মাঝেমধ্যে, বৈষম্য নিয়ে এত স্পষ্ট, আর নাটকীয় সব ডেটা বেরিয়ে আসে যে শুধু সেই সংখ্যাগুলোই পাঠক ও নীতি-নির্ধারকদের মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়। যেমন, ২০১৭ সালের এক অনুসন্ধানে বোস্টন গ্লোবের স্পটলাইট দলটি বের করেছিল, মধ্যক মানে বোস্টন শহরের একটি শ্বেতাঙ্গ পরিবারের নিট সম্পদ যেখানে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ ডলার, সেখানে একেকটি কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের নিট সম্পদ মাত্র ৮ ডলার। এই একটি পরিসংখ্যানই সবাইকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, উত্তেজিত করে তুলেছিল। ব্ল্যাক ইকোনমিক কাউন্সিল গঠন এবং কয়েকটি নীতি-নির্ধারণী পদক্ষেপসহ এর বেশ কিছু প্রভাবও দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু সাধারণভাবে, ধনীর সঙ্গে দরিদ্রের, প্রভাবশালীর সঙ্গে প্রান্তিকের যে ফারাক, সেই ডেটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম, দুষ্প্রাপ্য, অথবা সেগুলো লুকিয়ে থাকে ‘জিনি সহগের’ জটিল মারপ্যাঁচে, যে সূচকটি দিয়ে কোনো জনসংখ্যায় আয় বা সম্পদের অসম বণ্টন দেখানো হয়। এতে করে, বিশ্বজুড়ে বৈষম্যের ক্রমবর্ধমান সংকট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাংবাদিকদের নানা রকম উপায় খুঁজে বের করতে হয়।
এটি স্পষ্ট যে বৈষম্য আমাদের বর্তমান সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে, যা রাজনৈতিক আন্দোলন, পরিবর্তনের আহ্বান এবং বিশ্বজুড়ে সমতা বিধানের নানা প্রচেষ্টারও জন্ম দিচ্ছে।
অক্সফামের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: “বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে এবং একই সময়ে, অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধির শঙ্কা তৈরি করেছে কোভিড-১৯; এবং রেকর্ড সংরক্ষণ শুরুর পর থেকে এমন ঘটনা এটাই প্রথম।” প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের শীর্ষ এক হাজার ধনী ব্যক্তি এরই মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠেছেন, যেখানে “বিশ্বের দরিদ্রতমদের জন্য এটি কাটিয়ে উঠতে এক দশকের বেশি সময় লেগে যাবে।” গবেষকেরা এ-ও দেখেছেন যে, কোভিড-১৯ মহামারির ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার বেশি হয়েছেন নারীরা। বিশ্বজুড়ে নারীরা প্রায় ৬৪ মিলিয়ন চাকরি হারিয়েছেন, আর আয় হারিয়েছেন ৮০০ বিলিয়ন ডলারের।
এসব বৈষম্য সাংবাদিকতায় তুলে ধরার একটি বিকল্প উপায় হলো নতুন নতুন ভিজ্যুয়ালাইজেশন টুল ব্যবহার, যেগুলো মূল ডেটাকে বিশেষভাবে তুলে ধরার এবং বৈষম্যের সত্যিকার চিত্র ফুটিয়ে তোলার সুযোগ করে দেবে।
ইউনিভার্সিটি অব মিয়ামির ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন বিশেষজ্ঞ, আলবার্তো কায়রো জিআইজেএনকে বলেছেন, ডেটার্যাপারের মতো টুল দিয়ে তৈরি স্ক্যাটারপ্লট গ্রাফ কতটা কার্যকরভাবে দেশ ধরে ধরে সম্পদ ও আয়ুর সম্পর্ক দেখাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে পদ্ধতিগত বর্ণবাদ কীভাবে সম্পদশালী পরিবারে বেড়ে ওঠা কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকেও নিম্নআয়ের শ্রেণিতে নিয়ে যেতে পারে, সেটি নাটকীয় কায়দায় তুলে ধরেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস, ফ্লুইড মোবিলিটি চার্ট ব্যবহার করে। এর বাইরে, শ্রমজীবী শ্রেণি ও বিলিয়নিয়ারদের মধ্যে সম্পদের বৈষম্য যে কতটা অযৌক্তিক ও হাস্যকর হতে পারে, সেটি দেখানোর জন্য আছে নানা ধরনের স্ক্রলিং গ্রাফিক টেকনিক, যা গত বছর এই গ্রাফিকের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন ম্যাট করোস্টোফ।
এ ছাড়া, বিবিসি দেখিয়েছে, অডিওগ্রাফ কীভাবে (এখানে শব্দ ব্যবহার করে বিভিন্ন ডেটা পয়েন্ট উপস্থাপন করা হয়। এই কাজে টুটোন-এর মতো টুল ব্যবহার করা হয়) অতি মাত্রায় বৈষম্যমূলক সংখ্যাগুলো বুঝতে সাহায্য করে। ২০০৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শ্রম মজুরি ও করপোরেট মুনাফার মধ্যে যে তাক লাগানো বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তা বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল গোল্ড ব্রিকের “ক্লিঙ্ক” ধরনের শব্দ।
দারিদ্র্য কাভার করার ক্ষেত্রে নিউজরুমে বৈচিত্র্যের যে অভাব রয়েছে, সেটি কাটিয়ে ওঠার জন্যও রিসোর্স প্রয়োজন রিপোর্টারদের। একথা ভেবেই দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা দুই রিপোর্টার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির দ্য জার্নালিস্টস রিসোর্স-এর হয়ে একটি টিপ শিট তৈরি করেছেন। এতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে: কেন “দারিদ্র্যপীড়িত” শব্দটি অবমাননাকর, কীভাবে গৎবাঁধা বিষয় এড়ানো যায় এবং সর্বোপরি, কেন রিপোর্টারদের “এমন মানুষদের সঙ্গে সময় কাটানো উচিত, যারা তাদের চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের।”
ওপর থেকে বৈষম্য উন্মোচন
বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পদ ও রিসোর্সের বিপুল ফারাক উন্মোচনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী কৌশল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আকাশ থেকে তোলা ছবি।
২০০৪ সালে, দৈনিক ফোলা দে সাও পাওলোর জন্য সম্পদের বৈষম্য নিয়ে সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে আইকনিক ছবিটি তুলেছিলেন ব্রাজিলের ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার টুকা ভিয়েরা। হেলিকপ্টার থেকে তোলা ছবিটিতে দেখা যায়, একটি সুইমিংপুল-বিশিষ্ট সমৃদ্ধিশালী অ্যাপার্টমেন্ট ভবন এবং তার ঠিক পাশেই সাও পাওলোর জনবহুল প্যারাইসোপোলিস বস্তি।
“আমার এই ছবি অনেক জায়গায় আছে, তবে যা আমাকে সবচেয়ে আনন্দ দেয় তা হলো, এটি স্কুলের বইয়ে ব্যবহৃত হয়েছে,” বলেন ভিয়েরা। “বৈষম্য পরিস্থিতি আগে থেকেই বাজে ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছে, এই মহামারিতে হুট করেই সবকিছু আরও খারাপ হয়ে গেছে। এমনকি বিলিয়নিয়াররা অল্প সময়ের মধ্যে অবিশ্বাস্য পরিমাণ নতুন সম্পদ অর্জন করেছেন।”
২০ শতকের অনেক নগর-পরিকল্পনাবিদ শহরের শ্রমজীবী মানুষের বাসস্থান চিন্তা করেছিলেন শহরতলি থেকে কয়েক মাইল দূরের কোনো শহর, বস্তি বা ঘনবসতি অঞ্চলে। কিন্তু শহরের বিস্তার এবং অনেক অনানুষ্ঠানিক বসতি গড়ে ওঠায় দুই পক্ষের মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই কমেছে। এখন প্রায়ই দেখা যায়, একটিমাত্র বেষ্টনী বা রাস্তা, ধনী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বাসস্থানকে আলাদা করে রেখেছে। ভিয়েরা বলেন, মাত্র একটি ছবি দিয়ে বিপুল সম্পদ বৈষম্যের স্বরূপ উন্মোচনের সুযোগ নিতে পারেন সাংবাদিকেরা।
তবে আকাশ থেকে তোলা ছবির সঙ্গে মাটি থেকে তোলা ছবির সম্মিলন ঘটিয়েই সেগুলো উপস্থাপন করতে হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন ভিয়েরা, যেন সেখানকার ব্যক্তিমানুষের বাস্তবতা ও বৈষম্যের অজানা বা অল্প জানা পরিণাম তুলে আনা যায়। ভিয়েরা, বৈষম্যের এই চিত্র তুলে ধরার কাজ চালিয়ে গেছেন এবং সম্প্রতি ২০০ আলোকচিত্রের একটি বই প্রকাশ করেছেন। বইটিতে দেখানো হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন শহরে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠী কীভাবে বাস করে।
তিনি বলেন, “বৈষম্য শুধু অর্থ ও সম্পদের বিষয় নয়, এটি একই সঙ্গে স্বাস্থ্য, আত্মমর্যাদা, অপমানবোধ ও নীতি-নির্ধারণে নির্বুদ্ধিতারও বিষয়।” তাঁর মতে, “আপনি যদি চান যে, মানুষ থমকে দাঁড়াবে এবং ভাববে, তাহলে আপনাকে ছবির মাধ্যমে প্রভাব তৈরি করতে হবে, কিন্তু সঙ্গে থাকতে হবে ভালো প্রেক্ষাপট ও ডেটা।”
তিনি আরও বলেন, “মেরিটোক্রেসির ধারণায় বলা হয়: আপনি যদি নিয়ম মেনে চলেন এবং কঠোর পরিশ্রম করেন, তাহলে উন্নতি করতে পারবেন। কিন্তু এটি মোটেও সত্য নয়। ব্যবস্থাটি সত্যিই অন্যায্য। এবং আমার মনে হয়, এই ধরনের ফটোগ্রাফি তা ফুটিয়ে তুলতে পারে।”
কিন্তু হেলিকপ্টার ভাড়া করা বেশ ব্যয়বহুল, আর স্যাটেলাইট ছবি সাধারণত কম রেজ্যুলেশনের হয়। সেটি পছন্দমতো নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন।
কিছু বিশেষজ্ঞের চোখে সমাধান হলো স্বল্প-ব্যয়ী ড্রোন, যা শুধু রিপোর্টারদের আকাশ থেকে ছবি তোলার স্বাধীনতাই দেয় না, একই সঙ্গে তথ্য সংগ্রহ ও থ্রিডি মডেলিংয়ের জন্যও শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে।
সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে কাজ করা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আনইকুয়াল সিনস, নগর-বৈষম্য সম্পর্কে বিস্তৃত পরিসরে সচেতনতা তৈরি করে এবং সমাধানের জন্য নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে আলোচনা উসকে দেয়। আর এই সবকিছুর জন্য তারা ড্রোন ছবি ব্যবহার করে।
এর প্রতিষ্ঠাতা জনি মিলার, সিয়াটল থেকে শুরু করে মুম্বাই ও মেক্সিকো সিটি পর্যন্ত, বিশ্বের দুই ডজনের বেশি শহরের ছবি তুলেছেন আকাশ থেকে। এবং দেখিয়েছেন, এই শহরগুলোতে ধনী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী কতটা কাছাকাছি বাস করে। দক্ষিণ আফ্রিকায় তোলা তাঁর একটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে ২০১৯ সালের মে মাসে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে।
আফ্রিকানড্রোন-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতাও মিলার। অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠান আফ্রিকায় “ভালো কাজে ড্রোন” ব্যবহারের ক্ষেত্রে সহায়তা দেয়। স্থানীয়ভাবে ড্রোন পরিচালনার রীতিনীতি ও অনুমতি নেওয়া, পোস্ট-প্রোডাকশন বিশেষজ্ঞ, ড্রোন পাইলট ঠিক করে দেওয়া, খরচ কমানো—এ ধরনের কাজে গণমাধ্যম ও নাগরিক সংগঠনগুলোকে সহায়তা করে আফ্রিকানড্রোন। দক্ষিণ আফ্রিকায় নিউজ২৪, কার্টে ব্লাঙ্ক, ও দ্য সানডে টাইমস-এর অনুসন্ধানী প্রকল্পে ড্রোন ফুটেজ দিয়ে সহায়তা করেছিল সংগঠনটি।
“আমার মনে হয়, ছবির মাধ্যমে বৈষম্য ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ ছিল আনইকুয়াল সিনস প্রকল্প। বিত্ত ও দারিদ্র্যকে পাশাপাশি রেখে, ফুটিয়ে তোলার মতো ছবি খুব একটা দেখা যায় না, এটি অদ্ভুত, এই পার্থক্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে বোঝা যায় না কিন্তু আকাশ থেকে স্পষ্ট দেখা যায়।”
প্রকল্পটি তাদের অ্যাকটিভিস্ট মনোভাবের বিষয়ে একদম স্পষ্ট: “আনইকুয়াল সিনস, অবাধ্য। আমি সেসব প্রথাগত ক্ষমতাকাঠামোকে অমান্য করি, যেগুলো এসব বৈষম্য চারপাশ থেকে ভালোভাবে লুকিয়ে রাখে, শুধু সরাসরি ওপর থেকে ছাড়া। এসব ছবি যদি কারও মনে ভয়, হতাশা বা অন্য কোনো জটিল উপলব্ধির অস্বস্তিকর বোধ তৈরি করে, তবু ভালো।”
লুকোনো বঞ্চনা: ব্যক্তিগত অনূভূতি
নাড়া দেওয়ার মতো এমন প্রতিক্রিয়ার সাক্ষী আমি নিজে। কয়েক বছর আগে, যখন দক্ষিণ আফ্রিকার পাপওয়া সিউগোলুম গল্ফ কোর্সে গিয়েছিলাম, তখন কোনো ধারণাই ছিল না যে, আমি কত কুৎসিত সামাজিক অন্যায্যতার অংশ হয়ে যাচ্ছি। তার বদলে, বর্ণবাদবিরোধী এক নেতার নামে নামকরণ করা এই মাঠে নিজের অল্পবিস্তর গল্ফ-দক্ষতা যাচাই করে নিতে পেরে আমি খুশিই ছিলাম। ১৯৬৫ সালে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত, স্বশিক্ষিত গল্ফ খেলোয়াড় সিউসাঙ্কার “পাপওয়া” সিউগোলুম এক প্রাদেশিক টুর্নামেন্টে কিংবদন্তি গ্যারি প্লেয়ারকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে বাইরে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে পুরস্কার গ্রহণ করতে হয়েছিল; কারণ, সে সময় ক্লাবহাউসে অশ্বেতাঙ্গ কোনো ব্যক্তি প্রবেশ করতে পারতেন না।
তো, সিক্সথ হোলে, আমি বলটা সজোরে উঁচিয়ে মারি এবং সুন্দরভাবে ছাঁটা ঘাসের গালিচার বাম সীমানাঘেঁষা গাছগুলোর ওপারে পাঠিয়ে দিই। এ জন্য আমাকে আরও দুটো পেনাল্টি শট নিতে হয় এবং আমি খেলা চালিয়ে যাই।
গত মাসে, আমি আনইকুয়াল সিনস-এর শক্তিশালী ছবিগুলো স্ক্রল করে করে দেখছিলাম। শুনেছি, দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিয়ে অনুসন্ধান করা সাংবাদিকদের মধ্যে এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে এবং আলোচিত হয়েছে। তখনই দক্ষিণ আফ্রিকার সেই একই সিক্সথ হোলের একটি আকাশ থেকে তোলা ছবি আমার সামনে এসে পড়ে এবং আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছিল, সেই গল্ফ কোর্সের বাম সীমানা ঘেঁষে গাদাগাদি করে বাস করছে বস্তির মানুষেরা; গল্ফ কোর্সে আমি যে বিশাল, সুরম্য রাস্তাটি ধরে হেঁটেছি, তার পাশ দিয়েই পুরো জায়গাজুড়ে এই ঘনবসতিপূর্ণ আবাসন।
২০১৮ সালে মিলারের ড্রোন দিয়ে তোলা ছবি থেকে উন্মোচিত হয় যে, পালমিয়েট রোডে অনানুষ্ঠানিক বসতি গড়ে উঠেছে এবং সেখানে পয়োনিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। এর বিস্তৃতি সেই জায়গার সীমানা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে, যেখানে সম্ভ্রান্তরা অবসর কাটান। যেখানে জমির অভাব নেই এবং তাঁরা একরের পর একর জুড়ে ঘাসের ওপর পরিষ্কার পানি ছিটাতে পারেন। আমার গল্ফ বলটা হয়তো বস্তির কোনো এক ঘরে গিয়েই পড়েছিল—বা আরও খারাপ কিছুও হতে পারে—কিন্তু এই অঞ্চলে এত দিন ধরে বৈষম্য ও দারিদ্র্য নিয়ে রিপোর্টিং করা সত্ত্বেও, আমার কোনো ধারণাই ছিল না যে, সেখানে এমন একটা বস্তি আছে।
মিলার বলেছেন, ছবিগুলো দেখানোর পর আমার মতো এমন সহজাত, অস্থির প্রতিক্রিয়া তিনি আরও অনেকের কাছ থেকেই পেয়েছেন। তাঁর মতে, এমন প্রতিক্রিয়াও জরুরি; কারণ, সেটি অসম সমাজে বঞ্চনার পার্থক্য, মাত্রা এবং পরিসর নিয়ে বিদ্যমান ভুল ধারণাকে কাঁপিয়ে দিতে পারে।
নিউ অরলিন্সে বৈষম্য যে কতটা গভীর, আমেরিকানরা সেটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ২০০৫ সালে হারিকেন ক্যাটরিনার ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর। এবং ২০১৭ সালে, শ্রমজীবী মানুষের আবাসিক ভবন, গ্রেনফেল টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরই কেবল ইংল্যান্ডের অনেক মানুষ উপলব্ধি করা শুরু করেছেন যে, তাঁদের সবচেয়ে অভিজাত এলাকাতেও কী পরিমাণ বৈষম্য লুকিয়ে আছে। গ্রেনফেল টাওয়ারের অবস্থান লন্ডনের কেনসিংটনে, যা সাধারণের কাছে অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডে মারা গিয়েছিলেন ৭২ জন, যাঁদের ৮৫ শতাংশই ছিলেন অশ্বেতাঙ্গ। কয়েকটি গণমাধ্যমের অনুসন্ধান থেকে দেখা যায়: স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বিনিয়োগে ব্যর্থ হয়েছে। এমন দাবিও করা হয়েছে যে, গ্রেনফেলের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ভবনটির সৌন্দর্যবর্ধনে ব্যয় করতে কর্মকর্তাদের চাপ দিয়েছেন এলাকার ধনী বাসিন্দারা, যেন তাঁদের একটি “চক্ষুশূলের” পাশে থাকতে না হয়। আর, এভাবে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা হালনাগাদের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
ক্রমশ বাড়তে থাকা বড় আকারের অবিচার সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার জন্য স্বল্পব্যয়ী ড্রোনই বেশি কার্যকর, অন্তত সেসব জায়গায়, যেখানকার আইনে পাইলটরা গণমাধ্যমের প্রয়োজনে ড্রোন ওড়াতে পারেন।
তিনি বলেন, বৈষম্যের ড্রোন ছবি আরও বেশিসংখ্যক পাঠককে সম্পৃক্ত করতে পারে, যা এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব। কারণ, দূর থেকে তোলা এই ছবি পাঠকের মনে শুধু আবেগ নয়, একটি স্বচ্ছ ধারণাও তৈরি করে।
মিলার বলেন, “একজন রক্ষণশীল ব্যক্তি এবং একজন সামাজিক ন্যায়বিচার-প্রার্থীর মাঝখানে এমন অনেক রকম মানুষ আছেন, যাঁদের বৈষম্যের আলোচনায় সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন; ক্রন্দনরত কোনো শিশুর ছবি বা ধনী ব্যাংকারের পাশে গৃহহীন কোনো ব্যক্তির ছবি দিয়ে তাঁদের হয়তো চমকেও দেওয়া যাবে। কিন্তু ড্রোন ছবির মাধ্যমে আপনি তাঁদের সামনে একটি ধাঁধা তুলে ধরতে পারবেন, যেটি তাঁদের নিজেদেরই সমাধান করতে হবে,” বলেছেন মিলার।
ফ্রিল্যান্স গবেষক ও লেখক মোনিকা সেনগাল-জোনস সম্প্রতি ব্যাখ্যা করেছেন যে, যেসব এলাকায় সশরীরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে ড্রোন কীভাবে রিপোর্টিংয়ে সাহায্য করছে। তথ্য যাচাই ও হিট ম্যাপিং, এবং থ্রিডি মডেলিং ও রিমোট সেন্সিংয়ের মাধ্যমে ডেটানির্ভর প্রতিবেদনও তৈরি হচ্ছে ড্রোনের সাহায্যে। বাণিজ্যিক ড্রোন ব্যবহারের মোটা ব্যয়ভারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, যেসব দেশে তথ্য অধিকার আইন আছে, সেখানকার সাংবাদিকেরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার কাছে থাকা ড্রোন ফুটেজের জন্য আবেদন করতে পারেন।
তবে সেনগাল-জোনস সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, “সাংবাদিকদের শুরুতেই মাথায় রাখা উচিত যে, ড্রোন আদিতে তৈরি ও ব্যবহার করা হয়েছিল নজরদারি, সামরিক পর্যবেক্ষণ ও লক্ষ্য-নির্দিষ্ট হত্যার জন্য।”
“ড্রোনের ব্যবহার বেশির ভাগ সময়ই খুব বাজেভাবে হলেও আমার মনে হয়, এটি একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লব, যেমনটি ছিল প্রত্যেক মানুষের হাতে থাকা সেলফোন ক্যামেরা। এখন যেকোনো ব্যক্তি শহরের ওপর ড্রোন উড়িয়ে দেখে নিতে পারছেন যে, নিচে কী হচ্ছে। এমন ঘটনা ইতিহাসে প্রথম ঘটছে। ২০১২ সাল পর্যন্ত এটি শুধু সরকার ও ধনীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এরপর স্বল্প দামের বিভিন্ন ড্রোন বাজারে আসতে শুরু করে, যা শুধু জিপিএস অবস্থান বসিয়েই ব্যবহার করা যাচ্ছে।
মিলার বলেছেন, সম্পদের অপ্রতুলতায় ভোগা বার্তাকক্ষগুলোকে আরও কম খরচে বা বিনা পয়সায় ড্রোন-সেবা দিতে এবং ডেটার ব্যবহার ও নিয়মনীতি সম্পর্কে জানাতে আফ্রিকানড্রোনের এই মডেল আরও বিস্তৃত করা যেতে পারে।
“আফ্রিকানড্রোন দারুণ কিছু সাফল্য পেয়েছে। আমরা সত্যিই দক্ষিণ আফ্রিকাতে ড্রোন সাংবাদিকতার অগ্রপথিক হিসেবে কাজ করেছি,” বলেন মিলার। “ওয়েস্টার্ন কেপ অঞ্চলে অবৈধ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা হয়, যেখানে বিভিন্ন গ্যাং খামার থেকে ঘোড়া চুরি করে নিয়ে যায় এবং টাকার বিনিময়ে তাদের দৌড় প্রতিযোগিতায় নামায়। বিষয়টি নিয়ে আমরা একটি প্রতিবেদন করেছিলাম। সেখানে বেশ কয়েকজন ড্রোনচালক ছিলেন, যাঁরা নিজেদের ভবিষ্যতের অনুসন্ধানী সাংবাদিক বলে ভাবতেন। তাঁরা ড্রোনের মাধ্যমে এই মানুষগুলোর ওপর নজর রেখেছিলেন। আমরা সেই ঘোড়দৌড় কাভার করেছি এবং সেগুলো দিয়ে বানানো অনুসন্ধানী টিভি সিরিজ কার্টে ব্লাঙ্ক-এ প্রচারিত হয়েছে।”
ড্রোনচালক, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ও নিউজরুমগুলোর মধ্যে একটি স্বাস্থ্যকর ঐকমত্যও তৈরি হয়েছে যে, সুরক্ষা, বিশেষভাবে ড্রোনের পথে থাকা মানুষদের জন্য সুরক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
“আমি দেখেছি যে, বেশির ভাগ সম্পাদক আইন ও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার ধূসর এলাকাগুলো নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না, যদিও তাঁরা সবকিছু নিরাপদ ও সুরক্ষিত দেখতে চান। মাটিতে সবাইকে নিরাপদে রাখা আমাদের কাজের অন্যতম প্রধান জায়গা,” বলেছেন মিলার।
আনইকুয়াল সিনস-এর পরবর্তী প্রকল্প হবে নিউ ইয়র্ক সিটিকে ঘিরে। সহযোগিতামূলক এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভিজ্যুয়াল অনুসন্ধান চালানো হবে শহরটির বৈষম্য ও প্রান্তিকীকরণ নিয়ে।
মিলার বলেন, “নিউ ইয়র্ক নগরীর আইন অনুযায়ী, সেখানে ড্রোন ওড়ানো পুরোপুরি অবৈধ। তাই চিন্তা করছি, অন্য অপ্রথাগত উপায়ে সেখানকার বৈষম্যের গল্পগুলো কীভাবে বলা যায়।”
আরও পড়ুন
এ গাইড টু জার্নালিজম’স ড্রোন-পাওয়ারড ফিউচার
মাই ফেভারিট টুল: আলবার্তো কায়রো অন ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন
জিআইজেএন রিসোর্স সেন্টার: ইন্টারন্যাশনাল সোর্সেস ফর ইনভেস্টিগেটিং পোভার্টি
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএন-এর রিপোর্টার। দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসে কাজ করেছেন প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে। বিদেশী প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশ থেকে।