সম্পাদকের নোট: প্রকাশিতব্য রিপোর্টার্স গাইড টু ইনভেস্টিগেটিং অর্গানাইজড ক্রাইম থেকে বেছে নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে একটি সিরিজ প্রকাশ করে যাচ্ছে জিআইজেএন। সম্পূর্ণ গাইডটি প্রকাশিত হবে নভেম্বরে, গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে। অধ্যায়টি অবৈধ পুরাকীর্তি পাচার ও তার বাণিজ্য নিয়ে। এটি লিখেছেন ডোনা ইয়েটস। তিনি মাস্ট্রিখ্ট ইউনিভার্সিটির অপরাধ আইন ও অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং ট্রাফিকিং কালচার প্রজেক্টের সদস্য।
পুরাকীর্তির অবৈধ ব্যবসা হলো আন্তর্জাতিক অপরাধের এমন একটি ধরন, যা ঐতিহ্যবাহী স্থান থেকে চুরি করা সামগ্রীর সঙ্গে বৈশ্বিক শিল্প বাজারের অভিজাত জগৎকে সংযুক্ত করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই যোগাযোগ গড়ে ওঠে সংগঠিত অপরাধের একটি বিস্তীর্ণ জালের মাধ্যমে। সৌন্দর্য এবং সামাজিক গুরুত্বের কারণে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার বাজারে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ থেকে সংগ্রহ করা পুরাকীর্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী সরিয়ে নিয়ে সেগুলোকে সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে হস্তান্তর করতে উৎসাহিত করে এই বাজার। আর এভাবে জাতীয় ঐতিহ্য রূপ নেয় ব্যক্তিগত পণ্যে। এর প্রভাবে অনেক পুরাকীর্তিসমৃদ্ধ দেশ পুরাকীর্তি পাচার ও বিপণনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে। এর উদ্দেশ্য হলো জনসাধারণের কল্যাণে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা। তবু চাহিদার কারণে জোগানের ক্ষেত্র তৈরি হয়; নতুন আবিষ্কৃত পুরাকীর্তির উচ্চ চাহিদা এবং সেগুলো পাওয়ার জন্য বৈধ পথের অনুপস্থিতি, অপরাধমূলক সরবরাহ লাইনের বিকাশ ঘটায়।
গ্রে মার্কেটে সংগঠিত অপরাধের থাবা
পাচার হওয়া পুরাকীর্তির চূড়ান্ত বাজারটি প্রকাশ্য এবং সবার জন্য উন্মুক্ত। পুরাকীর্তির ক্রেতারা মূলত শৌখিন সংগ্রাহক, সম্পদশালী এবং তাদের সামাজিক অবস্থানও উল্লেখযোগ্য। মর্যদাপূর্ণ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং জাদুঘরগুলোও এর অন্যতম ক্রেতা। মাদক ও অস্ত্রের কারবারিরা যেমন ঝুঁকি নেন, পুরাকীর্তির ক্রেতারা তেমন ঝুঁকি নিতে চান না। তাঁরা কোনো রকম আইনি ঝামেলার ভয় ছাড়াই নিরাপদে কেনাকাটা সারতে চান। তাঁরা পুরাকীর্তি কেনেন প্রদর্শনের জন্য। তাই এই বাজারের জন্য অপরাধী নেটওয়ার্কগুলো এমন এক সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যেখানে তারা পুরাকীর্তি পাচার করে, চুরির চিহ্ন মুছে ফেলে, অপরাধের প্রমাণ লুকায় এবং ক্রেতাদের অবিশ্বাস দূর করে তাদেরকে গ্রে মার্কেট (যেখানে নিয়মের মধ্যে থেকে অনুমোদিত পণ্য বিক্রি করা যায়) থেকে পণ্য কিনতে উৎসাহিত করে, যে বাজারে সংগঠিত অপরাধীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
পুরাকীর্তির অবৈধ বাণিজ্যের মূল্যমান বা আর্থিক আকার নির্ধারণ করা অসম্ভব এবং একইভাবে অন্যান্য চোরাচালান বা অবৈধ বেচাকেনার সঙ্গে এর তুলনা করাও সম্ভব নয়। এই বিষয় নিয়ে রিপোর্টিং বেশ নিম্নমানের এবং এর ফলে খরচের উৎসবিহীন হিসাব ক্রমাগতভাবে পত্রিকায় ছাপা হয়ে আসছে। এসব পরিসংখ্যান যে ভুল, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত। “মাদক ও অস্ত্রের পর সবচেয়ে বড় অপরাধমূলক বাজারের প্রতিনিধিত্ব করে পুরাকীর্তি”; যে দাবি জোরালোভাবে অস্বীকার করেছে এফবিআই এবং ইন্টারপোল, অথচ এরা প্রায়ই এই ধরনের মিথ্যা ভাষ্যের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। যৌথ ঐতিহ্য ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আমাদের সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিচয়ের যে ক্ষতি হয়, তার মধ্যেই এই বাণিজ্যের সত্যিকারের সামাজিক ক্ষতি নিহিত থাকে।
শিল্পকর্ম চুরি: চলচ্চিত্রের মতো নয়
পুরাকীর্তি পাচারের তুলনায় প্রতিষ্ঠান থেকে শিল্পকর্ম চুরির ঘটনা বিরল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে লাভের সুযোগও কম। পুরাকীর্তি পাচারের ক্ষেত্রে অপরাধমূলক কাজগুলো “চোরাই পণ্যের” বেনামি এবং অননুমোদিত স্বরূপের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়। এগুলো এমন পণ্য, যা হাজার হাজার বছর ধরে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল। বিপরীতে, জাদুঘর, গ্যালারি এবং ব্যক্তিগত আবাস থেকে চুরির সঙ্গে হলিউডি কায়দার শিল্পকর্ম চুরির কোনো মিল নেই। একটি বড় ভুল ধারণা আছে যে, “স্টিল টু অর্ডার”, অর্থাৎ ক্রেতার পছন্দমাফিক বা আদেশে “পেশাদার চোরেরা” জাদুঘর থেকে শিল্পকর্ম চুরি করেন। কিন্তু প্রায় প্রতিটি বড় ক্ষেত্রেই বাস্তবতা বেশ জাগতিক ও কঠিন, এবং চোরেরা এটাও বোঝে যে যথাযথভাবে নথিভুক্ত শিল্পকর্ম চুরি করে সেটি সহজে কোনো বাজারে বিক্রি করা যায় না। অনেক চুরি করা শিল্পকর্ম আবর্জনার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়, পুড়িয়ে ফেলা হয় বা ধ্বংস করা হয়, অথবা যে জাদুঘর থেকে সেগুলো চুরি করা হয়েছিল, সেখানে বেনামে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিছু শিল্পকর্ম চুরির ঘটনা সংগঠিত অপরাধ গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত, কিন্তু যেকোনো শিল্পকর্ম চুরির সঙ্গে সংগঠিত অপরাধের সম্পর্কের দাবি প্রশ্নবিদ্ধ। যাহোক, এই নিবন্ধের মূল বিষয় হলো পুরাকীর্তি পাচার। আর পুরাকীর্তি পাচার অনুসন্ধানের সূত্রগুলো শিল্পকর্ম চুরির ঘটনা অনুসন্ধানেও কাজে লাগবে।
সূত্র
লুন্ঠিত এবং পাচারকৃত পুরাকীর্তির উৎস প্রমাণ করা (প্রোভেনেন্স) কঠিন। তাদের উৎপত্তি, মালিকানার ইতিহাস এবং বাজারে আসা পর্যন্ত গোটা পথের বিবরণ সম্পর্কে বিস্তারিত প্রমাণের অভাব থাকে। প্রোভেনেন্স রিসার্চ হলো শিল্পজগতের একটি পরিভাষা, যার অর্থ হচ্ছে বিস্তৃত এবং অপ্রত্যাশিত বিভিন্ন সূত্র থেকে টুকরো টুকরো ডকুমেন্টেশন বা প্রমাণ সংগ্রহ করে এবং সাজিয়ে কোনো বস্তুর ইতিহাস অনুসন্ধান এবং পুনর্গঠন করা। এই ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রোভেনেন্স রিসার্চের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পাচার করা পণ্য সম্পর্কে লেখা মানে, প্রকৃত অর্থে, এই অপরাধের পেছনের কাহিনি উন্মোচন করা। প্রতিটি পুরাকীর্তি পাচার অনুসন্ধানের প্রতিটি ঘটনাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং ভৌগোলিক অঞ্চল ও ঘটনার বিবরণের ওপর নির্ভর করবে আপনার উৎস বা সোর্স কেমন হবে। তবু সবকিছু মিলিয়ে সোর্সের একটি নির্দিষ্ট ধরন স্পষ্ট হবে।
প্রথমত, পুরাকীর্তি হোক বা শিল্পকর্ম, এই অনুসন্ধানের কেন্দ্রে যে বস্তু, তা এমনিতেই জটিল। পুরাকীর্তি সম্পর্কে পুরোপুরি না জেনে, এর লুন্ঠন, পাচার এবং বিক্রির প্রেক্ষাপট অথবা সেই সব অপরাধের সামাজিক পরিণতি বোঝা অসম্ভব। এই ক্ষেত্রে কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য তথ্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারেন একাডেমিকরা। তারা তথ্যের দরকারি উৎসের দিকে ইঙ্গিত করতে পারেন, কানাগলিতে সময়ের অপচয় রোধ করতে পারেন এবং পুরাকীর্তির অবৈধ বাণিজ্য-সম্পর্কিত জ্ঞানের বিস্তৃত জালের সঙ্গে একজন অনুসন্ধানকারীকে সংযুক্ত করতে পারেন।
অনেক দেশে পুলিশ, কাস্টমস, সীমান্ত নিরাপত্তা এজেন্ট বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্স আছে, যাঁরা পুরাকীর্তি এবং শিল্প অপরাধ তদন্তে বিশেষজ্ঞ। এঁদের কেউ শুধু এই কাজই করেন, আবার কেউ আধা নিবেদিত, অর্থাৎ অন্যান্য কাজের সঙ্গে পুরাকীর্তি পাচারও দেখভাল করেন। এই ধরনের অফিস, ইউনিট এবং সেখানে কাজ করা ব্যক্তিরা অভিজ্ঞ হলেও, অর্থ এবং কর্মীর অভাবে অনেক সময় সবখানে পৌঁছাতে পারেন না। যেকোনো দেশে পুরাকীর্তি এবং শিল্প অপরাধ ইউনিটের বিবরণ সাধারণত ইন্টারনেট সার্চ করেই পাওয়া যায়। জেনে রাখা ভালো, শিল্পকর্ম এবং পুরাকীর্তি সংশ্লিষ্ট অপরাধ নিয়ে ইন্টারপোলের একটি ছোট ইউনিট রয়েছে। তবে এই ইউনিটের ভূমিকা নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝি দেখা যায়। ইন্টারপোল অপরাধ তদন্ত করে না, বা পুলিশি কার্যক্রম পরিচালনা করে না। এই ইউনিটের কাজ হলো, চুরি করা শিল্পকর্মের একটি ডেটাবেস রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং বিশ্বব্যাপী পুলিশ বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগের সুবিধা করে দেওয়া। যাহোক, এই ভূমিকার কারণেই তারা হয়তো কোনো নির্দিষ্ট দেশের বিশেষ পুলিশ কর্মকর্তাকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করতে পারে।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষায় কাজ করা এনজিওগুলো সাংবাদিকদের জন্যও সহায়ক হতে পারে, বিশেষ করে এমন পরিস্থিতিতে যেখানে আইনি বা নীতিগত জটিলতা আছে, অথবা এমন পরিস্থিতিতে যেখানে মাঠে গিয়ে রিপোর্ট করা কঠিন বা অনিরাপদ। প্রথম উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে অ্যান্টিকুইটিজ কোয়ালিশনের কথা। তারা নীতি-গবেষণার পৃষ্ঠপোষকতা করে এবং বিশ্বব্যাপী পুরাকীর্তি পাচার রোধে লবিং করে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। দ্বিতীয় উদাহরণ হলো স্পেনভিত্তিক হেরিটেজ ফর পিস। সংগঠনটি মূলত পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় পুরাকীর্তিকেন্দ্রিক তথ্য সংগ্রহ প্রকল্পে অর্থ সহায়তা দেয়। দেশ এবং অঞ্চলভিত্তিক ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলো আপনাকে আন্তর্জাতিক প্রত্নসামগ্রী পাচার সম্পর্কে প্রেক্ষাপটমূলক তথ্য দিতে পারে, যা অন্য অনেক উৎস থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। তারা প্রায় ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করতেও আগ্রহী হন।
প্রত্নকর্ম পাচারসংক্রান্ত যেকোনো তথ্যের সর্বোত্তম উৎস সংশ্লিষ্ট অংশীজনেরা। তাঁদের সাক্ষাৎকার থেকে আপনি অনুসন্ধানের জন্য দরকারি নথিপত্রের সুনির্দিষ্ট উৎসব সম্পর্কে জানতে পারবেন। এই অংশীজনদের মোটামুটি চারটি গ্রুপে ভাগ করা যায়:
- যেসব দেশ থেকে পুরাকীর্তি চুরি হয়েছে, সেই ঐতিহ্যবাহী স্থানের আশপাশে যাঁরা বাস করেন, স্থানীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ,ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ, পুলিশ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং সাংস্কৃতিক বস্তু চুরি করে এমন ব্যক্তি, যাঁদের “সোর্স” স্টেকহোল্ডার বলা হয়।
- শিপিং কোম্পানি, কাস্টমস এজেন্ট, মধ্যস্থতাকারী এবং পুরাকীর্তি দালালসহ অবৈধ পুরাকীর্তি চলাচলের পথের সঙ্গে জড়িত, “ট্রানজিট” স্টেকহোল্ডাররা।
- “মার্কেট” স্টেকহোল্ডার, অর্থাৎ যেখানে পুরাকীর্তি বেচাকেনার সঙ্গে যারা জড়িত, সেই নিলাম ঘরের কর্মচারী, আর্ট গ্যালারির কর্মচারী ও ডিলার, জাদুঘরের কর্মচারী এবং আর্ট কালেক্টর। এই লোকেরা বেশির ভাগ সময় সাংবাদিক ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলতে নারাজ থাকেন।
- “ফ্যাসিলিটেটর্স” হলো, যারা পরোক্ষভাবে সাংস্কৃতিক বস্তু বেচাকেনায় সহেযোগিতা করেন; যেমন, শিল্পকর্ম সংস্কার, সংরক্ষণ এবং দাম নির্ধারণকারী। এ ছাড়া আছে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার, যারা উৎসবিহীন সামগ্রী খাঁটি কি না, তা যাচাই করে; এবং শিক্ষাবিদ, যাঁরা ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা অনথিভুক্ত পুরাকীর্তি নিয়ে কাজ করেন। ফ্যাসিলিটেটরদের কাছে প্রায়ই সাংস্কৃতিক বস্তুর অবৈধ বাণিজ্য সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য থাকে, কিন্তু অনুসন্ধানকারীরা খুব কমই তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
নথি ও তথ্য
নথিপত্রের জন্য নিলামের ক্যাটালগ (অনলাইনে এবং কিছু গণগ্রন্থাগারে পাওয়া যায়), ডিলারশিপ রেকর্ড (সীমিত, কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু পাবলিক আর্কাইভে রাখা আছে) জাদুঘর অধিগ্রহণ রেকর্ড (কিছু সবার জন্য উন্মুক্ত এবং অনলাইনে পাওয়া যায়; এবং কিছু সংরক্ষিত থাকে কিন্তু সংশ্লিষ্ট জাদুঘরে যোগাযোগ করলে পাওয়া যেতে পারে), এবং শিল্পকর্ম ব্যবসার নিবন্ধন ও মালিকানা কাঠামো-সম্পর্কিত ফাঁস হওয়া দলিল ঘেঁটে দেখতে পারেন সাংবাদিকেরা।
চুরি করা শিল্পকর্মের বেশ কিছু ডেটাবেস আছে (যেমন এফবিআই ডেটাবেস, ইন্টারপোল ডেটাবেস, এবং ইতালীয় কারাবিনিয়ারি ডেটাবেস)। কিন্তু সমস্যা হলো, সাংবাদিকদের জন্য উপকারী তথ্য এখান থেকে পাওয়ার সুযোগ কম। পুরাকীর্তি পাচারের বেশির ভাগ ঘটনা ডেটাবেসে পাওয়া যায় না। এর বদলে বরং প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে আরও অনেক বেশি তথ্য পাওয়া যেতে পারে। অনুসন্ধানকে এগিয়ে নিতে আপনার যে ধরনের নথিপত্র দরকার, তাদের উৎস সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পাবেন এ ধরনের ব্যক্তির সাক্ষাৎকার থেকে।
কেস স্টাডি
পুরাকীর্তি লুট এবং পাচার সম্পর্কে সবচেয়ে কার্যকর কয়েকটি গবেষণার উৎস মূলত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। এসব অনুসন্ধান নিয়ে সাংবাদিকদের লেখা গুরুত্বপূর্ণ বইও রয়েছে। বইগুলো এই বিষয়সংক্রান্ত নীতি, চর্চা এবং পাঠে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।
- প্রয়াত কার্ল ই. মায়ার্সের ১৯৭৩ সালে লেখা বই “দ্য প্লান্ডার্ড পাস্ট”, এই সমস্যার ধ্বংসাত্মক বাস্তবতা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে।
- শিল্পকর্ম ব্যবসা এবং সংগঠিত অপরাধের মধ্যে সংযোগ তুলে ধরার ক্ষেত্রে পিটার ওয়াটসনের “দ্য কারাভাজিও কনস্পিরেসি” (১৯৮৪), “সোথবি’স’: দ্য ইনসাইড স্টোরি” (১৯৯৮), এবং “দ্য মেডিচি কনস্পিরেসি: দ্য ইলিসিট জার্নাল অব লুটেড অ্যান্টিকুইটিজ” বইগুলোর অবদান অনেক। নিলাম প্রতিষ্ঠান ও পুরাকীর্তি ডিলারশিপের ব্যবসায় ব্যাপক পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছে তার প্রকাশনা।
- ২০১১ সালের পুলিৎজার ফাইনালিস্ট, জেসন ফেলচ এবং র্যালফ ফ্র্যামোলিনোর রচনা “চেজিং অ্যাফ্রোডাইটি: দ্য হান্ট ফর লুটেড অ্যান্টিকুইটিজ অ্যাট দ্য ওয়ার্ল্ড’স রিচেস্ট মিউজিয়াম,” অভিজাত জাদুঘর, তাদের কর্মকর্তা এবং সংঘবদ্ধ অপরাধীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তুলে ধরেছে।
নিচের কেস স্টাডিগুলো এই বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক এবং চলমান সাংবাদিকতা প্রকল্পের উদাহরণ, যা প্রচলিত ভাবনায় পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।
হারানো শিবমূর্তি
নিউ ইয়র্কের পুরাকীর্তি বিক্রেতা সুভাষ কাপুরের নির্দেশে ২০০৬ সালে দক্ষিণ ভারতের একটি মন্দির থেকে হিন্দু দেবতা শিবের একটি অমূল্য ও ১১ শতকে তৈরি ব্রোঞ্জ মূর্তি চুরি হয়েছিল। ২০০৮ সাল নাগাদ মূর্তিটি বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শন করা হচ্ছিল। ওই বছরই অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল গ্যালারির কাছে ৫.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বিক্রি করা হয় মূর্তিটি। সঙ্গে ছিল দক্ষিণ এশিয়ার আরও অনেক পুরাকীর্তি। ২০১১ সালে কাপুরকে জার্মানিতে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পুরাকীর্তি পাচারের অভিযোগে বিচারের জন্য ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর শিল্পকর্ম কেনাবেচার জগতে তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন জেসন ফেলচ (ওপরে দেখুন)সহ একাধিক সাংবাদিক।
অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কাপুরের সংযোগের ব্যাপকতা স্পষ্ট হয়ে উঠলে, দ্য অস্ট্রেলিয়ানের সাংবাদিক মিশেলা বোল্যান্ড বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। এটি পরবর্তীকালে পুরাকীর্তি পাচারে অস্ট্রেলীয় জাদুঘরের ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা একটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রকল্পে রূপ নেয়। এই অনুসন্ধানে দুটি মূল বিষয় উন্মোচন করেন বোল্যান্ড: যে অবৈধ পথ ধরে দক্ষিণ এশিয়ার পুরাকীর্তিগুলো অস্ট্রেলিয়ার জাদুঘরে পৌঁছেছে, এবং সংগঠিত অপরাধের চূড়ান্ত-বাজার হিসেবে জাদুঘরের মতো একটি গণপ্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে যে অবকাঠামো। তার রিপোর্ট, দেশটির সাংস্কৃতিক খাতকে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছে। বোল্যান্ডের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে শিব মূর্তিটিকে ভারতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি বিষয়টি নিয়ে আরও কাজ করেন (অন্যান্য সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ এবং কর্মীদের সঙ্গে), এবং একাধিক অপরাধী চোরাচালান নেটওয়ার্ক উন্মোচন করেন। তাঁর কাজের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ান জাদুঘরে আরও কয়েকটি চুরি হওয়া পুরাকীর্তি শনাক্ত হয়, যার মধ্যে কিছু ফেরতও দেওয়া হয়েছে।
ল্যাটিন আমেরিকার চুরি হওয়া স্মৃতি
ল্যাটিন আমেরিকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো থেকে ধ্বংসাত্মক লুটপাট ভাবিয়ে তোলে পেরুর অলাভজনক সাংবাদিকতা সংগঠন ও জিআইজেএন সদস্য ওহোপুবলিকোর সাংবাদিকদের। আর অঞ্চলটিতে এই বিষয় নিয়ে কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাও হচ্ছিল না। এই ভাবনা থেকেই পুরাকীর্তির অবৈধ বাণিজ্য নিয়ে গভীর অনুসন্ধান শুরু করে ওহোপুবলিকো, যা পরে “মেমোরিয়া রোবাদা” (“চুরি হওয়া স্মৃতি”) নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। লেখা এবং ভিডিওর বিশাল সংগ্রহটি পাবেন একটি পাবলিক পোর্টালে, যদিও স্প্যানিশ ভাষায়।
রিপোর্টিংয়ের বাইরে, অবৈধ পুরাকীর্তি বাণিজ্য নিয়ে সাধারণ মানুষকে তাদের নিজস্ব গবেষণা পরিচালনার জন্য উৎসাহিত করেছে ওহোপুবলিকো। তারা তাদের ওয়েবসাইটে সার্চযোগ্য একটি ডেটাবেসও হোস্ট করেছে, যেখানে তাদের অনুসন্ধানের সময় সংগ্রহ করা বিপুল পরিমাণ তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া ইন্টারপোলের চুরি করা শিল্পকর্মের ডেটাবেস থেকে স্প্যানিশ ভাষায় তথ্য পেতে, তারা একটি আলাদা পোর্টালও তৈরি করেছে। এভাবে তারা ভাষার প্রতিবন্ধকতা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছে যেন চুরি হওয়া সাংস্কৃতিক বস্তু শনাক্তকরণ এবং পুনরুদ্ধারে জনসাধারণের অংশগ্রহণকে অনুপ্রাণিত করা যায়।
ওপরের উদাহরণটি বাদ দিলে, এই বিষয় নিয়ে যত গভীর প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই ইংরেজিতে। সাংস্কৃতিক পণ্য পাচারের তথ্যও এই ভাষাতেই লিপিবদ্ধ থাকে। এর ফলে, যেসব জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ঐতিহ্যগত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তাদের পক্ষে তথ্যগুলো খুঁজে পাওয়া বা পড়ার ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়তে পারে। “মেমোরিয়া রোবাদা” ভাষার এই বিভাজন দূর করার চেষ্টা করেছে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য পুরাকীর্তি পাচারের তথ্য পাওয়া যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি তারা এমন অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ নেওয়ার জন্য উপযোগী হাতিয়ারও পেয়েছে।
বাইবেলীয় জালিয়াতি ও একাডেমিয়া
২০১২ সালে হার্ভার্ড ডিভিনিটি স্কুলের অধ্যাপক ক্যারেন এল. কিং ঘোষণা দেন যে তিনি প্যাপিরাসের একটি টুকরো আবিষ্কার করেছেন এবং সেটিতে এমন একটি অনুচ্ছেদ রয়েছে, যা থেকে প্রতীয়মান হয়, যিশু বিবাহিত ছিলেন বলে আদি খ্রিস্টধর্ম অনুসারীদের একটি সম্প্রদায় বিশ্বাস করত। এই ধরনের একটি বিতর্কিত বিষয় জনসাধারণের মনোযোগকে তীব্রভাবে নাড়া দেয়। কারণ, তথাকথিত সেই “যিশুর স্ত্রীর গসপেল” একটি বিশিষ্ট পণ্ডিত সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু এই টুকরো কোথা থেকে এসেছে, তা প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন প্রফেসর কিং। এর এটিই সাংবাদিক অ্যারিয়েল সাবারের কৌতূহলকে জাগিয়ে তোলে। তিনি কাকতালীয়ভাবে সেই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, যেখানে কিং তাঁর আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এখান থেকেই শুরু হয় প্যাপিরাসের টুকরো নিয়ে বহু বছরব্যাপী, বহু দেশজোড়া একটি অনুসন্ধানী প্রকল্প। শত শত সাক্ষাৎকার নিয়ে ও নথি ঘেঁটে তারা শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করে, এই টুকরো সম্ভবত একটি জালিয়াতি ছিল। সাবার তাঁর অনুসন্ধানের ফলাফল তুলে ধরেন প্রথমে বেশ কিছু লং-ফর্ম প্রবন্ধে, এবং তারপর ২০২০ সালে “ভেরিটাস: আ হার্ভার্ড প্রফেসর, আ কন ম্যান অ্যান্ড দ্য গসপেল অফ জেসাসে’স ওয়াইফ” নামের বইয়ে। অবৈধ ও জাল প্রাচীন-পাণ্ডুলিপির বাণিজ্যের অস্পষ্ট জগতে সাবারের দক্ষতা তাঁকে এই বিষয়ে আরও দীর্ঘমেয়াদি অনুসন্ধানী কাজের সুযোগ করে দেয়। তাঁর সাম্প্রতিক অনুসন্ধানের একটি ছিল, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে বাইবেলীয় প্যাপিরি চুরি এবং অবৈধভাবে বিক্রির অভিযোগ নিয়ে।
পরামর্শ ও টুল
১. একাডেমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, বিশেষ করে যাঁরা পুরাকীর্তির অবৈধ বাণিজ্য নিয়ে সরাসরি কাজ করেন, এবং যাঁরা হারানো বস্তু নিয়ে অনুসন্ধানে পারদর্শী। দুই ধরনের বিশেষজ্ঞই আপনাকে প্রচুর তথ্য জোগান দিতে পারেন।
২. নিশ্চিত করুন যে আপনি আইন জানেন। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে বিদ্যমান আইনগুলো জটিল। এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভুল করার আশঙ্কা বেশি। নিজে আইন পড়ুন এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
৩. সংখ্যা দেখলেই সতর্ক হোন: সাংস্কৃতিক পণ্যের অবৈধ বাণিজ্যের জগতে কোনো “প্রাইস ট্যাগ” নেই, এবং দাম অনুমান করার মতো দৃঢ় কোনো ভিত্তিও থাকে না। বিশেষজ্ঞরা আপনাকে বলবেন যে গল্পটি আসলে দামে নয়।
৪. শিল্পকর্ম বাজারের নথিপত্র দেখুন। যেমনটি আগে বলা হয়েছে: এর মধ্যে রয়েছে নিলামের ক্যাটালগ, ডিলারশিপের রেকর্ড, জাদুঘর অধিগ্রহণের রেকর্ড এবং শিল্পকর্ম ব্যবসার ফাঁস হওয়া নথি।
৫. চুরি হওয়া শিল্পকর্মের ডেটাবেস (যেমন এফবিআই, ইন্টারপোল এবং ইতালীয় কারাবিনিয়ারি) থাকলেও এগুলোতে সাংবাদিকদের জন্য দরকারি তথ্য পাওয়ার সুযোগ কম। পুরাকীর্তি পাচারের বেশির ভাগ ঘটনাই ডেটাবেসে পাওয়া যায় না।
৬. আগেই বলা হয়েছে, যেকোনো পুরাকীর্তি পাচারের ঘটনায় তথ্যের সর্বোত্তম উৎস হলো সংশ্লিষ্ট অংশীজনেরা। অনুসন্ধানকে এগিয়ে নিতে আপনার যে ধরনের নথিপত্র দরকার, তাদের উৎস সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পাবেন এ ধরনের ব্যক্তির সাক্ষাৎকার থেকে।
৭. প্রত্নতাত্ত্বিক রিকার্ডো এলিয়ার একটি বিখ্যাত কথা আছে: “সংগ্রাহকেরাই প্রকৃত লুটেরা।” নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে ধ্বংসের দিকে মনোনিবেশ করা সহজ, কিন্তু অপরাধের আসল চালক হলো বাজার, যা প্রায়ই ধনী দেশে পাওয়া যায়। গল্পটা সেখানেই।
আরও পড়ুন
টাকার খোঁজ: নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অনুসন্ধান করবেন যেভাবে
টাকার গন্ধ শুঁকে সংঘবদ্ধ অপরাধ খুঁজে বের করে যে চেক অনুসন্ধানী দল
ডোনা ইয়েটস মাস্ট্রিখ্ট ইউনিভার্সিটির অপরাধ আইন ও অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। এর আগে, তিনি গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের সিনিয়র প্রভাষক ছিলেন। প্রফেসর ইয়েটস কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পিএইচডি এবং এমফিল করেছেন। তিনি ট্রাফিকিং কালচার প্রজেক্টের একজন সদস্য, যা আমেরিকায় সংগঠিত অপরাধ পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং অনুসন্ধানের লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয়েছে।