জিআইজেএন-এর আমার প্রিয় টুল সিরিজের এবারের পর্বে আমরা কথা বলেছি ইলি গুকেরের সঙ্গে। ফরাসি এই ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক অনুসন্ধান করেন চরম ডানপন্থী গ্রুপ ও সশস্ত্র সংঘাত নিয়ে। গুকেরের লেখা প্রকাশিত হয়েছে মিডিয়াপার্ট, বেলিংক্যাটসহ বিভিন্ন সাইটে।
গত নভেম্বরে, গুকের ও তাঁর দুই সহকর্মী মিলে উন্মোচন করেন: প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সমর্থক সিরীয় খ্রিস্টান মিলিশিয়াদের সঙ্গে একটি ফরাসি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক; এবং কীভাবে সেই দাতব্য প্রতিষ্ঠানের দেওয়া সাহায্য শেষ পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত যুদ্ধবাজ নেতাদের কাজে।
গুকের বলেছেন, নব্য-নাৎসি ও অন্যান্য চরম ডানপন্থী গ্রুপ শনাক্ত করার ক্ষেত্রে আধুনিক ওপেন সোর্স টুলের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। তিনি মিডিয়াপার্টে, তাঁর সহকর্মী সেবাস্তিয়ান বোর্দোঁর একটি অনুসন্ধানের দিকে ইঙ্গিত করেন, যাতে বিভিন্ন ওপেন সোর্স টুল ব্যবহার করে ফরাসি সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে থাকা ৫০ জন চরমপন্থীকে শনাক্ত করা হয়েছে।
গুকের অবশ্য নিজের অনুসন্ধানে “তুলনামূলক লো-টেক টুল” ব্যবহার করে থাকেন। জিওলোকেশন (ভৌগোলিক অবস্থান) জানার কিছু ওপেন সোর্স টুলের ওপর তিনি বিশেষভাবে নির্ভর করেন। তাঁর অনুসন্ধান পদ্ধতির মূল লক্ষ্যই হলো চরম ডানপন্থী গ্রুপগুলোর চরিত্রগত আচরণ বিশ্লেষণ।
মজার ব্যাপার হলো, চরম ডানপন্থী গ্রুপের সত্যিকারের উদ্দেশ্য জানার জন্য তাদেরই নিজস্ব প্রোপাগান্ডাকেই সবচেয়ে উপযোগী মাধ্যম বলে মনে করেন গুকের।
তিনি বলেছেন, “শুনলে উল্টো মনে হবে, কিন্তু এই প্রোপাগান্ডাগুলো আপনাকে অনেক তথ্য দিতে পারে। চরম ডানপন্থী গ্রুপগুলো তাদের ডানপন্থী সাইট এবং প্রোপাগান্ডা সংবাদপত্রে কী বলছে, তা আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে; কারণ, এসব জায়গাতেই তারা অকপটে বলাবলি করে যে, তারা আসলে কী করতে যাচ্ছে। সিরিয়ার অনুসন্ধানটির ক্ষেত্রে, আমরা রাশিয়ান নিউজ সাইট স্পুটনিকে একটি লেখা খুঁজে পাই, যেখানে সেই [ফরাসি দাতব্য প্রতিষ্ঠানটি] খুব স্পষ্টভাবে বলেছে যে, তারা শুধু তাদেরই খাবার দেবে, ‘যারা লড়াই করবে’, যেটি আপনাতেই মানবতাবাদী নীতির লঙ্ঘন”।
ইনস্টাগ্রামে সিরিয়ার খবর সার্চ করার সময়, সেই ফরাসি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের এক সিনিয়র সদস্যের বিয়ের অনুষ্ঠানের ছবি খুঁজে পান গুকের। সেখানে অতিথিদের মধ্যে আসাদপন্থী ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সের (এনডিএফ) এক সামরিক নেতার ছেলেকে দেখা যায়। আরেক ছবিতে, দাতব্য সংস্থাটির মহাপরিচালককে দেখা যায়, পশ্চিম সিরিয়ায় মিলিশিয়াদের একটি গোলন্দাজ দলের অবস্থান পর্যালোচনা করছেন। ২০১৩ সালে, দুই চরম ডানপন্থী ফরাসি অ্যাকটিভিস্ট এই দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে।
গুকের বলেছেন, “অবশ্যই, চরম ডানপন্থী হওয়া কোনো অপরাধ নয়, যার ফলে এই গ্রুপগুলো নিজেদের অর্থায়নসংক্রান্ত যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়। কিন্তু ৬ জানুয়ারি, ইউএস ক্যাপিটলে দাঙ্গার মতো পরিস্থিতিতে সত্যিকারের অপরাধও ঘটে। এসব গ্রুপের সাবেক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আমরা লিংকডইনে তাদের অনুসরণের পদ্ধতি ব্যবহার করি। সাধারণ কিছু প্রশ্ন জানতে চেয়ে আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি খুব সতর্কতার সঙ্গে, এবং বলি যে, আমরা বিষয়গুলো নিয়ে আরও জানতে আগ্রহী।”
তিনি বলেছেন, সাংবাদিকেরা ক্রাউডসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এবং বিদ্বেষবিরোধী অ্যাকটিভিস্ট গ্রুপগুলোর (যেমন স্লিপিং জায়ান্টস) কাছ থেকেও তথ্য পেতে পারেন। এই অ্যাকটিভিস্ট গ্রুপগুলোর লক্ষ্য: এই ধরনের চরমপন্থী গ্রুপের বিভিন্ন চ্যানেল ও ওয়েবসাইটে যেন বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করা হয়, সে জন্য কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ তৈরি করা। কিন্তু রিপোর্টাররা এসব সাইট, চ্যানেলগুলোর কনটেন্ট এবং তাদের অনুসারী কারা, সেদিকেও মনোযোগ দিতে পারেন এবং সেখান থেকেও প্রাসঙ্গিক অনেক তথ্য পেতে পারেন।
এমন অনুসন্ধানে গুকেরের ব্যবহার করা প্রিয় কিছু টুলের বিবরণ থাকছে এখানে:
লাইভ ইউএ ম্যাপ
লাইভ ইউনিভার্সাল অ্যাওয়ারনেস ম্যাপ-এর সংক্ষিপ্ত রূপ লাইভইউএম্যাপ। গুকের বলেন, “জিওলোকেশন নিয়ে কাজের জন্য এটি একটি মজার টুল। সাবস্ক্রিপশন কিনে নিলে, এখানে আপনি দেখতে পাবেন কীভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক অবস্থান প্রতিবছর পরিবর্তন হয়েছে। সিরিয়া ও ইউক্রেনের মতো জায়গা নিয়ে কাজের সময় আপনি এটি ব্যবহার করতে পারেন। এবং এসব ম্যাপে মানুষজন বিভিন্ন ঘটনার কথা রিপোর্টও করতে পারে। যেমন, ‘এই দিনে, এখানে একটি আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়েছিল, এবং তিনজন মারা গিয়েছিল’ ইত্যাদি। এটি আমাকে সাহায্য করেছে [এনডিএফ] মিলিশিয়ার করা বিভিন্ন দাবি যাচাইয়ের ক্ষেত্রে। যেমন, কোথাও হয়তো তারা বলেছে যে তাদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, কোথাও তারা যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হওয়ার দাবি করেছে, কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেছে, সেটি নিছক অন্যদের পাল্টা গুলি চালানোর ঘটনা।”
তিনি আরও বলেন, “লাইভইউএম্যাপ-এ আপনি এমন অনেক ঘটনার পুরো ইতিহাস দেখতে পাবেন, ২০১৬ থেকে এখন পর্যন্ত। খুব বেশি কাজ হয়নি, এ ধরনের ইস্যু নিয়ে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এটি খুই কার্যকর। ফ্রি ভার্সনে, আপনি শুধু কয়েক মাসের ঘটনার রিপোর্ট পাবেন। এর চেয়েও পেছনে যেতে চাইলে আপনাকে ১৫ ডলারের মতো খরচ করতে হবে।”
উইকিম্যাপিয়া
“এটি গুগল ম্যাপ ও উইকিপিডিয়ার একটি সংমিশ্রণ,” বলেন গুকের, “আপনি যদি গুগল ম্যাপের মধ্য দিয়ে একটি অচেনা শহরে যান, তাহলে সেখানে খুব বেশি তথ্য পাবেন না। কিন্তু উইকিম্যাপিয়াতে অনেক মানুষ তথ্য যোগ করছে যে, এই জায়গায় একটি চার্চ আছে, বা একটি মসজিদ আছে ইত্যাদি। আপনি যখন এসব তথ্যের সঙ্গে অন্যান্য বক্তব্য ও ছবি মেলাবেন, তখন একটি উপসংহারে পৌঁছাতে পারবেন।”
অ্যাকটিভিস্ট গ্রুপ
“উদাহরণ হিসেবে বলা যায় স্লিপিং জায়ান্টসের কথা। এটি একটি নাগরিক আন্দোলন। চরম ডানপন্থী গ্রুপগুলোর সাইটে বিজ্ঞাপন কমানোর প্রচারণা চালিয়ে তারা অনলাইন বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই করে। আপনি যদি তাদের অ্যাকটিভিজম অংশটির বাইরে তাকান, তাহলে দেখবেন: তারা আসলে একভাবে সাংবাদিকতা-সংশ্লিষ্ট কাজই করছে। তারা এমন সব তথ্য সংগ্রহ করছে, যা আমরা কাজে লাগাতে পারি। তাদের প্রদায়কেরা পুরো দিন পার করছে বিভিন্ন টেলিগ্রাম চ্যানেল ও চরম ডানপন্থী ওয়েবসাইটগুলো থেকে বিভিন্ন বার্তা সংগ্রহ করতে। আপনি তাদের গবেষকদের সঙ্গেও কথা বলতে পারবেন যে, কীভাবে তারা এই ডেটা সংগ্রহ করছে।”
গুগল আর্থ প্রো
“আমি জিওলোকেশনের বড় ভক্ত,” বলেন গুকের। “আমাদের অনুসন্ধানের সময় একটি সহজ প্রশ্ন ছিল যে, ‘সিরিয়ার খ্রিস্টান মিলিশিয়ারা কি চার্চগুলোর আশপাশে কামান বসাচ্ছে?’ আমি একটি নির্দিষ্ট চার্চ খুঁজে পাওয়ার জন্য কয়েক দিন ধরে চেষ্টা করছিলাম। গুগল আর্থ প্রো-তে একটি সহজ টুল আছে। ‘ওয়াচ’ আইকনে ক্লিক করলে আপনি তারিখ নির্ধারণ করে দেওয়ার একটি বার পাবেন। বারটি আগেপিছে করলে দেখতে পাবেন, সেই জায়গায় বিভিন্ন সময়ে কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। এভাবেই আমরা দেখতে পাই: সেই চার্চের পাশে সত্যিই ভারী কামানবাহী যান বসানো হয়েছিল।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় “ধৈর্য ধরে স্ক্রলিং”
ইয়ানডেক্সের মতো রিভার্স ইমেজ টুল এবং পিমআইজের মতো ফেশিয়াল রিকগনিশন অ্যাপ থাকা সত্ত্বেও, সোশ্যাল মিডিয়ায় “ধৈর্য ধরে স্ক্রল” করার মাধ্যমে সবচেয়ে ভালো ফল পেয়েছেন বলে জানান গুকের।
তিনি বলেন, “সিরিয়ার প্রতিবেদনটির জন্য আমি দুপুরের পর দুপুর কাটিয়েছি ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে স্ক্রল করতে করতে। ফেশিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার দিয়ে আমরা হয়তো একটি ছবি সহজে খুঁজে বের করতে পারি। কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য ও জ্ঞান আছে, সেটিই সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে হয়; কারণ, আমরা গল্পের প্রধান চরিত্রগুলোকে চিনি। একদিন আমি একটি ছবিতে আটকে যাই আর বলি, ‘এটাই মিলিশিয়ার প্রধান!’ এরপরই যখন ছবির তারিখ ও স্থান খেয়াল করি, তখন সব যোগসূত্র উপলব্ধি করতে পারি।”
আরও পড়ুন
টিপস ফর ইনভেস্টিগেটিং ফার রাইট গ্রুপস অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড
এক্সপোর্টিং ইনটলারেন্স: হাও দ্য খ্রিস্টান রাইট ইজ ফান্ডিং পলিটিক্যাল কজেস ওভারসিজ (ওয়েবিনার)
প্রিয় টুল ২০২০: সেরা সাংবাদিকেরা যেসব টুল নিয়মিত ব্যবহার করেন
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএন-এর রিপোর্টার। দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসে কাজ করেছেন প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে। বিদেশি প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন বিশ্বের দুই ডজনের বেশি দেশ থেকে।