে অংশ নিয়েছিলেন ১ হাজার ৩৫০ জন সাংবাদিক।
রিও কনফারেন্সে, জিআইজেএন-এর সদস্য সংগঠনগুলো আমাদের উদ্যোগ-তৎপরতাকে সমর্থনসূচক অনুমোদন দেয় এবং প্রায় সবার সম্মতির ভোটে সেক্রেটারিয়েটকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখানে সেক্রেটারিয়েটকে একটি স্থানে রাখার (অফিস বদল করার বিরোধী প্রস্তাবটি ভোটে হেরে যায়), এবং আমাকে তিন বছরের মেয়াদে জিআইজেএন-এর প্রথম নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এরপর, ২০১৪ সালের মে মাসে, জিআইজেএন-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ-আলোচনার পর, সদস্যরা আবারও ব্যাপকভাবে এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণের অনুমোদন দেন, যা থেকে জিআইজেএন-কে আরও বেশি কাঠামোবদ্ধ এবং প্রাতিষ্ঠানিক আইনি রূপ দেওয়া যায়। সেই সময়ে জিআইজেএন-এর কলেবর বেড়ে ৪৪টি দেশে সদস্য সংগঠনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৮। একটি অনলাইন নির্বাচনে, সদস্যদের ৯০ শতাংশের বেশি ভোট দেন জিআইজেএন-কে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধনের পক্ষে। এবং একটি পরিচালনা পর্যদ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেখানে ছয়টি ভৌগোলিক অঞ্চলের প্রতিনিধির উপস্থিতি থাকবে। তারই জের ধরে অনুষ্ঠিত হয় জিআইজেএন-এর প্রথম পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন। ১০টি দেশ থেকে ১৫ জন সাংবাদিক নিয়ে গঠিত এই পর্ষদের মাধ্যমে নেটওয়ার্কটি আরও আনুষ্ঠানিক পরিচালনা কাঠামো পায়।
বর্তমানে, জিআইজেএন-এর কর্মীরা কাজ করেন ২৩টি দেশ থেকে। এবং এটি প্রকাশিত হচ্ছে ১২টি ভাষায়। ২০১২ সালে যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ায় মাত্র ৮০০ ফলোয়ার ছিল, সেখানে এখন ২০টি প্ল্যাটফর্মে আমাদের আছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ফলোয়ার। এবং একটি ব্যস্ত ওয়েবসাইট, যেটি প্রতিদিন পড়েন ১৪০টি দেশের পাঠক। আমাদের সদস্যপদ বেড়েছে চার গুণ। এখন ৮২টি দেশে আছে আমাদের ২১১টি সদস্য সংগঠন।
সেক্রেটারিয়েট গঠনের পর থেকে, আমাদের কর্মীরা গোটা বিশ্ব থেকে আসা প্রায় ১২ হাজার সাহায্যের অনুরোধে সাড়া দিয়েছেন। আমরা একটি ব্যাপক ব্যবহৃত রিসোর্স সেন্টারও গড়ে তুলেছি, যেখানে হাজারো টিপশিট, ভিডিও, টিউটোরিয়াল এবং একশ-র বেশি রিপোর্টিং গাইড আছে। জিআইজেএন-এর এমন আরও দুটি গাইড এ সপ্তাহেই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। একটি সংঘবদ্ধ অপরাধ নিয়ে এবং অপরটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তথ্য যাচাই নিয়ে।
২০১৪ সালে আমরা ম্যানিলায় শুরু করেছিলাম এশিয়ার প্রথম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সম্মেলন। এরপর এই আইজেএশিয়া মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে কাঠমান্ডু ও সিউলে। ২০১৫ সালে নরওয়ের স্কুপের সঙ্গে জোট বেঁধে আমরা জিআইজেসি১৫-র জন্য প্রায় এক হাজার সাংবাদিককে এক জায়গায় করতে পেরেছিলাম। দুই বছর পরে উইটস জার্নালিজমের সঙ্গে কাজ করে প্রথমবারের মতো আফ্রিকায় আয়োজন করি আমাদের এই বৈশ্বিক সম্মেলন। জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত জিআইজেসি১৭-এ অংশ নিয়েছিলেন ১ হাজার ২০০ সাংবাদিক।
আমাদের সৌভাগ্য যে, মহামারি শুরুর ঠিক আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে আমরা জিআইজেসি১৯ আয়োজন করেছিলাম হামবুর্গে, নেটওয়ার্ক রিসার্চের জার্মান সহকর্মীদের সঙ্গে মিলে। আমরা জানতাম যে, বৈশ্বিকভাবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু এই সম্মেলনে যত সাড়া পেয়েছি, তা আমাদেরও অবাক করেছিল। জিআইজেসি১৯ ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘ জমায়েত। ১৩১টি দেশ থেকে এসেছিলেন ১ হাজার ৭৫০ জন। এর বাইরেও অপেক্ষমাণ তালিকায় থেকে গেছেন আরও ৪০০ জন। তাঁদের আগ্রহকে ধারণ করার মতো সক্ষমতা আমাদের আয়োজনে ছিল না।
ভবিষ্যতে কী আছে? আমরা কঠোর পরিশ্রম করছি এমন সব নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে ও ছড়িয়ে দিতে, যেগুলো বিশ্বজুড়ে উদ্যমী সাংবাদিকদের এক জায়গায় আনবে রিসোর্স, সক্ষমতা এবং একে অপরকে দিয়ে। আমরা বিশ্বজুড়ে এই ধরনের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার গ্রুপকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। জিআইজেএন-এর রিসোর্স, সাহায্যের অনুরোধে সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা বাড়ানো; এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার গ্রুপগুলোকে ব্যবসায়িক দক্ষতা, তহবিল সংগ্রহ এবং বৈচিত্র্যময় মুনাফার পথ তৈরির ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছি।
আমাদের কাজ করতে হচ্ছে এমন পরিস্থিতির মধ্যে, যেখানে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ওপর দমনপীড়ন চলছে। এমনকি যেসব দেশের ক্ষেত্রে আমরা ভেবেছিলাম যে, আমাদের সহকর্মীরা সেখানে সুরক্ষিত আছেন; সেসব দেশেও সংবাদমাধ্যম পড়েছে গুরুতর হুমকির মুখে। তবে একই সঙ্গে অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যমও ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। এবং এমন মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে, যাঁরা সামাজিক জবাবদিহি ও প্রগতিতে বিশ্বাস করেন এবং ভালো স্বাস্থ্যসেবা, সৎ পুলিশ এবং ব্যবসার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির ক্ষেত্রে ওয়াচডগ রিপোর্টিংকে আবশ্যক বলে বিবেচনা করেন। বর্তমানে অনেক দেশে এমন অনেক সাংবাদিক আছেন, যাঁরা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরও ভালো সব টুল ব্যবহার করে প্রভাব তৈরি করার মতো সাংবাদিকতা করছেন।
এই কথার যুক্তি হিসেবে আমাদের দ্বাদশ বৈশ্বিক সম্মেলনের চেয়ে ভালো নির্দেশক আর কিছু নেই, যেটি অনুষ্ঠিত হবে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। আমরা এখানে ১৪০টি দেশ থেকে ১ হাজার ৬০০ অংশগ্রহণকারীর উপস্থিতি আশা করছি। অনেক ধন্যবাদ আমাদের এই সম্মেলনের সহ-আয়োজক অস্ট্রেলিয়ার জুডিথ নেইলসন ইনস্টিটিউট ফর জার্নালিজম অ্যান্ড আইডিয়াজ, ছোট-বড় এক ডজন দাতা এবং জিআইজেএন-এর ১৬ সদস্য সংগঠনকে, যারা আমাদের সমর্থন দিচ্ছে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে।
এসব সম্মেলন এবং এগুলোতে আপনাদের অংশগ্রহণ আমাদের নতুন করে বিশ্বাস জুগিয়েছে যে কী করা সম্ভব। প্রতিদিন, আমরা প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পাই: কীভাবে আমাদের সহকর্মীরা দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং জবাবদিহির অভাব উন্মোচনে প্রভাব রাখছেন। এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ সেই দুই অগ্রণী ব্যক্তির কাছে, যাঁরা এক দশক আগে ওয়াইনের গ্লাস হাতে কল্পনা করেছিলেন যে কী করা সম্ভব।
“আমরা পরবর্তী পর্যায়ে চলে গেছি,” বলেন ব্রান্ট হিউস্টন। “আপনি জানবেন যে পরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন, যখন দেখবেন: মানুষ কল্পনাই করতে পারছে না যে আপনি কখনো ছিলেন না।”
লেখাটির আদি সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৫ সালে নরওয়ের লিলিহ্যামারে অনুষ্ঠিত নবম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের ম্যাগাজিনে। এখানে সেটি আমরা হালদানাগ করেছি। লেখাটির প্রথম প্রকাশের জন্য আমরা আমাদের সহযোগী নরওয়েজিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (এসকেইউপি)-র কাছে কৃতজ্ঞ।
ডেভিড ই. কাপলান গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক। তিনি এর আগে পালন করেছেন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস-এর পরিচালকের দায়িত্ব। কাজ করেছেন ইউ.এস. নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট-এর প্রধান অনুসন্ধানী প্রতিনিধি হিসেবে। তিনি দুই ডজন দেশ থেকে ৩৫ বছরের বেশি সময় ধরে অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন এবং একক বা যৌথভাবে ২৫টির বেশি পুরস্কার জিতেছেন।